ইরানের পারসিরা গাঙ্গেয় অববাহিকায় বসবাসরত লোকদের ভাষাকে Hendi বলতো! সেখান থেকে হিন্দি শব্দ এসেছে, যা লেখা হয় দেবনাগরী (সংস্কৃত) হরফে! হিন্দি ইন্দো আর্য ভাষা গোষ্ঠীর উত্তরপুরুষ। হিন্দির পূর্বপুরুষ হলো বৈদিক সংস্কৃত। তৃতীয় থেকে দশম শতাব্দী পর্যন্ত নাটকের ভাষা প্রাকৃত ও অপভ্রংশ থেকেই বর্তমানের হিন্দির মূল শব্দভাণ্ডার। তেমনি গায়ের জোরে দখল করা হিন্দুস্তানে (হিন্দুস্তান মানে যেখানে হিন্দুরা থাকে, আরব ও মুসলিম জগৎ ভারতকে হিন্দুস্তান নামেই ডাকে) যখন যে ভাষার মুসলিম বা খ্রিস্টান বিদেশী শাসকরা ছিল, কালেই নিয়মে তারা তাদের ভাষা দিয়ে এ দেশের ভাষা পাল্টাতে চেষ্টা করেছে, তেমনি যে সব বস্তু এ দেশে ছিলো না, সেই বস্তু গুলো কে তারা যে নামে ডাকতো, সেই নামগুলো ভারতীয় ভাষায় ঢুকে গেছে! যেমন গণনাকারী যন্ত্র না বলে আমরা কম্পিউটার বলি। ইন্টারনেট, ট্যাবলেট, স্মার্ট ফোন আমাদের সবার ভাষা। দখলকারীরা সব সময় তাদের ভাষা ধর্ম সংস্কৃতিকে জোর করে চাপিয়ে দেয় ও প্রচার করে! আর বাঁচার ও সুবিধার তাগিদে স্থানীয় সুবিধাবাদী মানুষ দখলকারীদের ভাষা শিখে নেয়! যেমন আমরা আজকের যুগে ইংলিশ শিখি, তার পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষরা পারসী বা ফার্সি শিখতো- ধর্ম হিন্দু হলেও
হিন্দি আর উর্দু প্রায় একই ভাষা! হিন্দির ইসলামিক রূপ হলো উর্দু, লেখা হয় আল্লার ভাষায় মানে আরবিতে। তাই নিয়মিত আরবি পারসী ঢুকিয়ে উর্দু কে ইসলামিক করার চেষ্টা এখনো চলছে। আমাদের বাড়ির লেখা পড়া না জানা গৃহকর্মিণী ও চেষ্টা করে বাংলার মধ্যে ইংলিশ ও হিন্দি শব্দ বলতে, যাতে সে নিজেকে শিক্ষিত প্রমাণ করতে পারে! ঠিক একই ভাবে উর্দু বা বাংলায় আরবি যথা সম্ভব ঢুকিয়ে নিজেকে শিক্ষিত-মুসলিম প্রমাণ করার প্রবণতা এখনো চলছে ও চলবে! রামানন্দ সাগর রামায়ণের মাধ্যমে হিন্দির মধ্যে সংস্কৃত শব্দ বেশি ঢুকিয়ে সব ভারতীয় ভাষাভাষী মানুষদের হিন্দি রামায়ণ বোঝার সুযোগ করে দিয়েছিলো, কারণ সব ভারতীয় ভাষায় কম বেশি সংস্কৃত ভাষার প্রভাব যথেষ্ট। যদিও আধুনিক ভারতীয়রা জাতে ওঠার জন্য নিজের মাতৃভাষার সাথে ইংলিশ মিশিয়ে নিজেকে উচ্চ শিক্ষিত প্রমাণ করতে চেষ্টা করে! যে বাঙালি দের ইংলিশ জ্ঞান কম, তারা সহজপাচ্য হিন্দি বাঙলার সঙ্গে মিশিয়ে নিজেকে শিক্ষিত প্রমাণ করে। গুগল বা ফেসবুক বা ইন্টারনেট কোন ভাষার শব্দ , সেটা মুখ্য নয়! ওটাই আমাদের সবার শব্দ!
কাজেই হিন্দু বা হিন্দি যদি পারসী শব্দ হয়, কোনো সমস্যা নেই, যাহা সনাতন, তার বর্তমান নাম হিন্দু। পরে নতুন কি নামে পরিচিত হবে, সময় বলবে! যা ইসলাম, মুসলিমদের কাছে তার অর্থ শান্তি, অমুসলিমদের কাছে ইসলামের অপর অর্থ মহা-অশান্তি! বাংলাদেশে জামাত কর্মীরা অশান্তিতে আছে , তাই অনেক জামাত আওয়ামীলীগে শান্তির আশায় ঢুকছে, আর নিজের দল ভারী করার জন্য, অন্য পরিচিত জামাতিদের বলছে, লীগ মহাশান্তির দল , কারণ এখন সে আর জামাত নয় বলে, লীগের থেকে কোনো স্ট্রেস পায়না, বরঞ্চ ধর্ম(দল ) চেঞ্জ করার জন্য বাহবা পায়, সমাবেশে দেখায়, দেখুন কাল ছিল জামাত, আজ এরা শান্তি সমৃদ্ধি সেক্যুলার …. দলে ! জামাতের জায়গায় সিপিএম ও আওয়ামীলীগের জায়গায় তৃণমূল ভাবুন পশ্চিমবঙ্গের জন্য। আর ভয়ে জামাত ভাইটি নিজেকে জান প্রাণ দিয়ে নিজেকে অতি লীগার প্রমাণে ব্যস্ত থাকে, যাতে কারো সন্দেহ না থাকে, যে সে মনে প্রাণে জামাত আছে। নব-মুসলিমরাও জামাতের মতোই আচরণ করে। গরু বেশি খায়, অমুসলিমদের বেশি গালি দেয়, অমুসলিমদের মুসলিম বানাতে চেষ্টা করে দল ভারী করতে।
৬৪২ খ্রিস্টব্দে আরবদের হাতে পারসীরা পরাজিত হবার পর আস্তে আস্তে পার্সিদের সব দিকে অধঃপতন শুরু হয়! আজকের ইরানিদের যে গরিমা, তা ইসলামের অবদান নয়। সব পারসীরাই ইরানি। সব ইরানি পারসী নয়। ইসলাম পেরেছে কেবল কোরান-নিয়ম চালু করতে। সঠিক এডুকেশন বলতে আমরা যা বুঝি, তার প্রচারে ইসলামের কোনো অবদান ছিলো না বা নেই। ইরানেও সেটা হয়েছে।কিন্তু মোগলরা ইরানে এসে ইরানের ধ্বংসের কফিনে শেষ পেরেক পুঁতে দিয়েছে। সেই উজবেক মোগলরাই ভারতের বা তাদের হিন্দুস্তানকে ১৫২৬-১৮৫৭ পর্যন্ত শাসন ও শোষণ করে ভারতকে ৫০০০ বছর পিছনে নিয়ে গেছে। ব্রিটিশরাই আমাদের বাঁচিয়েছে। মোগলদের সময় ভারতের অফিসিয়াল ভাষা ছিল ফার্সি বা পারস্য র ভাষা, আর এলিট ক্লাসরা, যারা মোগলের তাঁবেদারী করতো, তারা তথাকথিত হিন্দি ভাষায় ফার্সি আরবি বেশি যুক্ত করে যে ভাষা বলতো, ও আরবি হরফে লিখতো, সেটাই আজকের উর্দু! আজকাল যেমন কলকাতায় ইংলিশ-ভাষী মাধ্যমের বাঙালি ছেলে মেয়েরা ইংলিশ ও হিন্দি মিলিয়ে বাংলা বলে- বেহিংলিশ ( বাংলা হিন্দি ইংলিশ)। এটাই তৎকালীন উর্দুর মত আজকের এলিট বাঙালিদের ভাষা! উর্দুকে জাতে তোলার জন্য যেমন উর্দু লেখার জন্য আরবী হরফ চালু হয়েছে, আজকাল এলিট বাঙালিরা ল্যাটিন হরফে বাংলা লেখে
ইন্দোনেশিয়া বা তুর্কিরও আলাদা লিপি ছিল, ইউরোপিয়ানদের কাছাকাছি যাবার জন্য নিজেদের হরফ বিসর্জন দিয়ে তারাও ল্যাটিন লিপি চালু করেছে। বালাদেশ কেন তা হলে পাকিস্তানের মত একদিন বাংলা আরবিতে লেখা শুরু করবে না? তখন করবে, যখন শরিয়তি চালু হয়ে যাবে! আর সেটা হবেই! সে লীগ ক্ষমতায় থাকার জন্য চালু করুক কি হেফাজত বা নতুন কোনো দল! ইসলামের চূড়ান্ত রূপ বালাদেশ দেখবেই, কারো ক্ষমতা নেই ঠেকানোর। ইরান বা পারস্য বা সিরিয়াতেও এমন হয়েছে! যেমন আমরা ধনতন্ত্র বা বৈশ্বিকীকরণের চূড়ান্ত রূপ এখন দেখছি। ১০ বছর পর পর যেমন ফ্যাশন চেঞ্জ হয়, ধর্ম বাণিজ্যে এক সময় আবার পুরানো নিয়মে ফিরে যায় বা রিফর্ম হয়। যেমন অর্থডক্স থেকে ক্যাথলিক সেখান থেকে প্রটেস্টান্ট, এথেয়িস্ট। হয়ত এথেয়িস্টরাই একদিন হিন্দুত্বের মধ্যে তাদের মনের চাহিদা পূরণের পথ খুঁজে পাবে।
২০০৮-এর জনগণনা অনুযায়ী পাকিস্তানে 7.59% মানুষ উর্দু বলে। ভারত থেকে যারা পাকিস্তানে গেছে, তাদের ভাষা ছিল উর্দু! খুদাবাদি লিপিতে সিন্ধি, গুরুমুখী হরফে পাঞ্জাবি না লিখে তারা উর্দু হরফে সিন্ধি , পাঞ্জাবি লেখে। ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে, নিজেদের হিন্দু ঐতিহ্য ও লিপিকে বাতিল করে পাকিস্তান সরকার সব পাকিস্তানী ভাষাকে উর্দু তে লেখার বিধি চালু করে দিয়েছে, সহি মুসলিম প্রমাণের জন্য। যদিও আরবিদের কাছে এরা এখনো সহি মুসলিম হতে পারেনি। আসলে যে একবার নিজের জাত ঐতিহ্য ত্যাগ করে, তাকে অন্যদের মনোবিদ্যার নিরিখে সন্দেহের চোখে দেখাই স্বাভাবিক! কাক ময়ূর কি হতে পারে? জীন তো একই থাকে!
বাংলাদেশে একদিন বারবি ( বাংলা + আরবি) চালু হতেই পারে! হিন্দু হিন্দি মুসলিম উর্দুর মতো হিন্দু বাংলা আর মুসলিম বারবি, বাংলাদেশী ও বাঙালি পাশাপাশি থাকবে! দুটো লিপিতে লেখা হবে! পানীয় জলকে কেহ বলবে জল কেহ পানি! সব পানি ( যা পানের যোগ্য) যে জল হয় না, সেটা নিয়ে কেহ মাথা ঘামাবে না।
অনেক ভাষাই মরে গেছে, বিদেশীদের আক্রমণে, আর্থিক কারণে! যেমন অনেক কম্পিউটার ভাষা মরে যাচ্ছে! আমাদের অফিদের ইন্সুরেন্সের ইআরপি সিস্টেম এক কালের কুলীন কম্পিউটার ভাষা কোবল ভাষায় লেখা ছিল! এখন আর কোবল জানা প্রোগ্রামার মেলে না! তাই ১৫০ মিলিয়ন ইউরো খরচ করে মডার্ন কুলীন ভাষা জাভা, ওরাকলের ইআরপি সিস্টেম চালু করার দায়িত্ব আমার ঘাড়ে। একদিন নতুন কোনো ভাষা আবার জাভাকে রিপ্লেস করবে, যদি না সূর্যের ম্যাগনেটিক ঝড়ে সব ইলেক্ট্রনিক সিস্টেম মুহূর্তের মধ্যে নষ্ট হয়ে আমরা এক দিনে দুসহস্র বছর পিছিয়ে পড়ি।
ভারতের সরকারের উচিত নয়, পাকিস্তান বা ইসলামিক নীতি অনুকরণ করে হিন্দি ভারতে জোর করে চালু করা! প্রাথমিকে মাতৃ ভাষা ও ইংলিশ আত্মস্থ করার পর, নিজের ইচ্ছামত তৃতীয় কোনো ভারতীয় ভাষা শিখুক সিক্স থেকে ১০ পর্যন্ত বাধ্যতামূলক ভাবে। আর ১১ থেকে বাকি ক্লাসগুলোতে বিদেশী ভাষা শেখার সুযোগ থাকুক। যেমন আরবি, মান্দারিন , জার্মান, ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ পর্তুগিজ, হিব্রু! প্রত্যেক রাজ্যে দুটো করে অন্য সব ইন্ডিয়ান ভাষার ১-১২ ক্লাস পর্যন্ত স্কুল থাকুক। কিন্তু যে রাজ্যতে স্কুল, সেই রাজ্যের ভাষা লিখতে পড়তে জানতেই হবে! মাতৃ ভাষা মাতৃদুগ্ধের সমান। গোমাতার দুধ মাতৃদুগ্ধর বিকল্প অনেকের নাও হতে পারে, ল্যাক্টোজেনের এলার্জির জন্য। জার্মানি , ফ্রান্স , স্পেন, চীন, কোরিয়া নিজের ভাষায় শিক্ষা দিয়েই এতো উন্নত! বারবিতেও যদি বাংলাদেশিরা সব শেখার সুযোগ পায়, একদিন উন্নতি করবেই। তবে লিপি পরিবর্তন করে আরবি করলে তারা ১০০-২০০ বছর পাকিস্তানের মত পিছিয়ে যাবে।
ইউরোপীয়ান ইউনিয়নের পার্লামেন্টে কি করে সব ভাষায় কাজ হয়, সেটা দেখে বহুভাষী ভারত শিখতে পারে! ইংলিশ বলে স্ট্যাটাস বাড়াবার কোনো যুক্তি নেই! আইফোন ভালো, তবে অ্যান্ড্রয়েড ব্যবহারকারীদের মত স্বাধীন নয়, এবং খুব দামী। একই ইংলিশ শব্দের অনেক মানে! যেমন bug। বাগ মানে কেবল ছারপোকা নয়! আর বিদেশী ভাষা হিসাবে ইংলিশ শব্দ জানলেই কি সঠিক জায়গায় সঠিক ভাবে ৫% লোক তা প্রয়োগ করতে পারে? তাই আমি বাঙালির সঙ্গে বাংলায়, জার্মানদের সঙ্গে জার্মান-ভাষায় কথা বলে তৃপ্তি লাভ করি, বুঝতে ও বোঝাতে পারি। উপায় না থাকলেই হিন্দি বা ইংলিশে কথা বলি, নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো বলে! তবে বারবি বুঝতে আমার খুব একটা সমস্যা হবে না!
মৃণাল মজুমদার
বার্লিন, ২২.০২.২০২০