বর্ণাশ্রমের অপব্যাখ্যায় সংরক্ষণ

ভারতবর্ষের রাজনীতিতে স্বাধীনতার পর থেকে এক শ্রেণীর মানুষ নিজেদের নিম্নবর্ণের বলে পরিচয় দিয়ে বর্ণাশ্রমের অপব্যাখ্যা করে বংশানুক্রমে সংরক্ষণের মধ্যে দিয়ে যেমন ক্ষমতা কুক্ষিগত করতে চাইছে, তেমনি হিন্দু সমাজকে আঘাত করে আরও ভাঙতে ভাঙতে দেশটাকেই ক্রমশ দুর্বল করে চলেছে। আমরা প্রত্যেকে যদি শ্রীকৃষ্ণ বর্ণিত বর্ণাশ্রমের কর্ম ও গুণের উত্তরণ ঘটিয়ে ব্রহ্মত্ব অর্জন করে চলতাম তবে শুধু দেশ নয়, পুরো সমাজেরই উন্নতি হতো।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জাতি ও বংশ বিচার করে মানুষকে চারটে ভাগে ভাগ করে বর্ণাশ্রম সৃষ্টি করেননি। তিনি বিচার করেছিলেন মানুষের গুণ ও কর্মের উপর ভিত্তি করে।
কিন্তু ব্রাহ্মণ সমাজপতিরা এক সময় বংশগত অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিজেদের ক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখতে যেমন বর্ণাশ্রমকে জাতিগত এবং বংশগত রূপ দিয়ে সমাজকে বিভক্ত করেছে, ঠিক একই ভাবে আজ তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষও বর্ণাশ্রমের অপব্যাখ্যা করে কোটা ব্যবস্থা দ্বারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে সমাজকে ভাগ করে ভারতবর্ষকে পঙ্গু করে চলেছে। অন্যদিকে আমাদের সংবিধানও জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে সাম্যের কথা বললেও বাস্তবে জাতিভেদকেই মান্যতা দিয়েছে। জাতি বিশ্লেষণ করে সংরক্ষণের স্বীকৃতি দিয়ে বর্ণাশ্রমের বিকৃত রূপ প্রতিষ্ঠা করেছে।
বর্তমান ভারতবর্ষে আজ এই জাতিগত সংরক্ষণকে কেন্দ্র করেই অশান্তির আগুন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। বিভিন্ন জাতি নিজেকে নিম্নবর্ণের পরিচয় দিয়ে সংরক্ষণের তালিকাভুক্ত হতে আন্দোলন করছে। পঞ্জাব, রাজস্থানে গুর্জর জাঠেদের মতো, গুজরাটে প্যাটেলদের মতো সম্পন্ন মানুষেরা; বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তিশগড়, মহারাষ্ট্রে এবং দক্ষিণ ভারতের বিভিন্ন সম্প্রদায় — উ চচবিত্ত হয়েও সংরক্ষণেরমধ্যে অন্তর্ভুক্ত হতে চেয়ে মারমুখী এবং ধ্বংসাত্মক আন্দোলন করছে। যার ফলে দেশের স্থিতিশীলতাই আজ ধ্বংসের মুখে।
সব থেকে আশ্চর্যের বিষয়, মুসলমানরা বলে থাকে, হিন্দু সমাজের শ্রেণী বিভাজনের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে সমান অধিকারের জন্য। এবং হিন্দু সমাজের বর্ণাশ্রমের প্রতিবাদে তথাকথিত নিম্নবর্ণের হিন্দুরা ইসলাম কবুল । করেছে। কারণ ইসলামে শ্রেণীবিভাজনের। কোনো জায়গা নেই। অথচ তারাই আবার ঘুরপথে বিকৃত বর্ণাশ্রমকে মান্যতা দিয়ে সংরক্ষণের অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রাহ্মণরাও আজ সংরক্ষণের দাবিতে সোচ্চার। কোটার আঘাতে মেধা আজ কোমায়। ফলস্বরূপ, জাতি দাঙ্গা আজ ভারতের নিত্য সঙ্গী। তথাকথিত নিম্নবর্ণের মানুষেরা সংরক্ষণের সুযোগ নিয়ে বংশ পরম্পরায় সব সুযোগ সুবিধা কুক্ষিগত করে ঠিক পূর্বের তথাকথিত ব্রাহ্মণদের মতোই নতুন এক । বিভেদকামী শক্তিতে পরিণত হয়েছে। অর্থনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীরাও কোনোদিন শ্রেণী সংরক্ষণের বিরোধিতা করেননি। উল্টে জাতিভেদকে সাংবিধানিক মান্যতা দিয়ে বিভেদের বিষবৃক্ষকে দিন দিন আরও বড়ো। হতে সাহায্য করেছে। ধর্মীয় ও জাতিগত দিক বিচার না করে অর্থনৈতিক অনগ্রসরতা বিচার করে একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করলে দেশ ও সমাজের যে অনেক উন্নতি হতো এতে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকতে পারে না। অন্যদিকে জাতিগত বিদ্বেষ ও হিংসার ক্ষেত্র তৈরি হতো ।
শ্রেণীহীন ও স্থিতিশীল সমাজ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ যখনই জাতিগত সংরক্ষণের যৌক্তিকতার প্রশ্ন তুলে বিরোধিতা করে এক ঐক্যবদ্ধ ভারতের কথা বলেছে, তখনই দেশের তামাম বুদ্ধিজীবী থেকে রাজনৈতিক দল মানুষকে ভুল বুঝিয়ে ভ্রাতৃঘাতী হানাহানিতে লিপ্ত হতে ইন্ধন জুগিয়েছে। যেসব রাজনৈতিক দল যারা এই জাতিগত সংরক্ষণের পক্ষে তাদের কাছে প্রশ্ন এই ব্যবস্থা আর কত দিন চলতে পারে। এই সংরক্ষণ কি সামাজিক বৈষম্য ও বিদ্বেষ সৃষ্টি করে না? এর ফলে কি স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে দেশ দুর্বল হচ্ছেনা। জাতির নামে সংরক্ষণের অর্থই হলো— কবি নজরুলের ইসলামের কথায়— জাতের নামে বজ্জাতি। কী আশ্চর্য বিষয়। যারা জাতিভেদের বিনাশ চাইছে তারাই আবার জাতির নামে সংরক্ষণের পক্ষপাতী।
২০১৯-এর ৯ জানুয়ারি ভারতে নতুন সূর্যের উদয় হয়েছে। ভারতবাসী এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হয়েছে। জাতি, বর্ণ, ধর্ম নির্বিশেষে শুধুমাত্র অর্থনৈতিক দুর্বল মানুষদের জন্য সরকারি চাকরি এবং শিক্ষাকেন্দ্রে ১০ শতাংশ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে কেন্দ্রীয় সরকার সাম্যর প্রতিষ্ঠার মধ্যে দিয়ে বর্ণাশ্রমের আসল রূপের প্রতিফলন ঘটিয়েছে। জাত-পত-ধর্মের হানহানি মুক্ত ও বিভেদহীন ভারত গড়তে এই সংরক্ষণ এক নতুন আলোর পথ দেখাবে।
দেবদত্তা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.