নরমপন্থী কংগ্রেসিদের নেতা গোপালকৃষ্ণ গোখলে ইংরেজ শাসকদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে গান্ধীজীকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসে কংগ্রেসের হাল ধরার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। গান্ধীজী দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ভারতে এসেছিলেন ১৯১৫ সালের জানুয়ারিতে। তিনি গুজরাটের সবরমতীতে সত্যাগ্রহ আশ্রম তৈরি করে অহিংসা সত্যাগ্রহের পাঠ দিতে আরম্ভ করলেন। তিনি শিক্ষা দিতেন সত্যাগ্রহীরা মার খেয়ে মরে যাবে কিন্তু কাউকে মারতে পারবেনা।তিনি ক্ষুদিরাম, ভগৎ সিংহের মতো বিপ্লবীদের বিপথগামী বলতেন এবং তাদের কাজকে তীব্র নিন্দে করতেন।
ইংরেজের বিরুদ্ধে তিনি প্রথম সর্বভারতীয় আন্দোলন আরম্ভ করেছিলেন ১৯১৯ সালে কুখ্যাত রাউলাট অ্যাক্টের প্রেক্ষিতে জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের পরে। সেই আন্দোলন তিনিমাঝপথেই বন্ধ করে দিয়েছিলেন উত্তরপ্রদেশের চৌরিচৌরাতে সত্যাগ্রহীরা হিংসার আশ্রয় নিয়েছে এই অজুহাতে। কংগ্রেসের আন্দোলনের সঙ্গে খিলাফতকে জুড়ে দিয়ে তিনি মুসলমান তোষণের বিষবৃক্ষটি কংগ্রেসের মধ্যে রোপণ করেছিলেন। এই সাম্প্রদায়িক আন্দোলনকে মদত দিতে বারণ করেছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, লালা রাজপত রায়, মদনমোহন মালব্য, চিত্তরঞ্জন দাস, বিপিন চন্দ্র পাল প্রমুখ ব্যক্তিত্ব; কিন্তু গান্ধীজী কর্ণপাত করেননি। তিনি হিন্দুদের মধ্যে গ্রহণযোগ্য হলেও মুসলমানরা তাকে নেতা হিসেবে গ্রহণ করেনি সেজন্য তিনি মুসলমান তোষণের রাস্তা নিয়েছিলেন। হঠাৎ এই আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়ায় মুসলমানরা মনে করল হিন্দুরা চক্রান্ত করে তাদের ‘খিলাফত’আন্দোলন ব্যর্থ করে দিয়েছে; মুসলমানদের রাগ গিয়ে পড়ল হিন্দুদের ওপর। ভারতের বিভিন্ন জায়গায় দাঙ্গা আরম্ভ করে দিল তারা। সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটে দক্ষিণ ভারতের মালাবারে। সেখানে মোপালা মুসলমানরা হাজার হাজার হিন্দুর ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়, হিন্দুদের হত্যা করে, হিন্দুমা-বোনেদের ইজ্জত নষ্ট করে। কিন্তু গান্ধীজী মোপালাদের নিন্দে করেননি, বরং তাদের ধর্মপ্রাণ মুসলমান বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। আব্দুল রশিদ নামে এক মুসলমান স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দকে হত্যা করে। এ ব্যাপারেও গান্ধীজী আব্দুল রশিদের কোনো দোষ দেখতে পাননি; স্বামী শ্ৰদ্ধানন্দ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেছিলেন, এই ছিল তার মত। আন্দোলনের এরকম বিয়োগান্ত পরিসমাপ্তিতে গান্ধীজী কিছু সময় চুপচাপ থাকলেন। ১৯২৭-২৮ সালে সাইমন কমিশনকে নিয়ে দেশ উত্তাল হয়ে উঠলে আবার আসরে অবতীর্ণ হলেন। ১৯৩০ সালের ১২ মার্চ সবরমতী আশ্রম থেকে ‘ডান্ডি’ পর্যন্ত পদযাত্রা করে লবণ আইন অমান্য করে দেশ জুড়ে অসহযোগ ও আইন অমান্য আন্দোলনের ডাক দিলেন। সারা দেশে সেই আন্দোলন যখন প্রবল আকার ধারণ করেছে সেই সময়ই ‘সাইমন কমিশনের রিপোর্ট নিয়ে আলোচনা করার জন্য লন্ডনে ‘Round Table Conference-এ ডাক পেতেই আন্দোলন মাঝপথে বন্ধ করে দেন। এবং ইংরেজের শুভ বুদ্ধির উদয় হয়েছে বলে আলোচনার জন্য লন্ডনে। চলে যান এবং কোনো উল্লেখযোগ্য দাবি আদায় না করে খালি হাতে ফিরে আসেন। গান্ধীজীর এই ধরনের আন্দোলনে বহু নেতাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। কংগ্রেসের উদীয়মান তরুণ নেতা সুভাষ বলেন—“ইংরেজের সঙ্গে লড়াইয়ে গান্ধীজী ব্যর্থ। এরকম ভাবে লড়াই করে স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব নয়। কংগ্রেসকে নতুনভাবে সংঘর্ষের পথে যেতে হবে; এবং তার জন্য নতুন নেতা চয়ন করতে হবে।” ১৯৩৮ সালে সুভাষ চন্দ্র কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হয়ে কংগ্রেসকে নতুনভাবে গঠন করার কাজে লেগে যান। সুভাষের সংঘর্ষের পথ পছন্দ হলো না গান্ধীজীর। তাই পরের বছর তার অমতে আবার সুভাষ কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভাপতি নির্বাচিত হওয়ায় গান্ধীজী ষড়যন্ত্র করে সুভাষকে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। তখন সুভাষ চন্দ্র নতুন পার্টি ফরোয়ার্ড ব্লক তৈরি করেন।
গান্ধীজী তথা কংগ্রেসের শেষ আন্দোলন ১৯৪২-এর ‘ভারত ছাড়’ আন্দোলন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় ৮ আগস্ট এই আন্দোলনের ডাক দিয়েছিলেন গান্ধীজী। ৯ আগস্টে গান্ধীজী-সহ কংগ্রেসের সমস্ত নেতাই বন্দি হয়েছিল। নির্মম ভাবে দমনপীড়ন করে সেই আন্দোলনকে চুরমার করে দিয়েছিল ইংরেজ সরকার। সমস্ত নেতা জেলে থাকায় নেতৃত্বহীন দিশাহীন হয়ে ভারত ছাড়’ আন্দোলন কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই স্তব্ধ হয়ে যায়। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত কংগ্রেসের সমস্ত নেতারাই জেলে বন্দি ছিলেন।’৪২ পর থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত কোনো আন্দোলনের নামগন্ধই ছিল না। কংগ্রেসের নেতারা বেশিরভাগই বয়সের ভারে আক্রান্ত এবং হতোদ্যম। মিত্র পক্ষের শরিক ইংরেজবিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী। কথা হলো বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন যখন ইংরেজসেনা জাপানিদের কাছে পরাজিত হচ্ছিল তখন ক্রিপস্ মিশনকে ভারতে পাঠিয়েছিল কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা করে ভারতীয়দের সাহায্য প্রার্থনা করার জন্য। তখনো কিন্তু তারা আলোচনার টেবিলে ভারতকে স্বাধীনতা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়নি। সেই ইংরেজ সরকার বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ী হয়েও কেন ভারত ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল? সে কি গান্ধীজীর অহিংস সত্যাগ্রহের ভয়ে? না কি তার অন্য কারণ ছিল ?
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার সময়ে ইংরেজ সরকার সুভাষচন্দ্রকে এলগিন রোডের বাড়িতে নজরবন্দি করে রেখেছিল। সুভাষচন্দ্র অসামান্য চাতুর্যের সঙ্গে ১৯৪১ সালের ১৬ জানুয়ারি ইংরেজের চোখে ধুলো দিয়ে পালিয়ে যান। তিনি ছদ্মবেশে আফগানিস্তান, রাশিয়া হয়ে জার্মানি তারপর সেখান থেকে জার্মান সাবমেরিনে ভয়াবহ বিপদসঙ্কুল অভিযান করে জাপানে আসেন। ১৯৪৩ সালের জুলাইয়ের প্রথম দিকে সিঙ্গাপুরে গিয়ে আর এক কিংবদন্তি বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর কাছ থেকে আজাদ হিন্দ বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি নেতাজী’নামে ভূষিত হন। তিনি জাপানি সহায়তায় আজাদ হিন্দ বাহিনী নিয়ে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রণাঙ্গণে ইংরেজ বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়েছিলেন এবং ইংরেজ অধিকৃত বহু অঞ্চল দখল করে নিয়েছিলেন। তিনি ডাক দিয়েছিলেন ‘দিল্লি চলো”। ১৯৪৩ সালের ২১ অক্টোবর তিনি গঠন করেছিলেন অখণ্ড ভারতের ‘স্বাধীন আজাদ হিন্দ সরকার। পৃথিবীর ১১টি দেশ সেই সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেই অর্থে নেতাজী সুভাষকেই অখণ্ড ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রীর মান্যতা দেওয়া উচিত। ১৯৪৪ থেকে জাপান পরাজিত হতে থাকে। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্ট আমেরিকা জাপানের হিরসিমা ও নাগাসাকিতে অ্যাটমবোমা ফেলে। ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট জাপান পুরোপুরি আত্মসমর্পণ করে। জাপানের সহায়তায় চলা আজাদ হিন্দ বাহিনী বন্দি হয় ইংরেজ সরকারের হাতে। সুভাষ আবার আত্মগোপন করেন। তার পরবর্তী সত্য এখনো উঘাটিত হয়নি।
আজাদ হিন্দ বাহিনীর সেনানীদের দিল্লির লালকেল্লায় যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিচার আরম্ভ হয়। দেশের স্বাধীনতার জন্য নেতাজী সুভাষ ও তার আজাদ হিন্দ বাহিনীর দুঃসাহসিক যুদ্ধ ও আত্মবলিদানের কাহিনি জানতে পেরে সারা দেশ উদ্বেল হয়ে উঠলো। তাদের বিচার হচ্ছে দেখে দিকে দিকে বিক্ষোভ আরম্ভ হয়ে গেল। ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সেনারা যখন দেখল তাদের সহকর্মী সেনারা যারা ব্রিটিশের হয়ে লড়াই করে জাপানিদের হাতে বন্দি হয়েছিল, তারাই আজাদ হিন্দ বাহিনীতে যোগ দিয়ে দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বলিদান করেছে। তাদের মধ্যে যারা বেঁচে আছে তাদের যুদ্ধবন্দি হিসেবে বিচার করে ইংরেজ শাস্তি দানের ব্যবস্থা করছে তখন দেশপ্রেমের তীব্র আবেগ তাদের মধ্যে সংক্রমিত হলো। তারা বিদ্রোহ আরম্ভ করলে। প্রথমে নৌবাহিনীতে বিদ্রোহ আরম্ভ হয়, তারপর তা স্থলবাহিনী ও বিমান বাহিনীতে ছড়িয়ে পড়ে। নেতাজী সুভাষ আজাদ হিন্দ বাহিনীর মধ্যে দেশপ্রেমের যে আগুন জ্বেলে দিয়েছিলেন, আজাদ হিন্দ বাহিনীর বিচারের অভিঘাতে তা ইংরেজ বাহিনীর ভারতীয় সেনাদের মধ্যে ছড়িয়ে গিয়ে। যেন স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হয়ে গেল। ইংরেজ অনুধাবন করল এবার তাদের ভারতশাসনের দিন শেষ।“Achinlek now warned his army commanders that they could no longer rely on the soldiers of Indian Army. He warned the Government in London to hestily announce the British departure.” (BOSE : An Indian Samurai-Maj.Gen. GD. Bakshi P. 292). অচিনলেক ছিলেন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির কমান্ডার-ইন-চিফ। আর বিশ্বযুদ্ধের ফলে ব্রিটেনের তখন দেউলিয়া অবস্থা। অন্য জায়গা থেকে লক্ষ লক্ষ গোরা সৈন্য এনে এত বড়ো ভারত দখলে রাখা তাদের পক্ষে অসম্ভব। যুদ্ধের পরে ইংলন্ডের শাসনক্ষমতায় এসেছিল ভারতের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন লেবার পার্টির সরকার। বিশ্বের ক্ষমতার অলিন্দে তখন নতুন শক্তি রাশিয়া ও আমেরিকার উত্থান। ব্রিটিশ শক্তির উপর তাদের চাপ ছিল কলোনি গোটাবার। সুতরাং সমস্ত পরিস্থিতি বিচার করে ব্রিটিশ সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল মানসম্মান নিয়ে ভারত ছাড়ার।
মেজর জেনারেল জি ডি বক্সি তার বইতে লিখেছেন— “Had the Indian Armed forces remained loyal or there had been enough British divisions to keep them in check, the British would never have left India.” (P-295)
মাইকেল এডওয়ার্ডস গান্ধীজী সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে তাঁর ‘TheLast Years of British India’গ্রন্থে লিখেছেন—“The British felt that they had little to fear from Gandhi himself, they soon recognised him for what he was an anti Indian reformer. As long as Gandhi was in control of Congress, they knew they had ally. As long as civil disobedience remained non-violent, it did not greatly worry the Govenment… মাইকেল এডওয়ার্ডস 01570 FOT76901-— “The British no longer feared Gandhi or Nehru, but they feared Bose and the violence he represented, and his suddenly amplified figure overawed the conferences that were lead to independence.”
অবশেষে দেশবিভাজনের মধ্য দিয়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। এটাই ছিল। ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির ইতিহাস; গান্ধীজীর অহিংসা আন্দোলন বা ভারত ছাড়ো আন্দোলনের ভয়ে ইংরেজ ভারত ছেড়ে যায়নি। এই ইতিহাসকে এতদিন ধরে সুচতুরভাবে আড়াল করে রাখা হয়েছে।
ভারতের স্বাধীনতা প্রাপ্তির সময় ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ক্লিমেন্ট অ্যাটলি। তিনি ১৯৫৬ সালে কলকাতায় এসেছিলেন। তখন পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল ছিলেন জাস্টিস পি বি চক্রবর্তী। তিনি নানারকম আলোচনার মাঝে অ্যাটুলিকে জিজ্ঞেস করেন- “১৯৪৭ সালের অনেক আগেই প্রকৃতপক্ষে গান্ধীজীর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন মৃত হয়ে গিয়েছিল এবং তখন ব্রিটিশের ভারত ত্যাগের পরিস্থিতি ছিল না। তাহলে ব্রিটিশ কেন। দ্রুততার সঙ্গে ভারত ছেড়ে চলে গেল?”অ্যাটলি এই কারণ সেই কারণের। সঙ্গে মুখ্য যে কারণটি বলেছিলেন তা হলো সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর কার্যকলাপ। আজাদ হিন্দ বাহিনীর প্রভাবে ভারতে ব্রিটিশ শক্তির ভিত দুর্বল করে দিয়েছিল। জাস্টিস চক্রবর্তীর পরের প্রশ্ন ছিল—“কিন্তু মহাত্মা গান্ধীর ‘ভারত ছাড়ো আন্দোলন ব্রিটেনের ভারত ত্যাগের সিদ্ধান্তকে কতটা প্রভাবিত করেছিল ?” অ্যাটলি অবজ্ঞাসুলভ বক্রোক্তি করে বলেছিলেন— M-I-N-I-M-A-L, অর্থাৎ খুবই সামান্য।
প্রণব দত্ত মজুমদার
2020-02-05