দিল্লীর শাহীনবাগের সিএএ-বিরোধী মঞ্চের অন্যতম উদ্যোক্তা জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শার্জীল ইমামের একটি বক্তৃতার ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আরও খানিক গতিবেগ পেল দেশের সিএএ-রাজনীতি। আলিগড় পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী এই বিতর্কিত বক্তৃতা শার্জীল দিয়েছিলেন গত ১৬ই জানুয়ারী, আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসে। ঐ ইউনিভার্সিটিরই অপর এক ছাত্র ফৈজুল হাসান আবার মন্তব্য করেছেন— যে কোনো দেশকে গুঁড়িয়ে দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন মুসলিমরা। তাঁর এমত হুমকির তাৎপর্য কি তা নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে অবশ্য তিনি বলেন যে ঐ কথা নাকি তিনি ভারতবর্ষ সম্বন্ধে বলেনই নি। কিন্তু তৎসত্ত্বেও ভারতসরকার যদি তাঁকে গ্রেফতার করে, তবে তাতেও তাঁর আপত্তি নেই। ন্যায্য প্রতিবাদের স্বার্থে প্রাণ দিতেও তিনি প্রস্তুত। নায়কোচিতভাবে বীরের সম্মান লাভ করার আকাঙ্ক্ষা ফৈজুল হাসানের বক্তব্যে ফুটে উঠেছে এবং তা সন্দেহজনক।
“কত বড় আমি, কহে নকল হীরাটি,
তাই তো সন্দেহ করি, নহ ঠিক খাঁটি”।
অপরপক্ষে, শার্জীল ইমাম তাঁর বক্তৃতায় প্রকাশ করেছেন যে ভারতের অমুসলমানদেরকে মুসলমানদের পাশে এসে দাঁড়াতে গেলে তাঁদেরকে মুসলমানদের শর্তে বাঁচতে রাজী হতে হবে এবং পশ্চিমবঙ্গের চিকেন নেক অংশটি যেহেতু মুসলমান-অধ্যুষিত, তাই সেই স্থানের মাধ্যমে বাকি ভারতের সঙ্গে নর্থ ইস্টের যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে নর্থ ইস্টকে আলাদা করে দেওয়ার দায়িত্ব মুসলমানদেরই। শার্জীল ইমামের এমত বক্তব্য ভারত সরকারের কাছে নতুন নয়, বরং এইসবই ভারতবিরোধী বিভেদকামী শক্তির বহুদিনের অভিসন্ধি। কিন্তু তা বলে প্রকাশ্য জনসভায় সে কথা মাইকে বলার মত কাঁচা কাজ তাঁরা করবেন, এমনটা প্রত্যাশিত ছিল না। তাই ফৈজুল বা শার্জীলের এমন প্রকাশ্য ভারতবিরোধী মন্তব্যের অন্যতর তাৎপর্য আছে বলেই মনে হয়। বর্তমানে টালমাটাল উত্তেজনার মুহূর্তে আলিগড় মুসলিম ইউনিভার্সিটির ছাত্রদের মধ্যে বক্তৃতা দিতে দিতে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছিলেন শার্জীল ইমাম এবং শ্রোতাদেরকে সরকারবিরোধী প্রতিবাদ-আন্দোলনের প্রতি আরও দৃঢ়-সংকল্প, নিবেদিতপ্রাণ ও উদ্বুদ্ধ করে তোলার জন্য তিনি এমন দেশদ্রোহী বক্তৃতা দিয়েছেন, তা-ও বোধ করি নয়। বরং প্রকাশ্য সভায় এমন কথা বলা আদতে দাবার একটি পরিকল্পিত চাল বলেই প্রতীত হয়। এর প্রেক্ষিতটি অনুধাবন করতে হলে শার্জীল ইমাম বা ফৈজুল হাসানের মন্তব্য বা বক্তৃতাকে বিচ্ছিন্ন দুটি ঘটনা বলে মনে করলে চলবে না।
দিনের পর দিন সাধারণ দিল্লিবাসীর যাতায়াতের চরম অসুবিধা সৃষ্টি না করে শাহীনবাগের আন্দোলনকারীরা যাতে তাঁদের ধর্ণা তুলে নেন এমন আবেদনের জবাবে শাহীনবাগের প্লাটফর্ম থেকে ইতিপূর্বেই বলা হয়েছে যে তাঁরা স্বেচ্ছায় সরবেন না, প্রয়োজনে পুলিশ এসে তাঁদেরকে তুলে দিক। এমন কথায় বিপদের আভাস পেয়েছিলেন অনেকেই। অনেকেরই সন্দেহ হয়েছিল যে একবার পুলিশ এলেই বিশ্রী কিছু ঘটানোর জন্য ভারতবিরোধী শক্তি হয়ত সম্পূর্ণ প্রস্তুত। এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কেন ধর্ণারত মহিলাদের প্রতি সম্মানবশতঃ একবারও তাঁদের ধর্ণামঞ্চে তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন না, তা নিয়েও অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন আন্দোলনকারীরা, কংগ্রেস, তৃণমূল ও আপের মত বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি এবং ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের একাংশ। কিন্তু দেশের সরকার বা ভারতীয় জনতা পার্টির তরফ থেকে কেউ সেখানে যান নি। আশঙ্কা করা হয়েছে যে অনভিপ্রেত কিছু ঘটলে দায় স্বাভাবিক ভাবেই এসে পড়বে ভারতসরকারের ওপর। ভারত সরকারের দিক থেকে দেশদ্রোহী শক্তিকে এমন নেতিবাচক রাজনীতি করার সুযোগ দিতে না চাওয়া সঙ্গত। সরকারের সঙ্গে বাক্যালাপের প্রয়োজনে প্রতিনিধি প্রেরণ করে যে কোনো সময় আন্দোলনকারীরা বাক্যালাপ করতে পারেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের সঙ্গে, এমন কথা জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। তাই শাহীনবাগের আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বাক্যালাপ করার জন্য প্রধানমন্ত্রী বা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সশরীরে সেখানে হাজির হওয়ার কোনো প্রয়োজন আছে বলে মনে করে নি ভারতসরকার। উপরন্তু স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ্ এ-ও জানিয়ে দিয়েছেন যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে একচুলও পিছু হঠবে না ভারতসরকার। অর্থাৎ শাহীনবাগ আন্দোলনের পিছনে যে ভারতবিরোধী বিভেদকামী শক্তির হাত আছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে তাদের ফাঁদে ভারতসরকার শুধু পা দেয় নি তা নয়, উপরন্তু যে গুরুত্ব ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়ার জন্য তারা অধীর হয়ে ছিল, সেই গুরুত্বের কানাকড়িও সরকারের তরফ থেকে তাদেরকে দেওয়া হয় নি।
অতএব অধৈর্য্য হয়ে পড়ছেন শাহীনবাগের আন্দোলনকারীরা। তাঁদের প্রতি ভারত সরকারের এই নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা তাঁরা হয়ত সহ্য করতে পারছেন না। রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির যে কোনো খেলায় ধৈর্য্য অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ভারত সরকারের ধৈর্য্য সীমাহীন, কিন্তু রাস্তায় বসে আন্দোলন করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের ধৈর্য্যের বাঁধ সম্ভবতঃ ভেঙ্গে যাচ্ছে। বেশিদিন যাতে আন্দোলন করতে না হয় সেই উদ্দেশ্যেই হয়ত তাঁদের আন্দোলন তাঁরা শুরু করেছিলেন মহিলাদের সামনে রেখে। চেয়েছিলেন ভারতসরকারকে মহিলাদের আবেদনের সামনে ইমোশনালি চাপে ফেলতে এবং সিএএ-সংক্রান্ত তাঁদের দাবিদাওয়ার তালিকা যথাশীঘ্র সম্ভব ভারত সরকারের হাতে তুলে দিতে। কিন্তু সে উদ্দেশ্য সফল হয় নি। মহিলারা দিনের পর দিন রাস্তায় ধর্ণা দেওয়ার পরেও ভারত সরকার তাতে সাড়া দেয় নি। তাই শাহীনবাগ আন্দোলনের মাসাধিককাল যখন অতিক্রান্ত হয়েছে তখন সরকারকে উত্তেজিত করে সরকারের দৃষ্টি ও মনোযোগ আকর্ষণের জন্যই হয়ত এমন চড়াসুরের দেশদ্রোহী বক্তৃতা দিয়েছেন শাহীনবাগ আন্দোলনের অন্যতম মাস্টার মাইন্ড এই শার্জীল ইমাম। এই সন্দেহ আরও দৃঢ় হওয়ার অপর কারণ এই যে আপ-নেতা মণীশ শিশোদিয়া শার্জীল ইমামের মন্তব্যের পরেই তোপ দাগেন যে ভারত সরকারের উচিত ২৪ ঘন্টার মধ্যে শার্জীলকে গ্রেফতার করা। শাহীনবাগ আন্দোলনকারীদের প্রতি আপের রাজনৈতিক সহানুভূতি বহুজনবিদিত একটি তথ্য। তাই শার্জীল ইমামকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে অর্থাৎ তড়িঘড়ি গ্রেফতার করার দাবী তোলার পিছনে তাঁকে তড়িঘড়ি বীরের মর্যাদা দেওয়ানোর কোনো তাগিদ মণীশ শিশোদিয়ার দিক থেকেও ছিল কিনা, উঠেছে সে প্রশ্নও।
ফৈজুল হাসানের মন্তব্যও বোধ করি অনুরূপ উদ্দেশ্যেই। তাই এমন অবিমৃশ্যকারী মন্তব্যের জন্য ফৈজুলকে যদি পুলিশ গ্রেফতার করে, তবে যে ফৈজুল হাসানের তেমন কোনো পরিচিতি নেই, তাঁকে একদিনে চিনে যাবে রাজনৈতিক মহল। অর্থাৎ একজন অখ্যাত, অনামা ব্যক্তির নেতিবাচক রাজনৈতিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়াশীল হতে গিয়ে আখেরে তাঁকে লাইমলাইটে নিয়ে আসার বোড়ে হিসেবে ব্যবহৃত হতে হবে ভারত সরকারকে। তাই শার্জীল বা ফৈজুলকে শাহীনবাগ আন্দোলনের নায়ক বানানোর ফাঁদে পা দেওয়া অর্থহীন বিশেষতঃ সেটিই যেখানে তাঁদের এমত দেশদ্রোহী মন্তব্যের মূল উদ্দেশ্য বলে প্রতীয়মান হচ্ছে। তাই শার্জীলের বিরুদ্ধে আইনি কার্যকলাপ চলুক কিন্তু অযথা তাঁকে নায়ক বানানোর প্রশাসনিক অবিমৃশ্যকারিতা ভারতসরকার করবে না বলেই মনে হয়।
এতদযাবৎ ঘটনাপ্রবাহ থেকে এ-ও অনুমান করা যায় যে শাহীনবাগ আন্দোলনকারীরা দিনে দিনে আরও মরিয়া হয়ে উঠবেন। ভারত সরকারের নৈর্ব্যক্তিক উদাসীনতা তাঁদের ধৈর্যচ্যুতি দ্রুততর করবে। ফলে এমন অবিমৃশ্যকারী কার্যকলাপ তাঁরা আগামীতেও করবেন এমনই প্রত্যাশিত। কিন্তু মোদীর নেতৃত্বাধীন ভারতসরকারের অধৈর্য্য বা প্রতিক্রিয়াশীল হওয়া সঙ্গত নয়। কারণ এই সরকারকে ‘অসহিষ্ণু’ খেতাব দেওয়ার সর্বাত্মক প্রয়াস ও সেই মর্মে প্রচার দেশবিরোধী লবির তরফ থেকে নিরন্তর হয়ে চলেছে দেশে বিদেশে সর্বত্র। তাই তাঁদের সেই প্রচারকে অক্সিজেন জোগাতে পারে এমন কোনো পদক্ষেপ ভারত সরকারের দিক থেকে নেওয়া হবে বলে মনে হয় না। স্বাধীনতার ৭২ বছর পর সত্যিকারের সামাজিক সংস্কারের পথে হাঁটতে শুরু করেছে ভারতবর্ষ। এমন সময় দেশের আভ্যন্তরীণ শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে দেশকে সেই পথ থেকে সরিয়ে এনে গত সাত দশকের “দরিদ্র, উন্নয়নশীল দেশ” এর ভাবমূর্তিতেই ভারতবর্ষকে ফিরিয়ে আনার প্রয়াস যে চলবে তা অনুমান করা কঠিন নয়। দেশের ভিতরে ও বাইরে ভারতবিরোধী শক্তির এই সক্রিয় প্রয়াসকে ব্যর্থ করতে হলে নিজেদের শক্তির প্রদর্শন করার আগে ভারত সরকারকে করতে হবে স্থৈর্য ও অফুরন্ত ধৈর্য্যের প্রদর্শন। “বীতরাগভয়ক্রোধ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে”।