সি এ এ -এর বিরুদ্ধে বহু রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন লাগাতার অপ্রচার চালিয়ে যাচ্ছে। অপপ্রচার পুস্তিকায় প্রকাশিত তাদের বক্তব্য যেন একই চিত্রনাট্যের প্রকারভেদ । একটি সুন্দর, সরল ও গঠনাত্মক আইনি সংশোধনের বিরুদ্ধে কুৎসিত, জটিল ও ধ্বংসাত্মক চিত্রনাট্য রচনার জন্য যদি কোনও অস্কার/একাডেমি পুরস্কার থাকত তবে অবশ্যই তাদের তা জুটত। এই লেখার মাধ্যমে এদের এই চিত্রনাট্যের এক একটি অনুচ্ছেদ ও তার সাপেক্ষে প্রকৃত তথ্য ও সত্য সকলের সামনে রাখার চেষ্টা করছি।
অপপ্রচার ১ – সি এ এ ২০১৯ আইনে বলা হয়েছে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে। আইন অনুযায়ী ভারতীয় নাগরিক না হলে ভোটার হতে পারেন না । তা হলে এতদিন ভোটার হিসেবে ভোট দিয়ে এসেছেন সেই সব নাগরিকদের আবার নতুন করে নিজেদের বিদেশী ঘোষণা করে নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করতে হবে।
প্রকৃত তথ্য ও সত্য – এটাই স্বাভাবিক যে, নাগরিক হলেই ভোটার হওয়া যায়। কিন্তু যা অন্য দেশে স্বাভাবিক তা ভারতে অস্বাভাবিক । কারণ কেন্দ্রের বিগত কংগ্রেস সরকার এবং পূর্বতন ও বর্তমান রাজ্য সরকারের আমলে ভারত তথা পশ্চিবঙ্গ যেন হরি ঘোষের গোয়াল যেখানে প্রতিবেশী দেশ থেকে ধারাবাহিক ভাবে আগত মুসলিম অনুপ্রবেশকারীরাও অবলীলায় রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড পেয়ে ভোট দেয় । ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড হাতে নিয়ে ভোট দিতে পারলেই যদি নাগরিক হওয়া যায় তবে তো মুসলিম অনুপ্রবেশকারীদেরও ( যাদের সংখ্যা 2 কোটিরও বেশি, বংশবিস্তার করে তারা আরো বেড়েছে) ভারতের নাগরিক গণ্য করতে হয়।
অর্থাৎ, সি এ এ বিরোধীরা ভারতে আগত একজন হিন্দু শরণার্থী ও মুসলিম অনুপ্রবেশকারী দুজনকেই ভারতের নাগরিকের সমান মর্যাদা দিতে চান। এটা যে কোনও স্বাভিমানী হিন্দু কী চোখে দেখবেন ব্যাপারটা তাদের উপরেই ছেড়ে দিলাম।
সংশোধনীর মাধ্যমে অনুপ্রবেশকারী, বিদেশী ও শরণার্থীর পার্থক্য স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তাই কোনও ব্যাক্তি যখন সি এ এ অনুযায়ী আবেদন করবেন তখন তিনি একজন ‘বিদেশী’ হিসাবে আবেদন করবেন না বরং একজন শরণার্থী হিসাবে আবেদন করবেন। আগেই বলেছি যে শরণার্থীরা যদি শুধু ভোটার কার্ড, আধার কার্ড পেয়ে বা ভোট দিতে পেরেই সন্তুষ্ট থাকেন তবে তারা নিজেরাই নিজেদেরকে একজন অনুপ্রবেশকারীর সমপর্যায়ে নামিয়ে আনবেন।
অপপ্রচার ২ – নাগরিকত্বের আবেদনের মীমাংসা হওয়ার আগেই ভোট দেবেন কী ভাবে ?
প্রকৃত তথ্য ও সত্য – এতদিন ধরে নাগরিকত্ব যাচাই না হওয়া সত্ত্বেও, একজন মুসলিম অনুপ্রবেশকারী শুধু রেশন কার্ড, ভোটার কার্ডের ভিত্তিতে ( যা সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের মতে কোনও ভাবেই নাগরিকত্বের প্রমান নয়) ভোট দিয়ে এসেছে। তাই, একজন শরণার্থীর নাগরিকত্বের আবেদনের মীমাংসা পর্যন্ত তিনি ভোট দিতে পারবেন না সে ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনের মাথাব্যথা আছে বলে মনে হয় না। সরকার এর মধ্যেই সি এ এ লাগুর জন্য বিজ্ঞপ্তি জারি করেছে। নির্বাচন কমিশন কিন্তু ‘নারিকত্বের আবেদনের মীমাংসা হওয়ার আগে ভোট দিতে পারবেন না’ এই মর্মে কোনও বিজ্ঞপ্তি বা নিষেধাজ্ঞা জারি করেনি। তা সত্ত্বেও এই আনুমানিক অপপ্রচারের উদ্দেশ্যেই হল সহজ-সরল মানুষকে বিভ্রান্ত করা।
অপপ্রচার ৩ – সরকারি চাকরিতে যোগদানের সময় জমি, বাড়ি কেনা বা ভোটার/ প্যান/ আধার/ রেশন কার্ড, পাসপোর্ট পাওয়ার সময় নিজেকে ভারতীয় ঘোষণা করা ব্যাক্তি সি এ এ অনুযায়ী আবার নিজেকে বাংলাদেশী বা বিদেশী ঘোষণা করবেন। একই লোকের দুই দেশে জন্ম হয় কী ভাবে ? চাকরি বজায় থাকবে তো ?
প্রকৃত তথ্য ও সত্য – অপপ্রচারকারীরা অবশেষে মেনে নিচ্ছেন যে বহু হিন্দু শরণার্থী চাকরি বা অন্য সুযোগ-সুবিধার জন্য অতীতে মিথ্যা ঘোষণা করেছেন। এখন প্রশ্ন হল হিন্দু শরণার্থীরা এরকম করতে বাধ্য হলেন কেন? তারা তো নিজেদের শরণার্থী বলেই নাগরিকত্ব বা রিফিউজি কার্ড সংগ্রহ করতে পারতেন। তাহলে অসুবিধা কোথায় ছিল? অসুবিধা বা আইনি জটিলতার আসল কারণ হল ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি। যার ফলে ১৯৭১- এর পরে আসা হিন্দুদের শরণার্থী রূপে স্বীকৃতি পাওয়াই সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে ভারত সরকার ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে হিন্দুরা যাতে নিরাপদে ও সসম্মানে থাকতে পারে তা নিশ্চিত করতে পারেনি। নোয়াখালির মতো গণহত্যাই একমাত্র নির্যাতন নয়। ধর্মাচরণের স্বাধীনতা না থাকা, মা-বোনের সম্মানহানি, সম্পত্তি দখল ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্যও নির্যাতন এবং ১৯৭১- এর পরেও বাংলাদেশ ধারাবাহিক ভাবে হিন্দুদের ওপর এই নির্যাতন অব্যাহত থাকায় হিন্দুদের ভারতে আসাও বন্ধ হয়নি। অন্যদিকে সেই চুক্তিই আবার তাঁদের ভারতীয় নাগরিকত্ব পাওয়ার পথে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যে জন্য একান্ত নিরূপায় হয়েই তাঁরা জীবন-জীবিকার তাগিদে মিথ্যা ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। এসব তথ্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন ও বর্তমান শাসক দল বিস্তারিত ভাবে জানে এবং যে জন্য উদ্বাস্তুরা শাসকের ‘ব্ল্যাকমেইলের’ও শিকার। তারা শাসকের অনুগত বা দাসানুদাস থাকতে বাধ্য হন। তাদের চিত্ত ভয় শূন্য নয় এবং শিরও উচ্চ নয়।
একমাত্র নাগরিকত্ব পেলেই তারা ‘ চিত্ত যেথা ভয় শূন্য, উচ্চ যেথা শির ‘ – এর মর্যাদা ভোগ করবেন এবং প্রকৃত স্বাধীন নাগরিকের মতো সিদ্বান্ত নিতে পারবেন। এ জন্যই অপপ্রচারকারীদের শরীর ও মনে এত জ্বালা।
এখন প্রশ্ন হল এ ধরনের চুক্তি ও পরবর্তী কালে তা থেকে উদ্ভূত আইনি জটিলতা বজায় রাখার জন্য কেন্দ্রের পূর্বতন কংগ্রেস সরকার দায়ী। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার মোটেই দায়ী নয়। অপপ্রচারকারীরা এই আইনি জটিলতা দূর করে হিন্দু শরণার্থীরা যাতে নাগরিকত্ব পান তাঁর জন্য কোনও দিন তাঁদেরকে নিয়ে মিছিল, সভা, বিতর্ক, নাটক, যাত্রা, কীর্তন করা বা ঘন্টা-কাঁসর বাজিয়েছেন কি? আসলে এরা নিজেরাই চেয়েছেন যে আইনি জটিলতা যেন বজায় থাকে এবং শরণার্থীরা মিথ্যা ঘোষণা করতে বাধ্য হন যাতে তাদেরকে ব্ল্যাকমেইল এর মাধ্যমে দাসানুদাস করে রাখা যায়।
বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের আনা এই নাগরিকত্ব (সংশোধনী) আইন, ২০১৯ –এ স্পষ্ট ভাবে বলা হয়েছে –
১। সার্টিফিকেটপ্রাপ্ত ব্যক্তি তাঁর ভারতে প্রবেশের তারিখ থেকে ভারতের নাগরিক রূপে গণ্য হবেন।
২। নতুন আইন অনুযায়ী কোনও ব্যক্তি নাগরিকত্ব পেলে, অবৈধ ভাবে থাকার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে কোনও মামলা চালু হয়ে থাকলেও তা বাতিল হয়ে যাবে।
৩। যে শরণার্থীরা অবৈধ ভাবে থাকার সময়কালে জমি-বাড়ি কিনেছেন, চাকরি করছেন বা অন্য সব অধিকার ও সুযোগ সুবিধা ভোগ করে আসছেন সেগুলি থেকেও বঞ্চিত হবেন না।
উপরোক্ত তিনটি সংশোধনী থেকে এটা স্পষ্ট যে, কেন্দ্রীয় সরকার সব ধরনের আইনি জটিলতা এড়িয়ে অতি সহজ-সরল পদ্ধতিতে হিন্দু শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্যই নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করেছে। তাই, অতীতে ইন্দিরা-মুজিব চুক্তির আইনি জটিলতার কারণে চাকরি, জমি-বাড়ি কেনা, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট ইত্যাদি পাওয়ার সময় যদি কেউ অন্য রকম ঘোষণা করেও থাকেন তবে তা সেই ব্যক্তির নাগরিকত্ব পাওয়ার পথে কোনও বাধা হয়ে দাঁড়াবে না এবং সেই ঘোষণার ভিত্তিতে পাওয়া কোনও অধিকার বা সুযোগ-সুবিধা থেকেও তিনি বঞ্চিত হবেন না। এছাড়াও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং লোকসভায় বলেছেন, রেশন কার্ড না থাকলেও কোনও সমস্যা নেই। আশা করা যায় এমন কোনও নথিপত্র চাওয়া হবে না, যাতে শরণার্থীরা নাম নথিভূক্ত করতে না পারেন।
অপপ্রচার ৩ – (বেজায় হাস্যকর!) সি এ এ-র মাধ্যমে উত্তর-পূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে বাঙালিদের সমস্ত অধিকার খর্ব করা হয়েছে। ওই সব রাজ্যগুলিতে বাঙালিরা কোনও দিন জমি বা স্থাবর সম্পত্তি কিনতে পারবেন না।
প্রকৃত তথ্য ও সত্য – জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ ব্যবস্থার জন্য দায়ী ৩৭০ ধারা বাতিল করার জন্য মুসলিম দরদি অপপ্রচারকারীরা কেন্দ্র সরকারের শাপ-শাপান্ত করছে। অন্যদিকে উত্তর-পূর্ব রাজ্যে বাঙালিরা কোনও সুযোগ-সুবিধা পায় না বলে আক্ষেপ করছে। হ্যাঁ, শুধু বাঙালি নয় অন্য রাজ্যের অধিবাসীরাও উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলিতে সুযোগ-সুবিধা পায় না। নাগাল্যান্ড ও মিজোরাম ইনার লাইন পারমিট দ্বারা সুরক্ষিত। মেঘালয় ষষ্ঠ তফসিল দ্বারা সুরক্ষিত। এ সবই তো কেন্দ্রের বিগত কংগ্রেস সরকার আগেই চালু করেছে। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার বা সিএএ-র সঙ্গে এসব ব্যবস্থার কোনও সম্পর্ক নেই। কেন্দ্র সরকার যখন কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলোপ করে তখন তার বিরোধিতা না করে অপপ্রচারকারীরা বলতে পারত যে শুধু ৩৭০ ধারা কেন, কেন্দ্র সরকার উত্তর-পূর্ব রাজ্যের ইনার লাইন পারমিট, ষষ্ঠ তফসিল বাতিল করুক, আমরা দু-হাত তুলে তা সমর্থন করব।
অপপ্রচার ৪ – অসমে এন আর সি-র ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালি হিন্দু নাগরিকত্ব হারিয়েছে। এখানেও এনআরসি-র মাধ্যমে উদ্বাস্তুদের নাম বাদ দেওয়ার চক্রান্ত চলছে।
প্রকৃত তথ্য ও সত্য – অসমের এন আর সি হচ্ছে ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধীর অসম চুক্তির অঙ্গ এবং সর্বোচ্চ ন্যায়ালয়ের তত্ত্বাবধানে তা কার্যকর হয়েছে। এতে বর্তমান কেন্দ্রীয় ও অসম সরকারের কোনও ভূমিকাই নেই। বিগত কংগ্রেস সরকারের অসহযোগিতায় বাঙালি হিন্দু উদবাস্তুরা নাম তুলতে পারেননি। বর্তমান সরকার বরং তাঁদের সকলের নাম তোলার জন্য সচেষ্ট হয়েছে। দ্বিতীয়ত রাজীব গান্ধীই তাঁর মায়ের করা ইন্দিরা-মুজিব চুক্তিতে উল্লিখিত ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ তারিখের পরে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুদের ‘বিদেশি’ চিহ্নিত করা হবে এই মর্মে অসম চুক্তি করে লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে সমস্যায় ফেলেন। সেই নিয়ে সি এ এ বিরোধীদের বাঙালি হিন্দু উদ্বাস্তুদের স্বার্থে এখনকার মতো আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে তুলে ‘নো সি এ এ’,‘মোদী আমিত শাহ নিপাত যাক’-এর মতো ‘নো-অসমচুক্তি’, ‘ইন্দিরা-মুজিব চুক্তি মানছি না, মানবো না’, ‘রাজীব গান্ধী নিপাত যাক’ এইরকম চিল-চিৎকার করতে দেখা যায়নি কেন?
আশা করা যায় হিন্দু শরণার্থীরা এ সব অসার ও নিহিত স্বার্থ চরিতার্থকারী অপপ্রচারে একটুও বিভ্রান্ত না হয়ে ‘প্রকৃত তথ্য ও সত্য’ উপলব্ধি করে ( ‘কাগজ দেখাবেন না’ এই চিল-চিৎকারে কান না দিয়ে) স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের নাগরিক হওয়ার মর্যাদা ও গৌরবের এই বহু প্রতীক্ষিত সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবেন।
2020-02-14