স্বাধীনতার ৭২ বছর পর গত ৫ আগস্ট, ২০১৯-এ ভারত সরকারের ৩৭০ ধারা বাতিলের সিদ্ধান্ত শুধু ঐতিহাসিকই নয়, অখণ্ড ভারত চেতনার ক্ষেত্রেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এত দীর্ঘদিন ধরে এই ব্যবস্থা চালু রেখে সব থেকে বেশি ক্ষতি করা হয়েছে। কাশ্মীরের বাসিন্দাদের, বিশেষত কাশ্মীরের সংখ্যালঘু সমাজের হিন্দু, শিখ ও বৌদ্ধদের। এই ধারার কারণে দেশের ভিতর আর একটা দেশের মতো যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তা অনাদিকাল ধরে চলতে পারে না। কাশ্মীরি বংশোদ্ভূত রাজনৈতিক ভাষ্যকার শ্রীমতী সুনন্দা বশিষ্ঠ আমেরিকার সংসদীয় প্যানেলে বলার সুযোগ গ্রহণ করে যথার্থই বলেছেন— “There is no Kashmir without India and there is no India without Kashmir”. সংসদে ৩৭০ ধারা বাতিল ও কাশ্মীর পুনর্গঠন বিল গৃহীত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়াত বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ প্রধানমন্ত্রী শ্রীমোদীকে অভিনন্দন জানিয়ে টুইটে লিখেছিলেন, ‘ধন্যবাদ প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। সারা জীবন ধরে এটা দেখার জন্যই অপেক্ষায় ছিলাম। আর প্রাক্তন বিচারপতি চিত্ততোষ মুখোপাধ্যায়ের ব্যক্তিগত অনুভূতি—এতদিনে মেজোকাকার স্বপ্ন পূর্ণ হলো। মেজোকাকা মানে ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়।
সেই প্রাচীনকাল থেকেই কাশ্মীর ভারতের অঙ্গরাজ্য। ঋষি কশ্যপের নামানুসারে এই কাশ্মীর। কশ্যপ ও কদ্রুর নাগ সন্তানদের স্মৃতি এখনও রক্ষা করছে অনন্তনাগ, ভেরীনাগ ও শেষনাগ। কাশ্মীর বলতে বোঝায় ভারতের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে অবস্থিত বর্তমান কাশ্মীর, উপত্যকা, জম্মু, গিলগিট – বালতিস্তান, আকসাই চীন, অধিকৃত কাশ্মীর কারাকোরাম অঞ্চল এবং লাদাখ। পাকিস্তান এবং চীনের অবৈধভাবে অধিকৃত স্থান ছাড়াও বাকি প্রদেশের ভৌগোলিক ক্ষেত্রফল যথাক্রমে কাশ্মীর উপত্যকা ১৫,৮৫৩ কিমি, জম্মু-২৬,২৯৩ কিমি. এবং লাদাখ ৫৯,২৪১ কিমি। ক্ষেত্রফলের বিচারেও কাশ্মীর উপত্যকা রাজ্যের তিনটি ভাগের মধ্যে সব থেকে ছোটো। কাশ্মীর উপত্যকা মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ। যদিও এখানে হিন্দু পণ্ডিতেরাও বসবাস করতেন। জম্মু বর্তমানে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ। আর লাদাখ বৌদ্ধ অধ্যুষিত।
কাশ্মীরের মোট জনসংখ্যা ১ কোটি ২৫ লক্ষ (২০১১)।
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে কাশ্মীরে ইসলামের প্রবেশ ঘটে। ১৩৩৯ খ্রিঃ কাশ্মীরে প্রথম মুসলমান শাসক শালমির। পাঁচশো বছর এখানে ইসলামি শাসন ছিল। রণজিৎ সিংহের নেতৃত্বে শিখরা কাশ্মীর দখল করে নেয়। (১৫.০৭.১৮১৯)। এরপর ইংরেজরা কাশ্মীর দখল করে নেয় (১৮৪৬)। তার পর ইংরেজদের কাছ থেকে গুলাব সিংহ অমৃতসর চুক্তির (০৯.০৩.১৮৪৬) মাধ্যমে কাশ্মীর। কিনে নেন। এরপর চলতে থাকে তাদের বংশধরদের রাজত্ব। স্বাধীনতার প্রাক্কালে এখানকার রাজা ছিলেন হরি সিংহ (১৯২৫-১৯৪৭)। প্রধানমন্ত্রী ছিলেন মেহেরচঁাদ মহাজন। হরি সিংহ স্বাধীন ডোমিনিয়নের (স্বাধীন কাশ্মীর) পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান কাশ্মীর দখলের চেষ্টা করলে হরি সিংহ ভারতীয় সেনার সাহায্য চাইলেন এবং জওহরলাল নেহরুর শর্ত মেনে ologfoor gioco (Instrument of accession) স্বাক্ষর করলেন। অন্যদিকে ন্যাশনাল কনফারেন্সের প্রতিষ্ঠাতা ও ‘মহারাজা কাশ্মীর ছাড়ো’আন্দোলনের প্রবক্তা শেখ আবদুল্লা কাশ্মীরের ভারতভুক্তির পক্ষে থাকলেও আসলে চেয়েছিলেন যে ভারতের ভিতরে থেকে কাশ্মীর কার্যত একটি ইসলামিক প্রজাতন্ত্রই হয়ে উঠুক। আর এই কারণেই হিন্দু অধ্যুষিত জম্মুতে ডোগরা সম্প্রদায়ের উপর অকথ্য অত্যাচার শুরু হয়। প্রতিবাদে প্রেমনাথ ডোগরার নেতৃত্বাধীন প্রজা পরিষদ আন্দোলন শুরু করে। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত নেহরু এইসব দেখেশুনেও নীরব রইলেন এবং তারই সক্রিয় সহযোগিতায় আবদুল্লার ইচ্ছা অনুসারে ১৯৪৯ সালের ১৭ অক্টোবর সংবিধানের ৩৭০ ধারা সংযোজন করলেন। ঘটনা হলো ১৯৪৮-এর ৪ মার্চ এই শেখ আবদুল্লাকেই কাশ্মীরের প্রধান প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করতে বাধ্য হয়েছিলেন মহারাজা হরি সিংহ।
৩৭০ ধারার শর্ত মেনে কাশ্মীরের জন্য স্বতন্ত্র সংবিধান স্বতন্ত্র বিচার ব্যবস্থা ও স্বতন্ত্র পতাকার ব্যবস্থা হলো। অর্থাৎ একই দেশে দুই সংবিধান বা দুই বিধান জারি হলো। পৃথক সেনাবাহিনীর দাবি করা হলে নেহরু অবশ্য চক্ষুলজ্জার খাতিরে তা মেনে নিতে পারেননি। এই প্রসঙ্গে B. N. Mullick তার My years with Nehru: 1948-1964’ -এর স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লিখেছেন, “then suddenly in our utter surprise Nehru started talking bitterly against Sheik Abdulla communalism.” কিন্তু তখন তো যা ঘটবার তা ঘটে গেছে।
এই সাম্প্রদায়িকতার বিষ বহন করে নিয়ে চলেছিলেন শেখ পুত্র তথা পরবর্তীকালে জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী ফারুক আবদুল্লা। ১৯৮৯ সালের আগস্ট থেকেই শুরু হয় কাশ্মীরি পণ্ডিতদের উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার। ১৯৯০-এর ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার রাতে। মাইকে ঘোষণা করে পরিবারের মেয়েদের বাড়িতে রেখে কাশ্মীর পণ্ডিতদের চলে যেতে বলা হলো। ওই দিনের পর থেকেই উপত্যকা ছাড়তে শুরু করেন কাশ্মীরের লক্ষ লক্ষ ভূমিপুত্র পণ্ডিত।৩ লক্ষ ৫০ হাজারেরও বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিত নিজ দেশেই পরবাসী হলেন। ১২০০-র বেশি কাশ্মীরি পণ্ডিতকে (এদের মধ্যে কিছু সংখ্যক শিখও আছেন) হত্যা করা হয়। এইসব শরণার্থীদের জম্মুর উপকণ্ঠে বিভিন্ন শিবিরে থাকতে বাধ্য করা হয়। জম্মুর লাগোয়া পুরখুতে এইরকম এক শিবিরে নিজের চোখে এদের নির্যাতিত জীবনের ছবি দেখে এসেছি। এইসব ত্রাণশিবিরে প্রায় গোরু-ছাগলের মতো তারা জীবন যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন। তিরিশ বছর পার হয়ে। গেলেও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের সমস্ত রকম নিরাপত্তা সহকারে উপত্যকায় পুনর্বাসনের ব্যবস্থা এখনও হয়নি। সেইক্ষণে দেখা একটা সামান্য দৃশ্য মনে পড়ছে। দশ-বারো বছরের সাত-আটজন বালক একটা দোলা কাঁধে নিয়ে নেচে গেয়ে তঁাবুগুলোর চারদিকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কৌতুহলী দৃষ্টিতে তাকালে উপস্থিতজনরা জানালেন —সামনেই জন্মাষ্টমী। তাই শ্রীকৃষ্ণের পুতুল নিয়ে এরা খেলছে। সামান্য ঘটনা, কী অসামান্য প্রকাশ! এত কষ্টের মধ্যেও নিজেদের পরম্পরাকে ধরে রাখার চেষ্টা মনকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
৩৭০ ধারা বাতিলের পর জম্মু-কাশ্মীরে কিছু পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেলেও এখনও কাশ্মীরি পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের কোনো বিশেষ প্রয়াস লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। যদিও গত তিরিশ বছর ধরে উদ্বাস্তু জীবনযাপনের পর এখন আশা জেগেছে যে তাঁরা আবার নিজেদের বাসভূমিতে ফিরে যেতে পারবেন। কিন্তু ঘটনা হলো পণ্ডিতদের পুনর্বাসনের বিষয়ে তেমন কোনও সোচ্চার দাবি লক্ষ্য করা যাচ্ছে না। কেন্দ্রীয় সরকারকেও এই বিষয়ে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিপরিষদের একটি প্রতিনিধি দল সম্প্রতি কাশ্মীর সফরে গিয়েছেন। তাদেরও এই বিষয়টি দেখতে হবে যাতে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থকরা স্পষ্ট বুঝতে পারে যে তাদের ডাল আর এখন সহজে গলবে না। যদিও এই অঞ্চলের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জেহাদিরা কিন্তু থেমে নেই।
স্বাধীনতার পর ৭২ বছর ধরে নেহরুবাদী কংগ্রেসি নীতি অনুসরণ করে কাশ্মীর সমস্যার কোনো সমাধান করা যায়নি। কংগ্রেস ও বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনে জয়লাভের মূল রসায়ন নিহিত ছিল মুসলমান তোষণের উপর। অথচ বাস্তবে দেখা গিয়েছে সারা দেশে কংগ্রেস ও কিছু রাজ্যে দীর্ঘদিন বামশাসনের পরও সাধারণ মুসলমানরা যে তিমিরে ছিলেন, সেই তিমিরেই রয়ে গিয়েছেন। উপকৃত হয়েছেন আলখাল্লাধারী কিছু ধর্মীয় নেতা। অযথা মুসলমান তোষণ এই দলগুলোর প্রতি হিন্দু সমাজকে বীতশ্রদ্ধা। করে তোলে। বিজেপি কোনওদিনই মুসলমান তোষণের রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। তারা প্রথম থেকেই ৩৭০ ধারা বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে। এক নিশান, এক বিধান, এক প্রধানের দাবিতে কাশ্মীরে গিয়ে দলের প্রতিষ্ঠাতা ড. শ্যামাপ্রসাদমুখার্জি আত্মবলিদান দিয়েছেন। নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার মুসলমান সমাজকে দেশের মূলস্রোতে যুক্ত করার জন্য বেশ কিছু পদক্ষেপ করেছে। দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে মোদী সরকার রাজ্যসভায় সংখ্যাগরিষ্ঠনা হওয়া সত্ত্বেও তিন তালাক রদ করতে সমর্থ হয়।
মুসলমান সমাজকে মূলস্রোতে শামিল করানোর ক্ষেত্রে সংবিধানের ৩৭০ ধারা বাতিল একটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। এই ধারা বাতিলের সঙ্গে সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীর দুটি পৃথক কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে বিভক্ত করা হলো—(১) জম্মু-কাশ্মীর ও (২) লাদাখ। আগে এই রাজ্যের যে বিশেষ মর্যাদা ছিল তা আর রইল না। পৃথক পতাকাও থাকবে না। এখন থেকে ৩৬০ ধারা অর্থাৎ অর্থনৈতিক জরুরি অবস্থা জারি করা যাবে। সাধারণ জরুরি অবস্থা অর্থাৎ ৩৫৬ ধারাও এখন প্রযোজ্য হবে। ৩৭০ ধারা বাতিল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ৩৫এ ধারাও অকেজো হয়ে গেল। ফলে ভিন্ন রাজ্যের বাসিন্দারাও জমি কিনতে পারবেন। যা তাঁরা আগে পারতেন না। সেখানে বিনিয়োগের দরজা এক ধাক্কায় খুলে যাবে। অমুসলমান অর্থাৎ হিন্দুদের জন্য চাকরি ও শিক্ষায় সংরক্ষণ ছিল না। এখন হিন্দু শিখ-বৌদ্ধরা সংরক্ষণের আওতায় আসবেন। বিধানসভার মেয়াদ ৬ বছর থেকে কমিয়ে অন্যান্য রাজ্যের মতো ৫বছর করা হলো। এবার থেকে তথ্যের অধিকার আইন কার্যকর হবে। পৃথক দণ্ডবিধির। পরিবর্তে এবার ভারতীয় দণ্ডবিধি লাগু হবে এবং ইতিমধ্যে তা হয়েছেও।
বস্তুত ৩৭০ ও ৩৫এ-র মতো ধারা জম্মু-কাশ্মীরে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে পাহাড় প্রমাণ বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কাশ্মীরিয়ত ও আঞ্চলিক সংস্কৃতির নামে রাজ্যের সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু সমাজকে অবহেলা ও বঞ্চনা করা হচিছল। কাশ্মীরিয়ত রক্ষার অজুহাতে উপত্যকার রাজনীতির কারবারিরা বাইরের । কোনো বিষয় বা ব্যবস্থাকে আমল দেয়নি। রাজ্যের উন্নয়নের জন্য কেন্দ্র যে বিপুল অঙ্কের টাকা সাহায্য হিসেবে পাঠিয়েছে তাও রাজ্যের কয়েকটি পরিবার ও শাসকদলের নেতারাই উদরস্থ করেছেন। রাজ্যের দরিদ্র ও প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই থেকে গেছেন। পার্মানেন্ট রেসিডেন্ট সার্টিফিকেট (পি আর সি)-এর আওতায় যেসব অবহেলিত মানুষ, যেমন তপশিলি জাতি, তপশিলি উপজাতি ও অন্যান্য পিছিয়ে। থাকা শ্রেণী (ওবিসি)-কে জম্মু-কাশ্মীর সরকার যে বিশেষ সুবিধা দেওয়ার ছাড়পত্র দিয়েছিল আসলে তা অন্য রাজ্যের সাধারণ মানুষ যেসব সুযোগ সুবিধা ভোগ করেন তার বেশি কিছু নয়। পাক অধিকৃত কাশ্মীর থেকে যে ৪৩০০ হিন্দুপরিবার মহারাজা হরি সিংহের আমল থেকেই বসবাস করছেন, শরণার্থী হিসেবে রয়েছেন, তাদেরও এই বিশেষ সুবিধা। আইনের আওতায় আনা হয়নি। ১৯৫৭ সালে পঞ্জাব থেকে ২০০ বাল্মীকি পরিবারকে সাফাই কর্মচারী (ঝাড়ুদার) হিসেবে জম্মু-কাশ্মীর সরকার নিয়ে এসেছিল। তারা ৬০ বছর পরেও সাফাই কর্মচারীই রয়ে গিয়েছেন। তাদের ছেলে-মেয়েরা সরকার পরিচালিত কোনো স্থানে ভর্তি হতে পারে না। বাল্মীকি পরিবারের শিক্ষিত যুবকেরা শুধু ঝাড়ুদার পদের জন্যই আবেদন করতে পারে। দেশভাগের কারণে ১৯৪৭ সালে যারা এসেছিল তারা এখনও এই রাজ্যে ওয়েস্ট পাকিস্তানি রিফিউজিজ এবং ত্রাণশিবিরে ক্রীতদাসের মতো বাস করতে বাধ্য হচ্ছে। এরাজ্যে এক লক্ষেরও বেশি বসবাসকারী গোর্খাদের অবস্থাও একই রকম। অথচ এরাই দেশের সুরক্ষার জন্য কখনও আত্মবলিদান দিতে পিছপা হয়নি। সামরিক বাহিনীর সর্বোচ্চ মর্যাদা পরম বীর চক্র’ (পিভিসি) যাঁরা পেয়েছেন, এমন ২১ জন সেনা পরিবারকে তাদের পুনর্বাসনের জন্য একখণ্ড জমিও দেওয়া হয়নি। এমনই এই রাজ্যের আইন! গত ৩০/৩২ বছর ধরে যেসব সেন্ট্রাল সিভিল সার্ভিস কর্মচারী জম্মু-কাশ্মীরে কর্মরত ছিলেন, অবসরের পর তাদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের অনুমতি দেওয়া হয়নি। সংখ্যালঘু হওয়ার কারণেই তাদের এই ললাট লিপি। আর লাদাখের ভাগ্য নির্ভর করেছিল উপত্যকার ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতাদের খেয়ালখুশির উপর। শুনলে আশ্চর্য হতে হবে লাদাখে হাইস্কুল শুরু হয় ১৯৭৩ সালে আর লাদাখের জন্য ‘অটোনমাস হিলস কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা হয় ১৯৭৫ সালে। অথচ আমাদের দেশের অখণ্ডতা রক্ষার ক্ষেত্রে লাদাখ অত্যন্ত স্পর্শকাতর অঞ্চল। পাকিস্তান ও চীন এই দুই দেশের সঙ্গেই লাদাখের সীমান্ত রয়েছে। ১৯৪৮ সালে লাদাখে প্রথম বিমানঘাঁটি তৈরি হয়। পাক অধিকৃত বালতিস্থান থেকে সাহসী লাদাখিরা ৮০০ বর্গ কিলোমিটার এলাকা উদ্ধার করে। সিল্ক রুট (Silk Route) অর্থাৎ কারাকোরাম হাইওয়ে যা লে’র মধ্য দিয়ে। গিয়েছে তা খান্ডালা বন্দরের সঙ্গে যুক্ত হতে পারে। স্বাধীনোত্তর কালে জম্মু-কাশ্মীরে শাসকেরা সেখানকার সংখ্যালঘু সমাজ অর্থাৎ হিন্দু-বৌদ্ধ-শিখ-খ্রিস্টান সমাজকে কখনও ভালো চোখে দেখেনি। কখনও কখনও যেসব ভালো কথা এদের সম্বন্ধে বলেছে, তা অনেকটা মন্দের ভালো। ইংরাজিতে যাকে foxymoronic Expressions’ 26071 যেমন, ওনলি চয়েস, ওপেন সিক্রেট, অনেকটা সেইরকম। জম্মু-কাশ্মীরের মুখ্যমন্ত্রী মেহবুবা মুফতির একটা ট্যুইটে এই ভাবনারই প্রকাশ দেখি। তিনি টুইটে লিখেছেন— “What was done to Kashmiri Pandits was very wrong. But does it justify what being done to Kashmiri Muslims today? The present Kashmiri youth were not even born then. To blame them would be like blaming the present Germans for what the Nazis did to the Jews in the 1930s and 40s.”
জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখের উন্নয়নে ৩৭০ ধারা বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের মদতদাতারা রাজ্যবাসীকে বারবার ভুল পথে চালিত করছিল। এই ধারা বাতিলের ফলে রাজ্যের সকলেই সমান অধিকার পেল। তাই এখন নতুন জম্মু ও কাশ্মীর গড়ে তোলার জন্য ভিত গড়ার কাজ শুরন করতে হবে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, সংবিধানের ৭০ বর্ষ পালন উপলক্ষ্যে বর্তমান কেন্দ্র সরকার মৌলিক অধিকারের পাশাপাশি ডাইরেক্টিভ প্রিন্সিপ্যাল অর্থাৎকর্তব্য পালনের প্রতিও আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। তাই রাজ্যের সংখ্যালঘুরা এখন যেমন কিছু অধিকার লাভ করেছে, ঠিক তেমনই তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যও বেড়েছে। জম্মু ও কাশ্মীরের ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার জন্য যেমন দূরদৃষ্টি ও প্রস্তুতি প্রয়োজন, তেমনই বর্তমানে যে অসংখ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে হচ্ছে, সেই বিষয়গুলির প্রতিও সচেতন থাকতে হবে। আজকের বিশ্ব পরিস্থিতিতে ভারতবর্ষকে এক সচেতন সমাজ (Knowledge society) হিসেবে গড়ে তোলার জন্য অন্যান্য রাজ্যের সঙ্গে জম্মু-কাশ্মীরকেও হাত মেলাতে হবে। জম্মু-কাশ্মীরে সংখ্যালঘু অর্থাৎ মূলত হিন্দুসমাজ এতদিন যে সুযোগ পায়নি, সেই সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবে এটাই কাম্য।
এই কর্তব্যকর্মে প্রথম প্রয়োজন নবীন প্রজন্মকে কাশ্মীরের মূল শিকড়টি চেনানো। এখন সেখানকার সরকারি কলেজগুলিতে শিক্ষকদের ইতিহাসের পাঠ্যসূচির সেই অংশটি পড়াতে নিষেধ করা হয়েছে যেখানে ডোগরা রাজত্বের কথা লেখা আছে। ইতিহাস পুনর্নির্মাণের নামে হিন্দুধর্ম ও কাশ্মীরি হিন্দুদের বিষয়গুলি পরিকল্পিতভাবে মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে। কাশ্মীরের শিক্ষা ব্যবস্থা পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে স্বশাসিত স্কুলগুলির থেকে সরকারি স্কুলগুলিই সন্ত্রাস ও বিচ্ছিন্নতাবাদের দ্বারা বেশি প্রভাবিত। তারাই বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ধর্মীয় মৌলবাদীদের সরাসরি সমর্থন করে। কাশ্মীরি হিন্দুরাই উপত্যকার মূল অধিবাসী এবং তাদের পূর্বপুরুষেরা যে সংস্কৃতি সৃষ্টি করেছে তা ভারতের সাংস্কৃতিক মূল্যবোধেরই অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। জেহাদিরা উপত্যকা থেকে বর্তমানে সংখ্যালঘু অর্থাৎ মূলনিবাসী এই হিন্দুসমাজকে সম্পূর্ণভাবে মূলোচ্ছেদ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এই অপপ্রয়াস রুখতেই হবে। কেননা কাশ্মীর ছাড়া ভারত অসম্পূর্ণ। হিন্দুদের নিজস্ব বাসভূমিতেই তাদের পুনর্বাসন দিতে হবে। এই প্রচেষ্টায় অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে উচ্ছেদ হওয়া পরিবারগুলিকে। ভারতের অন্যস্থানে তারা বসবাস বা জীবিকার সন্ধান করতেই পারে। কিন্তু তাদের পুরানো সম্পত্তি উদ্ধার করতেই হবে। এটাই প্রথম কাজ।
একইসঙ্গে পাকিস্তানি অপপ্রচার ও অপপ্রয়াসও প্রতিরোধ করতে হবে। জেহাদের কথা প্রচার করে পাকিস্তান একদিকে যেমন উপত্যকার মানুষকে বিভ্রান্ত করছে, অন্যদিকে প্রশিক্ষিত জঙ্গিদের পাঠিয়ে ভারতীয় নিরাপত্তা কর্মীদের পাশাপাশি সাধারণ নিরীহ মানুষকেও হত্যা করছে। ভারতের বাকি ৫৬০টি দেশীয় রাজ্যের ভারতভুক্তি যেমন আইনত সিদ্ধ ও অপরিবর্তনীয়, তেমনই মহারাজা হরি সিংহের স্বাক্ষরিত ভারতভুক্তিও (Instrument of Accession) আইনত সিদ্ধ ও অপরিবর্তনীয়। ৩৭০ ও ৩৫এ ধারা সাময়িক সাংবিধানিক শর্ত মাত্র। পাকিস্তানের সব ধরনের ভারতবিরোধী ষড়যন্ত্রকে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। আর এই কাজে উপত্যকার সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দুসমাজকেই এগিয়ে আসতে হবে। কেননা তারা ঘরপোড়া গোরু। আর এটাই এখন তাদের আশু কর্তব্য।
ভারতভুক্তি দিয়ে যে যাত্রা শুরু হয়েছিল, কাশ্মীরকে ভারতের সঙ্গে সংহত (Integration) করার মধ্য দিয়েই তা সম্পূর্ণ হতে পারে। জম্মু-কাশ্মীর ও লাদাখ ভারতমাতার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। মহাঋষি কশ্যপ বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে যেশান্তির বাণী উচ্চারণ করেছিলেন সিন্ধু ও ঝিলমের জল আজও তার সাক্ষী হিসেবে কুলকুল করে বয়ে চলেছে। মহাঋষি কশ্যপের উত্তরসূরী বর্তমানে কাশ্মীর উপত্যকার সংখ্যালঘু হিন্দুসমাজ সিন্ধু ও ঝিলমের নির্মল অবিরল ধারা বহমান রাখবে—এটাই এখন তাদের কাছে চ্যালেঞ্জ এবং কর্তব্যও।
বিজয় আঢ্য