পশ্চিমবঙ্গের স্কুলে সরস্বতী পুজো বন্ধ করা কি সাংবিধানিকভাবে সঙ্গত?

নতুন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বিরুদ্ধে একদিকে যখন ভারতবর্ষের কিছু মানুষ প্রতিবাদে উত্তাল, যখন শাহীনবাগের মঞ্চ থেকে তাঁরা বলছিলেন যে সিএএ ভারতের সেক্যুলার আত্মার ওপর আঘাত, বলছিলেন যে এই আইন সংখ্যালঘু-স্বার্থ-বিরোধী এবং ভারতবর্ষের মানুষকে যদি সংখ্যালঘু-স্বার্থ রক্ষার কথা চিন্তা করতে হয়, তবে সংখ্যালঘুদের পাশে এসে তাঁদের দাঁড়াতে হবে সংখ্যালঘুদের শর্তেই, তাঁরা বলছিলেন প্রতিবাদের প্রয়োজনে পশ্চিমবঙ্গের চিকেন নেক অংশটি অবরোধ করে গোটা উত্তর-পূর্ব ভারতকে তাঁরা নাকি বিচ্ছিন্ন করে দেবেন বাকি ভারতবর্ষ থেকে, তাঁরা বলছিলেন এ কাজ তাঁরা পারবেন কারণ পশ্চিমবঙ্গের চিকেন নেক অংশটি সংখ্যালঘু-অধ্যুষিত, বলছিলেন পৃথিবীর যে কোনো দেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা তাঁরা রাখেন, বলছিলেন তাঁদের আন্দোলনের অঙ্গ হিসেবে ভারতের জাতীয় সঙ্গীত গেয়ে, ভারতের ত্রিবর্ণরঞ্জিত পতাকা উত্তোলন করে তাঁরা যে গোটা ভারতবর্ষে ইসলামিক আদর্শ স্থাপন করার পথ থেকে সরে আসছেন তা নয়, বরং ভারতের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর সমর্থন সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভারতের পতাকার ও জাতীয় সঙ্গীতের প্রতি সম্মানপ্রদর্শনপূর্বক তাঁরা তাঁদের আন্দোলনকে কৌশলগতভাবে একটি সমন্বয়ের রূপ দিতে চাইছেন মাত্র, তখন পশ্চিমবঙ্গে কি কি ঘটছিল? আসুন দেখা যাক। প্রথমতঃ প্রজাতন্ত্র দিবসে কলকাতা কর্পোরেশনের মেয়রের তরফ থেকে যে শুভেচ্ছা বার্তা পেশ করা হয়েছিল, তাতে ভারতবর্ষের মানচিত্রটি ছিল খণ্ডিত। সে মানচিত্রে পাক-অধিকৃত কাশ্মীর ও আকসাই চীন ছিল অনুপস্থিত। কলকাতার মেয়রের তরফ থেকে ভারতের এমন ভ্রান্ত মানচিত্র কেন দেখানো হল, সে প্রশ্নের কোনো সন্তোষজনক জবাব পাওয়া যায় নি, যদিও মেয়র বলেছিলেন কর্পোরেশনের ওয়েবসাইট নাকি হ্যাকড হয়েছিল। কিন্তু একেবারে প্রজাতন্ত্র দিবসের দিনেই ওয়েবসাইট হ্যাকড হওয়ার ঘটনাটি একটু বেশিই নাটকীয় কিনা সে বিষয়ে উঠেছিল প্রশ্ন কারণ সমাপতন কদাচিৎই এতখানি নাটকীয় হয়। নিন্দুকে বলছিল, খণ্ডিত মানচিত্র হয়ত ইচ্ছে করেই দেওয়া হয়েছে। কলকাতা কর্পোরেশনের আগামী নির্বাচনের পূর্বে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বিশেষ শ্রেণীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার বার্তা পরোক্ষে পৌঁছে দিয়ে তাঁদের তুষ্ট করাই হয়ত এমন বিতর্কিত শুভেচ্ছা বার্তার সম্ভাব্য উদ্দেশ্য ছিল।

তাছাড়া সাম্প্রতিক অতীতে বিবাদ-বিসংবাদে বারংবার বিধ্বস্ত হয়েছে উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা। গত তিন মাসের মধ্যে এই জেলার দুইটি জায়গায় সৃষ্টি হয় সংঘাতের পরিবেশ। প্রথমে দত্তপুকুর, তারপর গোবরডাঙায়। দত্তপুকুরের লোকনাথ মেলায় এক ভদ্রমহিলার প্রতি কটূক্তি করেন এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত এক দোকানদার, তার প্রতিবাদ স্থানীয় মানুষের দিক থেকে উঠলে রণক্ষেত্রের চেহারা নেয় লোকনাথ মেলা এবং উত্তপ্ত হয়ে ওঠে দত্তপুকুর। এর জেরে ঐ এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেওয়া হয় বহুদিনের জন্য। জানুয়ারী মাসের ২০ তারিখের পর সংঘাত বাঁধে দত্তপুকুর নিকটবর্তী গোবরডাঙায়। এলাকার এক বিধবা তাঁর জমিজমা সম্পত্তি দান করে গিয়েছিলেন সরকারকে এবং লোকমুখে জানা যায় যে তাঁর জমিতে একটি মন্দির প্রতিষ্ঠিত হবে, এমনই শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন তিনি। কিন্তু সেই জমিতে গড়ে উঠেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সংখ্যালঘু বিষয়ক দপ্তর ও মাদ্রাসা এবং তারই প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠেন এলাকার মানুষজন। তাঁরা দাবী করেন জমিদাত্রী ঐ বিধবার শেষ ইচ্ছাপত্র তাঁদের দেখাতে হবে। ঐ জমিতে তাঁরা একটি হাসপাতাল গড়ে তোলার দাবী জানান কারণ ঐ অঞ্চলে কোনো হাসপাতাল নেই। এলাকাবাসী সাধারণ মানুষ দ্ব্যর্থহীনভাষায় জানিয়ে দেন যে তাঁরা সম্পূর্ণ অরাজনৈতিক মানুষ, কিন্তু ঐ জমিতে মাদ্রাসা তাঁরা চান না।

এবার আসা যাক ঐ একই জেলার হাড়োয়ায়। বনগাঁ লাইনের একটি স্টেশন হাড়োয়া। হাড়োয়ার চৌহাটা আদর্শ বিদ্যালয়ের সরস্বতী পুজো গত ১১ বছর যাবৎ বন্ধ। ঐ এলাকা এবং উক্ত বিদ্যালয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত। বিদ্যালয়ের প্রায় ১৭০০ ছাত্রের আনুমানিক ৭৫ শতাংশই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। তাদের আপত্তিতেই বন্ধ হয়ে রয়েছে এই স্কুলের সরস্বতী পূজা। এ বছর সেই পুজো পুনরারম্ভের দাবীতে উক্ত বিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীরা ধর্ণায় বসেন রাস্তার ওপরে। গত ২৪শে জানুয়ারী, শুক্রবার, তাঁদের ধর্ণা অবস্থানের সামনে ভিড় করে আসেন এলাকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ এবং জমায়েত হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বহু বহিরাগত মানুষও। তাঁরা উত্তেজিত ভাবে দাবী করতে থাকেন আদর্শ বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো আর কোনোদিনই হবে না কারণ তাঁরা হতে দেবেন না। বিদ্যালয়ের নাম আদর্শ বিদ্যালয়, অথচ বিদ্যার দেবীর আরাধনা সেখানে হবে না। কোন্ আদর্শকে তবে সামনে রাখবেন চৌহাটা আদর্শ বিদ্যালয়ের পড়ুয়ারা? তাঁরা ভারতীয় এবং ভারতের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বাগদেবীর আরাধনা বিদ্যাচর্চার অঙ্গ। তা বন্ধ করে আদর্শ বিদ্যালয়কে ভারতীয়ত্বের আদর্শ থেকে বিচ্যুত করতে তাঁরা কি তবে বদ্ধপরিকর? উঠছে প্রশ্ন।

তারপর সেইদিনই জুম্মার নামাজের পর তাঁরা শুরু করেন স্কুলের ধর্ণারত ছাত্র ছাত্রীদের অভিভাবকদের প্রতি উস্কানিমূলক কটূক্তি, মারামারি ও হাতাহাতি। অচিরেই শুরু হয় মারপিট, ভাঙচুর। স্কুলের কিছু অংশ ভাঙচুর করেন তাঁরা, কয়েকজন অভিভাবক আহত হন, কয়েকজনের মাথা ফেটে যায়। এমন পরিস্থিতির প্রতিবাদ করেন স্কুলের শিক্ষক গণেশ সর্দার। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের রাগ তখন গিয়ে পড়ে ঐ শিক্ষকের ওপর। অন্যান্য শিক্ষকরা নিরাপত্তার স্বার্থে গণেশ সর্দারকে নিয়ে গিয়ে লুকিয়ে রাখেন দোতলা’র একটি ঘরে। বাইরে উত্তেজিত জনতা ততক্ষণে গণেশবাবুকে টেনে হিঁচড়ে বাইরে নিয়ে এসে তাঁকে হত্যা করে তক্ষুনি ঐখানে পুঁতে দেওয়ার দাবী তুলে ফেলেছে। বিশেষ বাহিনী নিয়ে পুলিশ সুপারিনটেনডেন্ট সেখানে এসে পৌঁছন এবং শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেন গণেশ সর্দারকে। হাড়োয়ার চৌহাটা আদর্শ বিদ্যালয়ের এই চিত্র পশ্চিমবঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকার বহু বিদ্যালয়েরই চিত্র। এলাকাগুলিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সংখ্যা ও উপস্থিতির শতকরা হার বৃদ্ধি পাওয়ায় সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা রাজ্যের স্কুলগুলিতে সরস্বতী পুজো বন্ধ করে দেওয়ার দাবী তুলেছেন বা বন্ধ করে দিয়েছেন। কয়েক বছর আগে উলুবেড়িয়ার তেহট্টের স্কুলও খবরের শিরোনামে এসেছিল এই সরস্বতী পুজো বন্ধ হওয়াকে কেন্দ্র করেই, আবার‌ মালদহেও বেশ কিছু পুজো বন্ধ হয়ে গেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের আপত্তিতে। বছর দুয়েক আগে কলকাতার বালিগঞ্জ এলাকার নামী স্কুলের এক সংখ্যালঘু শিক্ষকও সোশ্যাল মিডিয়ায় মতামত পেশ করেছিলেন যে এদেশের বিদ্যালয়গুলিতে সরস্বতী পূজার মত ধর্মাচরণ অযৌক্তিক কারণ ভারতবর্ষ দেশটি সেক্যুলার। এই একই বক্তব্য, যত দিন যাচ্ছে তত জোরালোভাবে রাখছেন এ রাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত শিক্ষক, ছাত্র ও তাঁদের অভিভাবকবৃন্দ। একদিকে যখন কাজি মাসুম আখতারের মত সংখ্যালঘু শিক্ষক বিদ্যালয়ে ছাত্রদের জাতীয় সঙ্গীত গাইবার শিক্ষা দান করতে গিয়ে সংখ্যালঘু মৌলবাদীদের হাতে নিগৃহীত হচ্ছেন, অপরদিকে তেমনই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বৃহৎ অংশ বিদ্যালয়ের চিরাচরিত সংস্কৃতি ও ধর্মানুষ্ঠানে বাধা সৃষ্টি করছেন। এই বৈপরীত্য পশ্চিমবঙ্গকে চরম টানাপোড়েনে অস্থির করে তুলছে। তাই বিশদে বিচার করা প্রয়োজন যে সরস্বতী পূজা নিয়ে তাঁদের আপত্তি কতখানি সঙ্গত।

একথা আপাতদৃষ্টিতে যুক্তিগ্রাহ্য বলে মনে হয় যে স্কুলের ছাত্রদের বৃহত্তর অংশ যদি সরস্বতী পূজা করতে না চায়, তবে গণতন্ত্রের খাতিরে সে পুজো না হওয়াই সঙ্গত। কিন্তু সেক্ষেত্রে স্বতঃস্ফূর্ত প্রশ্ন ওঠে যে, গণতন্ত্রের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে একটি দেশের সাংস্কৃতিকতা, জীবনধারা ও মূল্যবোধেরই যদি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়, তবে ভারতীয় সাংবিধানিক গণতন্ত্র কি সেই ধরনের পরিবর্তনের অনুমতি দেয়? নাকি ভারতীয় সংবিধান ভারতীয়ত্বের আদত মূল্যবোধগুলি রক্ষা করারই দিকনির্দেশ করে? বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের মূল সুরটি বজায় রাখার উদ্দেশ্যে ভারতভূমির নানা প্রদেশের ধর্ম-সাংস্কৃতিক আচার-বৈশিষ্ট্যগুলির সংরক্ষণই কি কাম্য নয়? গণতন্ত্রের নামে ও সেক্যুলার হতে গিয়ে দেশ ও প্রদেশের নিজস্ব আচার-বৈশিষ্ট্যগুলি হারিয়ে ফেলতে ভারতবর্ষ বা তার কোনো রাজ্যের কি রাজী হওয়া উচিত? মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে মা সরস্বতীর পূজা করে বিদ্যালয়ের একটি নতুন শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়, যা এক আদি রীতি। সেইদিন সকালের কাঁচা হলুদ রঙের রোদ গায়ে মেখে যে আনন্দ, ভক্তি ও উন্মাদনা নিয়ে ছাত্রছাত্রীরা শিক্ষাবর্ষ শুরু করে, তার যে প্রভাব তাদের কোমল মনের ওপর পড়ে এবং সে প্রভাবে তাদের মনন যেভাবে বিকশিত হয়, সরস্বতী পূজাহীন একটি স্কুলজীবনও কি ছাত্রছাত্রীদের মনন ও মূল্যবোধ সেই একই রকম গড়ে তুলতে পারে? নাকি আচারের ভিন্নতা মননেরও ভিন্নতা হয়ে দেখা দেয়? প্রশ্ন হল গণতন্ত্রের নামে ছেলেমেয়েদের মনন ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের এই পরিবর্তিত পরিণতি কি আমাদের কাঙ্খিত? গণতন্ত্র আমাদের সমৃদ্ধ করতে পারে, কিন্তু গণতন্ত্র যদি আমাদের নিজেদের থেকেই বহুদূরে নিয়ে গিয়ে ফেলে, তবে তা কি গণতন্ত্রের সাফল্য না ব্যর্থতা? এই সব প্রশ্নের যথাযথ উত্তর খুঁজতে গেলে আমাদের শরণাপন্ন হতে হবে ভারতীয় সংবিধানের কারণ এদেশে সার্বভৌম একমাত্র সংবিধান।

সংখ্যালঘুদের একাংশ বারংবার দাবী করছেন ভারতবর্ষ সেক্যুলার তাই এদেশের বিদ্যালয়গুলিতে সরস্বতী পূজা চলতে পারে না। ইংরেজি ‘সেক্যুলার’ শব্দের অর্থ হল ধর্মবিরহিত বা ধর্মহীন। অর্থাৎ প্রকৃত সেক্যুলার হতে গেলে ভারতবর্ষের প্রতিটি মানুষের ধর্ম-পালনের অধিকার কেবলমাত্র তার ব্যক্তিগত পরিসরটুকুতেই হওয়া বাঞ্ছনীয় হত। না থাকত পাবলিক প্লেসে কোনো মন্দির, না থাকত মসজিদ, চার্চ বা অনুরূপ কোনো প্রতিষ্ঠান। কোনো ধর্মীয় উৎসব উপলক্ষ্যে কোনো সরকারি অফিস ছুটি থাকতে পারত না, তিথি বিচার করে ধর্মপালন করতে গিয়ে সেই কারণ দর্শিয়ে কেউ কোনো ছুটি নিতেও পারত না। সেক্ষেত্রে সরকারি কোনো ছুটির দিনে সুযোগ-সুবিধা মত ধর্মানুষ্ঠান করতে হত। সেক্যুলারের আদত আভিধানিক অর্থ এরকমই। কিন্তু ভারতীয় সংবিধান সেরকম সেক্যুলার নয়। ভারতের সংবিধানের ছত্রে ছত্রে আছে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা। সাধারণ নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে, নৈতিকতার সীমার মধ্যে থেকে এবং কোনো মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ না ঘটিয়ে নিজ ধর্ম পালন, প্রচার ও প্রসারের স্বাধীনতা যে কোনো ধর্মবিশ্বাসের যে কোনো ভারতীয়কে দিয়েছে ভারতের সংবিধানের ২৫ নম্বর ধারা। ভারতে এটি একটি মৌলিক অধিকার। অর্থাৎ ধর্মবিরহিত বা প্রকৃত অর্থে সেক্যুলার থাকার কথা ভারতীয় সংবিধান বলে নি। অনুরূপভাবে, সাধারণ নিয়মানুবর্তিতা বজায় রেখে, নৈতিকতার সীমার মধ্যে থেকে এবং কোনো মানুষের স্বাস্থ্যহানির কারণ না ঘটিয়ে নিজ ধর্মের প্রতিষ্ঠান স্থাপন, তার রক্ষণাবেক্ষণ ও সেই স্থানে যথোচিত আচার পালনের অধিকারও ভারতীয় সংবিধানের ২৬ নম্বর ধারা ভারতের সকল ধর্মের সমস্ত ধারার মানুষকে দিয়ে রেখেছে। অর্থাৎ পাবলিক প্লেসে ধর্মবিরহিত বা সেক্যুলার থাকার কথাও ভারতীয় সংবিধান বলে নি। বরং সকলকেই তার ধর্ম পালনের স্বাধীনতা দেওয়ার মাধ্যমে ভারতীয় সংবিধান তুলে ধরেছে সর্বধর্মসমন্বয়ের বার্তা, ইংরেজি সেক্যুলার শব্দের আভিধানিক অর্থ থেকে যা আদতে সম্পূর্ণ বিপরীত। এক্ষণে প্রশ্ন হল, যে সংবিধান সকল ধর্মের সকল ধরণের মানুষকে যে কোনো ধর্ম-আচারের স্বাধীনতা দিয়েছে, সেই সংবিধান কি একই সঙ্গে কাউকে কোনো ধর্ম-অনুষ্ঠান পালনে বাধা দিতেও পারে? দিলে তা পরস্পরবিরোধী প্রতীত হবে না কি? বাধা দেওয়ার কোনো উপায় কি সংবিধানের কোনোখানে উল্লেখিত আছে? বাস্তব হল, তেমন কোনো পরস্পরবিরোধিতা এক্ষেত্রে ভারতীয় সংবিধানে নেই। তাই যাঁরা সেক্যুলার হওয়ার কথা বলে সরস্বতী পুজোয় বাধা দিচ্ছেন, তাঁরা আদতে ভারতীয় সংবিধানের মূল সুরটিকেই অগ্রাহ্য করছেন। বাধা দেওয়া, জোর করা বা কোনো প্রকার আগ্রাসন ভারতীয় সংস্কৃতির অঙ্গ নয়। ভারতের সংবিধানও তেমন কিছুকে মান্যতা দেয় না।

ভারতীয় সংবিধানের ২৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী সরকারী কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মশিক্ষা দেওয়া যায় না। কিন্তু পূর্ণতঃ সরকারী বা সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি কোনো ধর্মশিক্ষা দেওয়া হয়, তবে তাতে অংশগ্রহণ করতে সেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত কেউ বাধ্য নয়, বরং তাতে অংশগ্রহণ করা তাঁদের ক্ষেত্রে ঐচ্ছিক। এমত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যদি কোনো পুজো হয়, তবে তাতে অংশগ্রহণ করাও বাধ্যতামূলক নয়, বরং ঐচ্ছিক। অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পুজো করার অধিকার ভারতীয় সংবিধানের ২৮ নং ধারা অনুযায়ী ভারতীয়দের একটি মৌলিক অধিকার, কিন্তু সেই পুজোয় অংশগ্রহণ করা প্রতিটি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির (বা ব্যক্তি মাইনর হলে তার অভিভাবকের) ব্যক্তিগত পছন্দ। এর অর্থ হল, সেক্যুলার হওয়ার কথা বলে এরাজ্যের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এক বৃহৎ অংশ যে বিদ্যালয়ে সরস্বতী পুজো বন্ধ করার দাবী তুলছেন, তাঁরা আদতে সংবিধানের ধারাগুলিকেই মান্যতা দিচ্ছেন না। তাঁদের এমত দাবী অসাংবিধানিক। বিদ্যালয়গুলিতে সরস্বতী পূজার অধিকার ভারতীয় ছাত্রদের মৌলিক অধিকার। তবে সংখ্যালঘু ছাত্রেরা না চাইলে তাতে অংশগ্রহণ না করার স্বাধীনতাও ভারতীয় সংবিধান তাঁদেরকে দিয়েছে। কিন্তু বাধা দেওয়ার অধিকার দেওয়া হয় নি। একটি বিদ্যালয়ে যদি ৯৫% ছাত্র সংখ্যালঘু হয় এবং ৫% ছাত্র সরস্বতী পূজা করতে চায়, তবে সেই ৫% ছাত্রেরও সে অধিকার আছে। তার ব্যত্যয় যাঁরা করছেন বা করতে চাইছেন তাঁরা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী বললে ভুল বলা হয় না। অতএব সেক্যুলার হওয়ার জন্য সরস্বতী পূজা বন্ধ করতে হবে, এই যুক্তি সংবিধান-গ্রাহ্য নয়।

সংখ্যালঘুরা অনেকেই বলে থাকেন মা সরস্বতীকে বিদ্যার দেবী বলে তাঁরা মানেন না, তাঁর পূজাও মানেন না। তাঁদের ধর্মবিশ্বাসে সরস্বতী পূজার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই এবং ভারতীয় সংবিধান তাঁদেরকেও তাঁদের ধর্মবিশ্বাস মত চলার স্বাধীনতা দিয়েছে। একথা সত্য। তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে সংখ্যালঘুদের উপর বাগদেবীর আরাধনা আমরা চাপিয়ে দিতে পারি না। তাই এমত পূজায় অংশ না নেওয়ার স্বাধীনতা তাঁদের সংবিধান-স্বীকৃত স্বাধীনতা। কিন্তু শুধু সেটুকু করতে পারলেই তাঁদের সমস্যাটি মেটে না, অপরের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করা এবং তাতে বাধা সৃষ্টি করাও তাঁদের ধর্মপন্থার মধ্যেই পড়ে এমন ভাবা কষ্টকর। কারণ সেই ভাবধারা ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী। এত বৃহৎ সংখ্যক ভারতীয় মানুষের ধর্ম-সংস্কৃতি যদি সত্যই ভারতীয় সংস্কৃতির পরিপন্থী হয়, তবে তা দুর্ভাগ্যজনক এবং অনভিপ্রেত। কিন্তু সরস্বতী পূজা নিয়ে এ রাজ্যের চিরাচরিত সংস্কৃতি যখন বিপন্ন হয়ে পড়ছে, সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করেও যখন এক শ্রেণীর মানুষ বিদ্যালয়গুলির সরস্বতী পূজা বন্ধ করতে মরিয়া হয়ে উঠছেন এবং সেই কারণে বিদ্যালয়ের শিক্ষককে হত্যা করতে পর্যন্ত উদ্যত হচ্ছেন, তখন বিষয়টি নিয়ে সম্যক চর্চার প্রয়োজন আছে।

সংখ্যালঘুরা সরস্বতী পূজার দিন নবীদিবস পালনের দাবীও জানিয়েছেন। তাঁদের বক্তব্য হল, তাঁরা যেহেতু দেবী সরস্বতী নয়, নবীকেই মান্য করেন, তাই সরস্বতী পূজার দিন তাঁরা নবীদিবস পালন করবেন। যুক্তিটি আপাত গ্রহনীয় হলেও কিছু বিপরীত তর্কও এক্ষেত্রে আছে। নবীর জন্ম উৎসব সংখ্যালঘুরা এমনিতেই পালন করেন। নবীর জন্মতিথিও সংখ্যালঘুদের ১১ মাসের ক্যালেন্ডার অনুযায়ী বছর বছর পরিবর্তিত হয়। এ রাজ্যে ফতেহা-দোহাজ-দহম উপলক্ষ্যে সরকারী ছুটিও থাকে। সুতরাং কেবলমাত্র সরস্বতী পূজার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার উদ্দেশ্যেই বছরে দ্বিতীয়বার সরস্বতী পূজার দিন নবীদিবস পালন করা কি শিশুসুলভ প্রতিযোগিতামূলক আচরণ প্রতীত হয় না? সরস্বতী পূজা ভারতীয়দের ধর্ম-সাংস্কৃতিক উদযাপন। তাতে ভক্তি, আনন্দ, সমর্পণ, উচ্ছ্বাস সব আছে। কিন্তু যে ধর্মানুষ্ঠান প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক, তা কি আর ধর্মানুষ্ঠান পদবাচ্য থাকে? দেবীপূজার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক নবীপূজা উদযাপনে নবীর প্রতিই কি প্রকৃত সম্মান প্রদর্শন করা হয়? তাছাড়া সরস্বতী পূজা স্মরণাতীতকাল থেকে এদেশের কালোত্তীর্ণ উদযাপন। সরস্বতী পূজা করার উদ্যোগ তাই ভারতীয় ছাত্রছাত্রীদের স্বতঃস্ফূর্ত উদ্যোগ। কিন্তু নবীদিবস তা নয়। সরস্বতী পূজার দিন নবীদিবস পালনের কোনো ঐতিহ্য নেই, ভারতীয় সংস্কৃতির মূলধারার সঙ্গে তার কোনো সংযোগ সূত্র নেই। শুধুমাত্র রেষারেষি করার উদ্দেশ্যে যে উদযাপনের আয়োজন সেই উদযাপন আদ্যোপান্ত ব্যর্থ। কেবল সরস্বতী পূজার “পাকা ধানে মই দেওয়া”র জন্য সেই সার্বিক ব্যর্থতার উদযাপন করে নিজেদেরকে হীন প্রতিপন্ন করতে এরাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষ সত্যই চান কি না, সে বিষয়ে বিচার বিবেচনার প্রয়োজন তাঁদের আছে।

দেবযানী ভট্টাচার্য্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.