মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন, ৪২ টার মধ্যে ৪২ টাই দখলে রাখতে হবে। ঠিক উল্টোদিকে অমিত শাহ বলেছেন, ২২টা আসন এবার এখানে জিতে নিতেই হবে। ফলত নির্বাচনের দিনক্ষণ ঘোষণা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে প্রশ্নটি পশ্চিমবঙ্গের ভোটদাতাদের তাড়িত করছে তা হলো—গতবারের যে কটা লোকসভা আসন জিতেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সে কটা কি ধরে রাখতে পারবেন এবার, নাকি বাংলায় এবার সত্যিই গৈরিকীকরণ হবে? শুধু দিল্লি দখলের প্রশ্নে নয়, পশ্চিমবঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে এবারের লোকসভা নির্বাচন আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, ২০২১-এর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনের আগে এই নির্বাচনটি কার্যত একটি সেমিফাইনাল। এই নির্বাচনেই প্রমাণ হয়ে যাবে, ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচন কোন খাতে বইবে। জাতীয় রাজনীতির প্রেক্ষাপটে বিচার করলে, পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশার মতো পূর্ব ভারতের এই দুই রাজ্যকে এবার বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব সবিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। এই দুই রাজ্যেই চমকপ্রদ ফল করে বিজেপির সর্বভারতীয় ভিত্তি আরো সুদৃঢ় করার কৌশলী চিন্তাই বিজেপি সভাপতি অমিত শাহ করেছেন। যদি কোথাও কোনো ঘাটতি থেকে যায়, তাহলে সেই ঘাটতি এই দুই রাজ্য মিটিয়ে দিতে পারবে— এমন ভাবনাও বিজেপি সভাপতির রয়েছে। তবে, বালাকোটে ভারতীয় বিমান বাহিনী জঙ্গি শিবির ধ্বংস করে দিয়ে আসার পর, সমগ্র দেশেই যেরকম জাতীয়তাবাদী আবেগের স্ফুরণ দেখা দিয়েছে এবং জাতীয় রাজনীতিতেও দ্রুত কিছু পরিবর্তন ঘটেছে, তাতে লোকসভা নির্বাচনেও বিজেপির ঘাটতি কিছু থাকবে বলে মনে হচ্ছে না। বরং, এটাই মনে হচ্ছে যে, ২০১৪-র আসন সংখ্যাকেও যদি এবার বিজেপি ছাপিয়ে যায়, তাহলে আশ্চর্য হওয়ার কিছু থাকবে না। এবং যে জাতীয়তাবাদী আবেগের স্ফুরণ ঘটেছে, তাতে বেশ কিছু রাজ্যে বিজেপির চমকপ্রদ ফল হবে— এমনও আশা করা যাচ্ছে।
পশ্চিমবঙ্গের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির সব থেকে বড় সুবিধা এখানে তাদের হারানোর কিছুই নেই। বরং জয় করার জন্য রয়েছে অনেকখানি জমি। এখানে যদি বিজেপি লড়াই করে দশটা আসনও দখল করতে পারে, তবে সেটাই হবে তাদের লাভ। তাতে ভর করেই তারা ২০১৯-এর বিধানসভা নির্বাচনের দিকে তড়িদ্ গতিতে এগোতে পারবে। আর যদি অমিত শাহের নির্ধারিত করে দেওয়া ২২টি আসনের লক্ষ্যকে ছুঁতে পারে বিজেপি–তবে বলতেই হবে তাদের বঙ্গ দখল শুধু সময়ের অপেক্ষা। অন্যদিকে তৃণমূল কংগ্রেস। এই রাজ্যের ৩৪টি লোকসভা আসন তাদের দখলে। বলা যায়, নির্বাচনী রাজনীতিতে সাফল্যের শীর্ষবিন্দুটিকে তারা ইতিমধ্যে ছুঁয়ে ফেলেছে। এখন আর তাদের নতুন করে জেতার কিছু নেই। বরং, যা আছে তাকে ধরে রাখার লড়াই তৃণমূলের। যদি একটি আসনও তৃণমূলের কমে যায়, তাহলে তার জনপ্রিয়তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে যাবে। আর যদি একাধিক আসন কমে, তাহলে বলতেই হচ্ছে, ২০২১ অশনি সংকেত বয়ে নিয়ে আসবে তৃণমূলের জন্য।
এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে বিজেপি অন্যান্যবারের তুলনায় আরও কয়েকটি বিষয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থায় রয়েছে। এর আগে বিজেপির ভিতরে যে আন্দোলন বিমুখতা পরিলক্ষিত হতো, আরও ভালোভাবে বললে, আন্দোলনের ক্ষেত্রে বিজেপির যে ঘাটতি দেখা যেত, দিলীপ ঘোষ রাজ্য সভাপতি হওয়ার পর সে ঘাটতি অনেকটাই মিটেছে। সভাপতি হওয়ার পর সবকটি জেলায় দিলীপবাবু অনবরত সফর করেছেন, করছেন। জনসভা এবং কর্মী সভায় নিয়মিত ভাষণ দিয়ে দলীয় কর্মীদের উজ্জীবিত করেছেন। ফলে জেলায় জেলায় বিজেপি কর্মীরা আগের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী হয়েছে, আন্দোলনমুখী হয়েছে। যে কারণেই বারবার তৃণমূল কংগ্রেসের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে তারা। কর্মীদের এই আন্দোলনমুখী হয়ে ওঠাটা লোকসভা নির্বাচনে বিজেপিকে অনেকটাই সুফল দেবে। পাশাপাশি, নির্বাচনী কৌশলে পটু সেরকম কোনো নেতা এতদিন সে অর্থে বিজেপিতে ছিলেন না। মকুল রায় যোগ দেওয়ার পর সে ঘাটতিও বিজেপির অনেকটাই মিটেছে। লোকসভা নির্বাচনে মুকুল রায়কে প্রার্থী ঠিক করার গুরুদায়িত্ব দিয়ে অমিত শাহ কৌশলী সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিছু কিছু জায়গায় তৃণমূল কংগ্রেসের ঘর যেমন ভেঙে দিয়েছেন মুকুল রায়, তেমনই আরও একটি কাজ সুকৌশলে তিনি করে ফেলেছেন। তা হলো, তৃণমূল কংগ্রেসের অন্দরে একটি অবিশ্বাস এবং সন্দেহের বিষবাষ্প ছড়িয়ে দেওয়া। তৃণমূল কংগ্রেস সভানেত্রী ইতিমধ্যে প্রকাশ্যে বলেছেন, “কারা কারা অন্য দলে যোগ দেওয়ার জন্য পা বাড়িয়ে রয়েছেন তা আমি জানি।” এতেই প্রমাণ হয়ে যায়, নিজের দলের নেতাদের স্বয়ং নেত্রীই বিশ্বাস করতে পারছেন না। দলের মধ্যে এই অবিশ্বাস এবং সন্দেহের বিষ, আখেরে লোকসভা নির্বাচনে ক্ষতিই করবে তৃণমূলের।
এবারের নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেসের যা যা মাইনাস পয়েন্ট, সেগুলিই এক অর্থে বিজেপির প্লাস পয়েন্ট। একথা সবাই স্বীকার করবেন যে, এবারের লোকসভা নির্বাচনে এই রাজ্যে মূল লড়াইটা হবে তৃণমূল কংগ্রেস বনাম বিজেপি। কংগ্রেস এবং সিপিএম এই প্রতিযোগিতায় অনেক পিছিয়ে। প্রায় শূন্য থেকে গত কয়েক বছরে ভিতরই এভাবে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় উত্তীর্ণ হওয়া এটা বিজেপির বড়ো রাজনৈতিক সাফল্য। গত লোকসভা নির্বাচনেও এই রাজ্যে বিজেপি কটা আসন পাবে তা নিয়ে জনতার বিশেষ কৌতুহল ছিল না। এবার কিন্তু জল্পনা হচ্ছে বিজেপি কি টেক্কা দিতে পারবে তৃণমূল কংগ্রেসকে। এটাই প্রমাণ করছে, কংগ্রেস কিংবা সিপিএম নয়, তৃণমূলের বিকল্প হিসেবে মানুষ ইতিমধ্যেই বেছে নিয়েছে বিজেপিকে। এটাও মানতে হবে, ২০১১ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে জনপ্রিয়তা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন, মাত্র আট বছরের ভিতরে ২০১৯ সালে তার সেই জনপ্রিয়তা এখন তলানিতে পৌঁছছে। তার জনপ্রিয়তা যে এত দ্রুত হ্রাস পাবে— তৃণমূল কংগ্রেস সভানেত্রীও আঁচ করতে পারেননি। ২০১১-র নির্বাচনে কোনো সাম্প্রদায়িক তাস খেলে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসেননি। সিপিএমের উৎখাতের ডাক তিনি দিয়েছিলেন। সিপিএমের অপশাসনে অতিষ্ঠ হয়ে তাতে সাড়া দিয়েছিলেন হিন্দু-মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকমণ্ডলী। ক্ষমতায় আসার পর সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নগ্নভাবে অন্যায় এবং অন্যায্য মুসলমান তোষণের রাজনীতিই সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু নির্বাচকমণ্ডলীকে ক্ষুব্ধ করেছে। এই মাত্রাতিরিক্ত তোষণের রাজনীতিই এবার লোকসভা নির্বাচনে বিপদ হয়ে দাঁড়াতে পারে তৃণমূলের পক্ষে। এরই পাশাপাশি লাগামছাড়া তোলাবাজি, মস্তানি, আইনশৃঙ্খলার অবনতির প্রসঙ্গটি তো রয়েছেই। এগুলিও যথেষ্ট ক্ষুব্ধ করেছে মানুষকে। এই রাজ্যে মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের মতো পাপকর্মটিও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল এবং সরকার করেছে। বিগত পঞ্চায়েত নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করা হয়েছিল। তদুপরি বিরোধী দলের কর্মীদের মিথ্যা মামলায় হেনস্থা করা, বিরোধী দলের সভা সমাবেশে অনুমতি না দেওয়া এসবও রাজ্যের নির্বাচকমণ্ডলী প্রত্যক্ষ করেছে। এতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দলের ভাবমূর্তিই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতিগ্রস্ত ভাবমূর্তি লোকসভা নির্বাচনে বিপদের কারণ হতে পারে। সর্বোপরি যেটি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা হলো, ওর স্বঘোষিত সততার প্রতীক ইমেজে কালির ছিটে লেগেছে। সারদা, নারদা, রোজভ্যালি কেলেঙ্কারির পর আর কেউ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তার দলকে সততার সার্টিফিকেট দিতে রাজি নয়।
বিজেপির সুবিধা এই যে, এই রাজ্যে বিজেপি কখনো ক্ষমতায় ছিল না। ফলে কোনোরকম কলঙ্ক বা ক্ষোভ তাকে সেভাবে স্পর্শ করেনি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে যখন ক্ষোভ সামলাতে হবে, বিজেপি তখন সেই ক্ষোভকেই নির্বাচনে কাজে লাগাতে পারবে। ২০০৯-এর লোকসভা এবং ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের সময় সিপিএমের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই সুযোগটিই পেয়েছিলেন। এবার সেটি বিজেপি যাচ্ছে। বিজেপি এটাকে কতটা কাজে লাগাতে পারবে—তার ওপর নির্ভর করছে কতটা নির্বাচনী সাফল্য সে পাবে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে অন্য রাজনৈতিক দলের ঘর ভাঙিয়ে বিজেপি বেশ কিছু নেতানেত্রীকে তাদের দিকে এনেছে। এদের ভিতর কেউ কেউ দলীয় প্রতীকে বিজেপির প্রার্থীও হবে এবারের নির্বাচনে। এনিয়ে বিজেপি মহলে কারো কারো ক্ষোভ রয়েছে। যাদের ক্ষোভ রয়েছে তারা নির্বাচনী পাটিগণিতটা বুঝছেন না। স্বয়ং অমিত শাহ সর্বভারতীয় স্তরে বৈঠকে দলীয় কর্মীদের বলেছেন, এবারের নির্বাচনে আসন বাড়াতেই হবে। এ রাজ্যে আসন বাড়াতে গেলে বিরোধী দল ভাঙিয়ে এনে আসন বাড়ানো ছাড়া উপায় নেই। কারণ, সে অর্থে এ রাজ্য সর্বত্র বিজেপির তেমন শক্তিশালী সংগঠনও নেই। তদুপরি, বিজেপির পরীক্ষিত যে সব নেতৃত্ব রয়েছেন, তাদের ভিতর নির্বাচনী যুদ্ধে জিতে আসার মতো তেমন নেতাও বিরল। সবদিক বিবেচনা করেই দিল্লির বিজেপি নেতৃত্বের নির্দেশেই অন্য রাজনৈতিক দলগুলি থেকে নেতানেত্রীদের বিজেপির দিকে আকৃষ্ট করে নিয়ে আসার একটি প্রচেষ্টা চলছে।
একটা প্রশ্ন ইতিমধ্যেই চতুর্দিকে উঠতে শুরু করেছে। লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি এই রাজ্য থেকে এবার কতগুলি আসন পাবে? কতগুলি আসন পাবে— তা ভবিষ্যদ্বাণী করা খুবই অবৈজ্ঞানিক। তবে, এটুকু বলাই যায়, শাসক বিরোধী একটি হাওয়া এ রাজ্যে উঠেছে, তাতে বিজেপির পক্ষে অভাবনীয় ফলের প্রত্যাশা করাই উচিত। ফলাফল যে তাঁর খুব একটা অনুকুলে যাচ্ছে না তা বোধকরি তৃণমূল কংগ্রেস সুপ্রিমোও আঁচ করেছেন। সম্প্রতি তিনি বলেছেন— ২২-২৩টা আসন এখানে জোর করে দখলের চেষ্টা চলছে। বোঝাই যায়, এগুলি হচ্ছে তার আগাম অজুহাত। ২২-২৩টা আসন যে আর তার পক্ষে নিরাপদ নয়, সেটা তিনিই বুঝিয়ে দিচ্ছেন। ৩৪টা আসন যে এবার কমবেই— সে ইঙ্গিত তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমোর কথাতেই মিলেছে।
কিন্তু বিজেপির পক্ষেও অস্বস্তির কিছু কাটা আছে। আর সে কাটা আছে বিজেপির অভ্যন্তরেই। বিজেপি সংগঠনের ভিতরে থেকেই কতিপয় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী প্রত্যহ প্রকাশ্যে নানা মন্তব্য করে দলকে অস্বস্তিতে ফেলার কাজটি করে চলেছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় দলীয় নেতৃত্বের প্রতি কটুক্তি করে নিজেদের অন্তর্কলহটিকে প্রকাশ করে ফেলেছেন। এরা বুঝছেন না, ব্যক্তিবিশেষের বিরোধিতা করতে গিয়ে সমগ্র সংগঠনটিরই ক্ষতি করছেন এরা। নির্বাচনের আগে দলের ঐক্যবদ্ধ চেহারাটা দেখানো যখন সর্বাধিক জরুরি, তখন এসব করে কার স্বার্থ রক্ষা করছেন এরা?
রন্তিদেব সেনগুপ্ত