#পর্ব_২
আশুতোষ ভট্টাচার্য মহাশয়ের রচনা থেকে জানা যায় :
ইনি ( শিব ) লৌকিকরূপে সম্পূর্ণ ভাবেই কোচজাতীয় কৃষকদের দেবতা ছিলেন। সুপ্রাচীন কাল হতে পশু ,কৃষি এবং ভূমির দেবতা হিসাবে মহেশ্বর শিবের অস্তিত্ব ছিল। তিনি স্বয়ংভূ পশুপতি। তাই প্রাচীনকাল হতে বিভিন্ন প্রাচীন জনজাতির এক ও অন্তিম আরাধ্য দেবতা হবেন সে বিষয় দ্বিমত থাকে না। তিনিই বৈদিক রূপে রুদ্র। তাই তিনিই প্রাচীন কাল হতে কোচ জাতির দেবতা তা অনুমান করা যেতেই পারে। তাই হয়ত , পরবর্তীকালে শিবের সঙ্গে পুরান বহির্ভূত কোচদিগের সংশ্রবের কাহিনী জড়িত থাকতে দেখা যায়।
তাই বৈদিক হোক বা লৌকিক সকল দেবতাদের আদিদেব হলেন শিব। শিব রূপে ত্রিশূল পূজা, লিঙ্গ পূজা, শিবের বাহন ( বৃষভ, সর্প) , শিবের ভৈরব প্রভৃতি মূলত কৃষিমূলক । বর্ষণ ও বৃষের সঙ্গে সম্পর্ক ঘনিষ্ট। সর্প প্রজননের প্রতীক। শিব তাই একধারে সর্বশক্তিমান আবার কৃষির দেবতা। তাই তিনি প্রাচীন কোচ জাতির নিকট কৃষিদেবতা, যুগ থেকে যুগান্তরে তাই হিমালয় সন্নিকস্থ তথা ভারতীয় লোক জীবনে শিবই হলেন প্রধান উপাস্য দেবতা।
উত্তরবঙ্গের ধর্মীয় জীবনের সমস্ত লোকবিশ্বাস , লোকসংস্কার , লোকাচার শিবকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। পরবর্তী কালে , বৌদ্ধ ,জৈন এবং বৈষ্ণব মার্গ মিলেমিশে একটি মিশ্র সাধনার ক্ষেত্র হিসাবে প্রসার লাভ করেছে।
উত্তরবঙ্গের সমাজ এবং সাংস্কৃতিক জীবনে সপরিবারে শিবের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দীপক কুমার রায় বলেছেন –
লোকায়ত সংস্কৃতির মধ্যেই শিবই হলেন প্রধান দেবতা । অন্যান্য দেবদেবী শৈব পরিবারেরই অন্তর্ভুক্ত। যেমন – মনসা, গোসান মারী, চন্ডী, ভাণ্ডানী, মাশান, বুড়ি ঠাকুর ইত্যাদি। উত্তরবঙ্গের বৃহত্তর জনসমাজ রাজবংশীরাও মূলত শৈব। বোরো বা মেচ, ধিমাল, রাভা, গারো, জলদা ইত্যাদি জাতি- জনজাতি সমাজেও প্রধান দেবতা শিব। ধিমাল সমাজে তিনিই দান্তা বেরাং, বোরো সমাজে শিব্রাই বা বাথৌব্রাই নামে পরিচিত।
আদি কৃষিভিত্তিক লোকাচারের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিব এই অঞ্চলে নানা রূপে ও নামে পরিচিতি। লৌকিক রূপের মহাকাল বুড়াঠাকুর, সন্ন্যাসী , ধূমবাবা, যখা ঠাকুর, মাশান ,মদনকাম , গমীরা, চড়ক প্রভৃতির পাশাপাশি শিবের আদিম পৌরাণিক রূপ জল্পেশ্বর , বাণেশ্বর , জটেশ্বর, সর্বেশ্বর, ভদ্রেশ্বর , বটেশ্বর , নীলাশ্বর প্রভৃতি শিব পূজিত হয়।
শিব উপাসনা দুই রূপে ঘটে :
১ : লৌকিকরূপে
২: লৌকিক রূপের পরিশীলিত পৌরাণিক রূপে
তিস্তা – তোর্সা নদীর অববাহিকা অঞ্চলে সমাজ জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত লৌকিক এবং আদিম পৌরাণিক রূপী শিবের নামে গ্রাম নাম একার্থে এই অঞ্চলের সমাজ সংস্কৃতিগত লোক ঐতিহ্যকে গভীর ভাবে দ্যোতিত করে।
ক. জল্পেশ (ময়নাগুড়ি) : উত্তরবঙ্গের জাগ্রত শিব মন্দির জল্পেশ মন্দির। সেই মন্দিরে অধিষ্ঠিত মহাদেব জল্পেশ্বর।পীঠনির্ণয়তন্ত্র মতে দেবী সতীর বাম চরণ ত্রিস্রোতায় পতিত হয়েছিল । দেবীর নাম ভ্রামরী, ভৈরবের নাম ঈশ্বর । পীঠনির্ণয়তন্ত্র বলে-
ত্রিস্রোতায়াং বামপাদে ভ্রামরী ভৈরবেশ্বরঃ ।
শিবচরিত গ্রন্থ অনুসারে এখানে দেবীর জানু পতিত হয়েছিল। দেবীর নাম চণ্ডীকা আর ভৈরবের নাম সদানন্দ । ভারতচন্দ্র তাঁর অন্নদামঙ্গল কাব্যে লিখেছেন-
তিরোতায় পড়ে বামপাদ মনোহর ।অমরীদেবতা তাহে ভৈরব অমর ।।
তিরোতা ও ত্রিস্রোতা কে এক ধরা হয় । জ্ঞানার্ণবতন্ত্র শাস্ত্র ও শাক্তানন্দ তরঙ্গিণী শাস্ত্রে ত্রিস্রোতায় শক্তিপীঠের উল্লেখ পাওয়া যায় । ত্রিস্রোতা বলতে উত্তরবঙ্গের তিস্তা নদীকে বোঝায় । তিস্তা নদী ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা । পশ্চিমবঙ্গের উত্তরে জলপাইগুড়ি জেলার বোদাগঞ্জ গ্রামে ফরেস্টের ভেতরে এই মন্দির। অনতিদূরে ভীষন গর্জন ও তীব্র স্রোত নিয়ে বয়ে চলছে তিস্তা । ভিন্ন মতে জলপাইগুড়ি জেলার জল্পেশ শিব মন্দির কেই শক্তিপীঠ ধরা হয়। সেজন্য কিছু পণ্ডিত দের মতে ভ্রামরী দেবীর ভৈরব হলেন জল্পেশ বা জল্পেশেশ্বর ।
চারুচন্দ্র স্যানাল তাঁর The Rajbansis of North Bengal গ্রন্থে বলেছেন :
Jalpeswar is mentioned in Skanda Purana as being installed by one Raja Jalpa. The deity is also mentioned in the Kalima purana Yogini Tantra . The Lingam is enshrined in a big temple which said to have been built at first by arama named Jalpeswar in the 19th year of Saka….. Probably one his descendants , Prithibi Raja , rebuilt the temple in the second Century . The Prannarayan and Modhnarayan the Fourth and fifth rajas of Coochbehar rebuilt the temple about 150 years ago.
অন্য দিকে গিরিজাশঙ্কর রায় বলেছেন , যে জল্পেশ নামে কোনো এক প্রতাপশালী রাজবংশী ক্ষত্রিয় রাজা অথবা সর্দারের নাম ছিল জল্পেশ। তাঁর নাম অনুসারে মন্দিরের নাম হয়েছে জল্পেশ। হয়ত তিনি কোনো দৈব শক্তির অধিকারী ছিলেন। তাই তাঁর মৃত্যুর পরে তাঁকে দেবতায় উন্নীত করা হয়েছে। উত্তরবঙ্গে এমন অলৌকিক ক্ষমতা সম্পন্ন নর দেবতায় রূপান্তরিত হয়েছে এমন বহু দৃষ্টান্ত আছে। …জল্পেশ হয়ত কোনো শক্তিশালী গ্রামদেবতা ছিলেন। পরে কোচবিহারের রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় শিবের সঙ্গে একীভূত হয়ে উত্তরবঙ্গের প্রধান দেবতা বলে স্বীকৃত হয়েছেন ।
খ. জটিলেশ্বর (ময়নাগুড়ি): ময়নাগুড়ির গ্রাম হসুলডাঙ্গা থেকে দক্ষিণ দিকে জটিলেশ্বর শিব মন্দিরের অবস্থান। তাঁর নামেই স্থানটির নাম জটিলেশ্বর।
জল্পেশ এবং জটিলেশ্বর দু’টিই বিখ্যাত শৈবক্ষেত্র। জল্পেশে প্রতি বছর অন্তত সাড়ে তিন লক্ষ পুণ্যার্থী আসেন। তার মধ্যে নেপাল থেকেও আসেন অনেকে। বৈশাখ, শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বিশেষ উৎসবে মন্দিরে জনসমুদ্র তৈরি হয়। জটিলেশ্বরেও শ্রাবণ ও ফাল্গুনে বেশ ভিড় হয়। এই দু’টি মন্দিরই বেশ প্রাচীন। এর মধ্যে জল্পেশ দু’হাজারের বছরের পুরনো সিল্ক রোডের উপরেই ছিল বলে গবেষকদের অনেকের ধারণা। জটিলেশ্বরের মন্দিরটি নবম শতকের বলে মনে করেন প্রত্নতত্ত্ববিদেরা।
গ. বটেশ্বর (ময়নাগুড়ি): ময়নাগুড়ি থেকে জল্পেশ যাওয়ার পথে মাধবডাঙ্গা গ্রাম পড়ে। সেই গাঁয়ের নিকট বটেশ্বর নামে এক সুপ্রাচীন শিব মন্দির অবস্থান করছে। চারুচন্দ্র স্যানাল তাঁর The Rajbansis of North Bengal গ্রন্থে বটেশ্বরকে মহাকাল বলেছেন। বটেশ্বর শিবের নামে স্থানটির নাম বটেশ্বর হয়েছে।
ঘ . জটেশ্বর ( ময়নাগুড়ি ) : জলপাইগুড়ি হল তিন ‘ঈশ্বরের দেশ’—জল্পেশ্বর, জটিলেশ্বর, জটেশ্বর। স্থানিক বাসীদের অনক্ষর অংশ এই ভূখণ্ডকে ‘মহাকালের দেশ’ বলে জানেন। সতীনাথ ভাদুড়ীর ‘গণনায়ক’ গল্পে এই মহাকালের কথা বিশেষ ভাবে উল্লেখিত হয়েছে। তবে স্থানীয় তন্ত্র সাহিত্যে এই অঞ্চলকে ‘রত্নপীঠ’ নামে অভিহিত করা হয়েছে। মহাকাব্য ও পুরাণে সামগ্রিক ভাবে এই বিস্তীর্ণ ভূখণ্ডকে ‘কিরাত দেশ’ বলে চিহ্ণিত করা হয়েছে। সম্ভবত এই সময়ই এই অঞ্চল ‘পাণ্ডব বর্জিত’ দেশ হিসাবে পরিচিতি পেয়েছিল। অর্থাৎ পাণ্ডবরা অন্যত্র গেলেও এ অঞ্চলে আসেনি।
তিস্তা-করলা-কালজানি-জলঢাকা স্নেহাশ্রিতা হিমালয় দুহিতা জলপাইগুড়ি একশো পঞ্চাশ বছরে পদাপর্ণ করেছে। এই জনপদের ইতিহাস স্মরণ শুধু স্মৃতি তর্পণ নয়, এই স্মরণের মাধ্যমে নিজেদেরও জানার একটা সুযোগ পাওয়া যায়। অর্থাৎ শিকড়ের দিকে ফিরে তাকানো যায়। লৌকিক শিবের পরিশীলিত রূপী হল এই জটেশ্বর শিব। কোনো এক জটাধারী সাধুর শিলামূর্তি স্থাপন করে শিব জ্ঞানে পূজা করার অনুসঙ্গ একান্তভাবেই লৌকিক।
ঙ . ধাপগঞ্জ ( কোতয়ালী ) : ধাপঠাকুর হলে গাঁয়ের গরাম, মানে গ্রাম দেবতা। তাঁর নামেই স্থানের নাম এলাকার নাম ধাপগঞ্জ। মেচ সম্প্রদায়ের উপাস্য দেবতা ধাপঠাকুর ।ধাপ হলেন স্বয়ং মহাকাল। কাল বা মহাকাল আবার শিবের শরীর হতে সৃষ্ট এক ভৈরবও বটে। মহাকাল উত্তরবঙ্গের মূল উপাস্য।
ধাপঠাকুর সম্পর্কে কল্যাণ দে তাঁর ” জলপাই-গুড়ি গুড়ি, টারি বাড়ি মারি ” প্রবন্ধে বলেছেন :
মেচ সম্প্রদায়ের মধ্যেও মহাকাল পূজার চল আছে। মেচের মধ্যে মহাকাল ধাপঠাকুর গ্রামেও পূজিত হয়ে আসছেন। মাদারীহাটের মুজ্নাই চা বাগানের লাগোয়া পাহাড়ে আশ্বিন মাসে এই দেবতার পূজা হয়। এই উপলক্ষ্যে মেলাও বসে।
চ. সন্ন্যাসীকাটা ( রাজগঞ্জ) : সন্ন্যাসীকাটা গ্রামের নাম একই সঙ্গে ইতিহাসের সত্য কাহিনীর স্মারক ও লোকমানসের নিজ কাহিনী। সন্ন্যাসী বিদ্রোহ যখন হয় সেই সময় এই স্থানে বহু বহু সন্ন্যাসী নিহত হয়েছিলেন। এরসঙ্গে মিলিত হয়েছে গ্রামীন লোকমানসের লোকবিশ্বাস জনিত কিংবদন্তি। জনশ্রুতি আছে রায়কত বংশের শিরা কুমার তার লোকজন নিয়ে এই স্থানে একবার দুর্গ খনন করাকালীন সময় কোদালের ঘ এক স্থানে গিয়ে পড়ে যেখানে মাটির তলায় ধ্যানস্থ দৈব শক্তিধারী এক সন্ন্যাসীকে আঘাত করে। কিন্তু সন্ন্যাসী বিরূপ মনোভাব প্রকাশ না করেই স্মিত হেঁসে তাঁকে পুনরায় মাটি চাপা দিয়ে দিতে বলেন। সেই থেকে এই অঞ্চলের নাম সন্ন্যাসীকাটা।
লৌকিক মানসিকতা প্রসূত এই সকল সন্ন্যাসীদের অতিলৌকিক ক্রিয়াকলাপকে শিবের সঙ্গে একীভূত হয়ে লোকদেবতা সন্ন্যাসী ঠাকুর লোকমনে স্থ্যাঙ্করে নিয়েছেন। কেবলমাত্র সন্ন্যাসীকাটা এলাকাই নয় পার্শ্ববর্তী এলাকাতেও আপন পূজা অধিকার করে নিয়েছে। গ্রামনাম তার নজির হয়ে আছে। সন্ন্যাসীপাড়া , সন্ন্যাসীভিটা সন্ন্যাসীদের বসতিস্থান হলেও স্থানীয় লোকবিশ্বাসে দেবতা রূপে পূজা পাওয়ার স্থান করে নিয়েছে মাথাভাঙ্গা মহকুমার সন্ন্যাসীর ধাম গ্রামে। শিব এই অঞ্চলে সন্ন্যাসীঠাকুর নামে পূজিত হন।
ছ . মহাকালগুড়ি ( আলিপুরদুয়ার ) : মহাকালের নামে গ্রামনাম মহাকালগুড়ি।
যদাহতমস্তন্ন দিবা ন রাত্রির্নসন্ন চাসচ্ছিব এব কেবলঃ।
যখন আলো ছিল না, অন্ধকারও ছিল না; দিন ছিল না, রাত্রিও ছিল না; সৎ ছিল না, অসৎ ও ছিল না- তখন কেবলমাত্র ভগবান শিবই ছিলেন। উল্লেখ্য বেদান্ত বৈদিক সনাতন ধর্মের ভিত্তি তথা বেদের শিরোভাগ; সম্পূর্ণ বেদান্তে শিব ব্যতীত কারো সম্পর্কে এভাবে বলা হয়নি। শুধুমাত্র শিবের ক্ষেত্রেই বলা হয়েছে “শিব এব কেবলঃ”। সুতরাং সৃষ্টির পূর্বে একমাত্র শিবই বর্তমান ছিলেন। তিনিই কালের গতি, জাগতিক সকল পাপ পুন্যকে নিয়ন্ত্রণ করেন। তাই তিনিই মহাকাল। তিনিই আদিম ,অন্তত।
গুড়ি স্থাননামবাচক শব্দ। শক্তিসঙ্গমতন্ত্র অনুসারে, কালীর এই দাম্পত্যসঙ্গী অত্যন্ত ভয়-উদ্রেককারী। মহাকাল চতুর্ভূজ, ত্রিনেত্রযুক্ত এবং ১ কোটি কৃষ্ণবর্ণ অগ্নির বিগঠনের দীপ্তিসম্পন্ন; আটটি শ্মশানভূমির মধ্যস্থলে তিনি বাস করেন। তিনি আটটি মাথার খুলি দ্বারা ভূষিত, পাঁচটি মানুষের শবের উপর আসীন, হাতে একটি ত্রিশূল, একটি পাত্র, একটি তলোয়ার এবং একটি খড়্গ ধরে থাকেন। তিনি শ্মশানভূমির ভস্ম দ্বারা শোভিত এবং বেশকিছু সংখ্যক উচ্চৈঃস্বরে তীক্ষ্ণ চিৎকাররত শকুন ও শিয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত। এদের মধ্যে, তাঁর পাশে তাঁর সঙ্গিনী কালী অধিষ্ঠিতা এবং তাঁরা উভয়ে মিলে সময়ের প্রবাহকে প্রকাশ করেন।
মহাকাল ও মহাকালী উভয়েই ব্রহ্মের অন্তিম বিধ্বংসী শক্তিকে প্রকাশ করেন এবং তাঁরা কোনো নিয়মনীতির দ্বারা আবদ্ধ নন। এমনকি, সময় ও মহাশূন্যকে নিজেদের মধ্যে দ্রবীভূত করার শক্তি তাঁদের আছে এবং ব্রহ্মাণ্ডের বিচূর্ণীভবনের সময় তারা শূন্যাবস্থায় বর্তমান থাকেন। তারা কল্পের অবসানে ব্রহ্মাণ্ডের বিগঠনের জন্য দায়ী।
শিবার্চনতত্ত্বে বলা হয়েছে ” আসাম – ব্রহ্ম সীমান্তে ” বনবাসী আদিম মানুষদের নিকট মহাকাল রূপে শিবই হলেন উপাস্য।
উত্তর বাংলায় ও আসাম – ব্রহ্ম সীমান্তে উপাসিত মহাকাল গোত্রীয় প্রমথ এবং শিবের সঙ্গে তাঁদের মিলনকে শাস্ত্রধৃত করে রাখা হয়েছে। আজও মহাকাল রূপী শিবের উপাসনা এবং কিছু বিশেষ নিয়ম আচার পালন করা র প্রথা দিনাজপুর ও উত্তর বাংলায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিদ্যমান। উত্তরবঙ্গের নদনদী ও বনজঙ্গলে ঘেরা পরিবেশের বিভিন্ন পশু মাছ শিবের নানা রূপের বাহন। তাই , মহাকালের বাহন হাতি, বাঘ ইত্যাদি।
জ. শিবকাটা ( আলিপুরদুয়ার ) : শিবের নামে গ্রাম নাম শিবকাটা। কাটা স্থাননামবাচক শব্দ। শিবকাটার শিব পায়রা বলির জন্য বিখ্যাত।
ঝ. বাণেশ্বর ( সদর কোচবিহার ): বাণেশ্বর মূলত শিবের পিঠস্থান। কোচবিহার শহর থেকে উত্তরদিকে প্রায় দশ কিলোমিটার দূরত্বে বাণেশ্বর অঞ্চলে বাণেশ্বর শিবমন্দির অবস্থিত। এই মন্দিরে শিব লিঙ্গ হিসাবে পূজিত হন। বাণেশ্বরের শিব পূজার লোকাচারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন ।
উক্ত মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে একাধিক রাজার নাম শোনা যায়। রিপুঞ্জয় দাসের বংশাবলীতে উল্লেখ আছে মহারাজা নরনারায়ণ এই শিব মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং অঞ্চলটির নাম রেখেছিলেন গের্দ্দাসান্ডারা। জনশ্রুতি আছে, পৌরাণিক রাজা বাণাসুর এতদঞ্চলে শিব লিঙ্গ স্থাপন করেছিলেন এবং সেই শিবই বাণেশ্বর নামে পরিচিত হন। পরে খেন বংশের রাজা নীলাশ্বর এই মন্দির নির্মাণ করেন।
Durgadas Majumder মনে করেন ,
The temple of Baneswar Shiva was was built by Maharaja Prannarayan in about 1665. There is reason to believe that the present temple was built on the side of an earlier temple.
বাণেশ্বর শিব মন্দিরের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতার নাম নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও মন্দিরটি যে শতাব্দী হতে শতাব্দী প্রাচীন সে সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। উত্তরবঙ্গ এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলের জনপ্রিয় শৈব তীর্থ হল বাণেশ্বর। বাণাসুরের বাণেশ্বর শিব প্রতিষ্ঠা এবং বংতী নদীর সৃষ্টি সংক্রান্ত এই অঞ্চলে বহু কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। প্রতি বছর শিব চতুর্দশীর দিন শিব পূজা, বলি , উৎসব এবং মেলা হয়।
ঞ. শিবেশ্বর (দিনহাটা) : শিবই ঈশ্বর । শিবের নামে গ্রাম নাম শিবেশ্বর।
ট . মহেশ্বর ( দিনহাটা ) : মহৎ যে ঈশ্বর । শিবের এক নাম হল মহেশ্বর। দেবাদিদেব মহেশ্বরের কথা স্মরণে রেখে হয়ত কোনো ব্যক্তির নামে গ্রামের নাম হয়েছে মহেশ্বর।
ঠ. শিবপুর ( শীতলখুচি) : শিবের নামে এই রূপ গ্রামের নাম খুবই প্রাচীন প্রথা।ব্যক্তিনামে গ্রামনাম হওয়ার প্রবণতা ধরা পড়ে পুর নামক স্থানবাচক শব্দে।
ড. মাশান পাট (দিনহাটা) : এই অঞ্চলে শিব হলেন মাশান ঠাকুর। মাশানের পাট নামক স্থানে মাশানের একটি মন্দির আছে। শিবের লৌকিক রূপ মাশান। অনেকে মনে করেন শ্মশান থেকে মাশান শব্দটি এসেছে। আগেকার দিনে রাজা মহারাজারা জল্লাদ দিয়ে মশানে অপরাধীর মাথা নিত। উত্তরবঙ্গ এলাকায় অধিকাংশ মাশানের ধাম নদীর নিকটস্থ শ্মশানে বা কাছাকাছি স্থানে।
মাশান সম্পর্কে গিরিজাশংকর বলেছেন :
শ্মশান বা মাশান একটি ব্যাপক প্রচলিত শব্দ। শ্মশানকে মশানও বলা হয়। সম্ভবত মশানে যে দেবতা বিরাজ করেন সেই দেবতাই পরবর্তী কালে মাশান হয়েছেন, অর্থাৎ শ্মশানচারী শিবই রয়েছেন মাশানের মূলে। পূর্বে হয়ত মাশানের পূজা শ্মশান মশানে হত, ক্রমে তাঁর পূজার ব্যাপকতা বৃদ্ধি পেলে শ্মশান হতে অন্যত্র থান তৈরি করে পূজার ব্যবস্থা হয়েছে বলে যে করা যেতে পারেন।
উত্তরবঙ্গে প্রায় ১৮ প্রকার মাশানের পূজা হয়। মাশানের বাহন শালমাছ, শূকর, হাতি প্রভৃতি। মাশানের ভোগ উত্তরবঙ্গের রাজবংশীদের প্রিয় খাদ্য ‘ দৈ চুরা আটিয়াকলা ‘ ও ‘ চালভাজা’ এবং ‘ ছবামাছ ‘ বা ‘ পোড়ামাছ ‘।
পূর্বক্ত গ্রামনাম ছাড়াও সমগ্র উত্তরবঙ্গ জুড়ে শিব নামে গ্রামের অভাব নেই। এইরূপ শিবের নামে গ্রাম নাম এই অঞ্চলে মহাদেব শিবের আধিপত্যের নজির হয়ে আছে। এই ভাবেই কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাচীন সমাজ সাংস্কৃতিক পরিচিতির এক বিরাট অংশ গ্রাম নামের সঙ্গে মিশ্রিত থাকে।
#সমাপ্ত
প্রবন্ধটি ঋতম বাংলায় প্রকাশিত হল। লিংক কমেন্ট বক্সে।
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ তিস্তা – তোর্সা অববাহিকা অঞ্চলের লোকঐতিহ্য : প্রসঙ্গ গ্রাম নামে শিব