১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের প্রথমদিকের ঘটনা।
ভারতের আগ্রার তাজমহলের গম্বুজে দেখা গেল একটি ফাটল। ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ার সেটি দেখতে পেয়ে মেরামতের বহু চেষ্টা করলেন। পারলেন না।
বিষয়টি তিনি তাঁর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের জানালেন। তাঁরাও কিছু করতে পারলেন না।
এদিকে সময় পেরিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে লাগলো তাজমহলের ফাটল।
শেষে ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারদের নিয়ে একটি কমিটি তৈরি হলো।
কিন্তু সেই কমিটিও তাজমহলের ফাটল সারাতে ব্যর্থ হলো।
এদিকে ফাটল ক্রমশ বড়ো হয়ে তাজমহলের গম্বুজ ভেঙে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিলে ।
কিন্তু ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতা কোনো কাজেই এলো না। কার্যত, তাঁরা তখন দিশাহারা।
এমনি দু:সময়ে তাঁদের কাছে হাজির এক অখ্যাত অতি সাধারণ হিন্দু যুবক। নাম—পূরণচাঁদ।
পূরণচাঁদ ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারদের জানালেন, ফাটল মেরামতের বিদ্যা তিনি জানেন এবং তাঁকে একবার সেই সুযোগ দেওয়া হোক্।
নিতান্ত অনিচ্ছায় ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা পূরণচাঁদকে সুযোগ দিলেন।
সুযোগ পেয়েই একদল রাজমিস্ত্রি নিয়ে তাজমহলের ফাটল মেরামতের কাজে লেগে পড়লেন পূরণচাঁদ। চুনমিশ্রিত এক ধরণের কংক্রিট তৈরি করলেন তিনি এবং তা দিয়ে গম্বুজের ফাটলটি ভরাট করে দিলেন। কংক্রিট জমে শক্ত হয়ে নিঁখুতভাবে জুড়ে গেল সে ফাটল ।
এক অখ্যাত হিন্দু যুবকের এই দক্ষতার খবর গিয়ে পৌঁছলো ভাইসরয়ের কানে। দেখা যাচ্ছে, ভারতের ভাইসরয় তখন দ্বিতীয় মারকুইস অব্ লিনলিথগো (১৮৮৭-১৯৫২) এবং তাঁর কার্যকাল ১৮/০৪/১৯৩৬ থেকে ০১/১০/১৯৪৩)।
ভাইসরয় রীতিমতো প্রশংসা করলেন যুবকের। তাজমহলের সংরক্ষণের কাজে তদারকির কাজে পূরণচাঁদকে নিয়োগের কথা ভাবলেন কর্মকর্তারা। কিন্তু ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়াররা এতে ঈর্ষান্বিত হয়ে বাগড়া দিলে পূরণচাঁদ সে চাকরি পেলেন না।
ইতিমধ্যে ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের ১ সেপ্টেম্বর হিটলারের পোলাণ্ড আক্রমণের মধ্যে দিয়ে শুরু হয়ে গেল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। পুরো বিষয়টাই চাপা পড়ে গেল ।
এরপর ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ড: বি. আর. আম্বেদকর ভাইসরয়ের কার্যকরী কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়ে শ্রম বিভাগের দায়িত্ব পেলেন। পুরো বিষয়টি নিয়ে ভাঙা হিন্দিতে পূরণচাঁদ তাঁর আশার কথা জানিয়ে একটি চিঠি লিখলেন। তিনি জানালেন, পারিশ্রমিকের মোহে নয়, তাজমহলের মতো একটি জাতীয় ঐতিহ্যমণ্ডিত সৌধের সঠিক পরিচর্যা এবং উত্তরপুরুষদের জন্য তা যথাযথভাবে সংরক্ষণের আশায় তিনি এই চাকরির সুযোগ খুঁজেছেন ।
পূরণচাঁদের এই চিঠি বিচলিত করলো ড: আম্বেদকরকে। তিনি ভাইসরয়ের সঙ্গে পূরণচাঁদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। ড: আম্বেদকর ভাইসরয়কে আরও জানালেন, ঐতিহাসিক সৌধ সংরক্ষণের জন্য তিনি পূরণচাঁদকে সহকারি বাস্তুকার হিসেবে নিয়োগ করতে চান এবং সেই সঙ্গে তাঁকে সম্মাননা প্রদানের অনুরোধ জানান।
ড: আম্বেদকরের প্রস্তাবে ভাইসরয় রাজি হয়ে গেলেন।
এরপর পূরণচাঁদ পেলেন “রায় সাহেব” খেতাব।
১৯৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৭ মে তৎকালীন বোম্বে (অধুনা মুম্বাই) থেকে প্রকাশিত বহুল প্রচারিত মারাঠি দৈনিক “লোকসত্ত্ব” পত্রিকায় শ্রীগোলাবরাও জগদীশের লেখায় এ বিষয়ে পুরো বিবরণ প্রকাশিত হলে বিষয়টি সাধারণের সামনে আসে।
সেদিন ব্রিটিশ ইঞ্জিনিয়ারদের দক্ষতাকে (?) কার্যত চ্যালেঞ্জ জানিয়ে যে অখ্যাত পূরণচাঁদ তাজমহলকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন, আমাদের কাছে তা আশ্চর্য হলেও অজানা। আজ তাজমহলের স্বাস্থ্য নিয়ে অনেককেই ভাবতে দেখা যায় ঠিকই, কিছু তার পাশাপাশি পূরণচাঁদদের মতো প্রচারবিমুখ মানুষের বড়োই অভাব দেখা যায়।
আর পূরণচাঁদদের জ্ঞান সংরক্ষণের কোনো ব্যবস্থাও চোখে পড়ে না। তাই চারদিকের অনেক নতুন নির্মাণ অকালেই হুড়মুড়িয়ে ভেঙে যায়।
“শিবালিক” থেকে রাস্তা ভাঙে, জলের ট্যাঙ্ক ভাঙে। ভেঙেই পড়ে ।