যেদিন বাজি নিষ্ক্রিয় করতে গিয়ে নৈহাটিতে বিস্ফোরণ ঘটল, সেদিন সন্ধ্যেবেলার ঘটনা। কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে এক লেখক বন্ধু মোবাইলে বিস্ফোরণের ছবি দেখিয়ে বললেন, ‘সর্বনাশ! এ তো পুরো হিসোসিমা। বন্ধুর বিস্ময় অকারণ বলা যাবে না। বিস্ফোরণের পর বিশাল আগুনের গোলা এবং ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখে হিরোসিমার কথাই প্রথমে মনে আসে। সেই সঙ্গে একটা প্রশ্নও উঠে আসে। পশ্চিমবঙ্গের আজকের রাজনৈতিক সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই বিস্ফোরণ কি অপ্রত্যাশিত?
বস্তুত দেবকের বাজি তৈরির কারখানাটি কয়েক দশক ধরে চলছে। এর সূত্রপাত বাম আমলে। তখন থেকেই পশ্চিমবঙ্গের বাজির কারখানাগুলিকে বোমা তৈরির কারখানায় পরিণত করা চলছে। তৃণমূল আমলে বোমা শিল্পে আরও কয়েক কদম এগিয়ে গেছে পশ্চিমবঙ্গ। দেবকের বিস্ফোরণের তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছে, এই কারবারে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত একটি সমাজবিরোধীদের চক্র। ভিনরাজ্য থেকে বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ে আসা থেকে এখানে তৈরি সামগ্রী অন্যত্র পাঠানো, সব কিছুর নিয়ন্ত্রক এই চক্রটি। এমনও কিছু কারখানা চলে, যেগুলির মালিকের বাড়ি দেবক গ্রামে নয়। জেলার অন্যত্র থেকে বা ভিন জেলার বাসিন্দা হয়েও দেবক গ্রামে কারখানা চালায়। কারখানায় শুধু শ্রমিকেরা কাজ করে। দেখভালের দায়িত্বে থাকে ওই সমাজবিরোধী চক্রটি। স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ, এই চক্রটিকে ভাঙতে পারেনি পুলিশ। এই চক্রে শাসকদলের নেতাদের মদত রয়েছে। পার্টি তহবিলে উৎসবগুলিতে মোটা অঙ্কের চাঁদা দেয় বাজি কারখানার মালিকেরা। যার ফলে পার্টির নেতারা সব জেনেও চুপ করে বসে থাকে।
একইরকম কথা শোনা গেছে ব্যারাকপুরের বিজেপি সাংসদ অর্জুন সিংহের মুখেও। দেবকের বাজি কারখানায় যেদিন বিস্ফোরণ ঘটল সেদিন অর্জুন সিংহ বলেন, কোনও বাজির বিস্ফোরক থেকে এতবড়ো ঘটনা ঘটতে পারে না। এখানে ১০০টিরও বেশি অবৈধ বাজি কারখানার। আড়ালে শক্তিশালী বোমা তৈরি করা হয়। সেই বোমাই গোটা ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চল জুড়ে সরবরাহ করা হয়। সেরকমই তীব্র শক্তিশালী কোনও বিস্ফোরক এখানে মজুত ছিল। তিনি দাবি করেন, পুলিশ গোটা ঘটনা ধামাচাপা দিতে চাইছে। ওরা দিনের পর দিন এই অবৈধ কারবার চালিয়ে আসছিল। আমি এই ঘটনা ইতিমধ্যেই কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে জানিয়েছি। আমি চাই এনআইএ এই ঘটনার তদন্ত করুক। এটা দ্বিতীয় খাগড়াগড় বলে মনে হচ্ছে। আমার।
পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে একনায়কতান্ত্রিক প্রভাব যত বাড়ছে, ততই বেলাগাম। হয়ে উঠছে এইসব অবৈধ বাজির কারখানা। এখানে বছরে মাত্র তিন মাস বাজি তৈরি হয়, বাকি ন’ মাস বোমা। বলা বাহুল্য, প্রধানত বিরোধী কণ্ঠস্বর দাবিয়ে রাখতে এই বোমা ব্যবহার করেন শাসকদলের নেতাকর্মীরাই। সব থেকে আশ্চর্যের ব্যাপার হলো, খুনোখুনির ওই রাজনীতির শিকার মাঝে মাঝে তৃণমূল কর্মীরাও হন। গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে দীর্ণ তৃণমূলের এক গোষ্ঠীর কর্মী অন্য গোষ্ঠীর ছোঁড়া বোমায় খুন হন। এরকমই এক ঘটনার সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। মুর্শিদাবাদ জেলায়। গত বছরের জুন মাসের ঘটনা। তৃণমূলেরই দুটি গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘর্ষে নিহত হন মিন্টু মণ্ডল, নান্টু মোল্লা এবং ছবি শেখ। একটি নদীবন্দরের দখল নিয়ে লড়াই চলছিল দুই গোষ্ঠীর মধ্যে। একই রকম ঘটনার সন্ধান আমরা পাচ্ছি। উত্তর চব্বিশ পরগনার কঁকিনাড়ায়। লোকসভা নির্বাচনে জেতার পর সেখানে বিজয় মিছিল বের করেছিল বিজেপি। তৃণমূলের গুন্ডারা মিছিল লক্ষ্য করে বোমা ছোঁড়ে। বিজেপির দু’জন কর্মী মারা যান। গত বছর জামাই ষষ্ঠীর রাতে সন্দেশখালিতে বিজেপি কর্মীদের ওপর হামলা করেছিল তৃণমূলের গুন্ডারা। সেখানেও বোমা এবং তিনজন বিজেপি কর্মীর মৃত্যু হয়।
সুতরাং দেবকের ঘটনা মোটেই অপ্রত্যাশিত নয়। পশ্চিমবঙ্গের কোনও রাজনৈতিক কর্মী, বিশেষ করে ভারতীয় জনতা পার্টির কর্মী যে কোনওদিন বোমার আঘাত পেতে পারেন। কারণ পশ্চিমবঙ্গের শাসক এখন যেন তেন প্রকারে বিজেপিকে থামাতে চায়। তার জন্য বাজির কারখানায় বোমা বানাতে হলে বানাতে হবে। আরও দু-একটা খাগড়াগড় হলে হবে। এমনকী বারুদের স্কুপের ওপর আসীন পশ্চিমবঙ্গ যদি একদিন ধোঁয়ার কুণ্ডলী হয়ে উড়ে যায়, তাতেও কুছ পরোয়া নেহী! আমাদের মুখ্যমন্ত্রী আছেন, তিনি প্রেসকে বলে দেবেন, ওসব ছোটো ঘটনা। ভুল করে হয়ে গিয়েছে।
সন্দীপ চক্রবর্তী
2020-01-25