ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, পর্তুগিজ ভাস্কো-ডা-গামা ১৪৯৭ খ্রিস্টাব্দে জাহাজে করে বেরিয়ে পড়েন আফ্রিকার দক্ষিণ অংশে দেশ আবিষ্কারের নেশায়। তারপর সেখান থেকে ১৪৯৮ সালে ভারতের কালিকটে পৌঁছোন, সঙ্গে প্রচুর মশলাপাতি ও দামি দামি অলংকার। বলা হয়ে থাকে 67 Shortly after Vasco-da-Gama reached India in 1498, the Portuguese set up a trading base in Goa. এর পর-পরই ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ-১ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে একটি সনদ বা চার্টার দেন ভারতে ব্যবসা বাণিজ্য করার। মধ্যযুগের সময়কালীন কর্পোরেট চার্টারের অর্থ ছিল সম্রাট, রাজা বা রানির অনুমতিক্রমে বাণিজ্যের অধিকার। এককথায় কর্পোরেট চার্টার হচ্ছে রাজা বা রানির কাছ থেকে পাওয়া এক ধরনের ব্যবসায়িক অধিকার। পাশাপাশি কর্পোরেট চার্টার ছিল রাজশক্তির ক্ষমতা অপব্যবহারের এক প্রাতিষ্ঠানিক হাতিয়ার। যেমন ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের রানি এলিজাবেথ-১ কর্তৃক ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে প্রদত্ত চার্টার বা সনদ ছিল কর্পোরেট চার্টার। ভারতীয় উপনিবেশ অর্থনীতির ওপরে নিরঙ্কুশ নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার উদ্দেশ্যেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তা প্রযুক্ত করেছিল। এর ফলে সুরাট, মাদ্রাজ, বোম্বে এবং কলকাতায় ইংরেজদের ব্যবসা কেন্দ্র স্থাপিত হয়। জানা যায় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ১৬৫১ সালে তাদের প্রথম কুঠি স্থাপন করে বাংলাদেশে। এদিকে ফরাসিরা ১৬৬৮ সালে তাদেরও কুঠি স্থাপন করে পণ্ডিচেরীতে। এরপর ১৬৮২ সালে উইলিয়ম হেজেস্ যখন ইংরেজ কোম্পানির প্রথম গভর্নর ও এজেন্ট হিসেবে হুগলী এসে পৌঁছোন, তখন দেখেন মোগল রাজপুরুষদের খাই এত বেড়ে গেছে যে ব্যবসা বাণিজ্যের হাল খুব সঙ্গিন হয়ে পড়ছে। ফলে “The administration of Black Zaminder had been more beneficial to himself than to them.” একটা কথা প্রচলিত আছে যে বঙ্গপ্রদেশে স্বাধীনভাবে বাণিজ্য করার অধিকার ইংরেজরা পেয়েছিল ব্রাউটন নামে একজন দেশওয়ালি চিকিৎসকের দৌলতে। মোগল বাদশা শাহজাহান তখন অসুস্থ। শুরু হয়েছে অন্তদ্বন্দ্ব, দিল্লির মসনদ নিয়ে ভ্রাতৃঘাতী সংগ্রাম। বিহারের মুঙ্গের থেকে সুজা ফৌজ নিয়ে ছুটলেন দিল্লির দিকে। এলাহাবাদ পেরোতে না পেরোতেই রুখে দাঁড়ালো ঔরঙ্গজেবের বিরাট ফৌজ। লড়াইয়ে হেরে গিয়ে সুজা ডেরা গাড়লেন বাঙ্গলায়। ততক্ষণে দিল্লির মসনদ দখল করেছেন ঔরঙ্গজেব। বন্দি করেছেন বৃদ্ধ পিতাকে আগ্রায়। সুজার হাল সঙ্গিন। আহা! লোকের মতো লোক হলেন সুলতান সুজা। বণিক ইংরেজদের ওপর ভারী সদয়। হবেন নাই বা কেন? একটা কৃতজ্ঞতাবোধ তো আছে। তাঁর প্রিয় বোন জাহানারার পোশাকে একবার আগুন ধরে গেল। দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো আগুন। অতিকষ্টে যখন আগুন নিভলো, শাহজাদির তখন অন্তিমকাল। অগর হাকিম বৈদ্য হার মানলো। বুঝি জীবনের আর কোনো আশা নেই। গুজরাটের সুরাটে খবর গেল। ডাক পড়লো ডাঃ গেব্রিয়েল ব্রাউটনের। জাহাজের ইংরেজ সার্জেন। সুরাট থেকে আগ্রা। তার চিকিৎসায় শাহজাদি সুস্থ হলেন। সুলতান সুজা খুশি মনে ডাঃ ব্রাউটনকে নিয়ে এলেন রাজমহলে। দিতে চাইলেন ইনাম। সুসভ্য ইংরেজ সন্তান ডাঃ ব্রাউটন নিজের জন্য কিছুই চাইলেন না। চাইলেন স্বজাতি ইংরেজদের জন্য নিশান। ব্যবসায়ের ছাড়পত্র। যার তিন হাজার টাকা বার্ষিক করের বিনিময়ে। ইংরেজ বণিকরা পেল ওড়িশা, বাঙ্গলায় অবাধ বাণিজ্যের অধিকার। বিনা শুল্কে। এটা সুলতান সুজারই দান। আর ইংরেজ ডাক্তার গেব্রিয়েল ব্রাউটন দেখালেন, স্বজাতিপ্রেম কাকে বলে। এই কাহিনির সত্যাসত্য নিয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও একথা ঠিক, ডাঃ ব্রাউটন তৎকালীন বাঙ্গলার সুবেদার শাহ সুজার পত্নীর রোগ নিরাময় করেছিলেন এবং সেই সূত্রে তাঁর কাছ থেকে আদায় করেছিলেন হুগলী বালেশ্বরে কুঠি স্থাপনের অনুমতি। অনুমতি বার্ষিক তিন হাজার টাকা শুল্ক দিয়ে বঙ্গদেশে বাণিজ্য করার অধিকার। এদিকে কলকাতার জনক জব চার্নকের সুতানুটি ডায়েরি থেকে জানা যায় যে তিনি ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এজেন্ট। তিনি প্রথমবার সুতানুটি এসেছিলেন ১৬৮৬ সালের ২০ ডিসেম্বর। হুগলী থেকে তাড়া খেয়ে। দ্বিতীয়বার আসেন ১৬৮৭ সালের ২০ সেপ্টেম্বর। উলুবেড়িয়া থেকে। তার তৃতীয়বার প্রত্যাবর্তন ২৪ আগস্ট ১৬৯০ সাল। তিনি তার লগবুকে লিখে গেছেন—“২৪ আগস্ট ১৬৯০, আজ সাঁকরাইল পৌঁছে ক্যাপ্টেন ব্রুককে আদেশ দিলাম তার জাহাজ নিয়ে সুতানুটি যেতে। আমরা সেখানে পৌঁছালাম মধ্যাহ্নে। কিন্তু পৌঁছে দেখি, জায়গাটার অবস্থা শোচনীয়। আমাদের মাথা গোঁজবার মতো কোনো ঠাই আর অবশিষ্ট নেই। এদিকে দিনরাত বৃষ্টি ঝরছে অঝেরে। বাধ্য হয়ে আশ্রয় নিতে হলো নৌকায়।” এরপর থেকে তিনি থেকে যান এখানেই। সুতরাং ১৬৯০ সালের ২৪ আগস্টকেই ধরা হয় কলকাতার জন্মদিন। যাইহোক, ১৬৯৮ খ্রিস্টাব্দে নবাব আজিম উত্সনের ছেলে। ফারুকসিয়রকে ১৬ হাজার টাকা উপঢৌকন অর্থাৎ ঘুষ জুগিয়ে আরমানি সদাগর খোজা সরহাদের ওকালতিতে নবাবপুত্রের অনুমতি আদায় করে সুতানুটি, গোবিন্দপুর আর কলকাতা—এই তিনটি ভিন্নমতে ১৬ শশা টাকায়। জমিদার সাবর্ণ চৌধুরীদের তখন পড়তির দশা। ইংরেজরা ছিলেন সদাগর, হয়ে গেল বণিক। এদিকে ১৭০০ সাল নাগাদ ভারতের অভ্যন্তরে নানারকম বিদ্রোহ মোগল সাম্রাজ্যের ভিত্তিকে দুর্বল করতে থাকলো। পাশাপাশি, ফরাসি এবং ইংরেজরা ভারতের ওপর কতৃত্ব স্থাপনের জন্য নিজেদের মধ্যে একটা প্রতিযোগিতা শুরু করে দিল। পাশাপাশি বাঙ্গলায় ওলন্দাজ, পর্তুগিজ প্রভৃতি বণিকদের তুলনায় ইংরেজ বণিকদের রমরমা। কারণ ইতিমধ্যেই ইংরেজরা ডাঃ গেব্রিয়েলের সুবাদে বাঙ্গলায় নিঃশুল্কে বাণিজ্য করার অধিকার পেয়ে গেছে। অপরদিকে বাঙ্গলার নবাব সিরাজদৌল্লা ইংরেজ বণিকদের কলকাতায় বাড়বাড়ন্ত দেখে মুর্শিদাবাদ থেকে সৈন্যসামন্ত নিয়ে কলকাতায় আসেন এবং ১৭৫৬ সালের ২০ জুন রবার্ট ক্লাইভ -সহ ইংরেজদের কলকাতা থেকে সমূলে বিতাড়ন করেন। সঙ্গে সঙ্গে ইসলামিক রীতি অনুযায়ী কলকাতার নাম পাল্টেনামকরণ করেন আলিনগর।
প্রায় একই সময়ে বাঙ্গলার নবাব সিরাজ ইংরেজদের ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গটিরও দখল নেন। আমরা অতুলকৃষ্ণ রায়ের ‘কলকাতার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস থেকে জানা যায় যে, শোভা সিংহের বিদ্রোহ আর তাঁর আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ইংরেজরা নবাবের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন দুর্গ গড়ার অধিকারের। নবাব দুর্গ গড়ার হুকুম দেননি। শুধু বলেছিলেন নিজের কুঠি রক্ষা করার জন্যে ব্যবস্থা নিতে পার। ব্যস, এটুকু অনুমতিতেই ইংরেজরা ঝাপিয়ে পড়েছিল ফোর্ট উইলিয়ম দুর্গ গড়ার। ১৬৯৭ সালের জানুয়ারির মধ্যে কাজ এতদূর অগ্রসর হয়েছিল যে তখনকার মতো ব্যবহারের জন্য মাদ্রাজ থেকে দশটি কামান আনা হয়েছিল। ১৭০০ সালের ২০ আগস্ট তদানীন্তন ইংল্যান্ডরাজ্যের নামানুসারে দুর্গটির নামকরণ করা হয়েছিল ‘ফোর্ট উইলিয়াম। আবার এটাও জানা 37737637 “In 1696, Old Fort William was named after king Wiliam III” 3909 খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দুটি রক্ষণপ্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছিল। প্রথমটি পূর্ব-উত্তরে এবং দ্বিতীয়টি দক্ষিণ পূর্বে। সে বছরই মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হলে তার পুত্রদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ইংরেজগণ এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পূর্বনির্মিত রক্ষণপ্রাচীরের সম্মুখভাগে নদীর তীরে আরো দুটি রক্ষণপ্রাচীর নির্মাণ করে নেয়। ১৭১০ সালের মধ্যে এই ফোর্ট উইলিয়াম মোটামুটি চতুষ্কোণ প্রাপ্ত হয়।
সিরাজদৌল্লা ফিরে যান মুর্শিদাবাদ। সিরাজের এই জয়ে কিন্তু মিরজাফর ক্ষুগ্ন। ইংরেজরা শঙ্কিত। আঞ্চলিক, জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সিদ্ধহস্ত ইংরেজরা সিরাজের ভয়ে কলকাতা ছেড়ে পালিয়েছিল ফলতায়। কেবলই সেখানে ছিল সেনাবাহিনীর লোক। তারপর একে একে ফিরতে লাগলো সবাই। ইতিমধ্যে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হলো সিরাজকে সিংহাসনচ্যুত করার। মিরজাফর হবেন বাঙ্গলার নতুন নবাব। তার সঙ্গে ইংরেজদের গোপনে সন্ধিপত্র স্বাক্ষরিত হলো। এইভাবে তৈরি হলো পলাশী যুদ্ধের পটভূমি। মিরজাফর গোপনে যে সন্ধিপত্রে স্বাক্ষর করলেন ইংরেজদের সঙ্গে পয়গম্বরের নামে শপথ করে, তার বহু শর্তের মধ্যে কয়েকটি ছিল এইরকম :“সিরাজদৌল্লার কলিকাতা অধিকার ও লুণ্ঠনের জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যে ক্ষতি হইয়াছে, তাহা পূরণের জন্য আমি ইংরেজগণকে এক কোটি টাকা দিব। এছাড়া কলিকাতার ইংরেজ অধিবাসীগণের যে সমস্ত দ্রব্যাদি লুণ্ঠিত হইয়াছে, তাহার ক্ষতিপূরণের জন্য ৫০ লক্ষ টাকা দিতে স্বীকার করিতেছি। এছাড়াও দেশীয়গণের লুণ্ঠিত দ্রব্যের ক্ষতিপূরণের জন্য ২০ লক্ষ টাকা দেওয়া হইবে।”তারপর অর্থাৎ In 1757 almost 3000 British Soldiers, led by the East India Company’s Robert Clive, defeated an army of over 50,000 French and Indian troops at the battle of Plassey. পলাশীর যুদ্ধ শেষে সিরাজকে হত্যা করা হলো। কেননা শত্রুর শেষ রাখতে নেই তা ব্রিটিশদের ভালোমতোই জানা। ১৭৫৭ সালের ২ জানুয়ারি ইংরেজরা বিনা বাধায় কলকাতা পুনরুদ্ধার করে। এরপর ব্রিটিশরা আলিনগরের নাম পাল্টে পুনরায় রাখে কলকাতা। মিরজাফর নবাব সাজলেন। লুঠ করা হলো সিরাজের ধনভাণ্ডার। তাতে ছিল ১ কোটি ৭৬ লক্ষ রৌপ্যমুদ্রা। বত্রিশ লক্ষ স্বর্ণমুদ্রা। দু’ সিন্দুক বোঝাই সোনার পাত। চার সিন্দুক মণিমুক্তো ও অলংকার। দুটি ছোটো সিন্দুকে ভর্তি জহরত। সে সব টাকা দুহাতে নিজেরাই ভাগ করেন নিলেন ক্লাইভ, ড্রেক, ওয়্যাটস, কিলপ্যাট্রিক, ম্যানিংহামেরা। এ যুদ্ধ জেতার কিছুদিন বাদেই মিরজাফরকে সরিয়ে ইংরেজরা প্রযুক্ত করেছিল। কর্পোরেট চার্টার ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে। তা প্রযুক্ত হয়েছিল কেবল বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশায়। ভারতের দিল্লির মসনদ তখনও মোগল সম্রাটের অধীন, ১৭৬৫ সালের ১২ আগস্ট মোগল সম্রাট শাহ আলমের কাছ থেকে ইংরেজরা বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশার দেওয়ানি লাভ করে। ১৭৭২ সাল ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস কলকাতাকে করেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অধীনস্থ ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। ১৭৫৭ সাল থেকে ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত কলকাতা ছিল কার্যত ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি অধীনস্থ বাঙ্গলা, বিহার ও ওড়িশার রাজধানী। দিল্লির সিংহাসনে আসীন তখনও মোগল সম্রাট।
নারায়ণশঙ্কর দাশ