সপ্তদশ লোকসভা নির্বাচনের নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গেল। টিভি চ্যানেলগুলিতে আছড়ে পড়ছে বিতর্ক। বারবার নির্বাচনী মুদ্দা (কেন্দ্রবিন্দু) হিসেবে উঠে আসছে চাকরি তৈরির ক্ষেত্রে সরকারের তথাকথিত ব্যর্থতার প্রসঙ্গ। সমস্ত বক্তব্যের অভিমুখ একই — মোদী তার প্রতিশ্রুতি রাখতে পারেননি। যুবক-যুবতীরা বেকার বা আধা নিযুক্ত। এখানে বুনিয়াদী প্রশ্ন আসবে আজ থেকে দু দশক আগেও চাকরি ক্ষেত্রের যে বাজার ছিল এখন কি তা আছে ? টেকনোলজি ক্ষেত্রে যে প্রয়োগ কুশলতা থাকলে এক ধরনের চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা ছিল আজ কি তা আছে? বিষয়টা তলিয়ে দেখা যেতে পারে অবশ্যই কোনো নিরেট পরিসংখ্যানের উদ্ধৃতি ছাড়া।
স্বাধীনোত্তর সময়ের শুরুতে দেশে উৎপাদন শিল্পের ঢেউ উঠেছিল স্বাভাবিকভাবেই। আনকোরা দেশের পরিকাঠামো ক্ষেত্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন জলসংসাধন, বাঁধ নির্মাণ থেকে রেল ইঞ্জিন তৈরি সবেরই ছিল বিপুল চাহিদা। খুব বেশি শিক্ষিত শ্রমিক বা কর্মীর বাধ্যবাধকতা ছিল
না।
খনন শিল্প থেকে খনিজ তেল উত্তোলন, পরিশোধনাগার নির্মাণ থেকে এয়ার ফোর্স তৈরি এগুলি সবই ছিল অগ্রাধিকার। এই ঘনীভূত শিল্প ক্ষেত্রগুলিতে ছিল সরকারি ও বেসরকারি দু’ধরনের মালিকানারই নিয়ন্ত্রণ। চার দশক এই কর্মকাণ্ডের পরিচালনার যে প্রশাসনিক কাঠামো তাতে উৎপাদন প্রক্রিয়ায় সরাসরি নিয়োজিত ছাড়া যন্ত্র বা টেকনোলজির অনুপ্রবেশ ছিল অকিঞ্চিৎকর। ভারত বিশ্ব বহির্ভূত নয়। উন্নত দেশগুলির বার্তা দ্রুত আসছিল। ৯০-এর দশকে ১০০টা বাড়ির মধ্যে হয়তো ১টি বাড়িতে টেলিফোন ছিল। তৎকালীন সংস্কার নীতির লক্ষ্য হিসেবে দুরভাষ সংযোগের ব্যাপক চাহিদা বাড়ল। তাল মিলিয়ে চলেছিল এর প্রসার। সৃষ্টি হয়েছিল হাজার হাজার চাকরির। ঠিক যেমন ৭০-এর দশকে ব্যাঙ্কের সরকারি করণের পর কাতারে কাতারে ছেলেমেয়ে ব্যাঙ্কে ঢুকেছিল। কলেজ চাকরি ছেড়ে আসাও বাদ যায়নি। টেলিফোনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নিজেদের পরিষেবা দ্রুতগামী করতে ডাক ও তার বিভাগ স্পিডপোস্ট চালু করল। লোক নিল। রেলের নতুন নতুন স্টেশনে কম্পিউটার ব্যবস্থায় আসন সংরক্ষণ শুরু হলো। এদিকে রাস্তায় রাস্তায় প্রকোষ্ঠ তৈরি করে পাবলিক টেলিফোন বুথ পরিচালনায় অজস্র ছেলেমেয়েরা স্বনিযুক্ত হয়ে গেল। ততদিনে নিজস্ব টেলিফোন থাকাকে সমৃদ্ধির চিহ্ন বলে মেনে নেওয়া হয়েছে।
কলকারখানার উৎপাদন তো কম বেশি সচল রাখতেই হবে। কিন্তু একটু নজর করলেই দেখা যাবে ব্যাঙ্কের যে কাউন্টারগুলিতে সারি দিয়ে কর্মীরা বসে থাকতেন সেগুলিতে ১০ জনের জায়গায় এখন সাকুল্যে দু’জন। অন্য বিভাগগুলিতেও কর্মীর অনুপাত একই রকম বা আরও কম। কারণ তো সহজবোধ্য, কম্পিউটার কাজ করছে। প্রতি নিয়ত তার আধুনিকীকরণের ফলে সে আরও বেশি কর্মক্ষম হয়ে উঠছে। ব্যাঙ্কে নিয়োগ তলানিতে ঠেকছে।
সরকারি বিএসএনএল দপ্তরগুলি মাছি মারছে। বিল দিতে নগদ বা চেক নিয়ে খুব সেকেলে কিছু লোকজনই যায়। তাদের ছোটো ছোটো এক্সচেঞ্জগুলিতে ১টি কি ২টি লোক দৃশ্যমান। ৮০ ভাগ ব্যক্তিগত ফোন সমর্পিত। রাস্তায় পোস্ট বক্সের সঙ্গে অজান্তেই হারিয়ে গেছে পাবলিক বুথগুলিও। রেলের আসন সংরক্ষণ করতে স্টেশনে গেলে লোক অবাক হয়ে তাকায়। অফিসে টাইপ রাইটারের আওয়াজ কয়েক দশক আগে স্তব্ধ হয়ে গেছে। দাপটে কাজ করে চলেছে কম্পিউটার কি সরকারি কি বেসরকারি ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা পরবর্তীকালের মহীরুহ-সম শিল্পদ্যোগগুলিকে আভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক কাজকর্মে উপযুক্ত ও আধুনিক পরিষেবা দিতে যে উদ্যোগগুলি নেওয়া হয়েছিল কালক্রমে তার কার্যকারিতা হারিয়ে গেল। সকলেই জানেন একই সঙ্গে এতগুলি পরিষেবা ক্ষেত্রকে একার চেষ্টায় অকেজো করে দেওয়ার ক্ষমতাধারী সেই যন্ত্রটির (ব্যবস্থার) নাম আন্তর্জাল। ডিপার্টমেন্ট থেকে কর্মী মসৃণভাবে লোপাট হয়ে গেছে। এখন মোবাইলে শয়ে শয়ে ঘণ্টা কথা বলা যায়। নেটের মাধ্যমে ব্যাঙ্কের টাকা প্রয়োজনমতো পাল্টানো যায়। চিঠি লিখে পোস্ট অফিসের কাজ বাড়াতে হয় না। মেল করলেই হলো। কোথাও গিয়ে টিকিট কাটতে লাগে না, এই অবাক যন্ত্রই সব করে দেয়। প্রসঙ্গত, পরিষেবা ক্ষেত্রের উন্নত অঙ্গ হিসেবে এই শতাব্দীর গোড়ার দিকে আন্তর্জাতিক দূরভাষে একটি বিরক্তিকর কিন্তু fashionable চাকরির বিপুল চাহিদা বেড়েছিল। সেই মধ্যমানের লেখাপড়া করে একটু ইংরেজি উচ্চারণ বুঝতে পারলেই ‘Back Process Outsourcing BPO’ GO কাজ করে’ কথাটা খুব শোনা যেত। সেই ধারাটিও প্রায় শুকিয়ে গেছে। কেন? এদের কাজ ছিল নিজেদের কাছে বিশ্বের সর্ববিধ জরুরি ব্যবহার্য বস্তু সস্তায় কোথায় মিলতে পারে তার শুলুকসন্ধান নিয়ে অপেক্ষা করা। মূলত ইয়োরোপ, আমেরিকার ধনী দেশগুলি সস্তায় কিস্তিমাত করতে এদের কাছ থেকে। খবরা-খবর নিত। তাই কাজের সময় ছিল গভীর রাতে। মসলিন থেকে গামছা, রাংতা থেকে রকেট— সবেরই খবর ইন্টারনেটে ‘গুগল’ এখন দিয়ে যাচ্ছে। এরাও শহিদ হওয়ার পথে। পাইকারি হারে চাকরির অথাৎ ব্যাঙ্ক, ডাক ও তার, টেলিফোন, রেল প্রভৃতিতে নিযুক্ত হতে পারলেই আদর্শ নিশ্চিন্ততার যে ছবি সমাজগ্রাহ্য ছিল, তা আর কোনওদিন সেই হারে ফিরে আসবে না। কেননা প্রযুক্তি এগিয়েই চলবে। কালকের প্রযুক্তি আজ তামাদি। বিকল্প পথ তো সন্ধান করতেই হবে। সরকার তাই যে ‘মুদ্রা যোজনা’ এনেছে তা নির্দিষ্টভাবে স্বনিযুক্তি বা স্বয়ম্ভর হয়ে ওঠার রাস্তা। এক্ষেত্রে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র কৃষির উৎপাদনের প্রক্রিয়াকরণ। যথাযথ সংরক্ষণ। পিয়াজ, টমেটো, আলু রাস্তায় গড়াগড়ি খাওয়ার আগে যদি সময়মতো কিছু সংরক্ষণ প্রযুক্তি আওতাধীন এমন ছেলেমেয়েদের হাতে যায়, এ থেকে সোনা ফলতে পারে। ভুললে চলবে না, এখনও দেশ কৃষিপ্রধান। শহরে কাজের হদিশ না পেরে তাকে গ্রামেই ফিরতে হবে। চলতি প্রজন্ম সরাসরি চাষ করতে ইচ্ছুক নয়। হ্যাঁ, উচ্চ প্রশাসনিক পদে চাকরি আছে, আদালতে বিচারকের বিপুল সংখ্যায় চাকরি আছে (সরকারের কোষাগারে খামতি, তাই নিয়োগে অক্ষম), নিরাপত্তা বাহিনীতে চাকরি আছে, পর্যটন শিল্পে চাকরি আছে। এগুলি পছন্দসই বা নিজে উপযুক্ত না হলে কৃষির হাত ধরা ছাড়া পথ নেই। আজ সরকারকে বারবার কৃষকদের দুর্গতির দায়ে কাঠগড়ায় তোলা হচ্ছে। সরকারের গৃহীত নীতির মধ্যে এই সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ সর্বাধিক গুরুত্বের। কেননা এর মধ্যে রপ্তানিরও প্রচুর সুযোগ রয়েছে। সরকার দেশব্যাপী স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রকল্পে ব্যাপক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছে। সুযোগ রয়েছে উদ্যোগপতি হওয়ার। পেট্রল গাড়ি ছেড়ে ইলেকট্রিক ভেহিক্যালস্ এসে গেছে। তাল মেলাতে সরকার বদ্ধপরিকর।
এই পাঁচ বছরে তথাকথিত সংগঠিত ক্ষেত্রে চাকরির মরা গাঙে জোয়ারের অলীক চেষ্টা না করে অসংগঠিত ক্ষেত্রে নামমাত্র মূল্যে বীমা, নির্দিষ্ট মাসিক কিস্তির বিনিময়ে আকর্ষণীয় পেনসন, স্বাস্থ্যবীমার মতো (দান দেওয়া প্রকল্প নয়) দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা নিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। দেশ ও দেশবাসীর কল্যাণে নাগরিক জীবনে যে গুণগত পরিবর্তনগুলি মানুষ ease of doing business -এর মতো অনুভব করতে পারবেন। এবং সেই মতো নির্বাচনী সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন সেগুলি (১) তুমুল হল্লা করার পেট্রলের দাম ২০১৪ – ৭১.৫৬; ২০১৬ – ৭২.২৪ (২) রপ্তানি বিলিয়ন ডলারে ২০১৪ – ২৬৪; ২০১৯ (এপর্যন্ত) ২৭০ (৩) উপভোক্তার আস্থার সূচক ছিল ১১৭ এখন ১২৯ (৪) রাজস্ব ঘাটতি ছিল ৬.৭১ আছে। ৫.৮০ (৫) দেশবাসীর আকাশ ভ্রমণ ছিল ৬-৭ কোটি, আছে ১৩.৯ কোটি (৬) মোবাইল ডাটার দাম ১জিবি ৩৩ টাকা, এখন ১১ টাকা (৭) বাড়িতে শৌচালয় ছিল ৩৮ শতাংশ, এখন ৯৮ শতাংশ (৯) আলুর দাম ছিল ২৫ টাকা, পেঁয়াজ ২৩ টাকা, এখন ১৫ ও ২০ টাকা।
কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, কি বৈদেশিক, কি জাতীয় নিরাপত্তা (দেশ ও বিদেশ তোলপাড় করা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ও তা নিয়ে দেশদ্রোহীদের গণহুল্লোড় সবাই চাক্ষুষ করেছেন) সর্বক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাঁর স্থিতধী ও পরক্রমী নেতৃত্বের পর্যাপ্ত নমুনা রেখেছেন। জানিয়েছেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা। মানুষ তা বিশ্বাস করেছে। শুধু উদ্বাহু হয়ে চাকরি নেই, চাকরি নেই বলে গলা না ফাটিয়ে প্রকৃত পরিস্থিতি বুঝতে হবে।
সারা বিশ্ব মধ্যমানের চাকরি সঙ্কটে আক্রান্ত। কেননা দিনকাল প্রযুক্তির অধীন। বিশ্ব আন্তর্জালে আবদ্ধ। আসছে কৃত্রিম বৌদ্ধিকতা (artificial intelligence)।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়