যাদের চোখের সামনে ঘটেছিল বিস্ফোরণটা, তাদের বেবাক দৃষ্টি যেন তিরের। মতো বিধছিল। তাদের একটাই প্রশ্ন— হিরোসিমা- নাগাসাকি কি ফিরে এল ? তীব্র আগ্নেয় গোলক তুষারশুভ্র ধোয়ার কুণ্ডলী ছড়িয়ে যখন ছুটছিল নীল আকাশকে লক্ষ্য করে, তখন টিভির পর্দায় কোটি কোটি দর্শকের বিস্ফারিত নেত্র একটাই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল— কত হাজার কেজি বিস্ফোরকে আগুন লাগালে তবে হতে পারে এমন বিস্ফোরণ। এগুলো কি সত্যিই বারুদ নাকিআরডিএক্স-এর মতো প্রাণঘাতী বিস্ফোরক যা নাশকতাপন্থী দাউদ ইব্রাহিম, তালিবান আর ধ্বংসের উন্মত্ততায় মেতে ওঠা আই এস বাহিনীর সবচেয়ে বড়ো অস্ত্র হিসেবে স্বীকৃত?
বিস্ফোরণ গঙ্গার ওপারে নৈহাটিতে। মাঝখানে হাত পা ছড়িয়ে শীতের দুপুরে পড়ে থাকা বিস্তীর্ণ গেরুয়া গঙ্গা। কিন্তু কেঁপে উঠল এপারের চুচুড়াও। ভেঙে পড়ল, দেওয়ালে ফাটল ধরল কমবেশি ৬০০ বাড়ি। এমনকী স্থানীয় পুরভবন-সহ চারটি সরকারি বাড়িও। কোনো বাড়ির শক্তপোক্ত দরজা ভেঙে পড়েছে সপাটে। কোনো বাড়ির জানালার কাচ সব ভেঙে পড়েছে ঝনঝন করে। খসে পড়েছে। অ্যাসবেস্টসের ছাউনি। পলেস্তারাহীন পলকা দেওয়ালও। নৈহাটির গঙ্গাপাড়ের বাড়িগুলির মতোই সমানভাবে ক্ষতিগ্রস্ত এপারের প্রতাপপুর, জোড়াঘাট, ময়ূরপঙ্খী ঘাট চকবাজার বাবুগঞ্জ-সহ বিস্তীর্ণ এলাকা।
গত ৯ জানুয়ারি এই বিস্ফোরণ ঘটার এক সপ্তাহ আগেই নৈহাটির দেবক গ্রামে বাজি কারখানার ভয়াবহ বিস্ফোরণ স্পষ্ট করে দিয়েছিল বাজি কারখানায় শুধু বাজিই হতো না। তৈরি হতো ভয়াবহ বিস্ফোরকশক্তি-সহ বোমাও। ওই কারখানারই অক্ষত বারুদের স্কুপ এনে ফেলা হয়েছিল নৈহাটির গঙ্গাতীরে ছাইঘাটে পুলিশি তত্ত্বাবধানে। তাতেই ধরানো হয়েছিল আগুন পুলিশি নিয়ন্ত্রণেই। পুলিশও কি ভাবতে পেরেছিল— ওগুলো শুধুমাত্র বাজি তৈরির বারুদ ছিল না?
একটু পিছিয়ে যাওয়া যাক। এরাজ্যে তখন বাম-জমানা। মুখ্যমন্ত্রী পদে আসীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। অতি সংগোপনে সীমিত কয়েকজন ঘনিষ্ঠ সাংবাদিককে তিনি বলেছিলেন, “বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, আমরা, পশ্চিমবঙ্গবাসীরা বারুদের স্কুপের ওপর বসে আছি। যেদিন একটা স্ফুলিঙ্গের স্পর্শ পাবে, সেদিনই কেঁপে উঠবে গোটা রাজ্য। বলেছিলেন, এ রাজ্যের প্রতিটি মাদ্রাসা জঙ্গি তৈরির কারখানা। প্রতিবছর এইসব মাদ্রাসা থেকে প্রশিক্ষিত হয়ে সন্ত্রাসবাদীদের তালিকায় নাম লেখাচ্ছে হাজার হাজার জেহাদি মুসলমান যুবক।
সেদিনের বারুদ আজ তৃণমূলি জমানায় ভয়াবহ বিস্ফোরকে পরিণত হয়েছে। তার প্রমাণ কয়েক বছর আগে বর্ধমানের খাগড়াঘাটের ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা। বুদ্ধদেববাবু কিছু করতে পারেননি। কিন্তু সত্যিটা স্বীকার করেছিলেন। এখনকার সরকার সত্য স্বীকারের ধার ধারে না। নৈহাটির বিস্ফোরণের পরেও এরাজ্যের সততার খোলস খসে যাওয়া মুখ্যমন্ত্রী একবারও সত্যিটা মেনে নেননি যে, গতন’বছর ধরে তারই প্রশ্রয়ে পশ্চিমবঙ্গ বিস্ফোরকের গুদামঘরে পরিণত হয়েছে। একবারও রাজ্য প্রশাসন স্বীকার করেনি, দেবক গ্রামের বাজি তৈরির কারখানা ছিল এ রাজ্যের বোমা-শিল্পের আঁতুড়ঘর। বিস্ফোরণে ক্ষতিগ্রস্ত নৈহাটির মানুষ। যখন সত্যটা জানতে পথে নেমেছেন, তখন মুখ্যমন্ত্রী অনেক দূরের জনসভায় দাঁড়িয়ে বলেছেন, বোমা নিস্ক্রিয় করতে গিয়ে ভুলচুক করে ফেলেছে পুলিশ। আমরা সব ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণ দেব। আহা! কী মধুর বাণী। সেই কামদুনি বা সুজেটের ধর্ষণের কাহিনির পরের প্রতিক্রিয়া মতো— ‘ওসব ছোটোখাটো ঘটনা। দুষ্টু ছেলেরা করে ফেলেছে। যেন মুখ্যমন্ত্রী চোখে দেখেন না কিছু। কানে শোনেন না কিছু। তদন্তের কথা নৈব নৈব চ। শুধু ক্ষতিপূরণ। রাজ্যটাকে গোটা রাজ্যবাসীকে তিনি ভিখারির চেয়ে বেশি কিছু ভাবতেই পারেন না। তাই জনগণের করের টাকা বিলোন দু’হাতে ভোট কিনতে আর ক্ষমতা ধরে রাখতে। এর বেশি আর কিছু তিনি ভাবেনই না।
খুব সাম্প্রতিক হিসেব বলতে পারব না। কারণ, সে সব হিসেবে মিশে আছে প্রচুর জল যেমন জল মিশে আছে মিড ডে মিলের হিসেবে, কন্যাশ্রী, রূপশ্রী প্রকল্পের টাকায়, স্বাস্থ্যশ্রী, যুবশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী, সংখ্যালঘু স্কলারশিপ প্রকল্পে। কিন্তু প্রমাণ হিসেবে দাখিল করা যাক ২০১৪ সালের একটি হিসাব। ওই বছর এরাজ্যে ধরা পড়েছিল ৪৯৩০টি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র ২৭০২০টি গ্রেনেড, ৮৪০টি রকেট লঞ্চার, ৩০০টি রকেট, ২০০০ গ্রেনেড লঞ্চিং টিউব, ৬৩৯২টি বুলেট ম্যাগাজিন এবং ১১৪০৫২০টি বুলেট। সবই বেআইনি। আর প্রতিটি ঘটনায় ধৃত অভিযুক্তরা হলেন সংখ্যালঘু মুলমান। ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্স এজেন্সি জানাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গে ৪৫০০টি মাদ্রাসায় চলছে জেহাদি প্রশিক্ষণ। যার সিংহভাগ মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং নদীয়ার সীমান্তে এবং প্রতিটি মাদ্রাসার পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ রয়েছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠী।
না, মুখ্যমন্ত্রী এসবকিছুই জানেন না। জানেন না এরাজ্য থেকে নাবালিকা মুসলমান মেয়েগুলো কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে বছরের পর বছর ধরে এবং নারী পাচারের শীর্ষস্থানে এবছরও মুখ আলো করে বসে আছে পশ্চিমবঙ্গ। মুখ্যমন্ত্রী দেখেও দেখেও দেখেন না, এইসবনাবালিকাকে পাঠানো হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী প্রশিক্ষণ ক্ষেত্রে, এমনকী গৃহবধূদেরও।
সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, ১৯৭০ থেকে ২০১৬ গোটা ভারতবর্ষে এই ৪৬ বছরে ৯৯৪২টি সন্ত্রাসবাদী হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন ১৮৮৪২ জন। গুরুতর জখম হয়েছেন, ২৮৮১৪ জন। প্রতিটি ঘটনার পিছনেই রয়েছে মুসলমান সন্ত্রাসবাদীরা। অথচ পশ্চিমবঙ্গে প্রতিদিন গজাচ্ছে নতুন নতুন মসজিদ সরকারি মদতে। জেলায় জেলায় গড়ে উঠছে হজ হাউস। গড়ে উঠেছে ৪০০-র বেশি মাদ্রাসা হস্টেল। চল্লিশ হাজার ইমামকে মাসে ২৫০০ করে ভাতা দেওয়া হচ্ছে। কারণ, বিবি সাহেবানের মূল লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গটাকে মুসলমান প্রধান রাজ্য হিসেবে গড়ে তোলা। সেটা করতে পারলে শুধু তার গদি নয়—নিশ্চিত হয়ে যাবেতার ভাইপো-সহ আগামী ১৪ পুরুষের তখত দখল।
প্রশ্ন হলো, কোন পথে চলেছে পশ্চিমবঙ্গ ? একজন শাসকের ব্যক্তিগত স্বার্থ যখন গোটা দেশকে, দেশের মানুষের স্বার্থকে বিসর্জন দিতে উদ্যত হয়, তার পরিণাম কী ভয়াবহ হতে পারে, কদিন আগে ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের বিরোধিতায় জেহাদি মুসলমানদের ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ থেকে তা পরিষ্কার। একদিনে শুধু দক্ষিণ-পূর্ব রেলেই তারা ১৬ কোটি টাকার ক্ষতিসাধন করেছে। পরবর্তী ক’দিন মিলিয়ে। গোটা দেশে এই হার্মাদবাহিনী শুধুমাত্র রেলের ক্ষতিসাধন করেছে ৭০ কোটি টাকার। মাত্র ২/৩ দিনেই বোঝা গেছে, এ রাজ্যে কাদের মাথায় তুলে ধিনধিন করে নাচছেন মুখ্যমন্ত্রী? কাদের হাতে তুলে দিতে চাইছেন এ রাজ্যে তার বরাভয়ের আশীর্বাদ? কাদের ভোটের আশায় তিনি রাজ্যের ভূমিপুত্রদের বিরুদ্ধে ছোবল তোলার ইন্ধন জোগাচ্ছেন? কেন তিনি বাধা দিচ্ছেন জাতীয় জনগণনায়? জাতীয় নাগরিকত্ব আইনে? নাগরিক পঞ্জিকরণে?
হিসেব মেলালে দেখা যাবে, এরাজ্যের শাসক এবং তার পরিচালিত শাসকদলের কতিপয় চরম ধান্দাবাজ মন্ত্রী ও কলাকুশলীদের ছত্রছায়ায় গোটা রাজ্য তলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারের গর্ভে। মুখে যতই উন্নয়নের বাণী ছড়ান, সবটাই যে নাটক, তা আজ মানুষের কাছে স্পষ্ট। মা-মাটি-মানুষের স্লোগান তুলে তিনি রাজ্যের ভূমিপুত্রদের জমিহারা করতে চাইছেন। ভূমিপুত্রদের শিকড়ে আঘাত হানতে চাইছেন। বুঝতে পারছেন না, রাজ্যের শহরে গ্রামে সর্বত্র তিনি নিজের হাতে শতশত ফ্রাঙ্কেনস্টাইন তৈরি করছেন। এমন একদিন আসবেই (এবং সম্ভবত সেদিন বিশেষ দূরে নয়) যেদিন ওই হাজার হাজার সংখ্যালঘু ফ্রাঙ্কেনস্টাইন শাসকের গলা টিপে ধরবে। সেদিন তিনি কীভাবেনিজেকে রক্ষা রাখবেন, সে ভাবনা তার ব্যক্তিগত। কিন্তু সমস্যা হলো, ততদিনে দেশের সমূলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। পাচ্ছেন না।
আজ যখন গোটা রাজ্য দাঁড়িয়ে আছে তীব্র । বিস্ফোরণের মুখে, যখন প্রশাসনিক স্থবিরতায় গোটা রাজ্যের মানুষ ছিন্নমূল হবার সম্ভাবনার মুখে দাঁড়িয়ে, তখন সামগ্রিকভাবে রাজ্যের ভূমিপুত্ৰ তথা হিন্দু জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। ধর্মনিরপেক্ষতার খোলসে নিজেকে আবৃত রেখে কোনো হিন্দুই এই সংখ্যালঘু তোষণকারী সরকারের গ্রাস থেকে নিজেকে এবং নিজের পরিবার বা সম্পত্তিকে রক্ষা করতে পারবে না। ঠিক তেমনটি পারেননি বাংলাদেশের হিন্দু জনগণ।
আজ বাংলাদেশের হিন্দু জনগণের দুরবস্থার কথা চিন্তা করে পশ্চিমবঙ্গের হিন্দু বঙ্গসন্তানদের ঘুম ভেঙে জেগে ওঠার সময় এসে গেছে। মনে রাখবেন, আপনি যখন রুখে দাঁড়াবেন তখন শাসকদল আপনাকে বলবে সাম্প্রদায়িক। শাসকদল আপনার বিরুদ্ধে ঘরশত্রুদের লড়িয়ে দেবে। আপনাকে অপমান করা হবে। হেনস্থা করা হবে। মিথ্যা মামলায় ফাসানো হবে।
এগুলো শত্রু শিবিরের স্ট্রাটেজি। লড়াই দরকার এই স্ট্রাটেজির বিরুদ্ধে। একা নয়— সঙ্ঘবদ্ধ আন্দোলন। এটা রাজনীতির লড়াইনয়। ভুলে যান, আপনি কংগ্রেস, আপনি বিজেপি, আপনি বামপন্থী কিংবা আপনি তৃণমূল কংগ্রেস। আপনার একটাই পরিচয়, আপনি বঙ্গসন্তান। পশ্চিমবঙ্গের ভূমিপুত্র। আপনি বিদেশি নন। আপনি অনুপ্রবেশকারী নন। আপনার দেশ ভারতবর্ষ। আপনার রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ। বঙ্গমাতাকে রাখার দায়িত্ব আপনার, আমার, আমাদের সকলের।
সুজিত রায়
2020-01-25