বাংলাদেশে শিক্ষা ব্যবস্থার পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ইসলামিকরণ

বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা ইসলামিকরণের পর সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে কীভাবে মৌলবাদী চেতনার বিকাশ ঘটানো হয়েছে তার অন্যতম নজির হচ্ছে নির্বাচন কমিশন। নির্বাচনের দিন ধার্য করতে গিয়ে অন্য ধর্মকে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করা, আঘাত করা তাদের নিয়মে পরিণত হয়েছে। সম্প্রতি সরস্বতী পুজো নিয়ে তুলকালাম কাণ্ডের পর নির্বাচন কমিশনের বোধোদয় হবে কিনা জানি না। তবে একটা বড়ো রকমের শিক্ষা দিয়েছে হিন্দু সমাজ বিশেষ করে শিক্ষার্থীরা।
৩০ জানুয়ারি সরস্বতী পুজোর দিন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেছিল নির্বাচন কমিশন। হিন্দু সমাজের প্রচণ্ড প্রতিবাদের মুখেও নির্বাচন আয়োজনে অটল ছিল কমিশন। তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে পুজোর আয়োজন সংক্ষিপ্ত করার জন্যে বলা হয়েছিল। হিন্দু সমাজের পক্ষ থেকে হাইকোর্টে রিট আবেদন করা হয়। কিন্তু আদালতও নির্বাচন কমিশনের পক্ষে রায় দেয়। এর পরই প্রথমে বিক্ষোভ ও সড়ক অবরোধে নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হিন্দু শিক্ষার্থীরা। শেষ পর্যন্ত তারা আমরণ অনশনে যেতে বাধ্য হয়। টানা তিনদিনের অনশনে প্রায় ২০ জন শিক্ষার্থী অসুস্থ হয়ে পড়ে, মুমূর্ফ অবস্থায় কয়েকজনকে হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। এর মধ্যে রাজধানীর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে সারাদেশে হিন্দু শিক্ষার্থীদের মধ্যে। বাংলাদেশ হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ কয়েক ধাপে প্রতিবাদের কর্মসূচি ঘোষণা করে। শামিল হয় অন্য হিন্দু সংগঠনগুলোও। ভোট বর্জনের মতো কর্মসূচি নেওয়ার তাগিদ আসে। শেষ পর্যন্ত দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পরিস্থিতিতে নির্বাচন পিছিয়ে দিতে হয় নির্বাচন কমিশনকে। জানা যায়, প্রধানমন্ত্রীকেই অচলাবস্থা অবসানে এগিয়ে আসতে হয়।
বগুড়ায় গত অক্টোবর মাসে জাতীয় সংসদের এক শূন্য আসনে উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়েছিল দুর্গা পুজোর সপ্তমীর দিন। প্রতিবাদ সত্ত্বেও কমিশন অবস্থান থেকে সরেনি। শেষ পর্যন্ত ঐক্য পরিষদ ও অন্য হিন্দু সংগঠনগুলো ভোট বর্জনের ডাক দেয়। তা সত্ত্বেও ভোট সম্পন্ন করে কমিশন। আর তাতেই সাহস বেড়ে গিয়েছিল নির্বাচন কমিশনের। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে এবারে সরস্বতী পুজোর দিন ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন ধার্য করেছিল কমিশন। রাজধানীতে মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভোটকেন্দ্র স্থাপিত হয়। আর বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হিন্দু শিক্ষার্থীরা সরস্বতী পুজোর আয়োজন করে। এ কারণেই সিটি নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার পর থেকেই প্রতিবাদ জানানো হচ্ছিল। দাবি জানানো হয় ভোটের তারিখ পরিবর্তনের। বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ প্রধান নির্বাচন কমিশনারের সঙ্গে দেখা করে ভোটের তারিখ পেছানোর দাবি জানান। কিন্তু নির্বাচন কমিশন সচিব যুক্তি দেখান, ৩১ তারিখ শুক্রবার জুম্মাবার। ওইদিন ভোট হতে পারে না। অর্থাৎ সরস্বতী পুজোর দিন, তাও আবার বছরে এই একটা দিনের সরস্বতী পুজো হয়, সেদিন ভোট হতে পারে। সাপ্তাহিক জুম্মাবারে ভোট হতে পারে না। এর পরের দিন ১ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষা শুরু। তাই ওইদিনও ভোট হতে পারে না।
ঐক্য পরিষদের সঙ্গে আলোচনায় প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেন, প্রয়োজনে পুজো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দোতলায় কোনো কক্ষে বা মিলনায়তনে স্থানান্তরিত করা যেতে পারে। সচিব বলেন, ভোটকেন্দ্রে পুজোর আয়োজন করা যাবে। পুজোর জায়গা বাদ দিয়ে ভোটকেন্দ্র করা হবে। নির্বাচন কমিশনে এই বক্তব্যের জবাবে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়, নির্বাচন কমিশন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠের পুজোকে একটি কক্ষে বন্দি করতে চাইছে। নির্বাচন চলাকালে ভোট কেন্দ্রে ১৪৪ ধারা জারি থাকে। মোতায়েন থাকে নিরাপত্তা বাহিনী। স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনাবাহিনীও প্রস্তুত থাকে। এর মধ্যে পুজো হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) হিন্দু শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের সঙ্গে সহমত প্রকাশ করে। সংবাদ সম্মেলন করে নির্বাচন পিছানোর দাবি জানায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনশনরত ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে এসে সহানুভূতি জানান। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিও সমর্থন জানায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে। বিএনপিও সরস্বতী পুজোর দিন নির্বাচন দেওয়ার কড়া সমালোচনা করে। অনশনরত হিন্দু শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগ দেয় মুসলমান ছাত্র-ছাত্রীরাও। আওয়ামি লিগের এক হিন্দু সাংসদ পঙ্কজ দেবনাথ জাতীয় সংসদে অধিকার প্রস্তাবে দাঁড়িয়ে বলেন, পুজোর দিনে হিন্দুরা পুজোয় ব্যস্ত থাকে। তাদের ভোটদান থেকে বিরত রাখার জন্যেই পুজোর দিন নির্বাচন দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে।
শেষ পর্যন্ত নির্বাচন পিছিয়ে দিতে বাধ্য হয় নির্বাচন কমিশন। তাও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে। এবারের আন্দোলন থেকে শিক্ষা নিয়ে নির্বাচন কমিশন এগোতে পারলে মঙ্গল।তাদের নানা কার্যক্রম বিশেষ করে নির্বাচন আয়োজনে এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থা ইতিমধ্যে তলানিতে পৌঁছেছে।
ঢাকা থেকে বিশেষ প্রতিনিধি

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.