ভারতের বুদ্ধিজীবীরা বিপুল গরিষ্ঠাংশের মতামতকে অগ্রাহ্য করে থাকেন

বাকস্বাধীনতা, ভিন্ন মত পোষণ, সহিষ্ণুতা ও সকলকে সঙ্গী করে চলাই গণতন্ত্রের মূল মন্ত্র। এই সূত্রে বৈচিত্র্যের মধ্যে একতাই গণতন্ত্রের জীবনীশক্তি বলে চিহ্নিত। এটিই একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে প্রাণবন্ত করে রাখে। সকলেই জানেন গণতন্ত্র নাগরিকদেরই হিতার্থে, তাদেরই দ্বারা ও তাদেরই জন্য সৃষ্ট। তবে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকটি সিদ্ধান্তই কিন্তু গরিষ্ঠাংশের মতানুসারে নির্ধারিত হয়ে থাকে।

পঞ্চায়েত থেকে সংসদ অবধি একজন নাগরিক প্রতিনিধি সকলের মধ্যে সর্বাধিক ভোট পেয়েই নির্বাচিত হয়ে থাকেন। কোনো একটি রাজনৈতিক দল বা কয়েকটি দলের জোট একত্রিত হয়ে আইনসভায় নির্বাচিত সদস্যদের গরিষ্ঠাংশের সমর্থন পেলে তবেই সরকার গঠন করতে পারে। আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে সদস্যদের গরিষ্ঠাংশ যদি প্রস্তাবিত আইনের ক্ষেত্রে অনুমোদন দেয় তখনই কেবল সেটি আইনে রূপান্তরিত হতে পারে। যে কোনো অকিঞ্চিৎকর বা জরুরি বা দেশের সংবিধান সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো মামলা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের কাছে এসে পৌঁছলে বিচারকদের সংখ্যাধিক্যের রায়ের ভিত্তিতেই মামলাটির নিষ্পত্তি হয়।

উল্লেখিত সকল ক্ষেত্রগুলিতেই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ক্ষেত্রে সংখ্যার বিপুলত্ব বা অল্প ব্যবধানের গরিষ্ঠতায় গৃহীত সিদ্ধান্তের মান্যতা আইন হিসেবে বা সরকারি ভাবে তার গ্রহণযোগ্যতায় কোনো হেরফের ঘটায় না। কিন্তু ভারতের ক্ষেত্রে চরিত্রগতভাবে বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে অভ্যস্ত বুদ্ধিজীবীদের অংশবিশেষের প্ররোচনায় দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠের দৃষ্টিভঙ্গিকে খাটো করে দেখবার বা তাকে বাতিল করার প্রচেষ্টা চলে আসছে। নিশ্চয়ই বাকস্বাধীনতা একটি মৌলিক অধিকার। কিন্তু তার মানে কি এই দাঁড়ায় যে কোনো মতের বিরুদ্ধাচরণকারীদের মতটিই মৌলিকভাবে (অবিসংবাদিতভাবে) ঠিক ? অতীতে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেস ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামকে নেতৃত্ব দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশে একটি গণতান্ত্রিক ধাঁচা প্রতিষ্ঠা করারও চেষ্টা করেছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয়, তারা ভারত সম্পর্কে একটি বিশ্বজনীন পরিচিতি নির্মাণ ও বহুবিধ মতামতের একত্রীকরণ— এই উ ভয়ক্ষেত্রেই ব্যর্থ হয়েছিল। এরই পরিণতিতে দেশ দ্বিখণ্ডিত হয়। বিভাজনের কারণে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে লক্ষ লক্ষ শরণার্থী খুন হন এবং আততায়ীর গুলিতে মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যু হয়।

১৯৩৮ সালে সুভাষ চন্দ্র বোস কংগ্রেসের সভাপতি মনোনীত হন। স্বাধীনতা সংগ্রামকে বেগবান করে তুলতে তিনি জাতীয়তাবাদের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন। ১৯৩৯ সালে তিনি দুটি অ্যাজেন্ডাকে সামনে রেখে পুনর্নির্বাচনে লড়েন। একটি হলো বিদেশি প্রভুর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী সংগ্রাম এবং দ্বিতীয়টি ছিল কংগ্রেসের অন্দরে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত নেতা—যাঁরা এই আন্দোলনের বিরোধী ছিলেন তাদের আপোশপন্থী হিসেবে চিহ্নিত করা। মহাত্মা গান্ধী-সহ কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির একটা বড়ো অংশ পটুভি সীতারামাইয়াকে সভাপতি করার পক্ষে তাদের সমর্থন দেন। কিন্তু সামগ্রিক গরিষ্ঠাংশতার ভিত্তিতে সুভাষচন্দ্র জয়ী হন।

সকলে জানেন গান্ধী ঘোষণা করেছিলেন, সীতারামাইয়ার পরাজয় তাঁর ব্যক্তিগত পরাজয়। এরই পরিণতিতে দলের। অভ্যন্তরে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। অত্যন্ত কটু সমালোচনা সহ্য করতেনা পেরে সুভাষচন্দ্র পদত্যাগ করেন। সংখ্যালঘুর মতামত অবলীলায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকে পদদলিত করে। ভারতীয় গণতন্ত্রে সেই এক নতুন ঘরানার প্রতিষ্ঠা হলো। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেই হবে না আসল ক্ষমতা কুক্ষিগত থাকবে যারা ক্ষমতার অলিন্দের অন্তরালে থেকে নিজেদের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিতে চান তাদের হাতে।

এই তত্ত্বটিকে ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রে হাতে কলমে প্রয়োগ করে দেখান গান্ধী ও কংগ্রেস দল। ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাস বরাবরই গান্ধীজী মনস্থির করে ফেলেন জওহরলালই প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু কংগ্রেসের ১৫টি প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির মধ্যে ১২টির সদস্যরাই বিপুলভাবে সর্দার প্যাটেলকে প্রধানমন্ত্রী করার পক্ষে মত দেন। হ্যা, প্যাটেলের পক্ষেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল। কিন্তু নেহরুর সঙ্গে ছিলেন গান্ধীজী স্বয়ং। হায়! আমরা তো জানি কে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। সেদিনই ভারতীয় রাজনীতিতে গরিষ্ঠাংশের মতামতের গ্রহণযোগ্যতা চিরকালের মতো কবরস্থ হয়ে গেল। পরবর্তীতে দেখুন সংবিধান তৈরির সময়কাল। অভিন্ন দেওয়ানিবিধি (Uniform Civil Code) নিয়ে তীব্র বাদানুবাদ সৃষ্টি হয়। এবারও গরিষ্ঠাংশ চাইছিলেন ইউসিসি লাগু হোক। মুসলমান নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে বিহারের নেতা হুসেন ইমাম আদাজল খেয়ে এর বিরুদ্ধাচরণ করেন। পক্ষান্তরে বি আর আম্বেদকর শরিয়তি আইন যে শতাব্দীর পর শতাব্দী দেশ জুড়ে বলবৎ থেকে এক অপরিবর্তনীয়তা অর্জন করেছে ইমামদের এ যুক্তি নস্যাৎ করে দিলেও সংখ্যালঘু মতের কাছে তাকে নতি স্বীকার করতে হয়। ইউসিসি বরাবরের জন্য ৪৪ নং ধারাভুক্ত হয়ে সংবিধানের directive principle-এর আওতাধীন হয়ে যায়। আরও একবার গরিষ্ঠাংশের মতামত পরাজিত হয়। কত বলা যায়! ১৯৫৫-৫৬ সালে সংসদে হিন্দু কোড। বিল গৃহীত হয়। এই সময় সদস্যদের বিপুল সংখ্যক চাইছিলেন একই সঙ্গে মুসলমান Theosto TEC (personal law)-9 পরিবর্তন এনে একই ধরনের কোড প্রণয়ন। করা হোক। মুসলমানরা এর বিরোধিতা করল। প্রধানমন্ত্রী নেহর বলছিলেন। মুসলমান সম্প্রদায় এখনও ব্যক্তিগত আইনের পরিবর্তন গ্রহণ করার জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত নয়।

এর পর থেকে অভিন্ন দেওয়ানি বিধি চালু করা পক্ষে দাবি তীব্রতর হতে থাকে। লক্ষণীয় হলো ১৯৮৫ সালে শাহবানো মামলার শুনানির সময় সর্বোচ্চ আদালত জানিয়েছিল— “A Common Civil Code will help the cause of national integration by removing disparate loyalties to law (আইনের প্রতি বৈষম্যমূলক আনুগত্য) Which have con flicting ideologies” ১৯৯৫ সালে সারিয়া মুদগল মামলায় আরও এক ধাপ এগিয়ে সর্বোচ্চ আদালত জানায় “যখন। দেশের ৮০ শতাংশ নাগরিক নির্দিষ্ট ব্যক্তিগত আইনের শর্তাধীন হয়ে গেছে সেখানে দেশ জুড়ে ইউসিসি লাগু করার সিদ্ধান্তকে এখনও ঝুলিয়ে রাখার কোনো ন্যায়সঙ্গত কারণ থাকতে পারে না।”

এতগুলি ঘটনার উল্লেখ এটাই প্রমাণ করে আমাদের দেশে যথার্থ গণতন্ত্রকে দুর্বল করার রসদ মজুত করতে কোনো কসুর করা হয়নি। এর ফলে গরিষ্ঠাংশের অভিমতের বারবার কণ্ঠরোধ করে সংখ্যালঘুর ইচ্ছেকে গৌরবান্বিত শুধু নয় তাকে আইনি বৈধতা দেওয়ারও সবরকম চেষ্টা হয়ে এসেছে। বাস্তবে যদি আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বা ক্রিয়াকলাপ এই অতি অকিঞ্চিৎকর সংখ্যাক বুদ্ধিজীবীর মতামতের সঙ্গে না মেলে সেক্ষেত্রে তারা কিন্তু মুহূর্তে আপনাকে হুমকি দেবে। তাদের বক্তব্য you know who I am’। এই ধরনের একটি নাটকীয় ঘটনা চাক্ষুষ করল দিল্লি পুলিশ। দিল্লির এক সমাজকর্মী তথা বিখ্যাত উকিল ও একজন পূর্বতন সংখ্যাতত্ত্ববিদ ও রাজনৈতিক দল পরিচালকের শিকার হলেন তারা। এই দুজন সিএএ বিরোধী ধরনা অঞ্চলে যাওয়ার চেষ্টা করলে পুলিশ তাদের উত্তেজনার আশঙ্কায় ন্যায়সঙ্গত ভাবে বাধা দেয়। সঙ্গে সঙ্গে ওই আইনজ্ঞ তার এক সঙ্গীকে এই ঘটনার ভিডিয়ো তোলার নির্দেশ দেন বিশেষ করে যাতে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মীটিকে চিহ্নিত করা যায়। এর পরই তিনি হুংকার দিয়ে বলেন, “জানো আমি কে? আমি একজন মহামান্য। আমি সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের আইনজীবী। এখনই এইমামলা সর্বোচ্চ আদালতে তুলব। ভালো চাও তো তুমি ব্যাপারটার গুরুত্ব। বুঝতে চেষ্টা কর।” আচ্ছা, সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের বিচারপতিদের তিনি স্বপক্ষে কী যুক্তি দেবেন যদি তারা তার মামলাটির গ্রহণযোগ্যতাকেই অস্বীকার করেন অর্থাৎ মামলটি না নেন?

ধনঞ্জয় মহাপাত্র

(লেখক বিশিষ্ট ব্যবহারজীবী ও আইনজ্ঞ)

অনুবাদ : সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.