(দ্বিতীয় ভাগের পর)http://ritambangla.com/state/a-review-on-seventeenth-lok-sabha-election-second-part/
তৃতীয় পর্ব শুরু করার আগে একটা বিষয় স্পষ্ট করে নিই আরেকবার। মূল সমীক্ষায় প্রাথমিক ভাবে দুটো কেস স্টাডি করা হয়েছে – প্রথম কেসস্টাডিতে তৃণমূলের সর্বাধিক সম্ভাবনা এবং বিজেপির সর্বনিম্ন সম্ভাবনা বিচার করা হয়েছে এবং দ্বিতীয় স্টাডিতে একটা নমিনাল ট্রেন্ড ফলো করা হয়েছে। এই দুটোই পঞ্চায়েতের ভোটের গতিপ্রকৃতি দেখে বোঝা সম্ভব। কিন্তু তৃতীয় পসিবল কেস অর্থাৎ যেখানে তৃণমূল তার সর্বনিম্ন সম্ভাবনায় যাবে এবং বিরোধী (বেশীরভাগ ক্ষেত্রে বিজেপি) সর্বোচ্চ সম্ভাব্য ভোট পাবে সেটা উন্নয়নক্লিষ্ট পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকে পাওয়া সম্ভব নয়, তাই, এই পর্ব ভিত্তিক আলোচনা।
এই পর্ব আমরা শুরু করবো রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চল দিয়ে যেখানে ছয় জেলা জুড়ে আছে আটটি লোকসভা কেন্দ্র-বীরভূম, আসানসোল, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, বিষ্ণুপুর, ঝাড়গ্রাম, মেদিনীপুর আর ঘাটাল। প্রথমে আমরা দেখে নেব দ্বিতীয় কেস স্টাডি অনুযায়ী দলগুলির এই আসনগুলিতে প্রাপ্তব্য নমিনাল ভোট শেয়ার কতো (সারণী 4A, শতাংশের হিসেবে) । এই হিসাব অনুযায়ী সাতটি আসনের মধ্যে (আসানসোল বাদে) চারটিতে তৃণমূল (বীরভূম, বিষ্ণুপুর, মেদিনীপুর আর ঘাটাল) এবং তিনটিতে বিজেপির (পুরুলিয়া, বাঁকুড়া আর ঝাড়গ্রাম) জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা! যদিও প্রথম কেস স্টাডি অনুযায়ী (অর্থাৎ মোড়ে মোড়ে উন্নয়ন দাঁড়িয়ে থাকলে) সাতটির মধ্যে পুরুলিয়া বাদে সবেতেই তৃণমূলই জয় পাবে। এবার দেখা যাক, বিভিন্ন দলের প্রার্থী আর সম্ভাব্য ভোট স্যুইং কি প্রভাব ফেলতে পারে।
প্রথমে বীরভূম। আমরা জানি যে গুড়-বাতাসা থেকে নকুল দানা উন্নয়নের বিবিধ ধারার জন্মভূমি এই বীরভূমই। পঞ্চায়েতে বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রে মাত্র সাত শতাংশ মানুষ ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পেরেছেন। এ হেন অনুব্রতভূমিতে বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার মন্ডল হওয়াতেই সমীকরণ বদলের একটা সম্ভাবনা আছে। এমনিতে বীরভূমে অধিকাংশ ব্লকে প্রার্থী না থাকায় কং বা বামেদের প্রকৃত ভোটের আন্দাজ পাওয়া কঠিন কিন্তু একদিকে বামেদের প্রার্থী একটি বিশেষ গোষ্ঠিভুক্ত হওয়ায় এবং হাসন, রামপুরহাটে এখনো কং এর কিছুটা কোর ভোট ব্যাঙ্ক থাকায় উভয় দলের মিলিত ভোট প্রায় ১৫% শতাংশ হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে ভোটটা প্রায় পুরোটাই তৃণমূলের পঞ্চায়েতী ভোট শেয়ার থেকে আসবে। সেক্ষেত্রে যদি দুধকুমার বাবু ৩-৪% ভোট স্যুইং আনতে পারেন তাহলে বীরভূমে পরিবর্তনের সম্ভাবনা আছে। সম্ভাবনা কম কিন্তু ক্ষীণ নয়।
বীরভূমের ঠিক উল্টোটাই ঘটতে পারে বাঁকুড়াতে। সাধারণ হিসেবে বাঁকুড়ায় এবার পরিবর্তন হওয়ার কথা কিন্তু তৃণমূল নেত্রী সম্ভবতঃ বিপদ আঁচ করেই বিদায়ী সাংসদ শ্রীমতি দেববর্মাকে সরিয়ে রাজ্যের মন্ত্রী বর্ষীয়ান সুব্রতবাবুকে এখানে প্রার্থী করেছেন। এর ফলে একদিকে যেমন শ্রীমতী দেবী জনিত দলমধ্যে ও জনমানসে ক্ষোভ প্রশমিত করা যাবে তেমনই সুব্রতবাবুর ইমেজ কাজে লাগিয়ে হৃত ভোট কিছুটা হলেও পুনরুদ্ধার হবে। বিশেষতঃ সুব্রত বাবু আগেও এখান থেকে প্রার্থী হয়েছিলেন ফলে এই অঞ্চল সম্পর্কে তিনি সম্যক অবহিত। বিজেপি হয়তো এই অকস্মাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতি সামাল দিতেই এখনো অবধি প্রার্থী নিশ্চিত করতে পারেনি। কিন্তু যাই হোক, এখানে এখন এডভ্যান্টেজ তৃণমূল। সুব্রত বাবু যদি ২% ভোটও স্যুইং করাতে পারেন (যেটা হবে বলেই বিশ্বাস) তাহলে তৃণমূল এই আসন ধরে রাখবে।
শ্রীমতী দেববর্মার কথা যখন হলোই তখন সেই প্রসঙ্গে আসানসোলের আলোচনাটাও সেরে ফেলা যাক। পঞ্চায়েত ভোট থেকে আসানসোলকে মাপা বাতুলতা যেহেতু এখানে সিংহভাগ ভোটারই শহরবাসী। কিন্তু তৃণমূলের প্রার্থী পরিবর্তন এবং শ্রীমতী দেববর্মাকে এখানে প্রার্থী করা একটাই ইঙ্গিত দিচ্ছে যে এবারেও এখানে পদ্মের দাপট থাকবে। পুরুলিয়া আর ঝাড়্গ্রাম নিয়েও আলোচনার পরিসর সামান্য। পঞ্চায়েত ভোটেই পুরুলিয়াতে পদ্মের দাপট দেখা গেছে। শুধু তাই নয় ভোটের পরপরই নেতারা অগ্রিম ঘোষণা করে পুরুলিয়া গেছেন গেছেন যে জেলাপরিষদ বিরোধী শূন্য হবে, কিন্তু, অন্যত্র বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাফল্য পেলেও পুরুলিয়ায় নেতারা পদ্মফুলের প্রতীকে বিজয়ীদের দলবদলাতে ব্যর্থ হয়েছেন। অধিকন্তু এরকম জনশ্রুতি যে বিবিধ কং বিধায়করা পুরুলিয়াতে পদ্মশিবিরে আসবেন। পুরুলিয়ায় এখনো বিজেপি প্রার্থী নির্বাচিত করেনি কিন্তু পুরুলিয়ায় গেরুয়া ঝাণ্ডা উড়বে ধরা যায় যেমন উড়বে ঝাড়গ্রামে। তৃণমূলের প্রার্থী পরিবর্তন এক্ষেত্রে বিশেষ কোন ছাপ ফেলবে বলে মনে হয় না। বরং ভূমিপুত্রকে প্রার্থী করে বিজেপি বাড়তি সুবিধা পাবে।
অন্যদিকে ঘাটালে ভারতী দেবী আবার দেবকে বিশেষ চ্যালেঞ্জ দিতে পারবেন না, প্রায় ২০% শতাংশ ভোট পার্থক্য যা ভারতী দেবীর পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভব হবে না। আকর্ষণের মূল বিন্দুতে থাকবে বরং মেদিনীপুর। বিজেপির রাজ্য সভাপতি এই আসন থেকে দাঁড়াচ্ছে কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা হচ্ছে ভূতপূর্ব সাংসদ অভিনেত্রীর সম্পর্কে বিবিধ নিষ্কর্মতার অভিযোগ এবং বর্তমান তৃণমূল প্রার্থীর বিষয়ে নানা স্তরে আন্তর্দলীয় ক্ষোভ। এই প্রেক্ষিতে যুযুধান দুই পক্ষের মধ্যে মাত্র ১% ভোটের পার্থক্য দেখা যাচ্ছে। ফলতঃ সাবেক কংগ্রেসী ভোটাররা কাকে ভোট দেবে তৃণ না কং তার উপরে নির্ভর করছে দিলীপ বাবু না মানস বাবু কে দিল্লী যাবেন?
বীরভূম নিয়ে বহু চর্চা হলেও এটা খুব কমই সামনে এসেছে যে বিষ্ণুপুর লোকসভা কেন্দ্রেও মাত্র ৮ শতাংশ মানুষ পঞ্চায়েতে ভোট দিয়েছিল। সমকালীন তৃণমূল সাংসদ সৌমিত্র খাঁ বেশ কিছুদিন হলো বিজেপিতে। এমনিতে অঙ্ক বলছে বিষ্ণুপুরে তৃণ আর পদ্মের মধ্যে ভোট পার্থক্য হবে ৮% এর কম। কাজেই সৌমিত্র বাবু যদি সঙ্গে ৪% ভোটও সঙ্গে নিয়ে আসেন তাহলে পদ্ম এখানেও ফুটবে। (সারণী 4B পশ্য, শতাংশের হিসেবে)
অর্থাৎ তিনটে কেস স্টাডি মিলিয়ে পর্যালোচনা শেষে বলা যায় রাজ্যের পশ্চিমাঞ্চলের এই আটটি আসনের বর্তমান ট্রেণ্ডঃ তৃণমূল = ২-৬, বিজেপি = ২-৬, বাম = ০, কং = ০।
পশ্চিমাঞ্চলের পরে এবার আসি রাজ্যের দক্ষিণ দিকেঃ আসন এখানেও আটটি- কাঁথি, তমলুক, উলুবেড়িয়া, ডায়মন্ডহারবার, জয়নগর, মথুরাপুর, বসিরহাট ও বনগাঁ। সারণী 5A তে এই আসনগুলোর জন্য নমিনাল ভোট ট্রেণ্ড দেখানো হয়েছে (কেস স্টাডি ২ মাফিক)। সেই হিসেবে এই আসনের আটটিতেই তৃণমূলের জয় পাওয়ার সম্ভাবনা প্রবল। যদি আসন ভিত্তিক আলোচনাতেও যাই তো দেখতে পাবো কাঁথি, তমলুক, উলুবেড়িয়া, জয়নগর আর মথুরাপুর এই পাঁচটি আসনে বিশেষ কোন অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়। প্রসঙ্গতঃ এদের মধ্যে দুটি (কাঁথি আর তমলুক) অধিকারীদের খাস তালুক পূর্ব মেদিনীপুরে। যদিও লক্ষ্যণীয় এই পাঁচটিতেই বিজেপির প্রাপ্য ভোট ৩০% ছাড়িয়ে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় বিজেপি লক্ষ্য হওয়া উচিত প্রতিটা কেন্দ্র থেকেই অন্ততঃ দুটি করে বিধান সভায় লীড নেওয়া যা আদতে ২০২১ এর লড়াইতে বিজেপির অবস্থানকে মজবুত করবে। যদিও বাকি তিনটি আসন যথা মতুয়া প্রভাবিত বনগাঁ এবং কৌম ভোট প্রভাবিত বসিরহাট আর ডায়মন্ডহারবারের ক্ষেত্রে প্রার্থীভিত্তিক সবিস্তার আলোচনা প্রয়োজন।
(চলবে)http://ritambangla.com/state/a-review-on-seventeenth-lok-sabha-election-fourth-part/
ড: অভিষেক অধিকারী।
সহকারী অধ্যাপক,আই আই টি
(বি:দ্র:তৃতীয়ভাগ পর্যন্ত ২১টি লোকসভা আসনের মধ্যে টিএমসি = ১১-১৯; বিজেপি = ২-৯, কং =০-১, বাম =০)