নক্ষত্রেরা আকাশের বুকে হাজার হাজার বছর আগে মরে গিয়েছে।
তারাও কাল জানালার ভিতর দিয়ে অসংখ্য মৃত আকাশ সঙ্গে করে এনেছে
যে রূপসীদের আমি এশিরিয়ার, মিশরে বিদিশায় ম’রে যেতে দেখেছি
কাল তারা অতিদূরে আকাশের সীমানার কুয়াশায় কুয়াশায় দীর্ঘ বর্শা হাতে করে
কাতারে কাতের দাঁড়িয়ে গেছে যেন-
মৃত্যুকে দলিত করবার জন্য?
জীবনের গভীর জয় প্রকাশ করবার জন্য?
প্রেমের ভয়াবহ গম্ভীর স্তম্ভ তুলবার জন্য?
ভারতীয় -আফ্রো- আমেরিকান জনগনের লোককথা বিশ্লেষণ করে সাংস্কৃতিক নৃবিজ্ঞানীরা প্রমান করেছেন, ভারত, দক্ষিণ আমেরিকা এবং আফ্রিকার নানা প্রদেশের লোককথা নানাভাবে তাঁদের বর্তমান লোকভান্ডারকে পুষ্ট করেছে। আমেরিকার লোককথার মাইগ্রেশন চারিটি পথে ঘটেছিল। আমেরিকার আদি বাসিন্দা ছিলেন প্রাচীন রেড ইন্ডিয়ান রা। সেখানে ইউরোপ থেকে সাদা চামড়ার মানুষ কলম্বাসের মাধ্যমে আমেরিকার সন্ধান পেল। তখন থেকে স্পেনীয় সুযোগ সন্ধানীরা সেখানে আসতে শুরু করল। এরপর এল ব্রিটেন, ইতালি, ফ্রান্স, জার্মানি, পর্তুগাল, অস্ট্রিয়া, স্কটল্যান্ড ,আয়ারল্যান্ড প্রভৃতি ইউরোপীয় দেশ থেকে মানুষ এল সেই আদিম দেশে। তাদের আধিপত্য বিস্তার করল সেখানের প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে সরিয়ে দিয়ে। নিজ ভূমে পরবাসী হয়ে ক্রীতদাসে পরিণত হলেন সুপ্রাচীন জনগোষ্ঠী। মিশনারীরা এসে গ্রাস করল তাঁদের সনাতনী ধর্ম ও ঐতিহ্যকে। এরপর একে একে এল মধ্য এশিয়া, চীন ও মঙ্গলীয় জনগোষ্ঠী। তিন মহাদেশের চারিটি ধারায় আমেরিকার লোককথা নতুন পরিবেশ পেল। এসবই কিন্তু প্রত্যক্ষ মাইগ্রেশন এবং সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের ফল।
আসলে মধ্যযুগীয় সময়ে থেকেই একদল মরুদস্যু পৃথিবীর সনাতনী সভ্যতাগুলিকে আক্রমন করে ধ্বংস করতে শুরু করেছিল। পঞ্চদশ শতক থেকে বিশ্বের চারিদিকে ইউরোপীয় অভিযাত্রীরদল জলপথে জাহাজে চেপে নতুন নতুন উপনিবেশ গড়ে তুলতে সচেষ্ট হল। এই সময় থেকেই লোকসমাজের নতুন বসতি সম্পর্কে তথ্য লিপিবদ্ধ করা শুরু হল। এর আগের যা তথ্যঃ তা অধিকাংশই মরু আক্রমণে নষ্ট হয়েছিল। যেটুকু পাওয়া যায় তার থেকেই আমরা এক দেশ থেকে অন্য দেশে মানুষের যাতায়াতের কথা জেনেছিলাম। পঞ্চদশ শতকের পর প্রাপ্ত নথি থেকে মানুষের মাইগ্রেশনের বিষয়টি পাকাপাকিভাবে নথিভুক্ত হল। মানুষের মাইগ্রেশনের সঙ্গে তাঁর সংস্কৃতি ,মৌখিক ঐতিহ্য ইত্যাদির মাইগ্রেশন ঘটবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ থাকে না ।তাই লোককথাও নতুন স্পর্শে এসে নতুন রূপ পাবে তাতে বিস্ময় হবার কিছুই নেই।
এইসব তথ্যঃ তো ইতিহাসের সাক্ষ্য। বড়জোর ৫০০ থেকে ৭০০ বছরের কথা। কিন্তু যে ইতিহাসকে নষ্ট করা হয়েছে বা যে ইতিহাস লিখিত নেই তার কি হবে? প্রমান যে নেই একদমই নয়। বহু প্রমান আছে। যা কেবল সঠিকভাবে নথি বদ্ধ করা হয় নি। নৃবিজ্ঞানী এবং ভাষাবিজ্ঞানীরা সেই সুদূরকালের তথ্য নিয়েও তৎপর হয়েছেন।
ভাষা , সংস্কৃতি , আচার, পাল, পার্বন, পূজা, জীবাশ্ম ,লোককথার সাদৃশ্য বিচার করে মাইগ্রেশনের অজস্র বৈজ্ঞানিক প্রমান মিলেছে। সেসব অনেক ব্যাখ্যা আমি দিয়েছি বিগত পর্বগুলিতে। ওশিয়ানিয়ার মানুষ ও তার মৌখিক ঐতিহ্যের যে মাইগ্রেশন ঘটেছে সেই বিষয় আজ আর কারো কোনো সন্দেহ নেই।
নিউজিল্যান্ডের মাওরি আদিবাসী তিরিশ হাজার বছর আগে ভারতীয় উপকূল থেকেই সমুদ্রে পাড়ি দিয়েছিলেন। তাঁরা পৌঁছলেন ইরিহিয়া দেশে। সংস্কৃত ভাষায় যাকে বলা হয় ব্রীহিয়া। মাওরিদের প্রধান খাদ্য চাল। তাঁরা চালকে বলতেন আরি। ভারতের দক্ষিণ অংশের বাসিন্দারা চালকে বলে আরি । প্রাচীন ভারতে ধানকে বলা হত ব্রীহি। ব্রীহিক অর্থাৎ ধান্য বিশিষ্ট। মনে করা হয় ব্রীহিয়া বা ইরিহিয়া নাম এসেছে ব্রীহি বা ব্রীহিক থেকে।
মাওরিরা দক্ষ সমুদ্র অভিযাত্রী। ভারতীয়রাও তো অকুল দরিয়ার মাঝি।অদ্ভুত ভাবে ভাষাগত এমন মিল এই দুই এলাকায় পাওয়া গিয়েছে যে, দুজন খ্যাত নাম ভাষা বিজ্ঞানী এবং সাংস্কৃতিক নৃ বিজ্ঞানী এস.পারসি স্মিথ ও এলসন বেস্ট এই জনগোষ্ঠীর মাইগ্রেশন বিষয় প্রামাণ্য গবেষণা করেছেন।ভাষা ও লোকসংস্কৃতি সাদৃশ্য তারা ব্যাপক ভাবে খুঁজে পেয়েছেন।
লোকসমাজে মাইগ্রেশন ঘটে প্রধানত দুভাবে:
১. বাধ্যতামূলক দেশত্যাগ : ইউরোপ , আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে দক্ষিণ আমেরিকা, আফ্রিকা ও এশিয়ার মানুষকে নতুন বসতি তে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল জোর করে। এইসব এলাকায় যাঁরা গেলেন তাদের ঐতিহ্যে লোককথা রয়েছে । আদিবাসভূমির লোককথা বহমান রয়েছে । কিন্তু খন্ডিত আকারে। বর্তমান পরিবেশে সেই সব লোককথার আদি উৎস অর্থাৎ মূল রূপটি আবিষ্কার করা সহজ নয়। তবে একেবারে অসম্ভবও নয়।
২. স্বেচ্ছায় দেশত্যাগ : অবশ্য এখানেও বাধ্যবাধকতা থাকে । যুদ্ধ, পরাজয়, বন্যা , খরা, খাদ্যাভাব ইত্যাদি কারণে ঘটে দেশত্যাগ। যেমন ঘটেছিল কাশ্মিরী পন্ডিতদের বা বাঙ্গালী হিন্দুদের ক্ষেত্রে। তবে জোর করে নিজেরাই দেশত্যাগে বাধ্য হয় নি , অধিকাংশ ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক , আর্থিক কারন মূল হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। স্বেচ্ছায় কেই বা নিজের জন্মভূমিকে ছাড়তে চায় ? তবে হ্যাঁ , বাণিজ্যিক কারণে বা সাম্রাজ্য বিস্তারের নিমিত্ত অন্য দেশের বাসিন্দা হয়েছে এমন উদাহরণও ইতিহাসে কম নেই। এমন দেশ ত্যাগ ওশিয়ানিয়া এলাকায়ও ঘটেছে ।
ইন্দোনেশিয়া , শ্যাম , যবদ্বীপ অঞ্চল এবং ভারতের দক্ষিণ অংশ থেকে দলে দলে।মানুষ মাইক্রোনেশিয়া , মেলানেশিয়া , পলিনেশিয়া ও অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন এবং সেটি সম্পূর্ণ স্বেচ্ছায়। ফলে ,তাঁদের ভাষা- নিজস্ব সংস্কৃতি- আচার- পাল-পার্বনকে এক কথায় বিসর্জন দেননি। কালের প্রভাবে নানা জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশ্রণের ফলে তাদের ভাষা ও সংস্কৃতির বিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি । তাই তাঁদের সামাজিক লৌকিক সংগঠনে পুরনো ঐতিহ্যের রেশ রয়েছে। নানা প্রতিকূল ঢেউ আছড়ে পড়লেও তাঁদের ঐতিহ্যলালিত ভাষা ও সংস্কৃতিকে একেবারে মুছে দিতে পারেনি। লোককথার মধ্যেও তার হদিস মিলেছে।
সেই যে পলিনেশিয়ার মানুষদের বিশ্বজগতের আদিস্রষ্টা তরোয়া। তরোয়া একা বাস করতেন রুমিয়া নামের এক ডিম আকৃতির খোলসের মধ্যে। তখন আকাশ, চাঁদ, সূর্য, পৃথিবী কিছুই ছিল না। কি মনে করে তরোয়া একদিন ভেঙে দিলেন তার ডিমের খোলস। বেরিয়ে পড়লেন বাইরে। তারপর সেই ডিমের খোলসের একভাগে তৈরি করলেন পৃথিবী, আরেক ভাগে আকাশ।
কিন্তু এই নিঃসঙ্গ একাকী জীবন বেশি দিন ভালো লাগলো না তরোয়ার। সৃষ্টি করলেন দেবতাদের। তারপর দেবতারা সৃষ্টি করলেন গাছপালা, লতা-গুল্ম ইত্যাদি। এসব কিছুই হয়েছে প্রায় অন্ধকারের মধ্যে। কারণ তুমুরাই ফিউনা নামের একটি অক্টোপাস তরোয়ারের সেই পরিত্যক্ত ডিমের খোলসটির দুই প্রান্ত টেনে ধরে রেখেছিল কাছাকাছি।
তরোয়ারের আদেশে পাতালের দেবতা রুয়া অক্টোপাসটাকে মেরে ফেললেও তার ধরে রাখা ফাঁস কিছুতেই আলগা করতে পারলো না। ফলে এই অন্ধকারাচ্ছন্ন জগতেই সবকিছু চলতে থাকলো।m1
দেবতা রু অক্টোপাসের টেনে ধরা আকাশটাকে আবার প্রাণপণে ওপরে উঠিয়ে দেওয়া চেষ্টা করলেন। কিন্তু প্রচণ্ড পরিশ্রমের পরও পারলেন না তিনি। বরং হিতে বিপরীত হলো। রু এর শরীর বেঁকে চুরে শেষ পর্যন্ত টুকরো টুকরো হয়ে গেল। তার শরীরের কিছু অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ শূন্যে ভেসে থাকতে থাকতে পরিণত হলো মেঘে।
রু এর ব্যর্থতার পর একাজে হাত দিলেন আরেক দেবতা মাউই। মাউই আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে সামান্য যে ফাঁক ছিল তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিলেন একটা খোঁটা। তারপর ক্রমাগত দিতে থাকলেন চাড়। এভাবে চাড় দিয়ে দিয়ে আকাশটাকে একটু উপরে তুলে ঠেকনা দিয়ে রাখতে সক্ষম হলেন। এবার সাহয্যের জন্য ছুটলেন দেবতা তেন এর কাছে।
mতেন এসে বড় বড় পৃথিবী ও আকাশের মাঝে বিশাল গুঁড়ির সাহায্যে ঠেকনা দিলেন। তারপর বিশাল আকৃতির একটি ঝিনুক দিয়ে খুঁড়তে লাগলেন আকাশটাকে। এভাবে আকাশ ও পৃথিবী আলগা হয়ে গেল। পৃথিবী ভরে উঠলো আলোয় আলোয়। ফাঁস আলগা হয়ে দুষ্টু অক্টোপাসটাও তখন পড়ে গেল সাগরের পানিতে। আর তার শরীররটা পরিণত হলো তবুয়াই নামে একটি দ্বীপে।
তেন এবার মন দিলেন পৃথিবীটাকে সুসজ্জিত করে তোলার কাজে। একে একে সৃষ্টি হলো অসংখ্য গ্রহ, তারা, চন্দ্র প্রভৃতি। সমুদ্রে ঘুরে বেড়াতে লাগলো বড় বড় মাছ, রংবেরঙের প্রাণী। এরপর পথিবীটাকে আরও রঙিন করতে দায়িত্ব পড়লো অন্য দেব-দেবীর উপর।
আবার ওইদিকে যেরকম সুবৃহৎ রাশিয়ার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। অথচ রাশিয়ার সঙ্গে যুক্ত ছিল এবং পরবর্তীকালে তার থেকে সৃষ্ট দেশগুলোতে এরকম রাশিয়ান বহু উপকথা দেখা যায় । গল্প গুলো কাজাকিস্তান ,তাজাকিস্থান , ইউক্রেন দেশ গুলোতে প্রায় একই রকম ভাবে অবস্থান করে থাকে। তাই কিং ক্যাকর বা বেড়াল রাজা, ব্যাঙ রাজকুমারী, এক চোখা দৈত্যারা রুশ থেকে বেলারুশ হয়ে হাঙ্গেরী অবধি চলে গেছে নানা নামে।
মাইগ্রেশন আলোচনার সময় দুটি ভিন্ন রূপ কে মনে রাখতে হব। ঔপনিবেশিক ভারতবর্ষে অবিভক্ত বাংলার উত্তরাংশে পাহাড়ি এলাকায় ইংরেজরা চা বাগিচা গড়ে তুলল। তাদের বাসযোগ্য করে নিল । সমানভাবে একই কাজ হয়েছিল নাগাল্যান্ড, অরুণাচল প্রদেশ, আসাম ,এদিকে উত্তরাখণ্ড ইত্যাদি অঞ্চলে। তারা এই সমস্ত এলাকায় কুলী সংগ্রহ করেছিল সেই সব এলাকার জনজাতিদের মধ্যে থেকে এবং ছোটনাগপুরের আদিবাসী মানুষ জনের মধ্য থেকে। দরিদ্র মানুষের মধ্য থেকে বাধ্যতামূলকভাবে ঘটেছিল দেশ ত্যাগ। অনেক বছর কেটে গিয়েছে। পরিবর্তিত প্রকৃতির পরিবেশে নতুন জীবনেও কিন্তু সেই সমস্ত আদিম লোককথার মধ্যে প্রাচীন মানুষের প্রাণ স্পন্দন আজও অনুভূত হয়ে থাকে।
ক্রমশঃ
দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ লোককথার লিখিত ঐতিহ্য