আদৌ আমরা সবাই নাগরিক ছিলাম এতদিন?
CAA বা সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন আর এই আইনের তীব্র বিরোধিতা কিন্তু সত্যি একটা অছিলা মাত্র। আর এই অছিলা বা অজুহাতের মাত্র তিন হাত পেছনেই কিন্তু দাঁড়িয়ে আছে এক গভীর ষড়যন্ত্র। ভারতকে ইসলামিক ভারতবর্ষে রুপান্তরিত করার এক মারাত্মক ” জিন্না ওয়ালি আজাদী”র জীবন্ত খোয়াইশ।
উদাহরন চাই? এই ছেলেটার নাম ভাস্কর মালাকার। বাড়ি হাবড়ার উপনে নামক একটি গ্রামে। দেশ ভাগের পাপ বহন করে চলা এক উদ্বাস্ত হিন্দু ঘরের সন্তান। লক্ষ লক্ষ বাংলাদেশের ভাগ্যহীন, নিপীড়িত এক জন্মপাপলব্ধ হিন্দু ঘরের সন্তান। সংখ্যালঘু মনস্তত্ব নিয়ে বেচে থাকা যে কি যন্ত্রনার তা আমি আপনি কজনেই বা বুঝি?এক স্বদেশ আর এক হিন্দুভুমির স্বপ্ন বুকে নিয়ে তাই পরিবারের সাথেই কোন এক নিশুতি রাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভাস্করদের ঠাই এই ভারতভূমিতেই। তারপর?
কোন রকমে এ কাগজ সে কাগজ জোগাড় যন্তর করে স্কুলে ভর্তি হওয়া আর চোখে ভারত মায়ের সেবা করার আজন্মলালিত স্বপ্ন। পড়াশুনা শেষে দেশ রক্ষার গুরু দায়িত্ব নিয়ে সৈনিকবৃত্তি গ্রহন করল ভাস্কর। সেনা বাহিনীতে যোগদানের সময় কাগজ পত্র সব মোটামুটি ঠিক ই ছিল। কিন্তু বাধ সাধল নিয়তি। কোন এক পুলিশ ভেরিফিকেশনের জটিলতায়, সাত বছর দেশ সেবার কাজে নিযুক্ত থাকার পরেও তাকে ছাটাই করা হল। এই দেশের নাগরিকত্বের সম্পুর্ণ কাগজ পত্র না থাকার জন্য।
ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! হঠাৎ যেন এক কাল বৈশাখী ঝড়ে তছনছ হয়ে গেল ভাস্করের জীবন যৌবন আর দুচোখের নির্মল স্বপ্ন। ভাস্কর সেদিন ই নিজের ক্যারিয়ার, স্বপ্ন সব জলাঞ্জলি দিয়েই উপলব্ধি করেছিল রাস্ট্রের চোখে সে এদেশের নাগরিক নয়।তারপর শুরু হল এক কঠিন জীবন সংগ্রাম।ভাস্কর শুরু করল শব্জি বিক্রি। শিখে নিল গাড়ি চালানো। এর ওর গাড়ি চালায় আর যেদিন কাজ থাকে না সেদিন শব্জি বিক্রি করে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে।পেট, ক্ষিধে এগুলো তো আর তার পাওয়া ডিগ্রির কথা শোনে না, সে বোঝে ক্ষুধার রাজ্যে পৃথিবী টা সত্যিই গদ্যময়।পুর্নিমার রাত তার কাছে ঝলসানো রুটি হয়েই দেখা দেয়।
এভাবেই কাটছিল দিন, কাটছিল রাত। দিন যায় মাস ঘুরে বছর আসে। সব দল ই এই সব ভাস্কর দের ভোট নিয়েছে, কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দে ঢুকে আর তাদের মনে থাকেনা ভাস্করদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা।
তারপর যখন দুই গুজরাটি, নরেন্দ্র ভাই আর মোটা ভাই নাগরিকত্বের বিল আনে সংসদে, চোখে মুখে খুশীর ঝিলিক খেলে যায় হাজারো ভাস্করের পরিবারের অলিন্দ নিলয়ে। আর কেউ তাদের “বাংলা” বলে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করতে পারবে না ( সীমান্ত বর্তী এলাকায় বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুদের “বাংলা” বলা হয় হেয় প্রতিপন্ন করার জন্য)।
তারপর লোক সভা, রাজ্যসভা পেরিয়ে রাষ্ট্রপতির সাক্ষর হয়ে বিল টি যখন আইনে পরিনত হয় তখন হাতের চাঁদ পায় হাজারো ভাস্করের দল।।অনুভব করে ভাস্কর, তার জীবনে তো অনেক বসন্ত পেরিয়ে গেছে অ- নাগরিক্ত্বের ছোয়ায়, পরবর্তী প্রজন্ম যেন নাগরিকত্ব নিয়েই মাথা উচু করে একজন গর্বিত ভারতবাসী হিসাবেই প্রজাতন্ত্র দিবসে জাতীয় পতাকার দিকে তাকিয়ে স্যালুট দিতে দিতে গাইতে পারে ” সারে জাহাসে আচ্ছা হিন্দুস্থা হামারা।” এই স্বপ্ন বুকে নিয়েও ভাস্কর বুঝতে পারে তার অথবা তাদের নাগরিকত্ব প্রাপ্তির বিপক্ষেও আছে প্রচুর মানুষ। যারা আকাশ বাতাস কাপিয়ে সিন্ডিকেটের দাদাদের খুশী করতে, আর চাল, কলা, মুলোর সাপ্লাই নিরন্তর রাখতে, নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থে নেমে পড়েছে এই CAA আইনের বিরোধিতায়। চিল চিৎকারে আকাশ বাতাস কাপিয়ে তার স্বজাতির ভাইয়েরাই স্লোগান তুলছে NO CAA, NO NRC, NO NPR
ভাস্করেরা বুঝে উঠতে পারেনা স্বজাতির, স্বধর্মের মানুষের নাগরিকত্ব না থাকার যন্ত্রনা এদেরকে কি একটুও কষ্ট দেয় না? এত অমানবিক আর নিষ্ঠুর কি করে হতে পারে মানুষ?
সে আর কালক্ষেপ না করে তাই ঝাপিয়ে পড়ে CAA র পক্ষে প্রচারে।বুঝতে পারে তার নিজের লড়াই তাকেই লড়তে হবে। আত্মঘাতী বাঙালি হিন্দুরা বুঝবে না তার আত্মজন,তার স্বজনের অ-নাগরিকত্বের যন্ত্রনার কথা।সেই নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের (CAA) র প্রচারেই বেরিয়েছিল ভাস্কর গতকাল( ০২:০২:২০২০) হাবড়ার কুমড়ো কাশীপুর অঞ্চলে। সেখানেই মোহ: হাফেজের বাহিনী, শুভেন্দু সর্দারের ( গ্রামের তৃনমুলের নেতা)লোকজন তাকে ঘিরে ফেলে ইট দিয়ে, লোহার রড দিয়ে মাথা, নাক, মুখ ফাটিয়ে দেয়। অসংখ্য সেলাই আর অনাবিল যন্ত্রনা নিয়ে ভাস্কর এখন বারাসাত হাসপাতালের মেল সার্জিকাল ওয়ার্ডে ভর্তি।। এখনো সারা গায়ে চাপ চাপ রক্ত।গত কাল দেখা করে বললাম ভাই ভাস্কর খুব যন্ত্রনা হচ্ছে তাই না রে?
ভাস্কর কে আমি আগে চিনতাম না। এদিন ই পরিচয় হল। উদ্বাস্ত হিন্দুদের অধিকার রক্ষার এত বড় একজন সৈনিক হাসপাতালে বিছানায় শুয়ে আছে শুনে নিজেকে আর বাড়িতে ধরে রাখতে পারিনি, ছুটে গিয়েছিলাম হাসপাতালে। আমি যখন ওকে যন্ত্রনা হচ্ছে কিনা জিজ্ঞাসা করলাম ও অদ্ভুত একটা উত্তর দিল.... "এখন ই যন্ত্রনা হলে চলবে দাদা? লড়াই এর এই তো শুরু।"
হ্যাটস অফ ভাস্কর। তোর সারা গায়ের চাপ চাপ ড্যালা পাকানো রক্ত দেখে মনে পড়ে গেল কারা যেন ইস্টবেঙ্গল এর গ্যালারী তে বিরাট ফ্লেক্সে লিখেছিল ” রক্ত দিয়ে কিনেছি জমি, কাগজ দিয়ে নয়”, ওরা শুধু ভাষন ই দেয়। বড় লোকের বাপের আলালের ঘরের দুলালেরা হয়ত জানেই না তাদের বাপ ঠাকুর্দাও ওই বাংলাদেশ থেকে সলিমুদ্দিন, কলিমুদ্দিনের লাথি খেয়েই পালিয়ে এসেছিল কোন এক ফাইন মর্নিং এ।আর এরা এখন সব ভুলে সেকুলারিজিমের পতাকা তোলে। ইতিহাস বিস্মৃত এই বাঙালি উদ্বাস্তু হিন্দুদের গালে তুই নিজের শরীরের রক্ত ঝরিয়ে এক সপাটে থাপ্পড় মেরেছিস। আমি জানি ওদের গালে সেই থাপ্পড়ের পাচ আঙুলের দাগ মিলিয়ে যেতে এখনো পাক্কা “৩৪ বছর” ই লেগে যাবে।
তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ওঠ ভাস্কর। যারা হোয়াটস্যাপের ডিপি আর ফেসবুকের প্রোফাইলে বড় বড় করে নোটিস লটকেছে ” আমরা সবাই নাগরিক “, তাদের গালে আরো একটা বিরাশি শিক্কার থাপ্পড় কষাতেই হবে। আর এটা তুই ই পারবি। আমাদের রাজ্যের হাজার ভাস্করেরাই পারবে।পারতেই হবে।