১৭৪ ই রাসবিহারী এভিনিউতে জর্জ বিশ্বাসের বাড়ি এখন ‘দেবব্রত কাফে’

একটা ইলেকট্রিক বেল কিনা গেয়ে উঠল রবীন্দ্রসঙ্গীত, তা-ও জর্জ বিশ্বাসের গলায়!

এমনই এক গল্পের শুরু একটা বন্ধকী বাড়ি আর তার প্রাগৈতিহাসিক ভাড়াটের ইলেকট্রিক বিলকে নিয়ে। বলি তাহলে।

বছর দশেক আগে খবরের কাগজে একটা বিজ্ঞাপন চোখে পড়ল একদা যাদবপুরের কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ছাত্র অর্ণব মিত্রের। ব্যাঙ্কে মর্টগেজ দেওয়া হয়েছিল বাড়ি। আর ছাড়ানো যায়নি। তাই ব্যাঙ্ক ওই বাড়ি বিক্রি করে দিচ্ছে। ঠিকানায় রাস্তার নাম রাসবিহারী এভিনিউ দেখে বেশ উৎসাহ পেলেন অর্ণববাবু। কারণ, তাঁর ঠাকুরদার তৈরি বাড়িটিও রাসবিহারী এভিনিউয়ের ওপরেই পড়ে। যেখানে তিনি নিজে থাকেন। তাই ব্যাঙ্কের সঙ্গে যোগাযোগ করে শেষ অবধি বাড়িটি কিনেই ফেললেন তিনি। এরপর?

কেনার কিছুদিনের মধ্যেই হাতে এল একখানা ইলেকট্রিক বিল। সেখানে স্পষ্ট ও ততোধিক স্পষ্ট করে লেখা একজনের নাম– দেবব্রত বিশ্বাস! অর্ণববাবুর কথায়, “আমি তো প্রথমে কিছু বুঝতেই পারিনি। খানিক্ষণপর ঘোর কাটল। বুঝতে পারলাম পুরো ব্যাপারটা। বুঝতে পারলাম এই বাড়িতেই মৃত্যুর আগে অবধি ভাড়া ছিলেন দেবব্রত বিশ্বাস!”

এরপর বাকিটা শুধু ইতিহাস।

উন্নততর কলকাতায় তখন রাসবিহারী এভিনিউয়ের ওপরে, ট্রাঙ্গুলার পার্কে একেবারে রাস্তার ওপরে একখানা তিনতলা বাড়ি পেলে কোদাল-গাঁইতির হাত ধরে প্রোমোটারের লোভ সামলানো ভয়ানক কঠিন ব্যাপার ছিল। কিন্তু সেই অসাধ্যই সাধন করলেন বাড়ির নতুন মালিক। বাড়ি ভেঙে অতিকায় ফ্ল্যাট বানানো তো দূরের কথা, এমনকি সেই বাড়িতে ভাড়া পর্যন্ত দিলেন না। নিজেও থাকলেন না। সেখানে তৈরি করলেন একটা ছোট্ট কাফে। নাম দিলেন–মাড। ১৭৪-ই রাসবিহারী অ্যাভিনিউতে, জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে লোকে আবার আনাগোনা শুরু করল, প্রায় তিনদশক পর।

আপনি যদি কোনওদিন ওই কাফেতে যান, দেখবেন, একতলার যে ঘর থেকে ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত ভেসে আসত একদা, সেই ঘরেই এখন তৈরি হচ্ছে কফি-স্যান্ডউইচ। আর আপনি সেখানে বসে কফিতে চুমুক দিতে-দিতে শুনছেন, ‘দিন পরে যায় দিন, বসি পথপাশে।’ চাইলে বইয়ের তাক থেকে একখানা বই পেড়ে নিয়ে পাতা ওল্টাতেও পারেন। আবার ইচ্ছে হলে, লাল মেঝের সিঁড়ি দিয়ে সোজা দোতলায় উঠে গিয়ে বসতে পারেন। সেখানেও তিষ্ঠোতে পারেন ক্ষণকালের জন্য। কানে আসতে পারে, কেউ একজন ওপরতলায় গান শেখাচ্ছেন তাঁর ছাত্র-ছাত্রীদের। কৌতূহল মেটাতে সিঁড়ি বেয়ে সেখানে উঠে যেতে পারেন। তারপর, জর্জ বিশ্বাসের বাড়িতে দাঁড়িয়ে ইতিহাসের এক পুনরাবৃত্তির সাক্ষী হতে পারেন। দেখতে পারেন, সেখানে হারমোনিয়াম বাজিয়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখাচ্ছেন এই প্রজন্মের এক শিল্পী, মনোজ মুরলী নায়ার। আর, চৌকিতে পা মুড়ে বসে রয়েছেন আগামী প্রজন্মের হবু শিল্পীরা। আর অলক্ষ্যে, অলৌকিকভাবে, জর্জ বিশ্বাস গেয়ে চলেছেন, “তুমি খুশি থাকো, আমার পানে চেয়ে চেয়ে…।”

সম্প্রতি ওপার বাংলায় সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের জন্মভিটে সংরক্ষণের দাবি উঠেছে। শোনা যাচ্ছে, ঋত্বিকের বাড়ি ভেঙে তৈরি হচ্ছে গ্যারেজ। এদিকে এপার বাংলাতেও চলছে প্রবলভাবে ভাঙাভাঙির কাজ। হয় ভগ্নদশা নয় প্রোমোট-দশা। এর মাঝে কোথাও “কেউ নেই কিছু নেই সূর্য নিভে গেছে”। এমতাবস্থায়, কি কাকতলীয়ভাবেই-না ব্রাত্যজনের বাড়ি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠল, “গানের সুরে”। এ যেন অতিপ্রাকৃত গাথা, এক রাবীন্দ্রিক পুনর্জন্ম। না-কোনও সরকারি উদ্যোগ, না-কোনও বেসরকারি উদ্যোগ, কেউই যখন এগিয়ে এল না জর্জ বিশ্বাসের স্মৃতিকে বাঁচাতে, তখন অজান্তেই নীলামে ওঠা বাড়ির মালিক হয়ে পুনরায় তার প্রাণ প্রতিষ্ঠা করলেন যাদবপুরের এক প্রাক্তনী। জিজ্ঞেস করলাম, ওই বাড়ি ভেঙে প্রোমোটিংয়ের কথা ভাবেননি একবারও? প্রশ্নটা শুনে কী যেন একটা ভাবলেন বাড়ির বর্তমান মালিক অর্ণব মিত্র। তারপর বললেন, “আসলে কী জানেন, মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে দেবব্রত বিশ্বাসকে যে সম্বর্ধনা দিয়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্য়ায়, রবীন্দ্রসদনে, সেখানে আমি ছিলাম। ক্লাস সিক্সে বোধহয় পড়তাম তখন। একজন বাঙালি হিসেবে দেবব্রত বিশ্বাস আমার ও আমার পরিবারের ধমনী ও শিরায় বইছেন। তাঁর বাড়ি যখন কাকতালীয়ভাবে আমার হাতে এসেইছে, তখন সেই বাড়ি ভেঙে প্রোমোটারের হাতে দেওয়ার কথা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি।”

উঠে আসার সময়ে শুধু একটাই কথা বলে এলাম, “দেখুন, আপনার কাফের নাম যা-ই হোক না কেন, আমি কিন্তু আমার স্টোরিতে এর নাম দেব, ‘দেবব্রত কাফে’।”

ডা. সুনীত মুখোপাধ্যায়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.