ভারতের ধর্মনিরপেক্ষতাকে প্রহসনে পরিণত করেছে মেকি ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি

ইদানীং একটা কথা খুব প্রচার হচ্ছে যে ভারত হলো সেকুলার দেশ। বারবার উঠে আসছে সংবিধান প্রণেতা ড. আম্বেদকরের কথা। আরও প্রচারিত হচ্ছে বর্তমান শাসন ব্যবস্থায় সরকার সেকুলার ভারতের টুটি টিপে ধরতে উদ্যত। গোয়েবলসীয় প্রচারের কায়দায় মানুষের মনে বিশেষ করে তরুণ সমাজের মধ্যে এমন একটা ধারণা গেঁথে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে যেন ভারত নামক দেশটি স্বাধীনতার পর পরই বা সংবিধান রচনাকালেই ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার ছিল। রাজনৈতিক কূটকৌশল বাদ দিলেও বর্তমান সময়ে আসল সত্যটা তুলে ধরা খুবই জরুরি। উল্লেখ্য, ১৯৪৯ সালের ২৬ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হওয়ার পর ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি থেকে আমাদের নিজস্ব সংবিধান কার্যকরী হয়। সেই সংবিধানের কোথাও ভারতকে ধর্মনিরপেক্ষ বা সেকুলার বলা হয়নি। সংবিধান প্রণয়নের ২৬ বছর বাদে ১৯৭৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী অনৈতিকভাবে ভারতের সংবিধানে ৪২ তম সংশোধনীর মাধ্যমে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ কথাটি যুক্ত করেন।

এখন প্রশ্ন হলো, অনৈতিকভাবে কথাটা বলা হচ্ছে কেন? যদি আমরা পিছন ফিরে তাকাই, দেশে তখন এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি। ১৯৭৫-এর ১২ জুন এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ে ইন্দিরা গান্ধী নির্বাচনে দুর্নীতির অপরাধে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন এবং ৬ বছর পার্লামেন্টারি রাজনীতি থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন। এই রায়ের প্রেক্ষিতে দেশব্যাপী জয়প্রকাশ নারায়ণ, মোরারজী দেশাই, অটলবিহারী বাজপেয়ী, চৌধুরী চরণ সিংহ, প্রফুল্ল সেন প্রমুখ বিরোধী নেতারা এক দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলেন। আন্দোলন যত প্রসারিত হতে থাকে তত ইন্দিরা গান্ধী ক্ষমতা হারাবার ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে পড়েন এবং একনায়কতন্ত্রী মনোভাব তার মধ্যে প্রবল হতে থাকে। ক্ষমতা ধরে রাখতে তার পরামর্শে তদানীন্তন রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদ ২৫ জুন, ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত ২১ মার্চ ২১ মাসব্যাপী ভারতে জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেছিলেন। এই জরুরি অবস্থা ভারতবর্ষের মানুষের রাজনৈতিক, গণতান্ত্রিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এমনকী সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মানুষের কথা বলার অধিকারকে পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে হরণ করেছিল। তাই ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাসে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী প্রবর্তিত জরুরি অবস্থা ভারতের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত অধ্যায়।

Maintenance of Internal Security Act অর্থাৎ মিসা (বিনা বিচারে যে কোনো ব্যক্তিকে জেলে পুরে রাখার জন্য নতুন করে মিসা অর্ডিন্যান্স হিসেবে চালু হয়েছিল) প্রয়োগ করে সমস্ত বিরোধী রাজৗনতিক নেতা তথা শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ-সহ সমস্ত প্রতিবাদী মুখকে কারান্তরালে পাঠিয়ে

দেন। এই সময় তিনি ক্ষমতার দম্ভে এবং নিজের অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রাখার জন্য মুসলমানদের ভোটব্যাঙ্কে পরিণত করার প্রয়াসে, ১৯৭৬ সালে বিরোধী শূন্য গণপরিষদে ৪২ তম সংবিধান সংশোধনীর দ্বারা ভারতবর্ষকে সেকুলার বা ধর্মনিরপেক্ষ দেশের তকমা দেন। রাতারাতি ভারতবর্ষ হয়ে গেল ধর্মনিরপেক্ষ দেশ।

ভণ্ড ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দলগুলি এরপর থেকে রাজনৈতিক সুবিধা লাভের আশায় এবং ভোটব্যাঙ্ক তৈরি করার জন্য এই ব্যবস্থাকে সমর্থন করতে শুরু করে। কংগ্রেস, কমিউনিস্ট, সমাজবাদী, থেকে আরম্ভ করে। সমস্ত রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায় কে কত বড়ো সেকুলার। ওই সব দলের মুখ্য উদ্দেশ্যই হলো যে কোনো ভাবেমুসলমান সংখ্যালঘু ভোটকে নিজের দলে কুক্ষিগত করা।

বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে নাগরিকত্ব আইন বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি আখের গোছাবার আশায় ভারতীয় গণপরিষদে গণতান্ত্রিক নিয়ম কানুনের মধ্যে দিয়ে তৈরি করা আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে মারদাঙ্গা, সরকারি সম্পত্তির ভাঙচুর, লুটপাট এবং জ্বালিয়ে দেওয়ার প্ররোচনা দিয়ে চলেছে, যা একপ্রকার গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার শামিল।

এখানে একটা কথা না বললেই নয়, ১৯৫০ সালে স্বাক্ষরিত নেহরু-লিয়াকত চুক্তি ভারতের সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দিতে পারলেও পাকিস্তান ব্যর্থ হয়। তাই কোনো দেশকে যদি সত্যিকারের ধর্মনিরপেক্ষ হতে হয় তাহলে তার প্রতিবেশী দেশকেও ধর্মনিরপেক্ষ হতে হবে, নচেৎ ধর্মনিরপেক্ষ ভাবনাটাই প্রহসনে পরিণত হয়।

ডাঃ বলরাম পাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.