হোগলা বনের হুগলি

নোনা জলের গাছ হোগলা। বৈজ্ঞানিক নাম “Typha.” হোগলা গাছ মাটির ওপরে ৭৬ থেকে ৯০ ইঞ্চি লম্বা হয়। প্রস্থ হয় ১ ইঞ্চি। শেকড় মাটিতে থাকে ১০/১২ ইঞ্চি। গোঁড়ার দিকের শিকড় খানিকটা কচু গাছের মতো।
নদীর দু’ধারে জন্মায় হোগলা গাছ। বিনা পরিশ্রমেই মানুষ হোগলা গাছ পেয়ে থাকে। এটি গ্রামীণ পরিবেশে জন্মানো একটি পাতাসর্বস্ব গাছ। জুলাই-আগস্ট মাসে এই গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করা হয় এবং মাদুর তৈরি হয়।
এছাড়া হোগলা পাতা থেকে তৈরি হয় পুষ্টিগুণে ভরপুর মিষ্টি গুড়। এছাড়াও হোগলা ফলের তুলো থেকে তৈরি হয় নরম তুলতুলে বালিশ‌।

ইওরোপে তিন হাজার বছর আগে হোগলা গাছের কন্দ ও পরাগ রেণু খাদ্য হিসেবে ব‍্যবহৃত হতো।
এর পাতা দিয়ে একসময় বাঙালির বিয়েবাড়ি থেকে শ্রাদ্ধবাড়ির ম‍্যাড়াপ তৈরি হতো। তখন আজকের মতো রঙবাহারি প‍্যাণ্ডেলের জন্ম হয়নি। এছাড়াও হোগলা দিয়েই তৈরি হতো গরীব বাঙালির বাড়ি।
দক্ষিণ বাঙলার নোনা জলে একসময় আপনা থেকেই এই হোগলা গাছ জন্মাতো। ইংরেজ আমলে অখণ্ড বাঙলার খুলনা, চব্বিশ পরগণা ও মেদিনীপুর ছিল হোগলা বনে ভর্তি। খুলনা তখন ছিল যশোরের অন্তর্গত, চব্বিশ পরগণা ছিল নদীয়ার অন্তর্ভুক্ত। আর মেদিনীপুরের তখন নাম ছিল “হিজলি।”
দক্ষিণ বাঙলার বণিকরা যখন সমুদ্রযাত্রায় যেতেন, তাদের সঙ্গে থাকতো মাটির জালা ভর্তি জল আর এই হোগলার বাণ্ডিল। ভিন্ দেশের মাটিতে এই হোগলা দিয়েই তৈরি হতো তাঁদের সাময়িক ছাউনি।

প্রাচীনকালে বাঙালির নৌসেনা বেশ শক্তিশালী ছিল। বরেন্দ্রভূমির কৈবর্তরা ছিল দক্ষ নৌসেনা।
এই হোগলা গাছকে বাঙালি জলযুদ্ধের কাজে ব‍্যবহার করতো। মেদিনীপুর অঞ্চলে “বেরা” পদবির মানুষেরা ছিলেন বড়ো বড়ো হোগলা বনের মালিক। জলযুদ্ধে এই হোগলা গাছের বেড়া দিয়ে এলাকা ঘিরে ফেলে ব‍্যুহ তৈরি করা হতো। আর যুদ্ধের সময় যাঁরা “বেড়া” তৈরির কাজে দক্ষ ছিলেন, তাঁদের পদবি হয়ে যায় “বেরা।”
অন্যদিকে, যাঁরা জলযুদ্ধে দক্ষ হতেন, তাঁদের বলা হতো “দহিন্দা।” এই “দহিন্দা” থেকে এসেছে পদবি “দিন্দা।”
শুধু তাই নয়, হোগলা বনের প্রাচুর্যের জন্য কিছু কিছু এলাকার নাম হয়ে গেছে “হুগলি।” আজকের জেলা হুগলি তার প্রমাণ। এই হুগলি জেলা ছাড়াও হোগলা বনের নামে স্থানের নাম হয়েছে “বন হুগলি।” এছাড়াও মেদিনীপুর-বালাশোর সংযোগস্থলে সুবর্ণরেখা নদীর মোহনায় রয়েছে আরেকটি “হুগলি।”

এখানে রয়েছে বিখ্যাত চন্দনেশ্বর মন্দির , যেটি হুগলি-চন্দনেশ্বর নামে অনেকের কাছে পরিচিত।
শিয়ালদহ-নামখানা লাইনে ভারতীয় রেলের একটি রেলওয়ে স্টেশন রয়েছে দক্ষিণ চব্বিশ পরগণায়, নাম—“হোগলা।”
হোগলা থেকে বাদ যায়নি সুন্দরবনের বাঘ। সুন্দরবনের মোটা কেঁদো বাঘকে তাই বলা হয় “হোগলা বনের বাঘ।”
সব মিলিয়ে বাঙালির কাছে একসময় অতি আপন ছিল এই হোগলা গাছের বন। বাঙালির উৎসবের ম‍্যাড়াপ, জলযুদ্ধ, পদবি, স্থাননাম থেকে সুন্দরবনের বাঘের নামের উৎসেই তার প্রমাণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.