এতদিন আমরা জেনে এসেছি, অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা মোহনদাস করমচাঁদ
গান্ধী। ব্রিটিশ ভারতে গান্ধীজীর নেতৃত্বে একাধিকবার অহিংস সত্যাগ্রহ
আন্দোলন হয়েছে।
কিন্তু সত্যিই কি গান্ধীজীকে অহিংস আন্দোলনের প্রবক্তা বলা যায় ?
আমরা তো দেখতে পাচ্ছি, গান্ধীজীর অনেক আগে অহিংস সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু
করেছিলেন এবং সফল হয়েছিলেন মধ্যযুগে ভক্তিবাদ প্রচারের অন্যতম ব্যক্তিত্ব
শ্রীচৈতন্য (১৪৮৬-১৫৩৩ খ্রি:)।
তুর্কি সৈনাধ্যক্ষ বখতিয়ার খিলজি
সেনরাজ লক্ষ্মণসেনের হাত থেকে নদীয়া বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাংলায় শুরু হলো
মুসলমান শাসন। লক্ষ্মণসেন চলে গেলেন পূর্ববঙ্গে। আর সেই থেকে এই বাংলার
জাতীয় জীবনে নামলো অন্ধকার। প্রখ্যাত পণ্ডিত ড: সুকুমার সেন এ সম্পর্কে
বলছেন, “Turkish invasion as a stunning blow to the culture of Bengal.”
অর্থাৎ তুর্কি বিজয় ছিল বাংলার কৃষ্টির প্রতি এক চরম আঘাত।
ড: সেন আরও বলছেন :
“In consequence of the atrocities directed mainly to looting of
townships and to destruction of temples monasteries and other seats of
devotion and learning which appeared as forts or palaces to the invaders
, the intellectual activities of Bengal appearntly came to a stop for
about a couple of centries , and as a result , we draw a perfect blank
for the period in the literary and cultural history of the country.”
অর্থাৎ শহর-নগর-গ্রাম-গঞ্জ-দেবস্থান-মন্দির-মঠ এবং শিক্ষাদীক্ষার
কেন্দ্রস্থানগুলিকে তুর্কিরা দুর্গ আর প্রাসাদ বলে মনে করেছিল। সীমাহীন
নির্মমতায় এরা লুঠপাট হত্যা চালিয়েছিল জনবসতিগুলোয়, আর
মন্দির-মঠ-আশ্রমগুলোকে ধ্বংস করেছে বর্বর উল্লাসে। বাংলার মনীষার বিকাশ তাই
খ্রিস্টিয় ত্রয়োদশ এবং চতুর্দশ শতাব্দীতে একেবারে স্তব্ধ। তাই
সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো বিভাগেই আমরা উল্লেখযোগ্য কিছুরই সন্ধান পাই না।
ইসলামের নামে যখন তুর্কিরা বাংলায় এই অমানবিক অত্যাচার চালাচ্ছে, তখন এই
অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রথম গর্জে উঠেছিলেন রাঢ়-বাংলার এক বিদ্রোহী কবি,
বীরভূমের নানুরের চণ্ডীদাস। নির্ভিককন্ঠে চণ্ডীদাস বললেন,
“সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই।”
এই যে মানবিকতাবাদের জন্ম দিলেন কবি চণ্ডীদাস, তা ফুলে-ফলে সম্পূর্ণরূপে
বিকশিত হলো শ্রীচৈতন্যের আবির্ভাবের ভেতর দিয়ে। তুর্কির অত্যাচারে লাঞ্ছিত
বাংলা পেল মুক্তির দূতকে। তাঁর অননুকরণীয় জীবনধারা বাংলাকে দেখিয়েছিল পথ।
জোয়ার এসেছিল সাহিত্যে, ধর্মে, মানবজীবনের মূল্যায়নে। শুধু সংস্কৃত
সাহিত্যেই নয়, বৌদ্ধযুগের চর্যাপদ রচয়িতাদের সূচিত কীর্তনের ধারাটিও
শ্রীচৈতন্যের অনুগামীদের হাতে পেল নতুন প্রাণ। চর্যাপদের দুর্বোধ্য
ভাষাগুলো হয়ে উঠলো সুবোধ্য।
নাম-গান-ত্যাগধর্মে যে জয় হয়, সে দৃষ্টান্ত নিজেই রেখে গেছেন শ্রীচৈতন্য তাঁর কাজী দলনের ভেতর দিয়ে।
শ্রীচৈতন্য তখন ভারতবিখ্যাত ” পণ্ডিত নিমাই।” আর ভারতবর্ষের মুসলমান
শাসিত অন্যান্য প্রদেশগুলোর মতো বাংলাতেও তখন প্রকাশ্যে হিন্দুর
ধর্মাচরণ নিষিদ্ধ। কারণ, ইসলামীয় শরিয়তের নিয়ম অনুসারে হিন্দুরা স্বদেশেই
দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক, সংজ্ঞা যাদের “কাফের।”
“বাংলার অক্সফোর্ড” নবদ্বীপ মণ্ডলের মুসলমান শাসক চাঁদ কাজী খোল-করতাল নিয়ে কীর্তন করে সরব নগর পরিক্রমা নিষিদ্ধ করে দিলেন।
তখন কয়েক হাজার নিরস্ত্র লোকজনদের নিয়ে অহিংসভাবে গৌরাঙ্গদেব চাঁদ কাজীর
এই অন্যায় আদেশের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করেন। শেষ পর্যন্ত চাঁদ কাজীকে
তার আদেশ তুলে নিতে হয়েছিল।
এই ঘটনা শুধু সেই সময়েই নয়, পরবর্তীকালে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনেও পথ দেখিয়েছে।
ড: সুকুমার সেন শ্রীচৈতন্যকে তাঁর কীর্তন সমারোহ, জগাই-মাধাই উদ্ধার এবং
চাঁদ কাজীর নিষেধাজ্ঞা তুলে কীর্তনের সমর্থন প্রদানের ঘটনাকে ভারতের
ইতিহাসে প্রথম সত্যাগ্রহ বলেছেন। ড: সেন বলছেন, —
“It was perhaps the first act of civil disobedience in the history of India.”
আর শ্রীচৈতন্যের সমবেত কীর্তনই হলো প্রথম “বাংলা ব্যাণ্ড।”
শ্রীচৈতন্যের এই অহিংস আন্দোলনই পরবর্তীকালে মহাত্মা গান্ধীর কাছে অসহযোগ সত্যাগ্রহের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।
তাই গান্ধীজী নন, ভারতে অহিংস আন্দোলন বা সত্যাগ্রহের প্রবক্তা নি:সন্দেহেই শ্রীচৈতন্যদেব।