স্বাধীনতার সাত দশক পর জন্ম নিল নতুন ভারত। উরি হামলার জবাব দিতে ভারতীয় সেনার লেগেছিল ১০ দিন। পুলওয়ামায় সিআরপিএফের কনভয়ে আত্মঘাতী জঙ্গি হামলার প্রত্যাঘাত করতে মাত্র ২৪ ঘণ্টা অতিরিক্ত সময় নিল বায়ুসেনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি মঙ্গলবার ভােরবেলা বালাকোট সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ রেখা পেরিয়ে জইশ-ই-মহম্মদের আলফাও কন্ট্রোলরুম ও প্রশিক্ষণ শিবির ধ্বংস করে ওই শিবিরে অবস্থানরত কমপক্ষে ৩৫০ জন সন্ত্রাসবাদীকে খতম করে ৪৪ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যুর বদলা নিল।
২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ভােরবেলা সকালে চারটি পাক যুদ্ধবিমান আকাশসীমা লঙ্ঘন করে ভারতে ঢুকে পড়লে তাদের তাড়া করছিলেন উইং কমান্ডার অভিনন্দন। মিগ-২১ বিমান নিয়ে পাকিস্তানের এফ-১৬ বিমান ধাওয়া করতে গিয়ে ঢুকে পড়েছিলেন পাকিস্তানের আকাশে। বিমানটিকে গুলি করে নামায় পাক সেনা। জীবন বাঁচাতে প্যারাসুটে ঝাঁপ দেন অভিনন্দন। হাওয়া অনুকূলে না থাকায় শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানের মাটিতে নেমে বন্দি হন পাকসেনার হাতে। পাক বিদেশমন্ত্রী শাহ মেহমুদ কুরেশি অভিনন্দনের মুক্তির জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মােদীর সঙ্গে পাক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের কথা বলার আগ্রহের কথা জানান। আলােচনার অনুরােধ পত্রপাঠ খারিজ করে দিয়ে ভারত পালটা জানিয়ে দেয় অভিনন্দনকে ফেরাতে তারা কোনােরকম আলাপ আলােচনায় যাবে না। অবিলম্বে অভিনন্দনকে নিরাপদে সুস্থ অবস্থায় ভারতের হাতে তুলে দিতে হবে। তা না হলে পাকিস্তানকে চরম পরিণতির জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আসলে ভারতীয় যুদ্ধ বিমানের পাইলটকে আটক করে পাকিস্তান ভারতকে লেজে খেলানাের চেষ্টা করেছিল বটে কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। প্রবল কূটনৈতিক চাপের কাছে নতিস্বীকার করে ইমরান খান ২৮ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার পাক সংসদে দাঁড়িয়ে ভারতীয় বায়ুসেনার উইংকমান্ডার অভিনন্দন বর্তমানকে মুক্তি দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। ১ মার্চ জুম্মাবার শুক্রবারই ওয়াঘা সীমান্ত দিয়ে ভারতে ফেরানাে হয় অভিনন্দনকে। এটাই নতুন ভারত।
এর আগেও পার্লামেন্ট ভবনে হামলা, ২৬/১১-এর হামলার মতাে ভয়ংকর সব ঘটনা ঘটেছে। পড়ে পড়ে মার খেতে অভ্যস্ত ভারত শত্রুর ঘরে প্রবেশ করে প্রত্যাঘাতের কথা স্বপ্নেও ভাবেনি। এতে প্রমাণ হয় সামর্থ্য থাকলেও উপযুক্ত নেতৃত্বের অভাবে ভারতকে এতদিন পড়ে পড়ে মার খেতে হয়েছে।
জম্মু-কাশ্মীরের ৭৪০ কিলােমিটার দীর্ঘ নিয়ন্ত্রণরেখা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা জঙ্গি প্রশিক্ষণ শিবির ও লঞ্চপ্যাডগুলি ছেড়ে প্রত্যাঘাতে লক্ষ্য হিসেবে সীমান্ত থেকে ৮০ কিলােমিটার ভিতরে বালাকোটকে কেন বেছে নেওয়া হলাে সে ব্যাখ্যাও বায়ুসেনার তরফ থেকে এসেছে। ২০১৬ সালের সার্জিক্যাল স্ট্রাইকের পর নিয়ন্ত্রণরেখার আশেপাশে লঞ্চপ্যাডগুলি থেকে জঙ্গিদের জনবহুল এলাকায় সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল পাকসেনা। আবার হামলা চালালে ভারত যাতে জঙ্গি ও আমজনতার মধ্যে তফাত করতে না পারে সেজন্যই এই ব্যবস্থা। পাক অধিকৃত কাশ্মীরের রাজধানী মুজফফরাবাদের কাছে অবস্থিত বালাকোটে পাহাড়ের উপরে নির্জন জায়গায় গড়ে উঠেছিল লস্করের ঘাঁটিটি। এজন্যই হামলার ফলে আমজনতার প্রাণহানি হয়নি। এই ঘাঁটিতে ৩০০ জনেরও বেশি জঙ্গিকে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিল ২৫-২৭ জন অভিজ্ঞ জইশ কমান্ডার। জইশ প্রধান মাসুদ আজাহারের ভাই মৌলানা তলহা, দাদা ইব্রাহিম আজাহার শালক ইউসুফ আজাহারের মতাে শীর্ষ সন্ত্রাসবাদী নেতারাও ছিল এই ঘাঁটিতে। কয়েক মিনিটের হামলায় জইশের গােটা একটা প্রজন্মকেই কার্যত সাফ করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে এত বড়াে সংখ্যায় জঙ্গি নিধনের দৃষ্টান্ত নেই।
এই হামলা যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয় সেটাও ভারতের পক্ষ থেকে পরিষ্কার করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ভারতের লক্ষ্য ছিল পুলওয়ামার ঘটনার দায় স্বীকার করে নেওয়া সন্ত্রাসবাদীদের ঘাঁটি। সন্ত্রাস দমনে আন্তরিক হলে পাকিস্তান বা চীন কারাে পক্ষেই ভারতের এই পদক্ষেপকে সমর্থন করতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। আমেরিকা, ইউরােপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া এমনকি ইরান সংযুক্ত আরব আমিরশাহির মতাে দেশও ভারতের পক্ষে রয়েছে। পুলওয়ামার প্রত্যাঘাতে শক্তি ও কূটনীতির সঠিক মিশেলে বাজিমাত করেছে ভারত। ফলে চীনেরও পক্ষেও এই মুহূর্তে পাকিস্তানের পাশে দাঁড়ানাে সম্ভব হয়নি। কাশ্মীর ভারতের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হলেও পাক অধিকৃত কাশ্মীরকে পাকিস্তান ‘আজাদ কাশ্মীর’ হিসেবে চিহ্নিত করে থাকে। ফলে ‘আজাদ কাশ্মীরে’ অবস্থিত বালাকোটের প্রত্যাঘাতকে পাকিস্তান নিজের ভূমিতে আক্রমণ হিসেবে দেখাতে পারবে না। তবে কোনাে অজুহাতে যদি পাকিস্তান নিজের সামরিক শক্তিতে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে শামিল হয় তা হলে তা হবে আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। কারণ সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে ভারতের নেওয়া পদক্ষেপকে পৃথিবীর প্রায় সমস্ত দেশই খােলাখুলি সমর্থন জানিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে ভারতকে আক্রমণ করার অর্থ হলাে সমগ্র বিশ্বের সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইকে চ্যালেঞ্জ করা।
দেশের বর্তমান পরিস্থিতি বলছে সন্ত্রাসবাদী পাকিস্তানের সঙ্গে সম্মুখ সমরে ভারতকে শক্তি জোগাচ্ছে একশাে ত্রিশ কোটি ভারতবাসী। সংখ্যালঘু ভােট ব্যাঙ্কের কথা ভেবে তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলি কখনােই পাকিস্তান কিংবা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিতে পারেনি। ২৬/১১-এর মুম্বই হামলার মতাে ভয়ংকর ঘটনা নিয়ে কংগ্রেসের মতাে শতাব্দী প্রাচীন দলও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থা নেওয়ার সাহস দেখাতে পারেনি। মুসলিম ভােটব্যাঙ্ক দখলের প্রতিযােগিতায় জিততে কংগ্রেস নেতা দ্বিগবিজয় সিংহ তাে পাকিস্তানের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে এই হামলার পেছনে পাকিস্তান নয় বরং হিন্দু সংগঠনগুলির হাত আছে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এটাই প্রমাণ করার জন্য উঠে পরে লেগে ছিল। কংগ্রেস নেতা মণিশঙ্কর আয়ার তাে মােদীজীকে সরানাের জন্য পাকিস্তানের সাহায্যও চেয়ে রেখেছেন। সন্দেহ নেই স্বাধীনােত্তর ভারতে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতাহীন রাজনীতির জন্যই পাকিস্তান বিভিন্ন সন্ত্রাসবাদী দলের মাধ্যমে বিগত সত্তর বছর ধরে ছায়া যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে।
তবে ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি কাশ্মীরের পুলওয়ামা জেলার লেথপুরায় জম্মু শ্রীনগর জাতীয় সড়কের উপর আত্মঘাতী হামলায় ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ান শহিদ হওয়ার পর সমস্ত দেশ জুড়ে স্বতস্ফুর্ত ভাবে মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছে। পাড়ায় পাড়ায় অলিতে গলিতে সমস্ত বয়সের সমস্ত পেশার মানুষ জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে মােমবাতি/মশাল মিছিল করছে। আওয়াজ ওঠছে পাকিস্তান মুর্দাবাদ, বন্দে মাতরম্, ভারতমাতা কী জয়। পাকিস্তানকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার দাবিতে ঝড় উঠছে সােশ্যাল মিডিয়াতেও। দেশে এখন এমনই একটি আবেগ কাজ করছে যে পাকিস্তানের পক্ষে কিংবা ভারতীয় সেনার বিরুদ্ধে কারাে তরফে কোনােরকম অভিব্যক্তি সামনে এলেই তাকে হেনস্থার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। যারা সন্ত্রাসবাদী ইয়াকুব মেননের ফাঁসি রদ করার জন্য রাত দুটোয় সুপ্রিমকোর্ট খুলিয়েছিল, জেএনইউ যাদবপুরের আফজল গুরুর সমর্থনে মিছিল করে ভারতকে টুকরাে টুকরাে করার স্লোগান তুলেছিল, ভারতীয় সেনা শহিদ হলে যারা উৎসব পালন করে সেই ভারত বিরােধী গ্যাংও ওদের এজেন্ডা নিয়ে। জনসমক্ষে আসতে সাহস পাচ্ছে না। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এই সমস্ত ঘটনাবলি সবই স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে ঘটছে। এই উন্মাদনা দেখে হয়তাে একঘরে হওয়ার ভয় থেকে স্থানীয় ভাবে তৃণমূল কংগ্রেস ও বামপন্থীদেরও মােমবাতি হাতে রাস্তায় নেমে ভারত মাতা কি জয় স্লোগান তুলে মিছিল করতে দেখা গেছে। ঘটনার পর কয়েকদিন কোনাে বিরােধী দলের সর্বোচ্চ নেতাও কেন্দ্র কিংবা মােদী বিরােধী কোনাে মন্তব্য করতে সাহস পাননি পাছে প্রাে-পাকিস্তানি তকমা লেগে যায়। দেশ জুড়ে এই অভূতপূর্ব পরিবেশ ভারতীয় পাকিস্তানপন্থীদের এমনকী খােদ পাকিস্তানের মনে ভয়ের সঞ্চার করবে এই বিষয়ে সন্দেহ নেই।
কথায় বলে স্বভাব যায় না মলে/কয়লা যায় না ধুলে। এই আবেগ আসন্ন লােকসভা নির্বাচনে ভােটে রপান্তরিত হয়ে বিজেপির বাক্স ভরাবে না তাে? চলমান পরিবেশ দেখে এই আতঙ্ক জন্মানাে শুরু হলাে ভারতের বিজেপি বিরােধী রাজনৈতিক দলগুলির মনে। ব্যাস উবে গেল দেশপ্রেম, সঙ্কটময় মুহূর্তে দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা। শহিদের চিতা তখনাে নেভেনি। ঘটনার দিন পাঁচেক পর সাংবাদিক সম্মেলন ডাকলেন মমতা ব্যানার্জি। না পাকিস্তান কিংবা সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে নয়, আঙুল তুললেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর অপারেশনাল ডিটেল এবং কেন্দ্র সরকারের গৃহীত পদক্ষেপগুলির বিরুদ্ধে। প্রশ্ন তুললেন ভােটের আগে যুদ্ধ জিগির কেন, ভােটের আগে এমন একটি সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ কেন, রুটিন গােয়েন্দা সতর্কতা থাকা সত্ত্বেও কেন এড়ানাে গেল না এই ঘটনা? আকাশ পথে না নিয়ে রাস্তা দিয়ে নিয়ে কেন যাওয়া হচ্ছিল জওয়ানদের ইত্যাদি ইত্যাদি ? আরাে অভিযােগ তুললেন আর এস এস-বিজেপির প্ররােচনাতেই দেশপ্রেমের নামে বাড়াবাড়ি হচ্ছে, গভীর রাতে জাতীয় পতাকা নিয়ে মিছিল করা হচ্ছে, ভারতমাতা কি জয় বলা হচ্ছে, দাঙ্গা লাগানাের চেষ্টা হচ্ছে।
জইশ-ই-মহম্মদ ঘটনার দায় স্বীকার করে নেওয়ায় পাকিস্তানও চুপসে গিয়েছিল। মনে হচ্ছিল ওরা যেন আত্মপক্ষ সমর্থনের জায়গাটাও নষ্ট করে ফেলেছে। কিন্তু মমতা ব্যানার্জি মুখ খােলার পর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান সাংবাদিক সম্মেলন নির্বাচনের আগে ইস্যু তৈরির জন্যই এরকম ঘটনা ঘটানাে হয়েছে। ইমরান খানের বক্তব্য শুনে মনে হচ্ছিল উনি যেন মমতা ব্যানার্জির লিখে দেওয়া স্ক্রিপ্টই পাঠ করছেন। সাংবাদিক সম্মেলন করা হয় কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে। এখানেও পাকিস্তান বা সন্ত্রাসবাদী গােষ্ঠীগুলির বিরুদ্ধে একটি বাক্যও ব্যয় না করে কাশ্মীরের স্থানীয় মানুষের যুক্ত থাকার কথা বলা হলাে। একধাপ এগিয়ে একটি ছবি দেখিয়ে অভিযােগ তােলা হলাে পুলওয়ামার হামলার ঘটনা শােনার পরও প্রধানমন্ত্রী নাকি শুটিং করছিলেন। অথচ পরে দেখা গেল যে ছবিটি কংগ্রেস দলের পক্ষ থেকে দেখানাে হয়েছে সেটি সকালবেলা তােলা আর প্রধানমন্ত্রী ঘটনা শােনার পর সমস্ত কর্মসূচি বাতিল করে দিয়েছিলেন। এমনকী সেদিন মুখে খাবারও তােলেননি।
এদেশে ক্ষমতা কেন্দ্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে দেশদ্রোহিতাও যে অপরাধ নয় এটা পুলওয়ামার হামলার আগে অনেকবার প্রমাণিত হয়েছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সমস্ত দেশে উত্তেজনার স্রোত বইলেও একসময় অসহিষ্ণুতার ধুয়াে তুলে যে সমস্ত বড়াে বড়াে লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীরা পুরস্কার ত্যাগ করেছিলেন ওরা নীরব কেন? এদের মধ্যে একটি অংশ নীরব থাকলেও আরেকটি অংশ তাে কাশ্মীরের ঘটনার পর স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে তৈরি হওয়া আবেগ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বলছেন ‘জাতীয় পতাকা হাতে নিয়ে ভারতমাতা কী জয় স্লোগান তুলে যখন তখন মিছিল করতে বেরিয়ে যাচ্ছে ওরা কারা’। কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেস, বামপন্থীদের সঙ্গে সঙ্গে ওদের ঘরানার ‘বড়াে বড়ো’ লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীরাও বিপন্নতাবােধ করবে এটাই স্বাভাবিক। সােশ্যাল মিডিয়ার আগমনের আগে পর্যন্ত মূলস্রোতের মিডিয়ার মাধ্যমে সেই ব্রাহ্মণ্য প্রথার মতাে ভালােমন্দ নির্ধারণের অলিখিত দায়িত্ব এই বড়াে বড়াে লােকেদের উপরেই ছিল। ফলে সে সময় আমজনতার আবেগ উচ্ছ্বাসের বড়াে বেশি একটা মূল্য ছিল না। কিন্তু সােশ্যাল মিডিয়ার আগমনের পর আমজনতার আবেগের এই স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশ কর্তৃত্ব হারানাের ভয়ে ভীতবড়াে ‘বড়াে’ লেখক, শিল্পী, অভিনেতা, বুদ্ধিজীবীদের কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে তুলবে। এটাই স্বাভাবিক।
১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার ঘটনার পর থেকে সমস্ত দেশই ক্ষোভে ফুঁসছে। কিছু ব্যতিক্রম বাদে আসমুদ্রহিমাচল সবাই চাইছে এমন কিছু একটা করা চাই যাতে পাকিস্তান কোনােদিন এরকম হামলা করার সাহস না পায়। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়া পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ভারতের কাছে পাকিস্তানের যুক্ত থাকার প্রমাণ চাইছেন। ভারতের তরফ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেওয়া হয়েছেঠ যে ২৬/১১ হামলা, পাঠান কোটের সেনা ছাউনিতে জঙ্গি হানা নিয়ে প্রচুর তথ্য প্রমাণ পাকিস্তানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু কোনাে ফল হয়নি। ফলে আর প্রমাণ নয় এবার চরম ব্যবস্থা। প্রধানমন্ত্রী প্রকাশ্যেই বলে দিয়েছেন সেনাবাহিনীকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে। এদিকে আন্তর্জাতিক স্তরে ভারতের পক্ষে ক্রমশই সমর্থনের পাল্লা ভারি হচ্ছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডােনাল্ড ট্রাম্প এই জঙ্গি হামলাকে ভয়ংকর বলে উল্লেখ করে পাকিস্তানকে অবিলম্বে জইশ-ই-মহম্মদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ও জঙ্গিদের আশ্রয় দেওয়া বন্ধ করতে বলা হয়েছে। শুধু আমেরিকা নয় রাশিয়া, ফ্রান্স, ব্রিটেন-সহ বিশ্বের বহু দেশ এই ব্যাপারে ভারতের পাশে থাকবে বলে খােলাখুলিই জানিয়েছে। কেন্দ্রীয় সরকারের অতুলনীয় কূটনীতির জেরে সমগ্র বিশ্বের সমর্থন এখন ভারতের পক্ষে। বিশ্ব জুড়ে এমনই পরিবেশ তৈরি হয়েছে যে রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদের নিন্দা প্রস্তাবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চীনকে স্বাক্ষর করতে হয়েছে।
চীনের মতাে অবস্থা কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের মতাে দলগুলিরও। দেশের ভেতর চলছে পাকিস্তান বিরােধী ঝড়। এই ঝড়ের প্রতিকূলে দাঁড়ালে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। এই ভয় থেকে রাহুল গান্ধী, মমতা ব্যানার্জি নামকাওয়াস্তে সেনার স্তুতি করলেও পরিস্থিতির নজর রাখছিল। পুলওয়ামা হামলার পর প্রত্যাঘাতের আগের দিন পর্যন্ত পাকিস্তানকে শিক্ষা দেওয়ার প্রশ্নে মােদীজীকে কটাক্ষ করে ৫৬ ইঞ্চির খোঁচা দিয়ে গেলেও বালাকোটের প্রত্যাঘাতের পর রাহুল মমতা অ্যান্ড কোং কোন এক অজানা আশঙ্কায় চুপসে গিয়েছিল। উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান বন্দি হতেই পাকিস্তানের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ওকে ছাড়ানাের জন্য দেশের ভেতর সস্তা সেন্টিমেন্ট তৈরি করে ভারত সরকারের উপর পালটা চাপ তৈরির রাজনীতিতে নেমে পড়েন রাহুল মমতা স্পনসর্ড একদল ‘মানবতাবাদী’। পাকিস্তানও এটাই চাইছিল যে অভ্যন্তরীণ চাপে ভারত আলােচনায় রাজি হলে ওদের মুখরক্ষা হবে। কিন্তু কেন্দ্র সরকারের দৃঢ়তায় সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
বিমান হামলার পর থেকে পাকিস্তান নিজের দেশে জঙ্গি শিবিরের অস্তিত্ব অস্বীকার করার জন্য বলে আসছে ভারত ফাকা জায়গায় বিমান হামলা চালিয়েছে, একজনেরও মৃত্যু হয়নি। নরেন্দ্র মােদীকে বিপাকে ফেলার সমস্ত পাকিস্তানি প্রয়াস ব্যর্থ হওয়ার পর মমতা ব্যানার্জি ও রাহুল গান্ধীরা মাঠে নামলেন। পশ্চিমবঙ্গের ২৮ শতাংশ মুসলিম ভােট নিশ্চিত করতে মমতা ব্যানার্জি পাকিস্তানের সঙ্গে সুরে সুর মিলিয়ে বিমান হামলায় কতজনের মৃত্যু হয়েছে সেই প্রমাণ চাইতে লাগলেন। ক্ষমতা হারানাের ভয়ে মমতা ব্যানার্জিরা এতটাই ভীত যে দেশের শত্রু ও রাজনৈতিক বিরােধীদের মধ্যে পার্থক্য ভুলে গিয়ে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে এমন সব কথা বলতে লাগলেন যা সরাসরি শত্রু দেশের সুবিধে হয়। সাধারণ মানুষের মুখে এই সমস্ত প্রশ্ন উঠলে আমজনতার হাতে গণধােলাই খেতে হতাে।
শুধু বহির্বিশ্বে নয় পাকিস্তানের অভ্যন্তরেও এমন অবস্থা যে কোনাে মুহূর্তে আরাে দুই তিন ভাগে বিভক্ত হয়ে পাকিস্তানের অস্তিত্বই সঙ্কটের মুখে পড়তে পারে। স্বাভাবিক ভাবেই বিশ্বের দরবারে বিপন্ন দেশ হিসেবে চিহ্নিত পাকিস্তান এখন মমতা ব্যানার্জি রাহুল গান্ধীদের বক্তব্যকে খড়কুটোর মতাে আঁকড়ে ধরে ঘুরে দাঁড়াতে চাইছে। পাকিস্তানের টেলিভিশন চ্যানেল ‘২৪ নিউজ’ প্রাইম টাইম স্লটে লাগাতার মমতার বক্তব্য সম্প্রচার করে যাচ্ছে। মােট কথা মমতার বক্তব্যই এখন পাকিস্তানের শাসককূলের একমাত্র হাতিয়ার। একদিকে পাকিস্তানের মােল্লা মুফতিরা ভারতীয় মুসলমানদের প্রতি লােকসভা নির্বাচনে নরেন্দ্র মােদীকে হারানাের আবেদন রাখছে। অন্যদিকে রাহুল মমতাদের পাকপন্থী আচার-আচরণ পাকিস্তানের শাসক গােষ্ঠীকে অক্সিজেন জোগাচ্ছে। দুর্ভাগ্য হলেও এটা সত্য যে স্বাধীনতার সাত দশক পরেও ভারতের জাতীয়তাবােধ সম্পন্ন মানুষকে দেশের ১৭তম লােকসভা নির্বাচনেও পাকিস্তানের ছায়ার বিরুদ্ধে লড়তে হবে।
সাধন কুমার পাল