অযোধ্যার মন্দির হোককৌশল্যা-সুখবন্ধন রামলল্লার

সদ্য বিগত ২০১৯ সালটি নানা দিক দিয়ে ভারতের ইতিহাসে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে রইল। এই বছরে তাৎক্ষণিক তিন তালাক প্রথা আইনবিরুদ্ধ ঘোষিত হওয়ায় বিবাহিতা মুসলমান মহিলারা এক দীর্ঘকালীন বিরাট মানসিক চাপ থেকে মুক্তি পেয়েছেন। এই বছরেই জম্মু ও কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বাতিল হয়ে যাওয়ায় কাশ্মীরের ভূমিপুত্র প্রায় চার লক্ষ পণ্ডিত তিরিশ বছরের উদ্বাস্তু জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে আবার নিজেদের বাসভূমে ফিরে যাবার সম্ভাবনার পথ পেয়েছেন। এই বছরেই নিজমন্দির থেকে উৎখাত হয়ে প্রায় পাঁচশো বছরের উদ্বাস্তু অবস্থা থেকে অযোধ্যার রামলল্লা পুনরায় নিজক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সনদ লাভ করেছেন। ভারতের সুপ্রিম কোর্ট অযোধ্যার বহু বিতর্কিত মন্দির-মসজিদ সৌধ স্থলে রামলল্লার মন্দিরই প্রতিষ্ঠা করার রায় দিয়েছে। দীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ার অন্তে, নানা প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ সাপেক্ষে নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে বাবরের নামাঙ্কিত মসজিদটি একদা রামের জন্মভূমির ওপর তৈরি মন্দির ধ্বংস করেই গড়ে উঠেছিল। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে এই বিশাল দেশের নানা প্রান্ত থেকে আসা এই রায় পুনর্বিবেচনার আর্জির মধ্যে দেশের চল্লিশজন প্রতিষ্ঠিত বুদ্ধিজীবীর আবেদনটিও ছিল। বুদ্ধিজীবী অর্থাৎ যাঁরা জীবিকা নির্বাহ করার জন্য নিজেদের বুদ্ধিকে আশ্রয় করেন, যা সমস্ত প্রাণীই করে থাকে। মানুষ কার্যোদ্ধারের জন্য যে বুদ্ধি প্রয়োগ করে তা সুবুদ্ধি, দুবুদ্ধি, কূটবুদ্ধি, দুষ্টবুদ্ধি—সবই হতে পারে। তাই সেইসব বুদ্ধিজীবীদের গ্রাহ্য না করাই ভালো। কথায় বলে “লড়েকা সঙ্গ সরিকা নহী’। অর্থাৎবালকের (লড়েকা) সঙ্গে শরিকানি (সরিকা) করতে নেই। তবুবালক রামের সঙ্গে, অযোধ্যার । রামলল্লার সঙ্গে পাঁচশো বছর ধরে চলা শরিকানার এই দ্বন্দ নিষ্পত্তি। হওয়ায় কিছু স্বার্থান্বেষী ব্যক্তি ছাড়া এই বিশাল ভারতের সবাই আনন্দিত হয়েছেন। আযোধ্যায় রামলল্লার মন্দির সুস্বাগতম্।
‘সারে জহা সে আচ্ছা হিন্দোস্তা হমারা’ গানটির রচয়িতা মুহম্মদ ইকবালকে আমরা পাকিস্তানের প্রবক্তা হিসাবেও জানি। তার মতে শ্রীরামচন্দ্র ছিলেন ‘ইমাম-ই-হিন্দ’অর্থাৎ ভারতের নেতা বা পরিচালক। সেই ইমাম-ই-হিন্দ আজ তাঁর নিজের জন্মস্থলে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছেন। সে কাজের জন্য এক দলিত পরিবারের ব্যক্তিকে শীর্ষে রেখে পনেরো সদস্যের ট্রাস্ট তৈরি হয়ে গেছে। এবার কাজ আরম্ভ করলেই হয়। বলা হয় ‘শুভস্য শীঘ্র অশুভস্য কালহরণম্। এই শুভকাজ অবিলম্বে আরম্ভ হোক এই কামনা করি। ভুলে গেলে চলবে না ‘ছায়ী হুই হ্যায় গম কী ঘটায়ে চহার সু–চারদিকে ছেয়ে আছে দুঃখ-ঈর্ষা-চিন্তার মেঘ।
শ্রীরামচন্দ্রকে যেমন ইমাম ই হিন্দ বলা হয়েছে তেমন তাকে মর্যাদা পুরুষোত্তমও বলা হয়। সীতাকে বনবাসে পাঠানোর জন্য অনেকে বিশেষ করে এই বঙ্গভূ মে, রামের সমালোচনাও করেন। শ্রীরামকে বুঝতে হলে একটু তলিয়ে ভাবতেই হবে। তার প্রধান পরিচয় তিনি অযোধ্যাবাসীর হিতৈষী পালনকর্তা, লোকাভিরাম, রঘুকুলতিলক। তিনি সাধারণ মানুষের মতো ছিলেন না। তিনি ছিলেন রাজা। প্রজারা সর্বক্ষেত্রে রাজাকে অনুসরণ করে। প্রজারা জানত রাবণ সীতাকে হরণ করে দশমাস বন্দিনী করে রেখেছিল এবং শ্রীরাম রাবণকে পরাজিত করে সীতাকে উদ্ধার করেন। তারা জানত না রাবণের কাছে বন্দিনী হয়েও সীতা কীভাবে কায়মনোবাক্যে নিজের পবিত্রতা বজায় রেখেছিলেন। লঙ্কায় দেবতাদের সামনে সীতা অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিজের নিষ্কলুষতার প্রমাণ দিয়েছিলেন। সেকথা প্রজারা জানত না। কবি কৃত্তিবাস সেকথা স্পষ্টলিখেছেন, প্রথম পরীক্ষা দিলে সাগরের পার/দেবগণ জানে তা না জানে সংসার। তাই সীতাকে অযোধ্যায় এনে মর্যাদার সঙ্গে সংসারে স্থান দেওয়ায় প্রজারা সমালোচনা আরম্ভ করে। পাছে সামাজিক স্থিতাবস্থা বিঘ্নিত হয় তাই শ্রীরাম নিজের সংসারসুখ বিসর্জন দিয়ে সীতাকে বাল্মীকির আশ্রমে নির্বাসিত করেন। তিনি জানতেন সীতা নির্দোষ। সীতাকে বনবাসে পাঠিয়ে শ্রীরাম নিজেকেও সকল বিলাস-বৈভব থেকে বঞ্চিত করে কেবল একজন সেবক হিসেবে নিয়োজিত রাখনে। এক পত্নীব্রত রামকে দ্বিতীয়বার দারপরিগ্রহের জন্য চাপ দিলেও তিনি দ্বিতীয়বার বিবাহ না করে স্বর্ণসীতা নির্মাণ করে স্ত্রীর বিকল্পের ব্যবস্থা করেন। যজ্ঞের সময়েও স্বর্ণসীতাই তার স্ত্রীর বিকল্প হয়েছে। এমন স্থিত প্রজ্ঞ পুরষ এবং একপত্নীব্ৰত স্বামী যদি মর্যাদা পুরুষোত্তম না হন, যদি ইমাম্-ই-হিন্দ না হন তবে আর কে হবে!
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রয়োজনে মসজিদ স্থানান্তরিত করার শতাধিক উদাহরণ আছে। ইসলামের উৎপত্তিস্থল সৌদি আরবেই হজরত মুহম্মদ, আবু বকর ও উমরের সমাধি যে অন্ নবা ই মসজিদে আছে তারই এক বিরাট অংশ সরকার অধিগ্রহণ করে সেখানে হজযাত্রীদের জন্য এক বিশাল অতিথিশালা নির্মাণ করেছে। বৃহত্তর জনস্বার্থে মসজিদের স্থানান্তরণ পাকিস্তানেও অনেক হয়েছে। শ্রীনগরে ঝিলম নদীর ওপর দ্বিমুখী যান চলাচলের উপযুক্ত একটি সেতু তৈরি করার জন্য রামপুরা অঞ্চলের মসজিদ আবু তুরাবকে ভেঙে দিয়ে স্থানান্তরিত করার কাজ চলছে।
অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে এগিয়ে এসেছেন সকল ভারতবাসী। উত্তরপ্রদেশের শিয়া ওয়াকফ বোর্ডের চেয়ারম্যান ওয়াসিম রিজভি জানিয়েছেন অযোধ্যায় রামমন্দির নির্মাণে তার বোর্ডের সম্মতি তো আছেই, সেই সঙ্গে তিনি তার নিজস্ব সংস্থার তরফে এজন্য ৫১ হাজার টাকা দান করবেন। তার কথায় “ভগবান রাম মুসলমান সহ সবারই পূর্বপুরুষ, তার মন্দির নির্মাণে সবারই এগিয়ে আসা উচিত”, এমন অনাবিল সত্য কথা বলার ক্ষমতা বেশি লোকের থাকে না, কারণ সহজ কথা সহজভাবে বলতে পারা মোটেই সহজ নয়। সংবাদে পাই, নবর্নিমিত মন্দিরে যে বিশালাকার ঘণ্টাটি স্থাপিত হবে, যার ধ্বনি দূরদূরান্ত নিনাদিত করবে, সেটি তৈরি করছে ইকবাল নামের এক মুসলমান কারিগর। ঘণ্টাটিকে দৃষ্টিনন্দন করার জন্য পরমযত্নে দিনরাত এক করে সে খেটে চলেছে।
নানা জায়গায় পুত্রকে মায়েরা নানাভাবে সম্বোধন করেন। বাঙ্গালি মায়েরা সম্বোধনে যেমন খোকন, বাবু তেমনই লাল, লালু, লান্টু। একবার ঢাকায় আমার ননদস্থানীয় দিলশাদের বাড়িতে শুনি তার মা নিজের জামাইকে খোকন বলে ডাকছেন। দিলশাদ তার একমাত্র কন্যা, তার কোনো পুত্র ছিল না। দিলশাদ বলে তার মা তার জামাইকে খোকন বলে ডাকতেই ভালবাসেন। আমার অনভ্যস্ত কানে সেই ডাক চোখের ওপর থেকে এক পর্দা সরিয়ে দিয়েছিল। বুঝেঝিলাম বাঙ্গালি মায়ের প্রাণের থেকে উৎসারিত সেই ডাকের কোনোও জাতি-ধর্মের গণ্ডী নেই। এই প্রসঙ্গে স্যার ভি.এস. নইপলের একটি লেখা মনে পড়ছে সেখানে তিনি বলেছেন ভারত ছেড়ে দীর্ঘকাল বিদেশে থাকায় তাঁর পূর্বপুরুষরা দেশের অনেক কিছুই বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু তাদের মায়েদের মুখের বেটা সম্বোধনটি রয়ে। গেছে। পুত্রকে বেটা সম্বোধনের মধ্য দিয়ে যেমন তারা মায়ের স্নেহের স্পর্শ পেতেন তেমনই পেতেন শতাধিক বর্ষ আগে ছেড়ে যাওয়া পিতৃভূমির পরশ।
পশ্চিম ভারতে বালক পুত্রকে মায়েরা লাল, লল্লা, লল্লন, ললন ইত্যাদি স্নেহের সম্বোধন করে ডাকেন। অযোধ্যায় রামের যে মন্দির গড়ে উঠবে তা প্রজাবৎসল অযোধ্যা নরেশ ‘রঘুপতি রাঘব রাজা’ রামের নয়। সে মন্দির ভয়হরমঙ্গল, পতিতপাবন রামেরও নয়, বা ‘ইমান ই হিন্দ’ রামেরও নয়। সেই মন্দির যেন হয় শুধুমাত্র আনন্দামৃতবর্ষক ‘দশরথনন্দনের বা কৌশল্যা সুখ-বন্ধন’ রামলল্লার।
গৌরী বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.