শনিবার কাতারের দোহায় আমেরিকা ও তালিবানদের মধ্যে শান্তি চুক্তিতে সিলমোহর পড়েছে। উভয় পক্ষের স্বাক্ষরিত এই চুক্তির শর্ত মেনে আমেরিকা আগামী ১৪ মাসে আফগানিস্তান থেকে সমস্ত বাহিনী প্রত্যাহার করবে। এই চুক্তির সময় ভারতসহ ৩০ টি দেশের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবানদের মধ্যে এই চুক্তি ভারতের অসুবিধা বাড়িয়ে তুলতে পারে ।
◾চুক্তির মূল বিষয়সমূহ:
চুক্তি অনুসারে, আমেরিকা ধীরে ধীরে আফগানিস্তানে উপস্থিত তার সেনার সংখ্যা কমিয়ে আনবে। এর শর্ত মেনে, প্রথম ১৩৫ দিনের মধ্যে প্রায় ৮,৬০০ সৈন্যকে আমেরিকাতে ফিরে যাবে।
অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আফগান সামরিক বাহিনীকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করবে, যাতে ভবিষ্যতের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে তারা পুরোপুরি সক্ষম হয়।
তালিবানরা পাল্টা যুক্তরাষ্ট্রকে আশ্বাস দিয়েছে যে তারা আল-কায়েদা এবং অন্যান্য বিদেশী সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে। একই সঙ্গে আফগানিস্তানের মাটিকে সন্ত্রাসবাদী তৎপরতার জন্য ব্যবহার না করার ক্ষেত্রে আমেরিকাকে সহায়তা করবে।
আংশিক যুদ্ধবিরতি শুরু হয়েছিল ২২ শে ফেব্রুয়ারি থেকে। আফগানিস্তানের জাতীয় সুরক্ষা কমিটির মুখপাত্র জাভেদ ফয়জল গত সপ্তাহে দাবী করেন শিগগিরই আফগান সুরক্ষা বাহিনী এবং যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবানদের মধ্যে হিংসা হ্রাস পাবে। ২২ ফেব্রুয়ারি শনিবার থেকে এই প্রক্রিয়া চালু হওয়ার কথা বলেন তিনি। এই প্রক্রিয়া আরও এক সপ্তাহ অব্যাহত থাকার কথাও বলেন তিনি। তিনি স্বীকার করেছেন যে হিংসা সম্পূর্ণরূপে শেষ হতে সময় লাগবে।
◾ভারতে ক্রমবর্ধমান অসুবিধার কারণ কী?
ভৌগলিক অবস্থানগত ও রাজনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ আফগানিস্তানে তালিবানরা নিজেদের মুঠি শক্ত করতে সেখানকার সদ্য নির্বাচিত সরকারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করবে এবং আফগানিস্তানে চলা ভারতের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পকে প্রভাবিত করবে। এ ছাড়া পশ্চিম এশিয়াতে ভারতের প্রভাব বাড়ানোর যে প্রস্তুতি নিচ্ছে মোদী সরকার, তা বড় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। এই কারণেই যুক্তরাষ্ট্র এবং তালিবানদের মধ্যে শান্তিচুক্তি সফল হলে ভারতের অসুবিধা বাড়তে পারে।
◾আফগানিস্তানে ভারতের চলমান প্রকল্পগুলি বিপদের মুখে
ভারত ইতোমধ্যে কয়েক বিলিয়ন ডলার ব্যয়ে আফগানিস্তানে বেশ কয়েকটি বড় প্রকল্প সম্পন্ন করেছে এবং তার কয়েকটি এখনও চলছে। ভারত এখনও পর্যন্ত প্রায় তিন বিলিয়ন ডলার সহায়তা দিয়েছে আফগানিস্তানকে , যার ফলে সংসদ ভবন, রাস্তাঘাট ও বাঁধ ইত্যাদি নির্মিত হয়েছে। আফগানিস্তানে ভারতের ক্রমবর্ধমান জনপ্রিয়তার কারণও এটি। তবে ভারত এখনও সেখানে বেশ কয়েকটি মানবিক ও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।
ভারত ১১৬ টি সামাজিক উন্নয়ন প্রকল্পে কাজ করছে, যা আফগানিস্তানের ৩১ টি প্রদেশে প্রয়োগ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, সেচ, পানীয় জলের, পুনর্নবীকরণযোগ্য শক্তি, ক্রীড়া পরিকাঠামো এবং প্রশাসনিক পরিকাঠামো। ভারত কাবুলের জন্য শাহতুত বাঁধ এবং পানীয় জলের প্রকল্পেও কাজ করছে।
আফগান শরণার্থীদের পুনর্বাসনকে উৎসাহিত করার জন্য, নানাগার প্রদেশে স্বল্প ব্যয়ে বাড়ি নির্মাণের প্রস্তাবও রয়েছে। ভারত বামিয়ান প্রদেশের বন্দ-এ-আমিরের সাথে সড়ক যোগাযোগ, পারওয়ান প্রদেশের চরিকার শহরের জন্য জল সরবরাহ ব্যবস্থা এবং মাজার-শরীফে পলিটেকনিক কলেজ নির্মাণে সহায়তা করছে। কান্দাহারে আফগান জাতীয় কৃষি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় ভারত অংশীদার।
◾পাকিস্তানের জন্য তালিবান-আমেরিকা শান্তি চুক্তি কি প্রভাব ফেলবে?
তালিবানদের সঙ্গে আমেরিকার শান্তি আলোচনা এবং চুক্তি পাকিস্তানের পক্ষে লাভজনক। সুতরাং, এই দুটি দেশের মধ্যে পাকিস্তান সরকার এবং গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই মধ্যস্থতাকারী হিসাবে কাজ করছিল। তালিবানদের সহায়তায় আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সেনা আফগানিস্তান থেকে ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গেই কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদী ঘটনা ঘটাতে পারে পাকিস্তান। এটিও ভারতের পক্ষে একটি কঠিন বিষয়।
পাকিস্তান তালিবানদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার বৈঠকে নিয়ে এসেছিল, কারণ তারা তাদের মহল্লা থেকে আমেরিকান বাহিনীকে দ্রুত ফিরিয়ে দিতে চায়। কাতারের রাজধানী দোহায় মার্কিন-তালিবান আলোচনায় যোগ দিতে কয়েক মাস আগে পাকিস্তান তালিবান উপ-প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা বড়দারকে জেল থেকে মুক্তি দিয়েছে।
আফগানিস্তানে তালিবানদের শক্তিশালী অবস্থান থাকলে, পাকিস্তান সেখানকার সরকারকে সরানোর জন্য তালিবানদের সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ করতে পারবে। কারণ, আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক সুবিধের নয়।
◾চবাহার প্রকল্পও বিপদের মুখে রয়েছে
আফগানিস্তান, মধ্য এশিয়া, রাশিয়া এবং ইউরোপের দেশগুলির সংগ্রহ বাণিজ্য ও সম্পর্ক জোরদার করতে ইরানের চবাহার বন্দরের উন্নয়নে ভারত ব্যাপক বিনিয়োগ করেছে। এই প্রকল্পটি চীনের ওয়ান বেল্ট ওয়ান রোড প্রকল্পের কাঁটা হিসাবে বিবেচিত । এমন পরিস্থিতিতে যদি তালিবানরা ক্ষমতায় থাকে তবে ভারতের এই প্রকল্পটিও বিপদে পড়তে পারে কারণ এটি আফগানিস্তান হয়ে অন্য দেশে ভারতের প্রবেশকে বাধাগ্রস্ত করবে।
◾আফগান সরকারকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তালিবানদের মধ্যে শান্তি আলোচনার সাফল্য আফগানিস্তানের বর্তমান সরকারের পক্ষেও একটি বড় বিপদ। তালিবানদের আবার শিকড়কে গাড়া থেকে রক্ষা করতে আমেরিকা তার সেনা প্রত্যাহার করবে।
শুধু তাই নয়, তালিবানরা আমেরিকান সেনা ফিরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আফগান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করতে পারে, এটি এদেশে গৃহযুদ্ধের বিপদ তৈরি করতে পারে। যদিও চুক্তির আওতায় ধীরে ধীরে মার্কিন সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহারের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে, তবে এমন পরিস্থিতিতে এলাকায় কী হয় তা দেখতে হবে। তবে পাকিস্তান থেকে পরোক্ষভাবে তালেবানদের সামরিক সহায়তা আফগান সরকারের পক্ষে চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
◾আফগান সরকার এই আলোচনার বিরুদ্ধে
প্রসঙ্গত আফগানিস্তান সরকার আমেরিকা-তালিবানদের মধ্যে শান্তি আলোচনার বিরোধী ছিল। রাষ্ট্রপতি আশরাফ গনিও এক বিবৃতিতে বলেছিলেন, যে সংগঠন নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে তার সঙ্গে শান্তিচুক্তি অর্থহীন। কারণ তালিবানরা আফগান সরকারকে বিশ্বাস করে না।
◾এই চুক্তির প্রধান কারণ আমেরিকার আসন্ন রাষ্ট্রপতি নির্বাচন
আমেরিকা আফগানিস্তানে প্রায় ২০ বছর ধরে চলমান যুদ্ধের অবসান ঘটাতে কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছিল, কারণ এখান থেকে ২০ হাজার সেনা প্রত্যাহার করে তাদের দেশে ফিরিয়ে নিতে হবে। একই সঙ্গে আমেরিকার আফগানিস্তান ছেড়ে চলে যাওয়াকে আন্তর্জাতিক বিশ্ব সুপারপাওয়ারের হার হিসেবে দেখার আশঙ্কা ছিল।
একই সময়ে, ২০২০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের এটি একটি বড় ইস্যু। রাষ্ট্রপতি ট্রাম্প সর্বশেষ নির্বাচনী প্রচারে দু’দশক ধরে আফগানিস্তানে অবস্থানরত মার্কিন সেনা প্রত্যাহারকে একটি প্রধান ইস্যু হিসাবে তুলে ধরেছিলেন। তবে ট্রাম্প এই প্রতিশ্রুতি আজ অবধি পালন করেননি। এখন ট্রাম্পের সর্বশেষ চুক্তির পরে মার্কিন সেনা প্রত্যাহার এই বিষয়ে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ট্রাম্পের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে।
১৯৯০ এর দশকে উত্তর পাকিস্তানে তালিবানদের উত্থান ঘটেছিল, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাহিনী আফগানিস্তান থেকে সরে আসছিল। ১৯৯৪ সালে আফগানিস্তানে পাশতুনদের নেতৃত্বে তালিবানদের আত্মপ্রকাশ ঘটে।
মনে করা হয় যে তালিবানরা প্রথমে তাদের উপস্থিতি ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা মাদ্রাসাগুলির মাধ্যমে জানান দেয়। যেখানে ব্যবহৃত বেশিরভাগ অর্থ সৌদি আরব থেকে আসে। আশির দশকের শেষের দিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন আফগানিস্তান ত্যাগ করার পরে বেশ কয়েকটি গ্রুপের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় যার পরে তালিবানের জন্ম হয়। তৎকালীন আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এমন ছিল যে স্থানীয়রা তালিবানদের স্বাগত জানায়।
প্রাথমিকভাবে তালিবানদের জনপ্রিয়তা বেশি ছিল কারণ তারা বন্দুকের নলে দেশের দুর্নীতি ও বিশৃঙ্খলা রোধ করেছিল। তালিবানরা তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলগুলি সুরক্ষিত করে যাতে লোকেরা স্বাধীনভাবে ব্যবসা করতে পারে।
◾তালিবান উত্থানের ক্ষেত্রে পাকিস্তানের হাত
তালিবানরা তাদের প্রভাব দক্ষিণ পশ্চিম আফগানিস্তান থেকে খুব দ্রুত বাড়িয়েছিল। ১৯৯৫ সালের সেপ্টেম্বরে তালেবানরা ইরানের সীমান্তবর্তী আফগানিস্তানের হিরাট প্রদেশ দখল করে। এক বছর পরে, তালিবানরা বুরহানউদ্দিন রাব্বানী সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুলকে দখল করে নেয়। ১৯৯৯ সালের মধ্যে তালিবানরা আফগানিস্তানের প্রায় ৯০ শতাংশ অঞ্চল নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনে।
পাকিস্তান বরাবর অস্বীকার করে এসেছে যে তারা তালেবানদের উত্থানের পিছনে ছিল। তবে, এব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই যে তালিবান যোদ্ধারা প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের মাদ্রাসাগুলিতে শিক্ষা নিয়েছিল।
নব্বইয়ের দশক থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় থাকার সময় পাকিস্তান, সংযুক্ত আরব আমিরশাহী এবং সৌদি আরব – কেবল তিনটি দেশ এতে স্বীকৃতি দিয়েছিল। পাকিস্তানও তালিবানদের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার পক্ষে ছিল না।
◾আমেরিকা ৯/১১ এর প্রতিশোধ নিতে আফগানিস্তান আক্রমণ করে
১১ ই সেপ্টেম্বর, ২০০১, নিউ ইয়র্কের ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারে আক্রমণ করার পরে মার্কিন সমর্থিত জোট বাহিনী ২০০১ সালের অক্টোবরে আফগানিস্তানে আক্রমণ করেছিল। ওসামা বিন লাদেনের সংগঠন আল কায়েদা আমেরিকান সন্ত্রাসবাদী হামলায় আফগানিস্তান থেকে কাজ চালাচ্ছিল ।
৯ / ১১-এর পরে খুব শীঘ্রই মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট বাহিনী আফগানিস্তানে তালিবানদের ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়, যদিও তারা তালিবান নেতা মোল্লা ওমর ও আল-কায়েদার বিন লাদেনকে ধরতে পারেনি। তবে, ২০১১ সালের ২ শে মে ওসামা বিন লাদেনকে পাকিস্তানের অ্যাবোটাবাদে ইউএস নেভি সিল কমান্ডো গুলি করে হত্যা করে ।