শুক্লপক্ষের চতুর্থ তিথিতে বাংলায় শীত শেষ হয়ে শ্রীপঞ্চমী তিথিতে শুরু হচ্ছে বসন্ত। তার মানে বাংলায় বসন্ত শুরু হচ্ছে মাঘ মাসেই, ফাল্গুনে নয়। এই শ্রীপঞ্চমী তিথিতেই বাংলায় অনুষ্ঠিত হয় সরস্বতী পুজো। এই সরস্বতী পুজোর দিন থেকেই বসন্ত ঋতুর শুরু বলে একসময় এদিন বাসন্তী রঙের কাপড় পরতো মেয়েরা। এই ঐতিহ্য প্রমাণ করছে, সরস্বতী পুজোর দিন থেকেই বসন্ত শুরু ।
আরো পড়ুন :বর্ষা-শীতের ডাল-খিচুড়ি থেকে জগাখিচুড়ি
সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রেও রয়েছে শীত বিদায়ের উল্লেখ, যেমন :
“যা পূর্ণেন্দুতুষারহারধবলা যা শুভ্রবস্ত্রাবৃতা ।
যা বীণাবরদণ্ডশোভিতকরা যা শ্বেতপদ্মাসনা ।।
যা ব্রহ্মাচ্যুতমহেশপ্রভৃতি দেবৈ: সদাবন্দিতা ।
সা মাম্ পাতু ভগবতী সরস্বতী নি:শেষজাড্যপহা ।।”
এখানে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে একটি শব্দ “জাড্যপহা”, যার অর্থ “জাড্য”
অর্থাৎ শীতের শেষ। বাংলায় “জাড্য” শব্দের অপভ্রংশে “জাড়” শব্দের ব্যবহার
এখনো রয়েছে, যার মানে শীত ।
সরস্বতী পুজোর দিনটি প্রাচীন বাংলায় ছিল বসন্তোৎসবের তিথি।
পারসিক ভাষায় বসন্তের নাম “বাহার।”
আসি সরস্বতীর কথায়।
বাংলা তথা ভারতের সরস্বতীর রঙ সাদা।
“সর:” মানে নদী। যাস্ক্য বলছেন,
“তত্র সরস্বতী ইতি এতস্য নদীবৎ এব তাবৎ চ নিগমা ভবন্তী।”
সুতরাং, সরস্বতী প্রথমে ছিল নদী। এই নদতটেই ছিল বৈদিক ঋষিদের আর্যাবাস।
সারা বছর ধরে এই সরস্বতী নদীর তীরেই ঋষিদের যাবতীয় যাগযজ্ঞ হতো এবং পবিত্র
বেদধ্বনিতে মুখরিত থাকতো এলাকা। পরে নদী সরস্বতী বাগদেবীতে রূপান্তরিত
হয়েছেন ।
“সরস” শব্দের দুটো অর্থ, একটি “সাদা রঙ” এবং অন্যটি “সরোবর।”
এখানেও সাদা রঙ ও জলের প্রসঙ্গ রয়েছে। তাই সরস্বতী যে প্রথমে নদী ছিল, নামেও তার প্রমাণ রয়েছে।
উত্তর ভারত বা আর্যাবর্তে ছিল সরস্বতী নদী। এখন বিলুপ্ত।
আবার বৌদ্ধদের সরস্বতী আছে, যার রঙ নীল এবং তাই এই সরস্বতী “নীল সরস্বতী”
নামে পরিচিত। আসলে এই বৌদ্ধ সরস্বতী হচ্ছেন “তারা”, যার পুজো হয় তিব্বতে।
এছাড়াও শবরকুমারীরূপিনী জঙ্গলবাসীনী এক বৌদ্ধ দেবী রয়েছেন, নাম—জাঙ্গুলী। এই দেবীর হাতেও বীণা রয়েছে।
অন্যদিকে, বৈদিক সরস্বতীর একটি রূপের সঙ্গে দেবী মনসা এবং দেবী জাঙ্গুলীর
মিল রয়েছে, তা হলো—এরা সকলেই সর্ববিষমোচয়িত্রী এবং সেক্ষেত্রে তিনি
শবরকন্যা ।
(–তথ্যসূত্র : বাঙালীর ইতিহাস—নীহাররঞ্জন রায়, ৭ম সংস্করণ, দে’জ, কলকাতা, পৃ: ৪৮৯)
পালরাজ ধর্মপালের খালিমপুর লিপিতে একটি “কাদম্বরী দেবকুলিকা”, অর্থাৎ
সরস্বতী মন্দিরের কথা উল্লিখিত আছে। বিষ্ণুর দুই পাশে লক্ষ্মী ও সরস্বতীর
মূর্তি আছে। সেইভাবেই তখন পুজো হতো। তবে পালযুগের স্বাধীন একক সরস্বতী
মূর্তিও পাওয়া গেছে।
বাংলায় সরস্বতীর বাহন যেমন হাঁস, দক্ষিণ ভারতে
আবার সরস্বতী হলেন ময়ূরবাহনা। পালযুগের একটি মূর্তিতে সরস্বতীর বাহন দেখা
যাচ্ছে ভেড়া। মানুষ যাতে ভেড়া না হয়ে বুদ্ধিমান হয়, সেজন্য সরস্বতী পুজোর
দিন কোথাও কোথাও ভেড়া বলি এবং ভেড়ার লড়াই চালু ছিল ।
বাংলায়
পাল-চন্দ্র-কম্বোজ যুগের আবিষ্কৃত মূর্তিগুলির মধ্যে বেশি রয়েছে বৈষ্ণব
পরিবারের মূর্তি। যেমন, এই পরিবারের প্রধান রয়েছেন স্বয়ং বিষ্ণু এবং তাঁর
দুই স্ত্রী—লক্ষ্মী ও সরস্বতী।
অন্যদিকে, জয়পালের গয়া লিপিতে মহানীল
সরস্বতী নামে এক তান্ত্রিক দেবীর উল্লেখ দেখা যাচ্ছে। সুতরাং, পালযুগে
তান্ত্রিকমতে সরস্বতীর পুজোর প্রচলন যে ছিল, এটিই তার উদাহরণ।
পালরাজ রামপালের পর বাংলায় বৌদ্ধ প্রভাব ক্ষীণ হয়ে আসে। পরবর্তীকালে
সেনযুগে বল্লালসেন তাঁর “দানসাগর” গ্রন্থের ভূমিকা প্রসঙ্গে বৌদ্ধদের
“পাষণ্ড” বলছেন ।
এই
গ্রন্থের উপসংহারে আবার দেখা যাচ্ছে,ধর্মের জাগরণ ঘটাতে এবং নাস্তিকদের
পদোচ্ছেদনের জন্য কলিযুগে শ্রী ও সরস্বতী পরিবৃত বল্লাল নামে প্রত্যক্ষ
নারায়ণের আবির্ভাব ঘটেছিল।
শীত শেষে সরস্বতী পুজোয় বাংলায় বসন্তোৎসব ছিল, কিন্তু কখনোই আজকের তথাকথিত “প্রেম দিবস” বা “ভ্যালেন্টাইন ডে” ছিল না ।
সরস্বতী পুজোর পরের দিন গ্রামবাংলায় “সিজোনো” খাওয়ার রীতি আছে। সেদিন অরন্ধন। সরস্বতী পুজোর দিন ভাতসহ বিভিন্ন শাকসবজি সেদ্ধ করে পরের দিন খাওয়া হয়। এই ঠাণ্ডা খাবার একসময় বসন্ত রোগের প্রতিষেধক হিসেবে ব্যবহৃত হতো ।
সরস্বতী
পুজোর পরের দিন হয় শীতলা ষষ্ঠী। এদিন গৃহস্থবাড়ির শিল-নোড়াকে দেবী শীতলা
রূপে পুজো করা হয়। বছরের এই একটি দিনে উনুন থেকে শিল-নোড়াকে বিশ্রাম দেওয়া
হয়।
এভাবেই বিশ্বকর্মা পুজো দিয়ে বাংলায় যে উৎসবের শুরু, সরস্বতী
পুজোয় এসে সাময়িক থামে। তারপর ফের শুরু হয় শিবরাত্রি এবং তারপর চৈত্র
সংক্রান্তিতে শিবের গাজন।
এভাবেই বাংলায় বারো মাসে চলে তেরো পার্বণের পালা ।