শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী (Sarathkumari Devi)ও শ্রীমতী হিরণ্ময়ী দেবী (Hironmoi Devi) কল্যাণীয়েষু,
তোমাদের হাতে প্রস্তুত বড়ি পাইয়া বিশেষ আনন্দলাভ করিলাম। ইহার শিল্প নৈপুণ্য বিস্ময়জনক । আমরা ইহার ছবি কলাভবনে রক্ষা করিতে সংকল্প করিয়াছি।
তোমরা আমার আশীর্বাদ জানিবে।
শুভাকাঙ্ক্ষী
শ্ৰী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
ইতি ২১ শে মাঘ / ১৩৪১
পূর্বমেদিনীপুরের (East Midnapore) তমলুক (Tamluk) মহকুমার মহিষাদলের লক্ষ্যা গ্রামের উপেন্দ্রনাথ মাইতির দুই নাতনি সেবা ও পুষ্প এবং নাতি আশিস শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন পড়াশোনার উদ্দেশ্যে। উপেন্দ্রর কাকা স্বদেশনারায়ণ ছিলেন বেশ শিল্পরসিক মানুষ। ফলে সে সময় তিনি উদ্যোগ নেন শান্তিনিকেতনে নিজের বাড়ি তৈরি অপরূপ নকশা বড়ি পাঠানোর। তাঁর মাতা শ্রীমতী শরৎকুমারী দেবী এবং বউদি হিরণ্ময়ী দেবীর হাতে তৈরি বেশ কিছু নকশা বড়ি তিনি সেবা মাইতির মাধ্যেমে পাঠান শান্তিনিকেতনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে। মেদিনীপুরের গয়না বড়ির অপূর্ব শিল্প সুষমা স্বভাবতই বিশ্বকবির চক্ষু এড়িয়ে যায় নি। মুগ্ধ কবি তৎক্ষনাৎ গয়না বড়ির দুই কারিগরের উদ্দেশ্যে লিখলেন প্রমথমোক্ত পত্রখানি।
সেই ১৩৪১ সালের ২১ মাঘ মেদিনীপুরের (Midnapore) গয়না বড়ি পেয়ে যায় আলাদা আভিজাত্য। এমন মনে করা হয় যে যে বহু বহু প্রাচীন কাল থেকেই জেলার যে মাহিষ্য সম্প্রদায়ের রমণীরা তাঁদের হাতে গড়া গয়নাবড়ি নিয়ে উচ্চবাচ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তা ঠিক কতটা সত্য তা নিয়ে বিতর্ক আছে। কারন এই সব সুচারু বড়ির কথা এরও পূর্বে শ্ৰীচৈতন্যচরিতামৃত , মঙ্গলকাব্যে ব্যাপক ভাবে উল্লিখিত হয়েছে।
রেলফ ফিচারের বর্ণনায় পাওয়া যায় কিছু বাঙ্গালী ছিলেন যারা নিরামিষ আহার করতেন এবং ফল ও দুগ্ধজাত দ্রব্য খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করতেন। বৈষ্ণবীয় রীতিতে ভোগ অন্ন পরিবেশন বাংলা বৈষ্ণব সাহিত্যের এক অপূর্ব দৃশ্য ।অতি তুচ্ছ বস্তু এখানে বড় উপাদেয় হয়ে ওঠে । গ্রাম বাংলার রন্ধন পটিয়সী মা ,স্ত্রী বা ভগিনীর হাতে রাঁধা ব্যঞ্জন স্বর্গের অমৃত সমান। কৃষ্ণদাস কবিরাজ সার্বভৌম ভট্টাচার্য্যের বাড়িতে চৈতন্যদেবেরনিরামিষ আহারের বিবরণ যে দিয়েছেন—
“ বত্রিশ কলার এক আঙ্গেটিয়া পাত,
তিন মান তণ্ডুল তাতে ধরে ভাত।
পীত সুগন্ধি ঘৃতে অন্ন সিক্ত কৈল
চারিদিকে পাতে ঘৃত বাহিয়া চলিল
কেয়াপত্র কলার খোলা ডোঙ্গা সারি সারি,
চারিদিকে ধরিয়াছে নানা ব্যঞ্জন ভরি।
……
দশবিধ শাক নিম্ব তিক্ত শুক্তার ঝোল,
মরিচের ঝালে ছেড়াবড়ি বড়া ঘোল।
দুগ্ধতুম্বী, দুগ্ধ কুষ্মাণ্ড, বেশারী লাফরা,
মোচা ঘণ্ট, মোচা ভাজা, বিবিধ শাকরা।
ভৃষ্ঠ মাষ মুদ্গ সূপ অমৃতে নিন্দয়।
মধুরাম্ল বড়াম্লাদি অম্ল পাঁচ ছয়।।
মুদ্গ বড়া মাষবড়া কলা বড়া মিষ্ট।
ক্ষীর পুলি নারিকেল তুলি আর যথ শিষ্ঠ।।
হ্যাঁ , শ্রী চৈতন্য চরিতামৃত….সেথায় খাদ্যের কথা বলতে গিয়ে বার বার #বড়ি শব্দটি এসেছে। এবার কলাই , কেঁড়িলি মানে ওই ডাল শস্য ব্যতীত বড়ি অন্য কোনো উপায় বানানো সম্ভব নয়। তাহলে? তাছাড়া মাষ , মুদ্গ সূপ শব্দ ব্যবহার হয়েছে।
গয়না বড়ি প্রাচীন বাংলার একটি ঐতিহ্য মন্ডিত লোক বা কুটির শিল্প। রাঢ় অঞ্চলের রমণীর হেঁসেলে ঢুকেই সেই নিখুঁত শিল্প কর্মটি পাওয়া যেত । যা আজ লুপ্ত প্রায়।
মেয়ে যাচ্ছে শ্বশুরবাড়ি
সঙ্গি হলো গয়না বড়ি
খুকুর কেন মন ভারী।
পাতে নেই যে গয়না বড়ি।।
রসিক মঙ্গলেও বৈষ্ণবীয় মহোৎসবে বিভিন্ন প্রকার নিরামিষ ব্যঞ্জনের কথা উল্লেখ হয়েছে । সেখানে অনেক প্রকার সবজি, ফলমূল, মশলার ব্যবহারের কথা জানতে পারা যায় ।সেখানে হিঙ্গু ,মেথি , গোলমরিচ , জায়ফল ইত্যাদির সঙ্গে গোধূম ছোলা এবং খেসারির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। রসিক মঙ্গলে শ্রীকৃষ্ণ মহোৎসবের জন্য যে সমস্ত রান্না হয়েছিল সেগুলো একটু আমি উল্লেখ করছি ।এর মধ্যে তদানীন্তন বাঙালির নিরামিষ ও শিমব গোত্ৰীয় শস্য আহারের বিশেষ পরিচয় পাওয়া যায় –
মহোৎসব দ্রব্য সব করিয়া প্রথমে।
তন্দুলাদি যুগ বিরি আনিল যতনে।।
মরাই করিয়া রাখি পর্বতসমান।
মহোৎসব মহানন্দে এসব প্রধান।।
গোধূম ময়দা ছোলা খেসারি অপার।
ঘৃত তৈল গুড় গুয়া শত শত ভার।।
মঙ্গলকাব্য গুলিতে তৎকালীন বঙ্গসমাজ জীবনের এক সামগ্রিক চিত্র ফুটে উঠতে দেখা যায়। বাঙালি জীবনচর্চার খুঁটিনাটি সমাজচিত্র এখানে ঘরোয়া চিত্রে প্রতিবিম্বিত হয়েছে । এখানে স্বর্গের দেবদেবীরা নিতান্তই বাঙালির ঘরের আপনজন। বাঙালির বৈচিত্র এবং রন্ধনের উপাচার বহুমাত্রিকতা এখানে বিস্তারিত ভাবে ব্যাখ্যা করা হয়েছে ।এইসব রন্ধন উপকরণের মধ্যে কলাই, মুগ ও বড়ির একটি বিশেষ স্থান ছিল তার বারবার প্রমাণ মেলে।
কবিকঙ্কন মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে “ধনপতি সওদাগরের উপাখ্যানে” খুল্লনার রন্ধন অংশে খুল্লনা দেবী সর্বমঙ্গলা কে স্মরণ করে যে রান্না করেছিলেন সেখানে বড়ির ও মুসুরের বিশেষ উল্লেখ আছে।
প্রভুর আদেশ ধরি রান্দেয়ে খুল্লনা নারী
সোঙরিয়া সর্বমঙ্গলা
তেল ঘৃত লবণ ঝাল, আদি নানা বস্তুজাল
সহচরী যোগায় দুর্ব্বলা।
বাইগুন কুমড়াকড়া কাঁচকলা দিয়া শাড়া
বেসার পিঠালি ঘন কাটি।
ঘৃতে সন্দ্রোলিল তথি হিঙ্গজীরা দিয়া মেথি,
শুক্তা রন্ধন পরিপাটি।
ঘৃতে ভাজে পলাকড়ি নৈঠা শাকে ফুলবড়ি,
চরঙ্গি কাঁঠাল বিচি দিয়া।
ঘৃতে নলিতার শাক তৈলে বস্তু করি পাক খণ্ডে খণ্ডে বড়ি ফেলিল ভাজিয়া।
মুসুরি মিশ্রিত মাস সুপ রানদে রসবাস
হিঙ্গুজীরা বাসে সুবাসিত,
ভাজে চিখলের কোল, রোহিত মৎসের ঝোল
মান বড়ি মরিচে ভূষিত।।
এরপর ভোজ পর্বে সাধু ব্যঞ্জনের প্রশংসা করেছিলেন। সেখানে আমিষ মাংসের সঙ্গে বড়ির উল্লেখ রয়েছে। সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে তৎকালীন বঙ্গসমাজে মাছ মাংসের সঙ্গে ঘি দিয়ে ভাজা বড়ির বিশেষ স্থান ছিল এবং তা ভোজনরশিক সাধুর কাছে ছিল অত্যন্ত উপাদেয় ব্যঞ্জন।
কবিকঙ্কন রচিত চন্ডীমঙ্গলের “নিদয়ার মনের কথা ” অংশে নিদয়া তার স্বামীকে সোহাগ করে বলছেন-
শোনো প্রাণনাথ কহিয়ে তোমারে
এবে মোর প্রাণ কেমন করে।।
কইতে নিজ সাধ বড়লাজ বাসি।
পান্ত ওদনে ব্যঞ্জনবাসী
বথুয়া ঠনঠনি তৈলের পাক ।
ডগডগি লাউ ছোলার শাক ।।
মীন চড়চড়ি কুসুম_বড়ি।
সরল সফরি ভাজা চাঙড়ি।।
খুলনার গর্ভ অংশে ব্রাহ্মণের দান সামগ্রিক কথা উল্লেখ করা হয়েছে। চলুন দেখে নিই সেইসব সামগ্রীতে কি কি দ্রব্য স্থান পেয়েছিল…
আসিবে ব্রাম্ভন ভাট কড়ি চাহি পাটে পাট
জোড়গড়া কাচা চাহি ধুতি।
আলোচালু ডাউল_বড়ি শতেক তস্কারকটি
চিঁড়ে কলা দধি গুয়া পান।
ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গল আমরা বিভিন্ন প্রকার ব্যঞ্জনের মধ্যে ডাল এবং বিভিন্ন বড়ির উল্লেখ পায় সেখানে বাঙালি রন্ধনে আমিষ নিরামিষ ব্যঞ্জনের মধ্যে ডালের যে বৈচিত্র পাই তার কিছু আমি উল্লেখ করলাম :
ভোগের রন্দন ভার লয়ে পদ্মমুখী।
রন্দন করিতে গেলা মনে মহা সুখী।।
স্নান করি করি রামা অন্নদার ধ্যান।
অন্নপূর্ণা রন্দনে করিলা অধিষ্ঠান ।।
ডালির রান্ধে ঘনতর ছোলা অরহরে।
যুগ মান বরবটি বাটুলা মটরে।।
কলাই ও বড়ি তখনকার দিনে যে বাণিজ্যিক পণ্য ছিল তার পরিচয় কিন্তু আমরা পাই এই মনসামঙ্গলে । সে সময় হয়তো মুদ্রার প্রচলন ব্যাপক ছিল না। তখনকার বাণিজ্যিক প্রথা পণ্য বদলের মাধ্যমে সম্পন্ন হত। কলাই ও বড়ি মূল্যবান বস্তুর সাথে বদল হতো তার বিস্তারিত উল্লেখ কিন্তু মনসামঙ্গলে করা হয়েছে।
চাঁদ বলে লেঙ্গাপাত্র শুনো মোর বাণী।
ডিঙ্গায় চাপাত ভাই যত দ্রব্য আনি।।
ঘরের বাহিরে আর কিনিতে যত পাঅ।
পাত ফলমূল সব ডিঙ্গায় চাপা।।
কাঁচা হরিদ্রা তোলে পুরান সুকুতা।
ইহার বদলে নিব পাটনে গজ মুকুতা।।
মাস কলাই আদার সুট আর তোলে জিরা।
মরিচ লবঙ্গ দিয়া বদল নিব হীরা।।
যতন করিয়া নেহ কিছু ফুলবড়ি।
একভারে বদল নিব দুই ভার কড়ি।।
রামেশ্বর শ’র রচনাবলী “দক্ষিণ রাঢ়ের তিন কবি ” নামক অংশে শিবায়ন পালার পার্বতীর বিবাহের যে বর্ণনা করেছেন তাতে বড়ি র উল্লেখ আমরা পাই। বিশেষজ্ঞদের মতে এখানে কুমারসম্ভবের প্রভাব রয়েছে। শিশুকন্যাদের পুতুল খেলার একটি মনোরম দৃশ্য এখানে আমরা পাই পার্বতীর খেলার ছলে ধুলাবালি মাটি কাদা ইত্যাদি দিয়ে যে ব্যঞ্জন প্রস্তুত করেছিলেন তা অতুলনীয়….
হৈমবতী পুতুলের বিবাহ দিতেছেন-
বরযাত্রা কন্যা যাত্রা বসাইয়া ঘরে।
আপনি অভয়া অন্ন বিতরণ করে ।।
সবাকার সম্মুখে পাতিয়া কচু পাত।
ধরণী ধূলার তাতে ধরা দিল ভাত।।
শাক দিল শাকম্ভরী সজিনার পাতা ।
সুপ দিল তপ্ত বালি ত্রিভুবন মাতা।।
বড়ি ভাজা বিতরণ বদমবি বদরির বীজ।
কলামূলা ভাজা দিল কাট্যা নাটা সিজ।।
রামেশ্বর রচনাবলী শিবায়ন পালায় চতুর্থ দিবাসীয় দিবাপালা বলা আরম্ভ শিবের ভিক্ষা অংশে আমরা বড়ি এবং ডালের উল্লেখ পাই……
শুনিয়া শিবের শব্দ সীমন্তিনীগন।
দেখে গিয়া দিব দিগম্বরে দিয়া নানা ধন।।
কেহ দেয় কড়ি বড়ি কেহ দেয় চালু ডালি ।
কেহ আমন্ত্রণ করিয়া আইস্যা কালি।।
চন্দ্রচূড় চলে অঙ্গীকার করায় তাকে ।
হরহর বল্যা কেহ কিরা দিয়া রাখে।।
গয়না বড়ি নিয়ে অনেক ছড়া আজও রাঢ় বঙ্গের (Radh Bangar) লোকমুখে ঘুরে ফিরে বেড়ায়।
যেমন –
চায়ের সাথে পলকা বড়ি
আতিথেয়তার নেইকো জুড়ি।
বা
গয়না বড়ি এতই হালকা
তেল জোগাতে পকেট ফাঁকা।
নন্দকুমার (Nandakumar) ব্লকের চোরগোদা (Chorgoda) গ্রাম গয়নাবড়ির জন্য বিখ্যাত। মঙ্গলকাব্য পরবর্তী একটা সময় বঙ্গে এসেছিল যখন কেবলমাত্র গৃহে খাবার নিমিত্ত মেদিনীপুরের (Midnapore) গাঁয়ের মা , বধূ, কন্যারা গয়না বড়ি বানাতেন। এখন ব্যবসায়িক ভিত্তিতে বানানোর চল হয়েছে।
শীতের সময়টা প্রতিদিনই তৈরি হয় হরেক রকমের গয়না বড়ি। একটা সময় কে কত ভালো নকশার গয়নাবড়ি বানাতে পারেন তা নিয়ে পাড়াগাঁয়ের মহিলাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা ছিল।এখন তো বানিয়ে প্যাকেট করে আমাদের সবার হেঁসেলে চলে আসে। বরগোছা গ্রাম গয়না বড়ি করিয়েদের আঁতুরঘর।ফলে এখানের মহিলারা আজ তাঁদের মা ঠাকুমার ,দিদাদের শেখানো বিদ্যা দিয়ে শ্বশুর বাড়ির আপনজনদের রসনা তৃপ্ত করছেন সেই গয়না বড়ি খাইয়ে। তাঁদের হাতে তৈরি গয়না বড়ি কতশত মানুষদের নিকট হতে বাহবা ও ভালোবাসা কুড়িয়ে নিচ্ছে।
উপহারে নকশা বড়ি
সাফল্য আনে পুরোপুরি।
এবার আসি বড়ি মানে কি বা গয়না বড়ি কি? মূলত বড়ি শব্দটি এসেছে সংস্কৃত বটিকা শব্দ থেকে। যার অর্থ হল ক্ষুদ্র বস্তু। এর সঙ্গে সঙ্গে যুক্ত হয়েছে গহনা বা গয়না শব্দটি, যার অর্থ হল অলঙ্কার। অর্থাৎ, যে বড়ি অলঙ্কৃত বা গয়নার মতো দেখতে তাকেই গয়নাবড়ি বলে। এতে নকশা থাকে বলে একটা নকশা বা নকশি বড়িও বলা হয়।
মেদিনীপুরের (Midnapore) গয়না বড়ির একটি ক্রমিক ইতিহাস আছে সেতো আগেই বলেছি। গহনা বড়ির ইতিহাস বহু শতাব্দী প্রাচীন। ভারতবর্ষে ব্রিটিশ আগমনের আগে গহনা বড়ি প্রস্তুতিতে পোস্তর প্রচলন ছিল না। পলাশীর যুদ্ধের পরে, ব্রিটিশরা বেআইনী আফিমের এক বিশাল বাজার আবিষ্কার করে চীনে। ব্রিটিশরা তখন বাংলার রাঢ় অঞ্চলের চাষীদের পোস্ত চাষে বাধ্য করে এবং তার থেকে বিপুল পরিমাণ আফিম নিষ্কাশন করে তা চীনে পাচার করতে শুরু করে। আফিম নিষ্কাশনের পর পোস্তর বীজ ফেলে দেওয়া হত। ক্রমে পোস্তর বীজ বাঁকুড়া, বীরভূম, বর্ধমান ও মেদিনীপুর জেলার রান্নার উপাদান হয়ে ওঠে। মেদিনীপুরে (Midnapore) গহনা বড়িতে পোস্ত দানার ব্যবহার শুরু হয়।
লোকসাহিত্য ও লোক শিল্পের বিশিষ্ট গবেষক নির্মলেন্দু ভৌমিক বলেছেন ” লোক শিল্পরূপে গয়নাবড়ি এবং লোকসাহিত্যকে পরস্পরের পটভূমিকায় লক্ষ্য ও বিচার করা দরকার। তবেই একের আলোকে অপরের ইতিহাস ও ক্রমবিকাশের যদি কিছু ইঙ্গিত মেলে। নতুবা তা মিলানো যায় না। “
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর (Rabindranath Tagore) স্বয়ং গয়নাবড়ির সাযুজ্য পেয়েছিলেন মধ্য এশিয়ার খোটান প্রদেশে খননের ফলের প্রাপ্ত প্রত্নসামগ্রীর সঙ্গে। নির্মলেন্দু ভৌমিকের দাবি, গয়নাবড়ির মূল উৎস হল ব্রতের আলপনা। আমাদের সনাতনী সমাজে এমন বহু ব্রতকথা ও পূজা থাকে যারমধ্যে দিয়ে বঙ্গের পুরনারীগণ নিজেদের জীবনের কাঙ্খিত বস্তুর চিত্র আলপনায় প্রতিফলিত করেন। এই বিশ্বাস থাকে যে এই সকল ব্রতের মাধ্যমে লাভ হতে পারে বস্তুর চিত্র যা আলপনায় প্রতিফলিত হয়েছে। তাই কোজাগরী সহ বাংলার গৃহে চার মাসের মা লক্ষ্মী আরাধনায় শালী ধান্যের শীষ , শাকান্ন, গোয়াল ঘর, কলমিলতা আঁকা হয়, পুন্যিপুকুর বা যমপুকুর ব্রতের সময় আঁকা হয় পুকুর, ক্ষেত্র ব্রতের সময় আঁকা হয় ধানের ক্ষেত,খুন্তিলতা ইত্যাদি। অলঙ্কার বা গহনা হল স্ত্রী ধন। ভারতীয় সনাতনী সমাজ ব্যবস্থায় গহনা স্বরূপ স্ত্রী ধন প্রতিটি স্ত্রী লোকের কামনার বিষয়। বিপদে আপদে সেই সম্পদই কাজে আসে সংসারে। ব্রতের আলপনায় যে দৃষ্টিভঙ্গিতে নানান ধরনের গহনা চিত্রিত করা হয় সেই ভঙ্গিটি এবং সংলগ্নতার বিষয়টিই গয়নাবড়ি তৈরির অনুপ্রেরণা হতে পারে অনায়াসেই।
তমলুক (Tamluk) শহর থেকে এখন গয়না বড়ি বা নকশাবড়ি বিদেশে রপ্তানি হয়। এখানের মা বোনেরা একেকজন দক্ষ গয়নাবড়ি শিল্পী , এনারা গয়না বড়ি তৈরির কৌশল শেখাতে যান দুরদুরান্তে। তমলুক (Tamluk) শহরের অনেকেরই বর্তমান জীবিকা এই গয়নাবড়ি তৈরি ও বিক্রি করা। মেদিনীপুরের সর্বত্র এখন গয়না বড়ির চল থাকলেও মূলত ময়না, তমলুক, পাঁশকুড়া, সুতাহাটা, কোলাঘাট, দাসপুর, নন্দকুমার, নারাজোল, মহিষাদল, কলাগেছিয়া, এগরা, মেদিনীপুর শহর, দাঁতন, বেলদা, মুগবেড়িয়, কাঁথি, ঘাটাল এলাকায় গয়না বড়ি নিত্যনৈমিত্তিক গৃহদ্রব্য স্বরূপ অবস্থান করে।
গ্রীষ্মকালে গয়না বড়ি তৈরি হয় না। শীতকালই এর আদর্শ সময়। কার্তিক মাসের পোড়াষ্টমীর দিন গয়নাবড়ি দেওয়া শুরু হয়। এখন প্রসঙ্গতই পাঠক মনে স্বাভাবিক প্রশ্ন আসবে যে এই পোড়াষ্টমী কি ?
পোড়াষ্টমীর ভালো নাম হল হলোপৌড়া অষ্টমী”। রাঢ় বাংলার অন্যতম সামাজিক ও পারিবারিক উৎসব এই “পৌড়া অষ্টমী”।কারো কাছে যা “পোড়া অষ্টমী”বা “প্রথমা অষ্টমী”।পরিবারের প্রথম কিংবা জ্যেষ্ঠ সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।কারো কাছে এটি “পোড়া অষ্টমী”বা “প্রথমা অষ্টমী”।প্রথম বা জ্যেষ্ঠ সন্তানের মঙ্গল কামনায় এই উৎসব পালন করা হয়ে থাকে।
এই অনুষ্ঠানে মামা বাড়ি থেকে নতুন পোষাক,চন্দন,ধান,দূর্বা,ফুল আসে।নিয়ে আসেন মামাবাডির কেউ।আবার নিজের বাড়িতেও কেনা হয় নতুন জামাকাপড়।বাড়ির উঠোনে তুলসিতলার কাছাকাছি মায়েরা সন্তানের মঙ্গলের জন্য কলাপাতা বিরির বড়ি বসান। যার অষ্টমী তিনি এদিন হলুদ ও গঁধাউলার(আবাটা) মিশ্রণ গায়ে মেখে চান করার পর নতুন বস্ত্র ,নতুন রেশম পরিধান করে করেন।তারপর তার কপালে মঙ্গল টীকা পরিয়ে দেন মা সহ বাড়ির বড়রা।
বিয়ের পর অবশ্য মামাবাড়ি থেকে জামাকাপড় আসাটা আর বাধ্যতামূলক থাকে না। মেয়েদের ক্ষেত্রে বাবার বাড়ি থেকে আর ছেলেদের ক্ষেত্রে শ্বশুরবাড়ি থেকে আসে।তবে অনেকের ক্ষেত্রে বিয়ের পর মামাবাড়ি থেকেও অষ্টমীর সামগ্রী আসে।এদিন নানা রকম পিঠে ,মিষ্টি ,পায়েস,পলাও তৈরি হয় বাডিতে।দুপুরের আহারেও থাকে আমিষ-নিরামিষ নানাপদ। যাদের অষ্টমী তাদের আজ “ভুজা” (মুড়ি) খাওয়া বারণ। রাঢ় বঙ্গের (Radh Bangar) ওই পাড়ে মানে উড়িষ্যার সীমান্তবর্তী অঞ্চলেও পোড়াষ্টমী সাড়ম্বরে পালিত হয়। যদিও এখন বঙ্গে এই সব পালপার্বন ব্রত কথা গুলো হারিয়ে যাচ্ছে।
যা হোক , তো উক্ত দিনে বাড়ির মা ঠাকুমারা কলারপাতে বিড়ির ডালের বড়ি বসিয়ে গয়না বড়ি তৈরির শুভারম্ভ করেন। যত ঠান্ডা থাকবে বড়ি তত মুচমুচে আর হালকা হবে।সকাল বেলা বিউলির ডালকে ভিজিয়ে রাখতে হবে। ভিজে নরম হলে ভালো করে খোসা ছাড়াতে হবে।পরের দিন ভোরবেলা জল ঝরিয়ে শীলনোড়ায় মিহি করে বাটতে হবে। আমি আবার বলছি শীলনোড়ায় বাটতে হবে , কোনো আধুনিক টেকনোলজিতে বাটাবাটির কাজ করলে কিন্তু বড়ি হবে না। মন্ডটি যেন ঘন মাখনের মতো দানা বিহীন হয়। অন্যান্য ডালের তুলনায় বিউলির ডাল বা বিরিকলাই অথবা মাষকলাই অধিক আঠালো বা চটচটে হয় ।
সংস্কৃত শব্দ বিদলিত থেকে অপভ্রংশ হয়ে বি অলিতা = বিউলি হয়েছে। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের “উদ্ভিদ অভিধান” অনুসারে এই মাষকলাইকে হিন্দিতে উড়ুৎ কি ডাল, উড়িয়া ভাষায় বিরহি , সংস্কৃতে বিদলিত, মাষক , ঋদ্ধি নামে ডাকা হয়। এছাড়াও একে যে যে নামে ডাকা হয় তা হল , কুরুবিন্দ , ধান্যবীর, পিতৃভোজন, মাংসল, বৃষকার, পিত্র্য এবং বলাঢ্য।
এবার পরিমাণ মতো নুন মিশিয়ে ভালো করে মন্ডটিকে ফেটিয়ে নিতে হবে। এতে বড়ির শুভ্রতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হালকা এবং সুস্বাদু হয়।ফেটানো মন্ডটি যেন পাতলা না হয়। জলে মন্ডটি ফেলে যদি ভেসে ওঠে তবে বুঝতে হবে ফেটানো ভালো হয়েছে। ফেটানোর সঙ্গে সমজে বড়ি বানাতে হবে নচেৎ কিন্তু ভালো বড়ি হবে না। ট্রে বা থালা বা কলারপাতে পোস্ত ছড়িয়ে মোটা কাপড়ের ফুটোতে চোঙ লাগাতে হবে। এবার সেই চোঙ পুটলিতে পেটানো মন্ড ভরে হাতের মুঠোয় ধরে চাপ দিয়ে চোঙ থেকে পাপড়ি বের করে সোজা উল্টে হাতের প্যাঁচে সৃষ্টির উল্লাসে মাতোয়ারা হন মা ঠাকুমা দিদিমারা। নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে তৈরি করেন কমপক্ষে ৩০ থেকে ৪০ টি নকশাদার বড়ি।
এককেজি বিউলির ডালে কমপক্ষে ১২০ টি নকশাদার বড়ি তৈরি সম্ভব।সীতাহার, সীতা দুল, রানীর মুকুট, কঙ্কন, জোড়া ফুল, লকেটসহ হার, সোনার চিরুণী, বরের টোপর, চূড় ,ললন্তিকা ইত্যাদি নানা ধরনের গয়নার আদলে তৈরি হয় গয়না বড়ি । তা ছাড়া রথের চাকা , চক্র, মন্দির, পশু পাখি, পালকি , শঙ্খ , মাছ, পানের পাতা, ঘরবাড়ি ইত্যাদি নানা নকশার আদলে তৈরি হয় গয়না বা নকশা বড়ি। অনেকেই প্রিয়তমের নাম লিখে চারদিকে সুদৃশ্য নকশা করে উপহার হিসাবে পাঠিয়ে থাকেন নকশাবড়ি।
অন্তত পক্ষে তিনদিন রোদে রেখে শুকোতে হবে।এরপর টিন বা প্লাস্টিক ডিবেতে ভরে রাখতে হবে। ইদানিং অসংখ্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মেয়েরা বাণিজ্যিক ভাবে যুক্ত হয়েছেন গয়না বড়ি নির্মাণের কাজে। কেবল গয়না বড়ি নয় মশলা বড়ি, বিচা বড়ি , ফুল বড়ি ,মসুর ডালের বড়ি , বেতো বড়ি ,খেসারি ডালের বড়ি ইত্যাদি। তবে গয়না বড়ির জন্য বিউলির ডালই বরাদ্দ।
এখনো শীতের বেলায় ছড়া কেটে প্রাচীন ঠাকুমা , দিদিমারা গয়না বড়ি বানান ।
বুড়ো বুড়ির নেইকো দাঁত
মাড়ির চাপে বড়ি কাত।
অথবা , খুকুর মন কেন ভারী
পাতে নেই যে গয়না বড়ি।
এইসব ছড়ায় রাঢ় বঙ্গের গ্রামগুলোর শীতের দুপুর মুখরিত হয়ে ওঠে।
তথ্যঃ বাংলার পেশা ভিত্তিক লোকায়ত শিল্প
দুর্গেশনন্দিনী