গ্রীষ্মসুন্দরকঃ

প্রথম_ভাগ

” গ্রীষ্মমুন্দরঃ সবনমসি ব্যূহচরণে প্রাণঃ প্রাণিনাং ব্যরংহৎ”

সে গাঁয়ের ক্ষেতে , মাঠে ময়দানে, পুকুর বা জলাশয়ের ধারে যেমন তেমন হয়ে জন্মায়। আমরা শহুরে মানুষজন ভাবি আগাছা জঙ্গল। হ্যাঁ সেটা অবশ্যই শাক এবং সেই শাক আহার্যে ,ঔষধে খুবই মূল্যবান ব্যবহার্য বস্তু। তার এক কালে প্রাচীন ভারতীয় নাম ছিল গ্রীষ্মমুন্দরক। ঋক্ বেদের ১/৪৮/৮ এবং ৮/২৯/১ সূক্তে এর নামের উল্লেখ আছে।

প্রথমোক্ত সূক্তের সায়ন ভাষ্যে বলা হয়েছে –

” গ্রীষ্মমুন্দরঃ শাকঃ , গ্রীষ্মস্তু রসগ্রাসকঃ নিদাঘঃ =
ঋতুবিশেষঃ, বিষুবরেখায়াঃ পার্শ্বস্থঃ কর্কট- মকর- ক্রান্ত্যা-
ভূখণ্ডঃ, তত্ৰজাত শাকঃ,প্রাণিনাং প্রাণান্ ব্যরংহৎ =
রক্ষকোহসি চতুর্বর্গেষু অগ্রিমঃ”

অর্থাৎ , গ্রীষ্মমুন্দর একটি শাকের নাম। আর গ্রীষ্ম হলো রসাগ্রাহক এবং নিদাঘ ঋতু বিশেষ, বিষুবরেখার পার্শ্বস্থ কর্কট ও মকরসংক্রান্তির দ্বারা আক্রান্ত ভুখন্ড, সেই ভূমিতে যে শাক জন্ম গ্রহণ করে, সেই শাক প্রাণিগণের প্রাণের শক্তিকে রক্ষা করে, এই শাকটি অন্য চারটি বর্গের মধ্যে অগ্রিম। তাই শাকটি পবিত্র।

বেদ উক্ত সেই মুন্দর শাকই এখন সুন্দর নামে আদৃত হয় । বিবর্তনেই বর্ণ বিপর্যয় এমনটি হয়। প্রায় সব বনৌষধি প্রদেশ বিশেষে ভিন্ন ভিন্ন নামে উচ্চারিত হওয়ার কারণও এই।

এই বেদ উক্ত শাক যা পথে ঘাটে হয়ে থাকে , যা অনেক ব্রত পালনের পর খাওয়া হয়, যা বৈদিক হতে লৌকিক সর্বত্র নানা নামে বিস্তৃত তার নাম হল ঢিমে বা গিমে শাক।

ঢিমে ? নাকি ধীর গতিতে শব্দের ভ্রংশতায় ধিমে ?

ধিমেপাকস্থলীতেগিমে_শাক ….

উড়িষ্যায় এই শাক ” পীতা গহম্ ” নামে পরিচিত। পীতা অর্থাৎ তিক্ত এবং গিমে বা গিমা হয়েছে গহম্। অর্থাৎ এর বীজকোষগুলি ক্ষুদ্র গমের মতো বলে একে উড়িষ্যা গহম্ বলে।

উক্ত সায়ন ভাষ্যের বিশেষ বক্তব্য অভ্যন্তরের তাপ দূর করে। তাই দেখাযায় ভৌগলিক সংস্থানের খন্ড খন্ড ভেদে সূর্য তাপেরও ভেদ হয়। তাই গ্রীষ্মঋতু টি এককালে সমভাবে সর্বত্র কিরণ বিকীরণ করে না; যেখানে করে সেখানেই গ্রীষ্মসুন্দর অর্থাৎ গিমে শাকের জন্ম।

গ্রীষ্মের দারুণ অগ্নিবাণে রে হৃদয় তৃষায় হানে রে॥
রজনী নিদ্রাহীন, দীর্ঘ দগ্ধ দিন. আরাম নাহি যে জানে রে॥
শুষ্ক কাননশাখে ক্লান্ত কপোত ডাকে. করুণ কাতর গানে রে॥

সেই সময় এই গুল্মলতাটির যৌবন যেন জৌলুষ নিয়েই
জনদৃষ্টি আকর্ষণ করে আর ভূমিশয্যায় স্বল্প গন্ডীতে ছড়িয়ে থাকে। অর্থাৎ সে তার তাপকে নিজের ভিতরে সংহরণ করতে পারে। তাই সে অমন যৌবনজ্জ্বল রূপ পরিগ্রহন করে। তেমনি মানব দেহে অন্তরগ্নির রূপ যে পিত্ত , তার অধিকারকে সংযত করে।পরবর্তী সময়ে ওই সূত্র ধরেই রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে পরীক্ষা নিরীক্ষা হয়েছে।
Ficoideae পরিবার ভুক্ত ভূমি প্রসারণী ছোট পাতার শাকটি মলিউগো গোত্র ভুক্ত। এর প্রায় চার থেকে পাঁচটি প্রজাতি পাওয়া যায়। তবে দুটি বিশেষ প্রজাতি খাদ্যে এবং ঔষধে ব্যাপক পরিমানে ও সর্বদা ব্যবহৃত হয়। এই দুটি প্রজাতির নাম হল : Mollugo Spergula বা Mollugo oppositifolia Linn এবং Mollugo Hirta বা Mollugo Lotoids.

উক্ত দুটি পৃথক গোত্রের গিমে শাকের কিন্তু গুণেরও সামান্য ইতর বিশেষ আছে। তবে কোনটি কি আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে বিচার করা সম্ভব নয়। আরো একটি প্রজাতি পাওয়া যায়, তার লৌকিক নাম হল জলপাপড়া বা জ্বরপাপড়া। বৈজ্ঞানিক নাম Mollugo pentaphylla Linn। এটি আয়ুর্বেদ শাস্ত্র অনুসারে এটি জ্বরের জন্য ব্যবহৃত হয়।

চরক , সুশ্রুত সংহিতায় #গ্রীষ্মসুন্দরকঃ নামের উল্লেখ নেই। কিন্তু তিক্ত শাকের উল্লেখ করা রয়েছে। শাস্ত্রকারগব এই তিক্ত স্বাদের শাককে গিমে শাক বলেই গ্রহণ করেছেন। চরকের সূত্রস্থানের ২৭ অধ্যায়ের ৭৫ শ্লোকগুচ্ছের প্রথম শ্লোকটি হল :

মণ্ডূকপর্নী বেত্রাগং কুচেলা বনতিক্তকম্ ।
পাঠান্তরং যবতিক্তকম্

কেউ কেউ বলেন শ্লোক উক্ত কুচেলাই উদ্দিষ্ট বনতিক্তকই হল গিমে শাক । তার অর্থ পাঠা এবং বনতিক্তক শব্দের অর্থ আকনাদি। এই স্থানে ভেষজ বিজ্ঞানী গন মনে করেন -চরকের কল্পস্থানের একাদশ অধ্যায়ের যেটি যবতিক্তা বা নীলী বা সপ্তলাই হল গিমে শাক।

শিবদাস বা চক্রদত্তের উদাবর্ত রোগে বলেছেন নীলী আর শঙ্খিনী হল কালমেঘ। এখানে উল্লিখিত গিমে শাক যেটি স্বাভাবিক প্রকৃতি , সেটি হলো জলের সঙ্গে একে পেষণ বা মর্দন করলে প্রচুর ফেনা হয় এবং এর ফল গুলি অনেকটা যবের আকৃতি হয়। তাই ফেনীলা, যবতিক্তা ও নীলী যখন একই প্রকৃতির পর্যায়ে এসে যাচ্ছে , তখন প্রকৃতি সাম্যে গিমে শাককেও সপ্তলা বলে নির্বাচন করা প্রসঙ্গাধীন। তবে সপ্তলার স্বভাব ধর্ম শঙ্খিনীতেও দেখা যায়।তাই হয়ত উক্ত শ্লোকে চরক সংহিতায় উভয়কে একত্র করে গ্রথিত হয়েছে।

ক্রমশঃ

দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ ভারতের চিরঞ্জীব বনৌষধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.