একই বৃন্তে চারটি কুসুম

স্বামীজী বলছেন, “গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে।” –“You will understand the Gita better with your biceps, your muscles, a little stronger.” বলছেন, “আমি এমন মানুষ চাই যাদের মাংসপেশী লোহা দিয়ে তৈরি, স্নায়ুগুলি ইস্পাত দিয়ে তৈরি আর এই দেহের মধ্যে এমন মন থাকবে যা বজ্রের উপাদানে গঠিত।” তিনি মনে করতেন দুর্বলতাই পাপ। শুভঙ্করী কাজে শক্তির প্রয়োগ প্রয়োজন। জগতের কল্যাণের জন্য, সমাজের মঙ্গলের জন্য শক্তির প্রয়োগই হচ্ছে ধর্ম। স্বামীজী মনে করতেন শারীরিক সৌর্বল্য আমাদের এক তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা যে একসঙ্গে মিলতে পারি না, পরস্পরকে ভালোবাসি না, তোতাপাখির মতো কথা বলে যাই, আচরণে পশ্চাৎপদতা দেখাই তার আসল কারণ হলো আমরা শারীরিকভাবে দুর্বল। বেদের প্রার্থনায় তাই বলের উপাসনা, সামর্থ্যের উপাসনা, শক্তির উপাসনার কথা পাই“তেজোহসি তেজোময়ি ধেহি। বীর্যমসি বীর্যং ময়ি ধেহি। বলসি বলং ময়ি ধেহি। ওজোহসিত্তাজা ময়ি ধেহি।” হে তেজস্বরূপ, আমায় তেজস্বী কর; হে বীর্যস্বরূপ, আমায় বীর্যবান কর; হে বলস্বরূপ, আমায় বলবান কর; হে ওজঃস্বরূপ, আমায় ওজস্বী কর। ঋগ্বেদ সংহিতা উদ্ধৃত করে বলছেন একচিত্ত হওয়াই সমাজ গঠনের রহস্য। “সং গচ্ছধ্বং সং বদধ্বং সং বো মনাংসি জানতাম।”
হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্মের সমন্বয় ও স্বামীজী :
স্বামী বিবেকানন্দ বৌদ্ধদের অজ্ঞেয়বাদ, জৈনদের নিরীশ্বরবাদ, গুরুগোবিন্দ সিংহের মতবাদের জায়গা হিন্দুধর্মে আছে বলে মনে করতেন। ১৮৯৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শিকাগো ধর্ম মহাসভার ষোড়শতম দিনের অধিবেশনে তিনি বললেন, “Hinduism cannot live without Buddhism, nor Buddhism without Hinduism…the Buddhists cannot stand without the brain and philosophy of the Brahmins, nor the Brahmin without the heart of the Buddhist. This separation between the Buddhists and the Brahmins is the cause of the downfall of India.” বৌদ্ধধর্ম ছাড়া হিন্দুধর্ম বাঁচতে পারে না। হিন্দুধর্ম ছেড়ে বৌদ্ধধর্মও বাঁচতে পারে না। ব্রাহ্মণের ধীশক্তি ও দর্শনের সাহায্য না নিয়ে বৌদ্ধরা দাঁড়াতে পারে না। বৌদ্ধ ও ব্রাহ্মণ্যের এই বিচ্ছেদই ভারতবর্ষের অবনতির কারণ। তিনি তাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় 76016201, “Let us then join the wonderful intellect of the Brahmin with the heart, the noble soul, the wonderful humanising power of the Great Master.”তাই তিনি প্রবুদ্ধ ভারত’ পত্রিকা প্রকাশে উদ্যত হয়েছিলেন ব্রাহ্মণের অভিনব ধীশক্তির সঙ্গে লোকগুরু বুদ্ধের হৃদয়, মহান আত্মা ও অসাধারণ লোককল্যাণশক্তি যোগ করতে। বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের হিন্দুধর্মের সঙ্গে একই ছায়ার নীচে আনতে চেয়েছিলেন। প্রবুদ্ধ’ কথাটির মধ্যে রয়েছেন হিন্দুদের দশাবতারের অন্যতম শেষ অবতার বুদ্ধ (প্র+বুদ্ধ=প্রবুদ্ধ)। তিনি মনে করতেন গৌতমবুদ্ধের সঙ্গে ভারত জুড়লে হিন্দুধর্মের সঙ্গে বৌদ্ধধর্মের সম্মিলন ঘটবে।“I repeat, Shakya Muni came not to destroy, but he was the fulfilment, the logical conclusion, the logical developmet of the religion of the Hindus.” হিন্দুদের মনে কোনো আঘাত না দিয়ে বৌদ্ধদের আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন তিনি। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে পড়বে প্রবুদ্ধ ভারতের প্রতি শীর্ষক তাঁর বিখ্যাত কবিতাটি—
“আবার প্রবুদ্ধ হও।
এ নিদ্রা, মৃত্যুতে নয়, জীবনেই ফিরাতে আবার,
এ শুধু বিশ্রাম, যাতে চোখে ভাসে নতুন স্বপ্নের
অদম্য সাহস।
দেখো, হে সত্য, পৃথিবী চায় তোমাকেই,
তুমি মৃত্যুহীন।”
স্বামী বিবেকানন্দ ও শিখধর্ম :
১৯০৩ সালের গ্রীষ্মকাল, মেদিনীপুর পৌঁছেছেন ভগিনী নিবেদিতা। দেশপ্রেমী যুবকেরা উল্লাসে চেঁচিয়ে উঠলেন, “হিহি হুররে’। না, না’, বারণ করে উঠলেন নিবেদিতা।এটা ইংরেজ জাতির বিজয়োল্লাস, ভারতীয়দের তা কিছুতেই ব্যবহার করা উচিত নয়, কখনই নয়।’হাত তুলে তিনি উচ্চৈস্বরে তিনবার বললেন— ‘ওয়া গুরুজীকি ফতে। বোল বাবুজীকি খালসা। গুর জয়, গুরুদেবের জয়, তিনিই আমাকে বাঁচিয়েছেন, তারই কৃপায় রক্ষা পেয়েছি। একদা এই ধ্বনি বীরত্বের লীলাভূমি পঞ্জাবে বীরেন্দ্র দেশপ্রেমিক শিখেরা দিমণ্ডল কম্পিত করে উচ্চারণ করত মোগল শিখের রণে।
দক্ষিণেশ্বরে নানকপন্থী সাধুরা আসতেন শ্রীরামকৃষ্ণ সান্নিধ্যে। তাঁরা শ্রীরামকৃষ্ণের সঙ্গে আধ্যাত্মিক আলোচনায় অংশ নিতেন। ১৮৮৩ সালের ২১ ডিসেম্বর, দিন উল্লেখ করে কথামৃতে রয়েছে, “অপরাহ্নে নানকপন্থী সাধু আসিয়াছেন। হরিশ, রাখালও আছেন। সাধু নিরাকারবাদী। ঠাকুর তাঁহাকে সাকারও চিন্তা করিতে বলিতেছেন।”(শ্রীরামকৃষ্ণ কথামৃত, প্রথম খণ্ড)। অনেকসময় পঞ্চবটীর তলায় এসে বসে থাকতেন নানকপন্থী সাধুরা। ঠাকুরের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল তাদের, যোগাযোগ ছিল চানক বা বর্তমান বারাকপুর পল্টনের সিপাই কুঁয়ার সিংহের সঙ্গে। তিনি ঠাকুরকে ‘নানক’ জ্ঞানে শ্রদ্ধা করতেন। কারণ ঠাকুরের মধ্যে তো ধর্মের সকল ধারার, সকল পন্থার বিকাশ! চানকের শিখ ও অন্যান্য সিপাইদের ঠাকুর আধ্যাত্মিক শিক্ষা দিয়েছেন, অভ্যাস যোগ করতে বলেছেন। এইভাবেই হিন্দু-শিখ ধর্মকে কাছাকাছি এনে ফেলছিলেন শ্রীরামকৃষ্ণ। | এবার ঠাকুরের শিষ্য স্বামীজীর উপর বর্তালো হিন্দু-শিখ সমন্বয়-নদীতে জোয়ার আনতে। হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি’ বিষয়ে লাহোরে ধ্যান সিংহের হাবেলিতে শিকাগো বিজয়ের পর ১৮৯৭ সালে বক্তৃতা দিলেন স্বামীজী (দ্রষ্টব্য : বিবেকানন্দ রচনা সমগ্র, অখণ্ড বাংলা সংস্করণ, নবপত্র প্রকাশন, কলকাতা, পৃ. ৭৭০-৭৭৬)। বললেন, “এখানেই অপেক্ষাকৃত আধুনিক কালে দয়াল নানক তার অপূর্ব বিশ্বপ্রেম প্রচার করেন। এখানেই সেইমহাত্মা তার প্রশস্ত হৃদয়ের দ্বার খুলে এবং বাহু প্রসারিত করে সমগ্র জগৎকে শুধু হিন্দুকে নয়, মুসলমানদেরও পর্যন্ত আলিঙ্গন করতে ছুটে গিয়েছিলেন। এখানেই আমাদের জাতির শেষ এবং মহামহিমান্বিত বীরগণের অন্যতম গুরু গোবিন্দ সিংহ জন্মগ্রহণ করেন।… আমাদের মধ্যে কী কী বিভিন্নতা আছে তা প্রকাশ করবার জন্যে আমি এখানে আসিনি। এসেছি আমাদের মিলনভূমি কোথায় তাই অন্বেষণ করতে। কোন ভিত্তি অবলম্বন করে আমরা চিরকাল সৌভ্রাতৃসূত্রে আবদ্ধ থাকতে পারি। কোন ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত হলে যে বাণী অনন্তকাল ধরে আমাদের আশার কথা শুনিয়ে আসছে, তা প্রবল থেকে প্রবলতর হতে পারে, তা বোঝার চেষ্টা করতে আমি এখানে। এসেছি।” দেখা যাচ্ছে বহুধা বিদীর্ণ ধর্মীয় মতবাদের মাঝে যোগসূত্র স্থাপনে অনন্য প্রয়াস-সাধনে হাত দিয়েছেন বীর সন্ন্যাসী। শিখ গুরুর মতোই তিনি বীর।
স্বামীজী বলেছিলেন, “বর্বর জাতির আক্রমণ-তরঙ্গ বারবার আমাদের এই জাতির মস্তিষ্কের ওপর দিয়ে চলে গেছে। শত শত বছর ধরে ধরে ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতের আকাশ মুখরিত হয়েছে। আর সেই সময় এমন কোনো হিন্দু ছিল না যে প্রতি মুহূর্তে নিজের বিনাশের আশঙ্কা করেনি।” (লাহোরে প্রদত্ত স্বামীজীর বক্তৃতা, বিষয় : হিন্দুধর্মের সাধারণ ভিত্তি, তথ্যসূত্র : ঐ, পৃ. ৭৭১)। শিখপন্থার মানুষের কাছে স্বামীজীর বার্তা ছিল, “যদি পারি তাহলে আমাদের পরস্পরের মিলনভূমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করব। এবং যদি ঈশ্বরের কৃপায় এ সম্ভব হয়। তাহলে ওই তত্ত্বকাজে পরিণত করতে হবে।”
ধর্ম ভারতবর্ষের আত্মা :
স্বামীজী রাষ্ট্রের আত্মার কথা বলেছেন। বলেছেন এই আত্মাতে যতদিন না ঘা পড়ে, ততদিন সেই রাষ্ট্রের মৃত্যু নেই। স্বামীজী উদাহরণ দিচ্ছেন রাষ্ট্রের আত্মা বা রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রীয়ত্ব যেন সাপের মাথার মণি, যেন। রূপকথার জগতে রাক্ষসীর প্রাণভোমরা-রূপ। ক্ষুদ্র পাখির ভিতর তার প্রাণ ততক্ষণ তাকে মারা যাবেনা। সাপ বা রাক্ষসীকে মারতে হলে। মাথার মণি সরাতে হবে, সেই প্রাণপাখিকে। টুকরো করে কেটে ফেলতে হবে। স্বামীজী বলছেন, ভারতবর্ষের যে রাষ্ট্রীয় সৌধ, ভারত রাষ্ট্রের যে মেরুদণ্ড তার আত্মা রয়েছে ধর্মে। ভারতের রাষ্ট্রীয় জীবন নিহিত আছে। হিন্দুধর্মে। তিনি ভারত রাষ্ট্রের মন ও প্রাণপ্রবাহের স্বরূপ চিহ্নিত করেছিলেন। বলেছিলেন ধর্ম অনুসরণ করলেই দেশ গৌরবান্বিত হবে। ধর্ম পরিত্যাগ করলে রাষ্ট্রীয় মৃত্যু অনিবার্য। বৈদেশিক আগ্রাসনকারীর অত্যাচারে মন্দিরের পরমন্দির ধ্বংস হয়েছে, নেমে এসেছে নানাবিধ আক্রমণ, ধ্বংসলীলা। কিন্তু অত্যাচারের স্রোতসামান্য বন্ধ হওয়ামাত্র পুনরায় উঁকি মেরেছেমন্দিরের চূড়া, স্পষ্টতর। হয়েছে পুনরাভ্যুত্থানের চিহ্ন। ধ্বংসাবশেষ থেকে উত্থিত হয়েছে নতুন জীবন, সে জীবন অটল-অচল ভাবে বিরাজ করেছে আগের মতোই।
রাক্ষসীর প্রাণ-পাখির মতো ভারতবর্ষের ধর্ম-রূপ প্রাণ-পাখিকে বিনাশ করা যায়নি। বলেই এত সয়ে এ জাতটা বেঁচে গেল। হাজার। হাজার বছরের স্বভাব— তা মরবেই বা কী করে?স্বামীজী ভারতবর্ষের এই জাতীয় চরিত্র বদলের কথা বলেননি। তার মতে যে নদী পাহাড় থেকে হাজার ক্রোশ নেমে আসে তাকে ফের পাহাড়ে ফিরিয়ে দেওয়া যায় না। বলছেন, যদি এ দশ হাজার বছরের জাতীয় জীবনটা ভুল হয়ে থাকে তো এখন উপায় নেই, এখন একটা নতুন চরিত্র গড়তে গেলেই মরে যাবে বই তো নয়। বলছেন, যে দেশের প্রাণ ধর্ম, ভাষা ধর্ম, ভাব ধর্ম সে দেশকে ধর্মের মধ্য দিয়েই সব করতে হবে।“রাস্তা বেঁটানো, প্লেগ নিবারণ, দুর্ভিক্ষগ্রস্তকে অন্নদান, এসব চিরকাল এদেশে যা হয়েছে তাই হবে, অর্থাৎ ধর্মের মধ্য দিয়ে হয় তো হবে, নইলে ঘোড়ার ডিম, তোমার চেঁচামিচিই সার…।” ভারতবর্ষের পক্ষে ধর্মের মধ্য দিয়ে ছাড়া কাজ করবার যে অন্য উপায় নেই তা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বামীজী জানিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সতর্ক করে তিনি বলেছেন ধর্ম ছেড়ে জড়বাদসর্বস্ব সভ্যতার অভিমুখে ধাবিত হলে ভারতবর্ষের সুবিশাল রাষ্ট্রীয় সৌধ তিনপুরুষ যেতে না যেতেই বিনষ্ট হবে, হিন্দুর মেরুদণ্ড ভেঙে যাবে।
এ প্রসঙ্গে স্বামীজীর পরামর্শ হলো, যে অমূল্য ধর্মসম্পদ উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছি তা প্রাণপণে ধরে রাখতে হবে। এখানেই তিনি থেমে থাকেননি। বলেছেন, তোমরা ধর্মে বিশ্বাস কর বা নাই কর, যদি জাতীয় জীবনকে অব্যাহত রাখতে চাও, তবে তোমাদিগকে এই ধর্মরক্ষায় সচেষ্ট হইতে হইবে। তিনি একহাতে দৃঢ়ভাবে ধর্মকে ধরে অন্য হাত প্রসারিত করতে বলেছেন শেখবার জন্য, বলেছেন সেই শিক্ষণীয় বিষয় যেন হিন্দুজীবনের মূল আদর্শের অনুগত হয়। “What we want are western science coupled with Vedanta and Brahmacharya as the guiding motto.” এটিই হচ্ছে নতুন যুগের বিশ্বায়নের মূলমন্ত্র। পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সঙ্গে বেদান্তের সমন্বয়, যার মূলে থাকবে ব্রহ্মচর্য।
হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ— বিশ্বের এই চারটি ধর্মের উৎসভূমি ভারতবর্ষ। আলাদা ধর্ম বলা হলেও তা যে আদতে একই ধর্মের কুসুমোদ্যানে প্রস্ফুটিত পৃথক ফুল— সেই শাশ্বত সত্যটি প্রকাশ করাই বর্তমান ভারতে একান্তভাবে জরুরি হয়ে পড়েছে।
ড. কল্যাণ চক্রবর্তী

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.