বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত যে কোনো ব্যক্তির কাছেই সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) একটি অতি পরিচিত ও প্রিয় নাম। বিশিষ্ট ভাষাতাত্ত্বিক, বহুভাষাবিদ মনীষী ও প্রাবন্ধিক হিসেবে তাঁর নাম আমরা মনে রেখেছি। The Origin and Development of Bengali Language'(1926) যা সংক্ষেপে ODBL নামে পরিচিত, তাঁর অসামান্য গবেষণাগ্রস্থ। বাংলা ভাষাতত্ত্বের আলোচনা সুনীতিকুমারকে ছাড়া অসম্ভব। ভাষা প্রকাশ :বাংলা ব্যাকরণ’তার বিখ্যাত ব্যাকরণগ্রন্থ। এছাড়া দ্বীপময় ভারত’(১৯৪০), ইউরোপ (১৯৩৮), ‘সাংস্কৃতিকী’ (১ম খণ্ড ১৯৬১, ২য় খণ্ড ১৯৬৫) বহু তথ্যে ভরা তার প্রবন্ধগ্রন্থ। সুনীতিকুমারের একটি বই হলো ‘বাঙ্গালির সংস্কৃতি। খুব ছোটো বই। প্রথম প্রকাশ ২১ মে, ১৯৯০। প্রকাশক পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি। বইটির মোট প্রবন্ধের সংখ্যা ৬। এর মধ্যে একটি বিশেষ প্রসঙ্গে আমরা প্রথম প্রবন্ধ ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রবন্ধটি গ্রহণ করব। প্রসঙ্গটি হলো আজকের বাঙ্গলার মুসলমান সমাজ ও সুনীতিকুমারের ভাবনা।
‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রবন্ধটি একটি বড়ো প্রবন্ধ, সুলিখিত; বাঙ্গালি জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের আলোচনায় অবশ্যপাঠ্য। স্বাভাবিকভাবেই বাংলা সাহিত্যের সাম্মানিক স্নাতক বা স্নাতকোত্তর পর্বের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবন্ধটি পড়তে হয়। খুব সংক্ষিপ্ত পরিসরে প্রবন্ধটিতে বাঙ্গালি মুসলমানদের প্রসঙ্গ এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এসেছে। কারণ বাঙ্গালি মুসলমানদের বাদ দিয়ে বর্তমান বাঙ্গালির জাতির পরিচয় তো সম্পূর্ণ হয় না।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় বঙ্গপ্রদেশে তুর্কি আক্রমণ হয় ত্রয়োদশ শতকের সূচনালগ্নেই (১১৯৯ বা ১২০২)। তুর্কি যোদ্ধা ইফতিকারউদ্দিন-বিন-বখতিয়ার খিলজি ‘মুষ্টিমেয় অনুচরদের সঙ্গে নিয়ে ছদ্মবেশে ও চাতুরির দ্বারা লক্ষ্মণসেনের রাজধানীনবদ্বীপ আক্রমণ করে। অতর্কিত আক্রমণে বিভ্রান্ত, অরক্ষিত পুরীর অধিনায়ক বৃদ্ধ লক্ষ্মণসেন সপরিবারে পূর্ববঙ্গের নিরাপদ অঞ্চলে পলায়ন করেন (অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়)। এরপর থেকেই বঙ্গপ্রদেশের শাসনক্ষমতায় উঠে আসে বিদেশাগত তুর্কি-পাঠান সুলতানেরা। তারা ইসলাম মাতাবলম্বী। প্রজার ভয়ে -ভক্তিতে ইসলাম গ্রহণ করতে লাগলেন। ভীত-সন্ত্রস্ত হিন্দু সমাজ। সাহিত্য সংস্কৃতির ধারা শতাধিক বছরের জন্য প্রায় লুপ্ত হয়ে গেল। এই ভীত হিন্দু সমাজকে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানোর যিনি সাহস জোগালেন তিনি চৈতন্যদেব (১৪৮৬-১৫৩৩)। দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাঠান। সুলতান আর কাজির বিরুদ্ধে অহিংসা আর প্রেমের মন্ত্র নিয়ে তিনি এগিয়ে গেলেন। চৈতন্যের সরল ঈশ্বরভক্তি আর জীবপ্রেমের কাছে মাথা নত করলেন মুসলমান কাজি। একথা হয়তো অসত্যভাষণ নয় যে, যদি চৈতন্যদেবের জন্ম না হতো তাহলে বঙ্গপ্রদেশের হিন্দু সমাজের অস্তিত্ব হয়তো বহুদিন আগেই লুপ্ত হয়ে যেত। হিন্দু সমাজকে সাহস জোগানো ও সংহত করা ছাড়াও চৈতন্যদেব বাঙ্গালিকে বৃহত্তর ভারত-চেতনার সঙ্গে যুক্ত করে দিলেন। ক্রমশ বাঙ্গালি বিদ্যার্থী, পণ্ডিত, এমনকী বণিকদের জন্য খুলে গেল উৎকলদেশ, দাক্ষিণাত্য, উত্তর-ভারতের নানা পথ। সুনীতিকুমার তার প্রবন্ধে এই বিষয়টিও আলোচনা করেছেন— “বাঙ্গালির প্রতিভা বাঙ্গালার বাহিরে আদর পাইল– মোগল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়, হিন্দু-যুগের অবসানের পরে, বাঙ্গালি গ্রামীণ সভ্যতার গণ্ডী প্রথম কাটাইয়া, নিখিল ভারতীয় সভ্যতার অংশ গ্রহণের একটা বড়ো সুযোগ পাইল।”
সুনীতিকুমার তার ‘জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য প্রবন্ধটি রাঁচির হিন্দু ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাব কর্তৃক আহূত সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণ রূপে পাঠ করেন। তারিখ ২১ কার্তিক,১৩৪১ সন। পরে এই লেখাটি লেখকের ‘ভারত সংস্কৃতি’ (১৩৬৪ সন) নামক প্রবন্ধ গ্রন্থে স্থান লাভ করে। প্রবন্ধটি লেখার সময়কাল হলো ১৯৩৪ খ্রিস্টাব্দে। তখন অবিভক্ত বঙ্গপ্রদেশ। এই সময় ‘বাঙ্গালি জাতির অর্ধেকের উপর এখন মুসলমান ধর্ম গ্রহণ করিয়াছে। কিন্তু এই মুসলমানদের মধ্যে যাঁরা ছিলেন সাধারণ বাঙ্গালি মুসলমান’ তারা ধর্মচেতনার জন্য আরবি-ফারসির তোয়াক্কা করতেন না। এঁদের মাতৃভাষা বাংলা, উর্দু এঁরা বাপের জন্মে শোনেননি। আরব দেশের প্রতি এঁদের কোনো আকর্ষণও ছিল না। গ্রাম-গঞ্জের সহজ, সরল, চাষাভুষো মানুষ ছিলেন এঁরা। ধর্মগতভাবে এঁরা গোড়া ইসলামি রীতিনীতি অপেক্ষা ইসলামি সুফি-দরবেশ-পিরফকিরদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত হতেন। এক উদার অসাম্প্রদায়িক ধর্মীয় ভাবনা এঁদের বিরোধ তো দূরে থাক, মিল ও সহাবস্থান ছিল বেশি। সুনীতিকুমার লিখেছেন—“সাধারণ বাঙ্গালি মুসলমান (কতকগুলি বিশেষ প্রান্তে, বিশেষ কতকগুলি গোষ্ঠী বা পরিবার ব্যতীত), বিশিষ্ট মুসলমান সংস্কৃতি সম্বন্ধে উদাসীন ছিল। যে দুই-চারিজন বড়ো আলেম, মোল্লা ও মৌলবি বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে। হইতেন, তাঁহারা নিজেদের আরবি ফারসি জগতের খবর বাঙ্গালির কাছে বেশি করিয়া পৌঁছান নাই। কিছু কিছু আরবি প্রার্থনা, মুসলমানি স্মৃতি-শাস্ত্রের কথা এবং মুসলমানি ইতিহাস পুরাণ কেচ্ছা কাহিনি বাঙ্গলায় অনুদিত হইয়াছিল, এইটুকু মাত্র। উত্তর ভারতের এবং ভারতের বাহিরের দেশের মুসলমান সংস্কৃতির সহিত এবং কোরান অনুমোদিত ইসলামের সহিত বাঙ্গালি মুসলমান অতি আধুনিক কালে—বিগত মাত্র ২৫/৩০ বৎসর মধ্যে একটু ঘনিষ্ঠ পরিচয় পাইবার চেষ্টা করিতেছে। কিন্তু নানা কারণে তাহার জীবনে সে পরিচয় কার্যকর হইতেছে না।”
সুনীতিকুমার এই প্রবন্ধে আরও জানিয়েছেন, “ফরমাইস দিয়া ইচ্ছামতো ‘জাতীয় সংস্কৃতি’ তৈয়ার করা চলে না।” জাতীয় সংস্কৃতি একটি স্বতঃসিদ্ধ স্বাভাবিক বিষয়, তার ইচ্ছামতো নির্মাণ চলে না। কিন্তু সুনীতিবাবুর এই প্রবন্ধটি লেখার পাঁচ-সাত বছর আগে থেকেই ‘ইসলামগত প্রাণ পূর্ণবিশ্বাসী আলেম মোল্লা মৌলবিদের’ চেষ্টায় বাঙ্গালি মুসলমানদের মধ্যে ইসলামি সংস্কৃতি’আনার সচেতন প্রয়াস দেখা গেছে। তারা তৈরি করতে চাইলেন এক নতুন সংস্কৃতি। সুনীতিকুমার আক্ষেপ করেছেন এই প্রয়াসের মধ্যে “পজেটিভ অর্থাৎ সংগঠনকারী দিক অপেক্ষা নেগেটিভ অর্থাৎ ধ্বংসকারী দিকটাই প্রবল। ইহাদের কাছে। ইসলামীয় মনোভাব মানে মুখ্যত যাহা ভারতীয়ত্বের বা হিন্দুত্বের বিরোধী; কারণ ভারতীয়ত্ব বা হিন্দুত্ব হঁহাদের চোখে ‘কুর’ বা বিধর্মিত্ব এবং শিরক বা বহু-দেব বাদীত্বেরই নামান্তর। হিন্দু বা ভারতীয় মাটিতে জন্ম—এই কথাতেই যেন কুফর ও শির-এর আমেজ লাগিয়া আছে; তাই বহু ভারতীয় বা বাঙ্গালী মুসলমান নিজেকে সৈয়দ বা আরব, অথবা ইরানি, পাঠন, মোগল বা তুর্কি বংশসস্তৃত বলিয়া পরিচয় দিতে পারিলে কৃতার্থ হয়। বাঙ্গালি বা ভারতীয় মুসলমানদের এই আত্মমর্যাদাবোধহীনতা তাহাদের পক্ষে এবং আমাদের পক্ষেও বটে — এক। হৃদয়বিদারক, সর্বনাশকর ট্রাজেডি।”
খুব দুঃখের সঙ্গে স্বীকার করতে হয়, যে সর্বনাশকর ট্রাজেডির সন্ধান সুনীতিকুমার আজ থেকে ৯০ বছর আগে পেয়েছিলেন, আজ আমরা তার ভয়ংকর ও বিনাশের রপের সামনে দাঁড়িয়ে। অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে সাধারণ মুসলমানদের মনে ভারত বিদ্বেষের বীজ বপন করা হচ্ছে। এতে। অনেকেইবিভ্রান্ত। দেশের প্রতি ঘৃণা ও বিদ্বেষ কত দূর পর্যন্ত গেলে দেশের সুন্দর ও সাজানো সম্পদ নষ্ট করা যায় তা আমরা নিজেদের চোখে দেখলাম। গণতন্ত্রে দেশের বা রাজ্যের সরকারের বিরোধিতা সহজেই করা যায়। গণতন্ত্রের স্বার্থেই এই বিরোধিতার প্রয়োজন আছে। কিন্তু বিরোধিতা এক জিনিস আর সমবেতভাবে পরপর বিভিন্ন স্থানে। রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি ধ্বংস কিংবা পাকিস্তান জিন্দাবাদ’ স্লোগান দেওয়া বা পাকিস্তানের পতাকা ওড়ানো আর এক জিনিস। মনের মধ্যে পুষ্ট হতে থাকা ভারতীয়ত্বের প্রতি বিদ্বেষ এ জাতীয় নৈরাজ্যের মধ্যে ডানা মেলাতে থাকে। দলমত নির্বিশেষে সমস্ত রাজনৈতিক দলের এ-জাতীয় নৈরাজ্যের বিরোধিতা করা উচিত ছিল। কিন্তু আমাদের দুর্ভাগা দেশ। সেরূপ উদ্যম সব রাজনৈতিক দলের মধ্যে দেখা যায়নি। এইসব রাজনৈতিক দল মুসলমানদের শুধু ভোটার করে রেখেছে। তারা শুধুই ভোটব্যাঙ্ক। ভোটের স্বার্থে দেশভাবনা অনেক সময়ই পিছনে পড়ে যায়। এভাবেও পথভ্রষ্ট হচ্ছেন দেশের এই সংখ্যাগরিষ্ঠ সংখ্যালঘু সমাজ।
কিন্তু আশার আলো যে কিছু নেই তা নয়। গ্রাম-গঞ্জ মফস্সলের বহু সাধারণ। মুসলমানের মধ্যে দেশের প্রতি অপরিসীম ভালোবাসা আছে। এই ভালোবাসায় কোনো খাদ নেই। এদের প্রতি কোনো কারণে সন্দেহ পোষণ করা বা জেহাদিদের প্রতি বিদ্বেষ জানাতে গিয়ে এদের কথা টেনে আনলে এদের মনকে তা ভারাক্রান্ত ও বিরূপ করে তুলতে পারে। তখন সুবিধা হয় সেই পাকিস্তানপন্থী মুসলমানদেরই। সাধারণ বাঙ্গালি মুসলমানদের মনকে আরব দেশের দিকে ঘোরানোর চেষ্টা চলছে প্রায় শতবর্ষ ধরে। আলেম-মোল্লাদের নিরন্তর প্রয়াস, মুসলমান মহল্লায় মহল্লায় আরবপাকিস্তানের জয়গান ও মুসলিম ব্রাদারহুডের উচ্চকিত ঘোষণা, বহু অবৈধ মাদ্রাসার। শিক্ষাপ্রণালী সাধারণ মুসলমানদের বিভ্রান্ত করছে। এই বিভ্রান্তির ফল যে ভালো হচ্ছে।
তা আমরা প্রায়ই দেখছি। সুনীতিকুমার এই প্রসঙ্গেই লিখেছেন— “বাঙ্গালি মুসলমানদের প্রকৃতি এবং ইসলামধর্মী অন্যান্য জাতির মনের ও সভ্যতার প্রকৃতি ভালো করিয়া না বুঝিয়া, বাঙ্গালি মুসলমানের মনকে চালিত করিবার চেষ্টা করিলে, একটা কিম্ভুতকিমাকার বস্তুই সৃষ্ট হইবে, সত্যকার জাতীয় সংস্কৃতির সৃষ্টি হইবে না।”
বাঙ্গালি মুসলমানদের অনেকেই যে। আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত হতে পারেনি, তাদের অনেকেই যে একটা কিম্ভুতকিমাকার অবস্থার মধ্যেই ঘুরপাক খাচ্ছেন রাজ্যের সদ্য নৈরাজ্য দেখে তাই মনে হচ্ছে। এই কঠিন সময়ে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষদের উচিত সুনীতিকুমারের রচনা পাঠ করা। হয়তো আমরা সঠিক দিশা সেখান থেকেই পেতে পারি।
গৌতম কুমার মণ্ডল