জাতীয় নাগরিক পঞ্জি, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ও নাগরিকত্বের গোলকধাঁধা

২০১৮-র জানুয়ারি মাসে আসামে নাগরিকপঞ্জি বা এনআরসি-র প্রথম তালিকা প্রকাশ ইওয়া ইস্তক আসাম তো বটেই সমগ্র উত্তরপূর্ব ভারত ও পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক ময়দান রণক্ষেত্র। আসামে শরণার্থী এমনকি মূল অধিবাসী বাঙালিদের বিরুদ্ধে এনআরসি-কে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহৃত হতে দেখে বেশ কিছু সংগঠন থেকে দাবি উঠেছিল প্রস্তাবিত নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল বা Citizenship Amendment Bill (CAB) পাস করিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশ আগত ধর্মীয় সন্ত্রাসের বলি সমস্ত অমুসলিম বিশেষত হিন্দুদের নিঃশর্তে নাগরিকত্ব দেওয়ার। ২০১৬-র ১৯ জুলাই বিলটি লোকসভায় প্রথম পেশ হওয়ার পর একটি যৌথ সংসদীয় কমিটি গঠন করে ১৯১৬-র ১২ আগস্ট সেখানে পাঠানো হয় এই বিষয়ে পর্যালোচনার জন্য। সেই কমিটিতে বহুদিন যাবৎ আলোচনা চলার পর রিপোর্ট আসে ২০১৯-এর ৭ জানুয়ারি কোন সংশোধনী প্রস্তাব ছাড়াই। অভিযোগ কমিটিতে বিরোধী দলের সদস্যদের আপত্তি ধোপে টেঁকেনি। বিলটি ২০১৯-এ ৭ জানুয়ারি সংসদে পেশ করার পর শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সৌজন্যে ৮ জানুয়ারি পাসও হয়ে যায়। নির্বাচনের পর লোকসভায় সেটি পাসও হয়েও ঝুলে থাকে ষোড়শ লোকসভা অধিবেশন শেষ হওয়ায়। তখন থেকেই প্রমাণের চেষ্টা হয়েছে, বিলটিতে শরণার্থী হিসাবে নাগরিকত্ব পেতে হলে এত রকম নথিপত্র দরকার যে কারও পক্ষেই সবকটি জোগাড় করা সম্ভব নয়। বিশেষ করে প্রতিবেশী দেশ থেকে পালিয়ে আসার কারণ হিসাবে ধর্মীয় অত্যাচারের প্রমাণ দাখিলের বিষয়টি সবচেয়ে অবাস্তব বলে সমালোচিত হয়েছে। ফলে কিছু সংশোধনের প্রয়োজন অনুভূত হয়েছিল এবং বিরোধীদের তরফ থেকেও প্রস্তাবিত ছিল। তবে প্রয়োজন ও প্রস্তাব অনুরূপ ছিল না। প্রসঙ্গত প্রধান বিরোধী শিবিরগুলো থেকে মারাত্মকভাবে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের অভিযোগ আনা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে কেন্দ্রে আসীন শাসকদল ২০১৯-এ পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী প্রচারে এই দুটি বিষয়কে গোপন তো করেইনি, বরং প্রচারের অন্যতম বিন্দু করেছিল। সুতরাং এই দুটি বিষয়ে দেশের জনমত যে সঙ্গে আছে, সে বিষয়ে আর কোনও প্রমাণ দাখিলের প্রশ্ন ওঠে না।
যাইহোক, ইউনিয়ান ক্যাবিনেট ২০১৯-এর ৪ ডিসেম্বর সপ্তদশ লোকসভায় পুনরায় বিলটি উত্থাপন করে এবং ২০১৯-এর ৯ ডিসেম্বর Citizenship Act of 1955 বা নাগরিকত্ব আইন ১৯৫৫-এর সংশোধনী হিসাবে Citizenship Amendment Bill (CAB)’ 2019 লোকসভায় পেশ করেন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ। লোকসভায় ৭ ঘণ্টা ধরে চলা বিতর্কে সাংসদদের সদন ত্যাগ না করার অনুরোধ জানিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ সব প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে বলেছেন, জিন্নার ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ মেনে ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে কংগ্রেস দেশভাগ না করলে এই বিলের প্রয়োজনই হতো না। তার পরেও ১৯৫০ সালে সাক্ষরিত নেহেরু-লিয়াকত চুক্তি অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয় দুই দেশ। কিন্তু ভারত প্রতিশ্রুতি রাখলেও পাকিস্তানে সংখ্যালঘুরা ধর্মীয় কারণেই চরম অত্যাচার ভোগ করে চলেছে, যে আশঙ্কা সে দেশের মুসলিমদের নেই। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ থেকে আগত মূলত হিন্দু শরণার্থীদের তো স্বয়ং ইন্দিরা সরকার নাগরিকত্ব দিয়েছিল যদিও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হল মনে করে বাংলাদেশ থেকে ১৯৭১-এর পর শরণার্থীদের আশ্রয় দেওয়া হবে সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়েছিল। তাহলে আজ বিতর্ক হওয়ার তো কথা নয়। কথা ওঠে আফগানিস্তানকে প্রতিবেশী রাষ্ট্র গণ্য করা নিয়েও। খুব লজ্জা ও বেদনার যে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে মনে করিয়ে দিতে হয়, আফগানিস্তানের সঙ্গে পাক অধিকৃত কাশ্মীরের সীমানা আছে এবং পাক অধিকৃত কাশ্মীরও ভারত রাষ্ট্রেরই অংশ। শেষে প্রবল বিতর্কের পর বিলটি ৩১১-৮২ ভোটে লোকসভার বেড়া টপকে যায়। তবে, রাজ্যসভায় ক্যাব পাস করানোই গেরুয়া শিবিরের কাছে ছিল বড় চ্যালেঞ্জ, কারণ রাজ্যসভায় এনডিএ এখনও সংখ্যাগরিষ্ঠ নয়। অবশ্য মোদী-শাহের ফ্লোর ম্যানেজমেন্ট থেকে ধারণা জন্মেছিল বেশ কিছু দল সভায় উপস্থিত না থেকে পদ্ম শিবিরের সুবিধা করে দিতে পারে। ১১ই ডিসেম্বর সরকারপক্ষ এই বিল রাজ্যসভায় পেশ করতে দিনভর তীব্রতর বিরোধিতা। সরকার পক্ষের অঙ্ক সত্য প্রমাণ করে সদ্য জোট ভাঙা শিবসেনা ও সমাজবাদী পার্টি সদন ছেড়ে ওয়াক আউট করে ভোটাভুটিতে কার্যত নেতিবাচক অংশগ্রহণ থেকে সরে থাকে। কংগ্রেসহ বিরোধীপক্ষ থেকে প্রস্তাব ওঠে বিলটিকে সংসদীয় সিলেক্ট কমিটিতে পাঠানোর। সেই প্রস্তাব ভোটে হেরে যাওয়ার পর পরিশেষে চূড়ান্ত ভোটাভুটিতেও ১২৫-৯২ ভোটে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯ (CAB 2019) রাজ্যসভাতে শাসকদলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও প্রধান সহযোগী দলের সহযোগিতা ছাড়াই উত্তীর্ণ হয়। রাজনাথ কোবিন্দ সাক্ষর করার পর তা Citizenship Amendment Law (CAA)’ 2019 বা আইন হিসাবে হিসাবে সংবিধানের অঙ্গ হিসাবে স্বীকৃতি লাভের পর অনেকের মনে হল আর কোনও দীর্ঘসূত্রী গেরোর ফেরে না পড়ে ২০১৯-এর শীতকালীন অধিবেশনেই বুঝি শরণার্থী ও উদ্বাস্তু সমাস্যার এক বহু প্রতীক্ষিত সমাধান সূত্র পাওয়া গেল।
তবে বিপুল জনাদেশ পাওয়া সরকারের সিদ্ধান্ত সংসদেও সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণের পরেও বেশ কয়েকটি বিরোধী দল ও সংগঠন এই আইনকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মোট ৫৯টি মামলা করেছে। লোকসভায় পাস হওয়া ইস্তক উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলিতে টানা প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, অশান্তির বিস্ফোরণ দেখা গেছে। সর্বোপরি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভের নামে মানুষ সম্প্রদায় বিশেষের যা বিধ্বংসী উন্মাদনা প্রত্যক্ষ করল, তাতে শুধু শরণার্থী নয় এদেশে বহু প্রজন্মের বাসিন্দা হিন্দু বাঙালিরও পিলে চমকে উঠেছে। আপাতদৃষ্টিতে ধর্মীয় নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতের শরণার্থী হওয়া মানুষগুলোর মধ্যে সর্বাধিক সংখ্যায় উপকৃত হওয়ার কথা বাঙালি হিন্দুর। কিন্তু উদ্ভূদ পরিস্থিতির চাপে বা সু্প্রীম কোর্টের রায়ে আইনটি আদৌ বলবৎ থাকে কিনা সেটাই দেখার। তাছাড়া এই আইনের অবতারণা নাগরিকত্ব নিয়ে অনেক প্রশ্ন ও ধন্দ উস্কে দিয়েছে।
উত্তরপূর্ব ভারতেও বিজেপি লোকসভা নির্বাচনে সাফল্য পেয়েছে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ও নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলকে সমানে রেখেই। কিন্তু ঐসব প্রদেশ নাগরিক পঞ্জির মাধ্যমে বিদেশি সনাক্ত করে বহিষ্কারের পক্ষপাতী হলেও বিপন্ন শরণার্থীদের নাগরিকত্ব দানের ঘোর বিরোধী। তাদের এই অবস্থানের কারণ কিছুটা বোধগম্য। দেখা যাক সেগুলো কী কী।
রাজনীতির ঘোলাজলে একটি নির্দিষ্ট সাম্প্রদায়িক অভিমুখ ছাড়া আর কিছু ঠাওর করা যাচ্ছে না। তাই যেটা বোঝা যাচ্ছে, শুধু সেটুকু তুলে ধরার চেষ্টা করি। অর্থাৎ উত্তরপূর্বের প্রদেশগুলোর অসন্তোষের কারণগুলো সেগুলোই দেখা যাক।

উত্তরপূর্ব ভারতে CAB নিয়ে আপত্তির কারণ
উত্তরপূর্বের প্রদেশগুলো মূলত শরণার্থী জোয়ারের আশঙ্কায় ভীত এবং নিজেদের প্রাদেশিক সত্ত্বা অক্ষুন্ন রাখতে কোনও শরণার্থীকেই জায়গা দিতে নারাজ। তারা তাদের দাবি একপেশে বিতাড়ন যন্ত্র এনআরসি-তেই সীমাবদ্ধ রাখতে চায়।
আসাম: ১৯৮০ সালে বাংলাদেশী অনুপ্রবেশকে কেন্দ্র করেই জাতিগত হিংসার চরমে পৌঁছয় আসাম যার ফলশ্রুতিতে আসাম চুক্তি ১৯৮৫ সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির ভিত্তিতেই এনআরসি তালিকার প্রস্তুতি, যে তালিকায় ভারতে প্রবেশের ভিত্তি তারিখ নির্ধারিত আছে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চ। এর পরে আসা বাংলাদেশীদের সীমান্ত পার করা হবে, আর না করা পর্যন্ত ডি-ভোটার হিসাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে পচানো হবে। ১৯১৪-র ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত অনুপ্রবেশ অনুমোদন করলে চালু এনআরসি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ প্রযোজ্য হবে না। আসু (All Assam Students’ Union), কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতিসহ আসামের ৩০টি গোষ্ঠী রাজ্যজুড়ে জনজাতিগুলির জীবনযাপন বরবাদ হবে বলে প্রবল প্রতিবাদে অশান্তি শুরু করেছে। আসাম গণপরিষদ তো আগে ২০১৬তেই এই বিষয়কে কেন্দ্র করে আসামের বিজেপি সরকারের সঙ্গে নিজেদের গাঁটছড়া খুলে নিয়েছিল। কৃষক মুক্তি সমিতির নেতা অখিল গগৈ ২০১৮-র ২৭ জানুয়ারিই হুমকি দিয়েছিল এই আইন জারি হলে আসাম ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে। আসু ও কৃষক মুক্তি সমিতির নেতাকর্মীরা ‘জনতা ভবনের সামনে নগ্ন হয়ে বিক্ষোভও দেখায়। মুখ্যমন্ত্রী সর্বানন্দ সোনোয়ালও জাতির স্বার্থে পদত্যাগ করার হুমকি দিয়ে রেখেছেন।
মিজ়োরাম: মিজ়োরামেও ২৩ জানুয়ারি ২০১৯ ৩০,০০০ ছাত্রছাত্রী ও এনজিও প্তিবাদে নেমেছিল বিলে চাকমা বৌদ্ধদেরও নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রস্তাব থাকায়। দক্ষিণ মিজ়োরামে চাকমারা ইতিমধ্যে বহু সংখ্যক চাকমা উদ্বাস্তু বাংলাদেশ থেকে এসে বসবাস করছে যাদের কর্ণফুলি নদীতে ‘কাপ্তাই’ জলবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য বাঁধ’ তৈরির জন্য ১৯৬২ সালেই উচ্ছেদ করেছিল পাকিস্তান সরকার কোনও পুনর্বাসন বা ক্ষতিপূরণের আয়োজন না করে। তারপরে ১৯৭১-এ বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময়ই চাকমাদের বাংলাদেশে স্থান দেওয়া নিয়ে আপত্তি উঠেছিল। ভাষা, সংস্কৃতি ও সর্বোপরি ধর্ম কোনওটাই বাংলাদেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের অনুরূপ নয়। ষাঠের দশক থেকে লাগাতার উচ্ছেদের অসন্তোষ থেকেই কালক্রমে ১৯৭২ সামে জন্ম নেয় “পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি”। নিজেদের “জুমিয়া জাতি”বলে বাংলাদেশে আওয়ামি লীগ সরকারের কাছ থেকে স্বীকৃতিও দাবি করে। তাতে ব্যর্থ হয়ে স্বায়ত্ব শাসনের চার দফা দাবি পেশ করে। তখন থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামবাসী এই জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ বিচ্ছিন্নতাবাদী তকমা দিয়ে দমন করে আসছে। ফলত ১৯৭৩-এর ৭ জানুয়ারি একটি সশস্ত্র প্রতিরোধ বাহিনী (Chakma armed resistance) তৈরি করে যার নাম “শান্তি বাহিনী”। বাংলাদেশ সেনা ও “শান্তিবাহিনী”র মধ্যে সহিংস সংঘাত চরমে পৌঁছয় ১৯৭৩ নাগাদ। রাষ্ট্রীয় সেনার বিরুদ্ধে সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর নিজস্ব ক্ষধদ্র বাহিনী কতদিন আর টিঁকে থাকবে। চাকমারা বাংলাদেশ থেকে আর এক প্রস্থ উৎখাত হয়ে ভারতে আসতে থাকে এবং মূলত আশ্রয় নেণ অরুণাচল, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরায়। । চাকমারা কিন্তু নিজেদের ভূমিতে বসবাসের অধিকার ছাড়া আর কিছুই দাবি করেনি। তবুও তাদের উদ্বাস্তু হতে হয়েছে।
পুনরায় চাকমা আবির্ভাবের সম্ভাবনা দেখা দিতে মিজ়োরামের এনজিও Young Mizo Association সারা রাজ্যজুড়ে প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান বয়কট করে। মিজ়োরামের মুখ্যমন্ত্রী জ়োরামথাঙ্গা (Zoramthanga) বিল পাস হলে বিজেপি-র সঙ্গে North-East Democratic Alliance (NEDA) ভেঙে দেবে বলে শাসিয়ে রেখেছে। মিজ়ো ছাত্র ইউনিয়ান Mizo Zirlai Pawl (MZP)-এর নেতার মতে বিল পাস নাকি দেশে একতার পরিপন্থী হবে। এটাও বিচ্ছিন্ন হওয়ার হুমকি বলেই ধরতে হবে।
মেঘালয়: মেঘালয়ের Meghalaya Democratic Alliance (MDA) সরকারও Citizenship (Amendment) Bill, 2016-র বিরোধিতা করবে বলেই রেখেছিল। তাদের আশঙ্কা মেঘালয়ের মতো ক্ষুদ্র রাজ্যে বিলের প্রস্তাবমতো অভিবাসন (immigration) হলে মেঘালয়ের মূল অধিবাসীরা সংখ্যালঘু হয়ে পড়বে। মুখ্যমন্ত্রী কনরাড সাংমা (Conrad Sangma) গৃহমন্ত্রী রাজনাথ সিংহকে বিলটি পুনর্বিবেচনার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তাঁর যুক্তি নতুবা মেঘঅলয়সহ উত্তরপূর্ব ভারতে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিত অবনতি ঘটাবে। শিলং শহরে প্রায় ৪০,০০০ মানুষ সমবেত হয়ে ১ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ এই মর্মে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। সাংমাও রাজ্যসভার গণ্ডী পেরোলে বিজেপি-র নেতৃত্বে এনডিএ (NDA) জোট ছেড়ে দেওয়ারই হুমকি দিয়ে রেখেছেন।
নাগাল্যান্ড: নাগাল্যান্ড উপজাতি কাউন্সিল বা The Nagaland Tribes Council (NTC) এবং নাগা ছাত্র সংগঠন Naga Students’ Federation (NSF) উত্তরপূর্বের জনজাতিদের মধ্যে নাগা রাজনৈতিক দলগুলি আঞ্চলিক চরিত্র হারাবে কারণ দেখিয়ে বিলের বিরোধিতা করে আসছে। এছাড়া আসাম থেকে নাগাল্যান্ডে পরিযায়ীদের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা তো আছেই।
মণিপুর: মণিপুরেও অনুরূপ আশঙ্কা্য় প্রতিবাদ হয়েছে। বিলটি আইনে পরিণত হয়ে বলবৎ হলে বিদেশী ও শরণার্থীদের আস্তানা হয়ে উঠবে মণিপুর। ২৪ জানুয়ারি ২০১৯ ইম্ফলে বিজেপি-র রাজ্যসভা সদস্য কে ভগবানানদা সিংহের বাড়ির সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির সময় ৪ জন ছাত্র গ্রেপ্তার হয়েছিল। এমনকি ২৬ জানুয়ারি ইম্ফলে বোমা বিস্ফোরণ পর্যন্ত অশান্তি হয়। মুখ্যমন্ত্রী এন. বীরেন সিং অমিত শাহকে অনুরোধ করেছিলেন যাতে মণিপুরকে বিলের বাইরে রাখা হয়।
ত্রিপুরা: ত্রিপুরায় আবার তিনটি আদিবাসী সংগঠনের ডাকা ১২ ঘণ্টা বন্‌ধে হিংসার জেরে অন্তত ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করতে হয়। ২০১৬ নাগরিকত্ব বিলটির প্রতিবাদ করে The Tripura Indigenous Tribal Parties Forum সম্মিলিতভাবে। তাদের বক্তব্য ত্রিপুরায় বাংলাদেশ থেকে শরণার্থী আগমণের কারণে ইতিমধ্যে স্থানীয় কোকবোরোক (Kokborok) জনগোষ্ঠীর জনানুপাত ৮০% থেকে ৩৩% হয়ে গেছে। বস্তুত ত্রিপুরায় হিন্দু বাঙালির পাশাপাশি এসেছে বাস্তুহারা চাকমা শরণার্থীরাও। অনুপ্রবেশের ফলে রাজ্যটির উপজাতিগত জনমানচিত্র আমূল বদলে গেছে। ৮ জানুয়ারি বিক্ষোভ চলাকালে পুলিসের গুলিতে ৬ জন ত্রিপুরী আহত হওয়ার পর দুদিন ইন্টারনেট পরিষেবাও বন্ধ ছিল। Indigenous Peoples Front of Tripura (IPFT)-ও ভারতীয় জনতা পার্টির সঙ্গে জোট ছিন্ন করার কথা বলেছে এই বিলের কারণেই।
অরুণাচল প্রদেশ: অরুণাচল প্রদেশের সমস্যাও মিজ়োরামের মতো চাকমা মূলত শরণার্থী। চাকমাদের সঙ্গে মিজ়োদের সংঘাতের ভয়ে চাকমা শরণার্থীদের অরুণাচল প্রদেশে সরানো হয়েছে। নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬ কার্যকরী হলে অরুণাচল প্রদেশে বসবাসকারী প্রায় ১ লক্ষ চাকমা, তিব্বতি ও হাজং শরণার্থী নাগরিকত্ব পেয়ে যাবে। ফলে স্থানীয় জনসমর্থনে ৫০০-র বেশি ছাত্রছাত্রী সেখানেও বিলের প্রতিবাদ করে।

নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৯-এর নতুনত্ব
পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের ধর্মীয় সংখ্যালঘু হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, পার্সি ও খ্রিস্টানদের নাগরিকত্ব দানের বিষয়টি ২০১৬-র বিলের মতো অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অপরিবর্তিত আছে ১৯৫৫-র আইনানুযায়ী ন্যূনতম ১১ বছর ভারতভূমিতে বসবাসের শর্ত শিথিল করে ন্যূনতম বসবাসের প্রয়োজনীয়তা ৬ বছর করার ব্যাপারটাও।
তবে একটি বড়সড় পরিবর্তন আনা হয়েছে মূলত উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলোর দাবি মেনে যাতে সেখানকার জনজাতিগুলির আঞ্চলিক সংখ্যাগুরুত্ব ও ভাষা-সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য রক্ষা নিয়ে আশঙ্কার কোনও কারণ না থাকে। সংবিধানের ষষ্ঠ তফশিলভুক্ত (Sixth Schedule to the Constitution ) আসাম, মেঘালয়, মিজ়োরাম ও ত্রিপুরার জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত অঞ্চলগুলো এর আওতায় পড়বে না। এই এলাকাগুলি হল আসামের কার্বি আলং, মেঘালয়ের গারো পাহাড়, মিজ়োরামের চাকমা জেলা ও ত্রিপুরার আদিবাসী এলাকা। এছাড়া অরুণাচল প্রদেশ এবং মিজ়োরাম ও মেঘালয়ের যে সমস্ত অংশে যাতায়াতের জন্য Inner Line Permit দরকার হয়, সেই জায়গাগুলোকেও নাগরিকত্ব দানের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এমনকি ১০ ডিসেম্বর ২০১৯-এ ত্রিপুরাকেও Inner Line Permit নিয়ন্ত্রণাধীন করা হয় যাতে সেখানে অভিবাসন দেওয়া না যায়।
নতুন বিলে Overseas Citizenship of India (OCI) রেজিস্ট্রেশন বাতিলের একটা ব্যবস্থা আছে যদি সেই রেজিস্ট্রেশন জালিয়াতির মাধ্যমে হয়েছে ধরা পড়ে। সেক্ষেত্রে রেজিস্ট্রেশনের ৫ বছরের মধ্যে ধরা পড়লে দেশের সার্বভৌমত্ব ও সুরক্ষার স্বার্থে ২-৫ বছরের কারাদণ্ড হতে পারে। কেন্দ্র সরকারের আইন অমান্য করলে উপায় কী সে ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। যেমন রেজিস্ট্রেশন বা পঞ্জিকরণ বাতিল করার আগে OCI নথিভুক্তদের সাফাই পেশ করার সুযোগ থাকবে।
সংসদে এই বিল পেশ করার সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী এটাও স্পষ্ট করেছেন, নাগরিকপঞ্জির জন্য নতুন করে মঞ্চ প্রস্তুতির কোনও প্রয়োজন নেই। সারা দেশজুড়েই এনআরসি হবে যেখানে একজন অনুপ্রবেশকারীকেও ছাড়া হবে না। প্রতিবেশী দেশ থেকে কোনও ‘সজ্জন’ মুসলিম ভারতীয় নাগরিকত্বে আবেদন করলেও বিবেচনা করা হবে। কিন্তু বাংলাদেশ থেকে আসা ‘রোহিঙ্গা’ জনগোষ্ঠীকে এই সুবিধা দেওয়া হবে না।

তবে ক্ষোভ কেন?
ভারতের উত্তরপূর্বে ও পশ্চিমবঙ্গসহ অন্যান্য অংশে বিক্ষোভের কারণ এক নয়, বরং পরস্পরবিরোধী। আসাম ছাড়াও উত্তরপূর্বের রাজ্যগুলির কাছে বিল বিরোধিতার বেশ কিছু যুক্তিগ্রাহ্য কারণ ছিল। জনবিন্যাস বদলানো ছাড়াও কর্ম সংস্থানে সংকটের আশঙ্কা। সম্প্রতি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমমন্ত্রীর সঙ্গে প্রস্তাবিত ‘ক্যাব’ নিয়ে আলোচনা করেন মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী সহ উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির প্রতিনিধিরা। সেখানেই ইনার লাইন পারমিট বৃদ্ধি বা রাজ্যগুলিতে প্রবেশ ও প্রস্থানের ক্ষেত্র পুনর্গঠনের কথা বলা হয়। ক্যাব আইনে পরিণত হলে সেই ওইসব রাজ্যের ক্ষতি হবে না বলে আশ্বাস দিয়েছেন অমিত শাহ, এমন দাবি স্বয়ং মণিপুরের মুখ্যমন্ত্রী এন বীরেন সিংয়ের।
তাদের দাবিগুলিলে যথাযোগ্য মর্যাদা দিয়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণের জন্য যথেষ্ট ব্যবস্থা রেখেই তো নাগরিকত্ব বিল ২০১৯ পাস করা হয়েছে। তারপরেও বিলটি লোকসভা পার করার অব্যবহিত পরেই উত্তরপূর্বের সাত ভগ্নী জুড়ে ১২ ঘণ্টার বন্‌ধ ডেকে যে প্রবল বিক্ষোভ দেখা গেল, তা কাদের ভুল বোঝানোয় হয়তো অনুমান করা যায়, হয়তো সবটা যায় না। উত্তরপূর্বের দুটি রাজ্য আনুষ্ঠানিকভাবে বিধানসভায় প্রস্তাব পাশ করেছে এই বিলের বিরুদ্ধে। বিশাল মশাল মিছিল চলেছে ১০-১১ ডিসেম্বর রাত জুড়ে। এসবের জেরে আসামে ‘বঙ্গাল খেদানো’র নতুন অধ্যায় শুরু হয় কিনা, ত্রিপুরায় জনজাতি রোষ আবার বাঙালিদের ওপর আছড়ে পড়ে কিনা, বা বাকি পাঁচ বোনের মধ্যে কী প্রতিক্রিয়া হয় সেদিকে সন্ত্রস্ত্র হয়ে তাকিয়ে থাকতে হবে। হিন্দু মুসলিম নির্বিশেষে বাঙালি মাত্রেই ঘারড়ধাক্কা দেওয়ার দাবিতে ৯ ডিসেম্বরই বিজেপির সঙ্গে জোট ভেঙ্গে বেরিয়ে গেছে অসম গণ পরিষদ। অথচ আসাম প্রাচীন যুগ থেকে আদতে হিন্দু বাঙালির বাসভূমি। অহমরাই এসেছে অনেক পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে চিনের ইউনান প্রদেশ থেকে। এসে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মকে আপন করে নিয়েছে বলে স্বাগত, কিন্তু মূল ভারতীয়দের যদি তারা বহিরাগত বিদেশি প্রমাণের চেষ্টা করে, তাহলে ওদের শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিন্তু উগ্র জাতিসত্তাবাদী অহম খিলাঞ্জিয়াদের প্রাদেশিক আবেগকে ধর্মনিরপেক্ষতার খাতিরে ভারতকে ধর্মশালা বানানোর দাবির সঙ্গে যারা গুলিয়ে নিজেদের দাবি আদায় করতে চায়, তাদের শিক্ষা কোনও কালেই হবে না।
কিন্তু ক্ষমতা দখল বড় বালাই। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, সিপিএম তো বটেই, এমনকি বিজেপির এনডিএ শরিক দল শিবসেনাও এই বিলের বিরোধিতা করছে। মহারাষ্ট্রের আঞ্চলিক দল শিবসেনা মহারাষ্ট্র বিধানসভা নির্বাচনে মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য বিজেপির সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে কংগ্রেসের হাত ধরার পর CAB নিয়ে নিজের অবস্থান ১৮০ ডিগ্রী বদলে ফেলেছে। পশ্চিমবঙ্গের প্রাদেশিক শাসক দলের কাছে মুসলিম ভোট ব্যাংক বাড়ানোই একমাত্র লক্ষ্য যার জন্য উদ্বাস্তু হিন্দু বাঙালির চেয়ে রোহিঙ্গারা বেশি স্বাগত। যদিও রাজ্যসভার ভোটাভুটিতে তাদের সাংসদদের অনুপস্থিতি থেকে ভিন্নতর সমঝোতা প্রমাণে সচেষ্ট অনেকেই। আর বাম দলগুলি তো নিজেদের কিম্ভূত মতাদর্শ নিয়ে বরাবরই খিলাফত ও জেহাদের সহযোগী। বিরোধী দলগুলির এমনকি আসামে বিজেপি-র জোট সঙ্গী থেকে প্রাদেশিক শাখার অভিযোগ এই বিল বিজেপি-র ভোট অঙ্ক ছাড়া কিছুই নয় – বাংলাদেশ থেকে আসামে আগত হিন্দুদের নাগরিকত্ব দিয়ে দেওয়া গেলে বিজেপির ভোট ব্যাঙ্ক জোরদার হবে। ঘটনাচক্রে নাগরিক পঞ্জিথেকে যে লাখ লাখ হিন্দু বাঙালির নাম বাদ পড়েছে, বিজেপি বোঝাচ্ছে নাগরিকত্ব বিল আইনে পরিণত হলে তাদের ভারতীয় নাগরিক হতে বাধা থাকবে না। কিন্তু নাগরিক পঞ্জি থেকে যে কয়েক লক্ষ মুসলমান বাদ পড়েছে, তাদের নিয়ে বিজেপি-র কোনও বক্তব্য নেই।
বিলের বিরোধিতা করে তৃণমূল সাংসদ সৌগত রায় বলেন, “৩৭০ ধারা বিলোপের সময় বলা হয়েছিল এক দেশ-এক সংবিধান। কিন্তু নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ত্রিপুরার অনেক জায়গাকে অন্তর্ভক্ত করা হয়নি। এই বিল বিভাজনের উদ্দেশ্য করা হচ্ছে, যা সংবিধানের ১৪ নম্বর ধারার পরিপন্থী।” আমাদের সাংসদরা নিশ্চয়ই অজ্ঞ নন। সৌগতবাবুরাও নিশ্চয়ই জানেন উত্তরপূর্ব ভারতের রাজ্যগুলির সঙ্গে কথা বলে তাদের জনবিন্যাস বজায় রাখার দাবিকে মর্যাদা দিতেই শুধু মাত্র ষষ্ঠ তফশিলভুক্ত আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষিত এবং আভ্যন্তরীণ পারমিটের অধীনস্থ অঞ্চলগুলোই নাগরিকত্ব বিল ২০১৯-এর বাইরে রাখা হয়েছে। তবু একদিকে মুসলিম অনুপ্রবিষ্টদের নাগরিকত্ব দেওয়ার আর অন্যদিকে উত্তরপূর্ব ভারতের জনমানচিত্র নষ্ট করার সমান্তরাল দাবি নিয়ে যেনতেন প্রকারে হিন্দু বাঙালি শরণার্থীদের অগ্নিকুণ্ডে ঠেলে দেওয়া।
আসাম তো বটেই সারা উত্তর পূর্ব ভারতে যে প্রবল প্রতিক্রিয়া হচ্ছে নাগরিকত্ব দানে এই উদারতাকে কেন্দ্র করে, তা শরণার্থীর বাঁধ ভেঙে স্থানীয়দের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও কর্মসংস্থান কমার আশঙ্কায়। অথচ আসাম প্রাচীন যুগ থেকে আদতে হিন্দু বাঙালির বাসভূমি। অহমরাই এসেছে অনেক পরে দ্বাদশ শতাব্দীতে চিনের ইউনান প্রদেশ থেকে। এসে ভারতীয় সংস্কৃতি ও সনাতন ধর্মকে আপন করে নিয়েছে বলে স্বাগত, কিন্তু মূল ভারতীয়দের যদি তারা বহিরাগত বিদেশি প্রমাণের চেষ্টা করে, তাহলে ওদের শিক্ষা দেওয়া দরকার। কিন্তু আজ উগ্র জাতিসত্তাবাদী অহম খিলাঞ্জিয়া আর পশ্চিমবঙ্গের নির্দিষ্ট রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় থাকা লোকগুলো এমনকি উগ্র জাতিয়তাবাদকে যারা ফ্যাসিজ়ম বলে ঘৃণা করে সেই কমরেডরাও কি সমপর্যায়ভুক্ত হয়ে গেল না, আসামের ঘৃণ্য প্রাদেশিক আবেগের সহিংস প্রকাশকে দেখিয়ে যারা নিজেদের দাবি আদায় করতে চাইছে?
ওদিকে দেশময় CAA বিরোধী মুসলিমদের প্রতিবাদে খ্রিস্টানরাও সমর্থন দিয়েছে। ২৫ ডিসেম্বর যিশুর জন্মদিনে কেরালার একটি চার্চে মাথায় ফেজ টুপি ও হিজাব পরে ক্রিসমাস ক্যারোল গেয়ে অভিনবভাবে মুসলিমদের প্রতিবাদে সহমর্মিতা দেখিয়েছে। সারা বিশ্বে ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেড করে এসে ভারতে জেহাদের হয়ে ওকালতি বেশ মামানসই! ভারতবর্ষ বলেই সম্ভব। ক্রিশ্চানরা জানে মুসলিমদের মধ্যে থেকে কাউকে খ্রিস্টধর্মের দিকে টানা যাবে না, কিন্তু এইভাবে ধর্মনিরপেক্ষতার ভড়ং দ্বারা হিন্দু সমাজে আরও ফাটল ধরিয়ে নিজেদের দল ভারি করা যাবে। দেশময় যে ধ্বংসলীলা ও সাম্প্রদায়িক হামলা চলল, তার নিন্দা নেই, শুধু সুযোগ বুঝে ধর্মীয় সহমর্মিতা দেখিয়ে পাশে একটি সম্প্রদায়ের পাশে থাকার ভান করে অন্যটিতে ফাটল ধরানোর কৌশল। অবশ্য আশ্চর্য কিছু নয়, ব্রিটিশ আমল থেকেই এই ছলচাতুরি চলে আসছে।
যেখানে ঘরের ভেতর এত শত্রু, সেখানে বাইরের লোকে তো কথা বলার সুযোগ পাবেই। পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রত্যাশিতভাবে ফোড়ং কেটেছেন এই বলে যে, ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র বানানোর চক্রান্ত চলেছে। নিজে পুরোপুরি মুসলিম রাষ্ট্রের প্রধান হয়ে কোন মুখে বলেন জানি না। তাছাড়া এর মাধ্যমে স্বীকার করে নিয়েছেন ওদেশের হিন্দুরা নির্যাতিত এবং প্রাণ বাঁচাতে ভারতমুখী। আমেরিকাও বিল সম্পর্কে বিশদে কিছুই না জেনেই ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়া নিয়ে দিল্লির নিন্দা করেছে এবং দরকারে নিষেধাজ্ঞার হুমকি দিয়েছে। কোনও ধর্মাবলম্বী নাগরিকেরই নাগরিকত্ব যে খোয়া যাবে না, শুধু অনুপ্রবিষ্ট ও শরণার্থীর তফাৎ করা হবে – সেই ধারণা ছাড়াই আমেরিকার দাদাগিরি করার অধিকার স্বতঃসিদ্ধ। আমেরিকান সংস্থাকে নিজের চরকায় তেল দেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হলেও নিরন্তর যদি এই দেশের কিছু মানুষ বিদেশে নিজের দেশ সম্পর্কে মিথ্যে দোষারোপ করে গুজব রটায়, তাহলে আন্তর্জাতিক মহলের চাপে পরিস্থিতি প্রতিকূল হতে কতক্ষণ?
আপাতত উত্তরপূর্বের প্রাদেশিক প্রশাসন কঠোরভাবে বিক্ষোভ দমন করে পরিস্থিতি ঠাণ্ডা করে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় বসে আসাম চুক্তি অক্ষরে অক্ষরে পালন করিয়ে নিজেদের আরও কিছু জাতিগত দাবি দাওয়া আদায় করে নিতে আগ্রহী। অন্যদিকে বিরোধী দলগুলোর কাছে ধর্মের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব, বিভাজন, সংখ্যালঘু বিদ্বেষ জাতীয় অভিযোগের ফাটা রেকর্ড বাজানো ছাড়া কোনওদিনই কোনও অকাট্য যুক্তি ছিল না, এখনও নেই। প্রসঙ্গত প্রধান বিরোধী শিবিরগুলো থেকে মারাত্মকভাবে সাম্প্রদায়িক বৈষম্যের অভিযোগ আনা সত্ত্বেও ২০১৪ থেকে কেন্দ্রে আসীন শাসকদল ২০১৯-এ পুনরায় ক্ষমতায় আসার আগে নির্বাচনী প্রচারে এই দুটি বিষয়কে গোপন তো করেইনি, বরং প্রচারের অন্যতম বিন্দু করেছিল। সুতরাং এই দুটি বিষয়ে দেশের জনমত যে সঙ্গে আছে, সে বিষয়ে আর কোনও প্রমাণ দাখিলের প্রশ্ন ওঠে না। ২০১৯-এ এসেও এনআরসি নিয়ে আসামে হিন্দু বাঙালির জন্য যে সংকট তৈরি হয়েছে, তা মোচনের জন্যই নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল ২০১৬-র আইনে রূপান্তরিত হওয়ার প্রয়োজন অনুভূত হয়। কিন্তু যে জাতির জন্য এই উদ্যোগ, তাদেরই নিরাপত্তা ও সুবিধাভোগী পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারীদের একাংশ বিলটির বিরোধিতা করে সাম্প্রদায়িক অভিন্নতার অস্তিত্বহীন রেকর্ড বাজিয়েছে সবচেয়ে বেশি। এমনকি পশ্চিমবঙ্গে প্রতিবাদের নামে একতরফা সাম্প্রদায়িক আস্ফালন ও আক্রমণ এবং তাতে প্রত্যাক্ষ সরকারি মদত দেখেও সেই রেকর্ড কোন যাদুবলে অক্ষত থাকে, তা সত্যিই বিস্ময়ের। আর সেই বাজনায় নেচে পশ্চিমবঙ্গ যা প্রত্যক্ষ করল এবং বিরামহীনভাবে করে চলেছে তাতে বাঙালির জাতিগত আশা আকাঙ্খা এমনকি অস্তিত্ব রক্ষার ইচ্ছাও আছে কিনা বুঝে ওঠা স্বয়ং বিধাতার কাছেও দুর্বোধ্য হয়ে উঠেছে।
একটা রাজনৈতিক দল যেখানে নিজের জেতা জমি বাজি রেখে বাঙালি হিন্দুর সহায় হতে চাইছে, সেখানে ভণ্ডামির সব সীমা অতিক্রম করে হিন্দু বাঙালিদেরই একাংশ মানুষকে ভুল বোঝানোর সবরকম চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। যারা ১৯৪৬-৪৭ থেকে ১৯৭১ এমনি তার পরেও এপারে পালিয়ে এসেছে প্রাণ বাঁচাতে, তারা ২০১৪-য় আসা বিপন্নদের আগমন আটকাতে চাইছে এই শর্ত দিয়ে– যদি অত্যাচারিতকে আশ্রয় দাও অত্যাচারীকেও দিতে হবে; নতুবা নতুবা মার খাওয়া সব হারানো মানুষকেও রেহাই পেতে দেব না?! ধর্মের নামে যে রক্তপাত শুরু হয়েছিল এই উপমহাদেশে, প্রতিবেশী পাকিস্তান ও বাংলাদেশে যা এখনও অব্যাহত, সেই রক্তপাতে সামান্য মলম লাগানোর চেষ্টায় কেন এত কষ্ট হচ্ছে কিছু মানুষের? এরপর যদি কেন্দ্রে শাসক দল নিষ্পৃহ হয়ে গৃহহীন মানুষের নাগরিকত্বের বদলে দেবতার জন্য সুউচ্চ অট্টালিকা নিয়ে মাথা ঘামায়, কাকে দোষ দেব? আমরা তো আত্মঘাতেই অস্তিত্ব হারাতে বসেছি।

নাগরিকত্বের গোলকধাঁধায়
সব দেশেই নাগরিকত্বের একটা সংজ্ঞা থাকে। আমাদের সংবিধান পৃথিবীর পৃথুলতম হওয়া সত্ত্বেও নাগরিকত্বের শর্ত নাকি ঠিক মতো নিরূপণ করে উঠতে পারেনি। তার কারণ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা যমজ রাষ্ট্র দুটির একটি পুরোপুরি নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় বুঝে নিয়ে সেই ধর্মানুশাসন দ্বারা এলোপাতাড়ি ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের সাফাই করে গেছে, আর বৃহত্তর রাষ্ট্রটি ধর্মনিরপেক্ষ থেকে সর্বধর্মের সহাবস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে অন্য রাষ্ট্রের নৃশংস অত্যাচার থেকে প্রাণ বাঁচাতে পলাতক মানুষগুলোকে ক্রমাগত আশ্রয় দিয়ে গেছে। ১৯৫০ সালে সাক্ষরিত দুই রাষ্ট্রপ্রধানের (নেহেরু-লিয়াকত) চুক্তি অনুযায়ী সংখ্যালঘুদের সুরক্ষা দেওয়ার যে পারস্পরিক অঙ্গীকার করা হয়, তা ধর্মনিরপেক্ষ দেশটি রাখলেও ধর্মপ্রাণ দেশটি রাখার প্রয়োজন অনুভব করেনি। ধর্মপ্রাণ রাষ্ট্রটি ভাষাগত কারণে এবং অবশ্যই ভৌগোলিক সংযোগের অভাবে পুনরায় বিভাজিত হয়েছে, আর পিলপিল করে সব ধর্মাবলম্বী নির্যাতিত তথা আর্থিক নিরাপত্তাকামী মানুষকে বমন করে দিয়েছে এই হতভাগ্য ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রটির ওপরেই। সেই বিভাজনে একটি জাতিসত্তার জন্ম– বাঙালি জাতিসত্তা, যার সরাসরি অনুঘটক এই পোড়া ভারতবর্ষ। ১৯৭১-এ অপরিমেয় রক্তক্ষয়ের পর বাংলাদেশকে স্বাধীন করার বিনিময়ে ভারত কাশ্মীরের মতো তাকে ভারতভুক্তির শর্ত দেয়নি, বরং সর্বতোভাবে তাকে স্বনির্ভর ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে বিকশিত হতে সাহায্য করেছে। তখনও বাংলাদেশ থেকে আগত কোটি কোটি শরণার্থীদের আশ্রয় ও সবরকম নাগরিক অধিকার দেয় ইন্দিরার ভারত। অবশ্য ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা পেল ভেবে ভারত সরকার স্থির করে ১৯৭১-এর পরে বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দুদেরও আর নাগরিকত্ব দেবে না। কিন্তু ক্ষুব্ধ পাকিস্তান তো বটেই, কৃতজ্ঞ বাংলাদেশের কাছ থেকেও নির্বোধ ভারত ধারাবাহিকভাবে খোলাখুলি ও গুপ্ত শত্রুতা উপহার পেয়েছে। তারই প্রতিক্রিয়ায় শরণার্থী ও অনুপ্রবেশের বলতে গেলে একমুখী স্রোত ভারত রাষ্ট্রটিকে নাগরিকত্বের ব্যাপারে কোনওদিন সুনির্দিষ্ট দৃঢ় অবস্থান নিতে দেয়নি, নমনীয় থাকতে বাধ্য করেছে।
কিন্তু সব কিছুর একটা ধারণ ক্ষমতা বলে ব্যাপার আছে। অতি নমনীয় ইলাস্টিকও টানতে টানতে ছিঁড়ে যায়। আর এই নমনীয়তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন ধর্মনিরপেক্ষতার ছদ্মবেশে সাম্প্রদায়িক সম্প্রসারণ ডালপালা শেকড় ছড়াতে শুরু করে ভারতের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়কে ক্রমশ সংখ্যায়, আর্থিক অবস্থায়, মানবিক অধিকারে, নারী ও শিশুর নিরাপত্তায়– সব দিক দিয়ে লঘু করে দিতে উদ্যত, তখন নিজস্ব বিবেকবোধ থেকে নির্বিরোধ মানুষ বিপন্ন বোধ করবেই। প্রতিবেশী পাকিস্তান বা বাংলাদেশে যারা সংখ্যালঘু বলে প্রতিনিয়ত নৃশংসতার শিকার হচ্ছে, ভারতে তাদের ওপরই এক তরফা সহিষ্ণুতা বজায় রাখার দায়িত্ব বর্তাচ্ছে। আর সব মিলিয়ে ভারতে নাগরিকত্ব নিরূপণ ও প্রদানের ব্যাপারটা আকার আয়তনহীন বায়বীয় থেকে যাচ্ছে যেখানে একতরফা সহিষ্ণুতা দেখিয়েও হিন্দু পরিচয় নিয়ে থাকাটা যতটা বিপজ্জনক ততটাই নিন্দিত।
সুতরাং দেখা যাচ্ছে এই নাগরিকত্ব নিয়ে স্পষ্ট ধারণা আমাদের সাধারণ মানুষ থেকে নেতা-মন্ত্রী কারোরই তৈরি হতে পারেনি। এ যাবত ভোটার কার্ড, রেশন কার্ড, আধার কার্ড, প্যান কার্ড ও পাসপোর্ট ইত্যাদি নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবেই দেখা হোত যদিও প্রত্যাকটির নির্দিষ্ট পৃথক উদ্দেশ্য আছে। CAA, 2019 প্রনীত হওয়ার পর কেন্দ্র সরকার বলছে কোনওটিতেই নাকি নাগরিকত্বের কথা বলা নেই। ব্যাপারটা খতিয়েদেখা যাক।
এগুলোর মধ্যে PAN কার্ড করাতে হয় ভারত সরকারের আয়কর বিভাগের নজরদারিতে থাকার জন্য। ভারতে বসবাস ও উপার্জনকারী প্রতিটি নাগরিক ও বিদেশীকে প্যান নম্বরের মাধ্যমে ভারত সরকারকে আয়কর দিতে হয়। সুতরাং প্যান নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় বোঝা গেল। আবার রেশনের মাধ্যমে ভর্তুকিতে কম দামে জরুরি পন্য পাওয়ার সুবিধা যদিও নাগরিকদেরই পাওয়ার কথা, তবু ধরে নেওয়া যাক সরকার মানবতার খাতিরে শরণার্থীদেরও এই সুবিধা নিতে অনুমতি দিয়ে এসেছে। রেশন কার্ড নবীকরণের পর অনেক পুরোনো কার্ডধারীরই নতুন কার্ড হয়নি সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মীদের অপদার্থতায় ও পদ্ধতিগত ত্রুটিতে। রেশন কার্ডকে নাগরিকতার প্রমাণ ধরতে গেলে দেশের বহু বৈধ ও বহু প্রজন্ম ধরে বসবাসকারীই অ-নাগরিক সাব্যস্ত হবে।
কিন্তু যদি যুক্তি দেওয়া হয় ভোটার কার্ড শুধু ভোটারের পরিচয় পত্র, নাগরিকত্বের নয়; তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে নাগরিক না হলে কি ভোটাধিকার জন্মায়? আরও গোল বাধে আধার (AADHAAR) কার্ড ঘিরে। বলা হচ্ছে আধার নম্বর শুধুমাত্র ব্যক্তিবিশেষ সনাতক্তকরণের বায়োমেট্রিক তথ্যের সূচক। কিন্তু সেই সূচক কি অভারতীয়দের জন্য প্রযোজ্য? ভারত সরকার প্রদান করছে যখন তখন সেটি তো তা দেশের নাগরিকদের বায়োমেট্রিরই নির্ভরযোগ্য তথ্যভাণ্ডার। কারণ ২০১০-এ শুরু হওয়া ন্যাশনাল পপুলেশন রেজিস্ট্রার বা NPR সম্পর্কে সরকারি তরফে বলা হয়েছিল, এটি হল উত্তর-পূর্ব ভারতে নাগরিকত্বের একটি তথ্যভাণ্ডার (database), যা বাকি ভারতীয় ভূখণ্ডে চালু ইউনিক আইডেন্টিফিকেশন অথরিটি অব ইন্ডিয়া (UIDAI)-র সমতুল্য যে বিভাগটি নাগরিকদের আধার (AADHAAR) কার্ড প্রদান করে। NPR-এর যাবতীয় তথ্যভাণ্ডার রক্ষণাবেক্ষণ করে Registrar General and Census Commissioner of India। ভারত সরকার NPR-এর ভিত্তিতেই একটি National Register of Indian Citizens বা NRC অর্থাৎ ‘জাতীয় নাগরিক পঞ্জি’ তৈরি করছে। এনপিআর ও ইউআরডিআই যৌথভাবে ভারতীয় নাগরিকদের একটি পূর্ণাঙ্গ তাথ্যভাণ্ডার প্রস্তুত করছে। নামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি হলেও পূর্ব ও উত্তরপূর্বের সীমান্তবর্তী অনুপ্রবেশের সমস্যায় জর্জরিত রাজ্যগুলোতে ‘প্রকৃত নাগরিক’ সনাক্তকরণের জন্য ২০১৮ পর্যন্ত শুধু আসামে প্রযোজ্য, ত্রিপুরার ক্ষেত্রেও প্রস্তাবিত, এবং পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রেও ভাবনাচিন্তার পর্যায়ে ছিল। কারণ যাই হোক, এখন NPR যদি নাগরিকদের তথ্যভাণ্ডার হয়ে থাকে, তাহলে তারই সমতুল্য UIDAI তথ্যভাণ্ডারের ভিত্তিতে প্রদত্ত আধার কার্ড কেন নাগরিকত্বের প্রমাণ নয়? তফাৎ শুধু এনপপিআর-এর সঙ্গে জনগণনার সম্পর্ক আছে যেহেতু তা সেনসাস কমিশনারের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে যেখানে দ্বিতীয়টির সঙ্গে জনগণনার বিষয়টি সরাসরি জড়িয়ে নেই। সারা দেশেই NPR করা যেতেই পারে। কিন্তু AADHAAR নম্বরের সঙ্গে নাগরিকত্বের সম্পর্ক নেই ব্যাপারটা বোঝার পক্ষে বেশ জটিল।
সবচেয়ে বড় কথা ভারতীয় পাসপোর্ট একমাত্র নাবালক/নাবালিকা বা প্রাপ্তবয়স্ক যাই হোক নাগরিক হলেই পাওয়া যায়। ওখানে citizen by birth/naturalisation/registration ইত্যাদি ঘোষণা করতে হয়। সুতরাং নাগরিকত্বের একটা প্রমাণ হিসেবে পাসপোর্ট্ তো অবশ্যই গণ্য হওয়ার কথা। তবে সবার পাসপোর্ট থাকে না; বিদেশযাত্রা ছাড়া পাসপোর্ট বাধতামূলকও নয়।
সুতরাং ধর্মীয় উৎপীড়নের শিকার প্রতিবেশী তিন দেশের মানুষকে প্রচলিত আইন মোতাবেক ১১ বছর বসবাসের শর্ত শিথিল করে নতুন আইনে একটু তাড়াতাড়ি মানে ৫-৬ বছরের মধ্যে নাগরিকত্ব দেওয়ার ঘোষিত নৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া আর কোনও সারবত্তা নেই। কিন্তু কিছু মানুষের কাছে এইটুকুও আপত্তিকর কেন, তার কোনও যুক্তিগ্রাহ্য কারণ নেই; যা আছে তা হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রসারণকামী সাম্রাজ্যবাদের ষড়যন্ত্র। যেখানে রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড থেকে পাসপোর্ট পর্যন্ত সবকিছুই জাল নথির ভিত্তিতে তৈরি হতে পারে, সেই জায়গাটা নিশ্ছিদ্র না করে নাগরিকত্ব নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করতে চাইলে কাজের কাজ হওয়ার বদলে ধন্দ জটিলতর হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। মাঝখান থেকে নাগরিকত্বের প্রমাণ হিসাবে এতদিন ভারত সরকার প্রদত্ত সবকটি পরিচয়পত্রের মান্যতা কেড়ে নেওয়ায় সেইসব সুযোগসন্ধানীরাই ভুল বুঝিয়ে জট পাকানোর সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে।
সর্বোপরি আসাম চুক্তির ৬ষ্ঠ শর্ততে আছে “Constitutional, legislative and administrative safeguards, as may be appropriate, shall be provided to protect, preserve and promote the cultural, social, linguistic identity and heritage of the Assamese people.” এটি তৈরিই হয়েছে বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের জেরে গড়ে ওঠা ‘বঙ্গাল খেদা’ আন্দোলনের পরিপরেক্ষিতে। এই ক্লজ় বা ফ্যাকড়া নং ৬ মেনে নাগরিকত্ব দেওয়া মানে রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক জীবিকা এমনকি প্রাকৃতিক সম্পদেও অসমীয়াদের অগ্রাধিকার সংরক্ষিত রেখে বাঙালিকে বড়জোর ভোটার বানিয়ে রাখা। আইনটি কার্যকর হলে ফরেনার্স অ্যাক্টে ধৃত হিন্দু বাঙালিদের ডিটেনশন ক্যাম্প নামের বন্দীশিবির ও বিভিন্ন জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্ত ৬ নং শর্তের ফলে বাংলাদেশ থেকে আগত বাঙালি তো বটেই, এমনকি কয়েক শতাব্দী ধরে বরাক উপত্যকার ভূমিসন্তান যেসব বাঙালিরা অনসমীয়া বহিরাগত ডি-ভোটার হিসাবে চিহ্নিত, তারাও দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকবে। মণিপুরেও মোটামুটি অনুরূপ চুক্তি হয়ে আছে মূলত বাংলাদেশ থেকে তাড়া খাওয়া হিন্দু বাঙালি ও বৌদ্ধদের থেকে স্থানীয় সম্পদ স্থানীয়দের জন্য সুরক্ষিত রাখতে। তাই ঐ ৬ নং শর্তটি পালিত হবে এই আশ্বাস পেয়ে উওরপূর্বে ক্যা (CAA) নিয়ে কাক পড়া চিল ওড়া দু-তিন দিনের মধ্যে থেমে গেল। আসাম মণিপুর ত্রিপুরা সরকারকে শুধু প্রাথমিক বিক্ষোভটি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হয়েছিল। চাপের মুখে আসাম চুক্তির ৬ নং ফ্যাকড়াটি সম্পূর্ণ রক্ষার মানে বাঙালিকে ভাতে জাতে পাতে মারার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার মধ্যে মোটা ভাই ও চাপ দাড়ির কোনও স্বার্থ আছে কিনা জানি না, তবে এ ছাড়া খর্বনাসা লোকগুলো শান্ত হতো না।
উত্তরপূর্ব ভারতের অধিকাংশ বিধানসভায় গেরুয়া ধ্বজা ওড়ায় চিরাচরিত বাঙালি বিদ্বেষের দায় আপাতত তাদের ওপরেই বর্তাচ্ছে যদিও আসাম ও ত্রিপুরার কুখ্যাত বাঙালি গণহত্যার ঘটনাগুলো ঘটেছিল ৬০ থেকে ৮০-র দশকে কংগ্রেস ও বাম আমলে। ওখানকার হিংস্র প্রাদেশিকতার জন্য কয়েকটি আঞ্চলিক সংগঠন ছাড়া কোনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক দলকেই আলাদা ভাবে দায়ী করা যায় না। কিন্তু সবকটি দলের গায়েই প্রাদেশিক হিংস্রতা বেড়ে উঠেছে জনতার একাংশের দাবিতেই। কেউ চাইলেও এই জট ছাড়াতে পারবে না। বরং ছাড়ানোর চেষ্টা করলে জটিলতা আরও বাড়বে যেমন এখন বেড়েছে। আসামের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী কংগ্রেসের তরুণ গগৈ এন আর সি ও ডিটেনশন ক্যাম্পের ব্যাপারে মোদী মিথ্যে কথা বলেছেন বলে জানিয়েছেন অটলবিহারীর নির্দেশেই শুরু হয়েছিল অবৈধ অনুপ্রবেশকারী সনাক্ত করার কাজ আর মোদী ৩০০০ বন্দি রাখার মতো ডিটেনশন ক্যাম্প তৈরির জন্য ৪৬০০০ কোটি টাকা অনুমোদন করেছেন। সেই ক্যাম্পে মুসলিমের চেয়ে হিন্দু ডি ভোটার বেশি আছে। বাংলাদেশ থেকে প্রাণ বাঁচাতে তাড়া খেয়ে ভারতে পালিয়ে আসা হিন্দুর সংখ্যা নিছক জীবিকার সন্ধানে ভারতে অনুপ্রবিষ্ট মুসলমানের চেয়ে স্বাভাবিকভাবেই বেশি। অসমীয়াদের জাতিবিদ্বেষ আর কংগ্রেসের ক্ষমতালোভ – দুটোই অতুলনীয়। সুযোগ বুঝে ভদ্রলোক যাদের জন্য CAA আনা হয়েছে, তাদের জলে ফেলে একই সঙ্গে চিরাচরিত বাঙালি বিদ্বেষ আর বিরোধী রাজনীতি দুটোই ঝালিয়ে নিচ্ছে।
পৃথক বাংলাভাষী রাজ্যের দাবি না উঠলেও সেটাই আপাত সমাধান মনে হচ্ছে। অবশ্য গোটা বরাক উপত্যকার যা সাম্প্রদায়িক জনবিন্যাস, তাতে সেটা আর একটা বাংলাদেশ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা যে কেউ অনুমান করতে পারে। হয়তো তাই হিন্দু বাঙালির পক্ষ থেকে সেই দাবি ওঠেনি। একদিকে উগ্র অসমীয়া জাতিসত্তার আগ্রাসন অন্য দিকে ইসলামিক সাম্রাজ্যবাদের আগুন — দুয়ের মাঝে ঝলসে নির্মূল হয়ে যাওয়াই কি হিন্দু বাঙালির ভবিতব্য? দুঃখের বিষয় পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা অসমীয়া বাঙালির প্রকৃত সমস্যার সমাধান না চেয়ে ধর্মনিরপেক্ষতার ফাটা রেকর্ড বাজিয়ে তাদের আরও বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। তাই সমস্যার সমাধান হল না নতুন সমস্যার সূত্রপাত তা সময় বলবে।

শ্রীপর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়

তথ্যসূত্র:
https://en.wikipedia.org/wiki/The_Citizenship_(Amendment)_Bill,_2019

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.