শুরুতেই আসি “আর্য” শব্দের ব‍্যাখ‍্যায়।
“আর্য” বলতে কোনো বিশেষ একটি জাতিকে বোঝায় না, এই শব্দের বুৎপত্তিতেই তা প্রমাণ। “ঋ” (গতৌ) ধাতুর সঙ্গে “অড়ণ” প্রত‍্যয় করে “আর্য” শব্দের উৎপত্তি। “চরৈবেতি” বা নিয়ত এগিয়ে চলার গতিতে যারা চিরস্থির, তারাই আর্য।
তাই কিরাত, যবন থেকে শুরু করে সকল অমৃতের পুত্রকন্যারাই আর্য। “আর্য” বলে কোনো একটি নির্দিষ্ট জাতিকে বোঝায় না, আর্যভাষাভাষী অনেকগুলি জাতিগোষ্ঠীর সমাবেশ হচ্ছে আর্যজনগোষ্ঠী। এর প্রমাণ রয়েছে মনুসংহিতায়, যেমন :
“শনকৈস্তু ক্রিয়ালোপাদি মা: ক্ষত্রিয় জাতয়:
বৃষলত্বং গতালোকে ব্রাহ্মণাদর্শনেন চ ।।
পৌণ্ড্রকাশ্চৌড্রদবিড়া: কাম্বোজা: যবনা: শকা: ।
পারদা পহ্নবাশ্চীনা: কিরাতা দরদা: খসা ।।”
–মনু ১০/৪৩-৪৪.

অর্থাৎ, ব্রাহ্ম‍্যকৃষ্টি থেকে স্খলিত হবার ফলে পৌণ্ড্রক (পৌণ্ড্র), ওড্র (উড়িষ্যা), দবিড় (দ্রাবিড়), কাম্বোজ, যবন (গ্রীক), পারদ (পারস্য), পন্নবা (পনিজাতি ),চিন, কিরাত, দরদ এবং খস প্রভৃতি জাতিরা “বৃষলত্ব” প্রাপ্ত হয়েছে অর্থাৎ তারা “আর্যত্ব” থেকে স্খলিত হয়েছে।
তাই দেখা যাচ্ছে, উপরোক্ত এতগুলো জাতি যে আর্যভাষা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ছিল, তার প্রমাণ মনুসংহিতায় রয়েছে।
“খসা” মানে এখানে “খিস” জাতির কথা বলা হয়েছে। এই “খিস” হলো মেসোপটেমিয়ার একটি দেশ। টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর মধ‍্যবর্তী অঞ্চল হলো মেসোপটেমিয়া (Land in between two rivers)। এই অঞ্চলগুলির মধ্যে অনেকগুলি রাজ‍্য বিদ‍্যমান, যার মধ্যে অন্যতম হলো “উর খিস আক্কাদ।” এখানকার “খিস” শব্দ হলো মনুসংহিতায় উল্লিখিত “খস” শব্দের পরিবর্তিত রূপ।
সুতরাং, মেসোপটেমিয়ার “খস”-এর অধিবাসীরাও ছিলেন আর্যসংস্কৃতির মানুষ।
শুধু তাই নয়, “মেসোপটেমিয়া” শব্দটিও বৈদিক শব্দ। ঋগ্বেদের ঋষি মৈত্রাসূরীয় তাঁর আশ্রমক্ষেত্র গড়ে তুলেছিলেন যেখানে, সেই দেশটি হলো মৈত্রীয় দেশ। এই ঋষি মৈত্রাসূরীয়-এর শিষ‍্য ছিলেন মৈত্রায়ণ এবং তা থেকে হয় মৈত্রায়ণ আশ্রম। পরবর্তীকালে তা থেকে হলো মিতনী এবং এই মিতনীই গ্রীক উচ্চারণে হয়েছে “মেসোপটেমিয়া।”
সুতরাং, মেসোপটেমিয়া ছিল আর্যসংস্কৃতিরই অঙ্গ।
আবার এশিয়া মাইনরের অন্তর্গত “বোঘজকোই”-য়ের প্রাচীন জনস্থানে যে প্রাচীন সভ‍্যতার নিদর্শন বেরিয়েছে, তার মধ্যে খ্রিস্টের জন্মের প্রায় দেড় হাজার বছর পূর্বের কীলাকার অক্ষরে (qunaiform letter) “পণি” নামটি পাওয়া গেছে, যে নামটি ঋগ্বেদের অনেক ঋকমন্ত্রেই উল্লিখিত আছে। এই পণিরা ছিল ঋগ্বেদী যুগের বৈশ‍্য সম্প্রদায় এবং তারা ছিল বণিক। বৈতযোগে অর্থাৎ ফ্ল্যাট বেড্ জাহাজের মতো বড়ো নৌকোয় চড়ে দূর দেশে বাণিজ্যে যেতো। ঋগ্বেদী যুগে ভারত ছিল নৌবাণিজ‍্যে সমৃদ্ধ।
বোঘজকোই লিপিতে মত্তি-উ-অজ এবং সুব্বিলুলিউম নামে দুই রাজার সন্ধিপত্রে ঋগ্বেদী দেবতাদের নাম দেখা যায়। চৌদ্দটি পোড়া টালির গায়ে উৎকীর্ণ যে লিপি তাতে উল্লিখিত রয়েছে,
“ইলানি-মি-ইৎ-র-অস্-সি-ইল-ইলানি-উরু-ব-ন-অস-সি-ইলু ইন্দর-ইলানি-না-স-অৎ-তি-ইথ-অন-ন।”
এই লিপিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায়,
১) “ইলানি-মি-ইৎ-র-অস্-তি” অর্থাৎ ইলানি মিত্রস্ ,
২) “ইলানি উরু-ব-ন”, অর্থাৎ বরুণ,
৩) “ইলু ইন্দর,” অর্থাৎ, ইন্দ্র,
৪) “ইলানি না-স-অৎ-তি-ইথ-অন-ন”, অর্থাৎ, নাশত্ব ।
তাহলে এর অর্থ দাঁড়ালো, একমাত্র মিত্র, বরুণ, ইন্দ্র, নাশত্ব দেবতারাই উপাস্য ।

এ থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায়, বৈদিক সংস্কৃতির ধারক ও বাহক পরিব্রাজক সন্ন্যাসীদের আর্য ভাবধারা বণিক পণিদের মাধ্যমে ইরাণ, মেসোপটেমিয়া প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল। সিন্ধু অববাহিকায় বসবাসকারী ঋগ্বেদী যুগের এই বৈশ‍্য পণিরা নৌকোযোগে লোহিত সাগর, ভূমধ্যসাগর প্রভৃতি অঞ্চলে পাড়ি দিতো এবং সেইসূত্রে এইসব এলাকাগুলি তাদের কাছে সুপরিচিত ছিল।
জার্মান বিশেষজ্ঞ ক্রিয়েন ও জিসক্রিপ্ট তাঁদের গবেষণায় প্রমাণ করে দিয়েছেন, জার্মানদের আদি সম্প্রদায় টিটনরা ভারতের মনুর বংশধর। জার্মান থিওলজিতে মনুকেই তাঁদের আদি পিতা বলে স্বীকার করা হয়েছে।
সুতরাং, দেখা যাচ্ছে, মেসোপটেমিয়া থেকে শুরু করে ইরাণ, আফগানিস্তান ও প্রাচী (পূর্ব দেশ) এবং অপরান্ত (উত্তর দেশ) পযর্ন্ত বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে গড়ে উঠেছিল ভারতের বৈদিক সভ‍্যতার আর্যাবাস‌‌।
এভাবেই ভারতীয় আর্যসভ‍্যতা ছড়িয়ে পড়েছিল বিশ্বজুড়ে ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.