আসছে সরস্বতী পূজা। মাঘ মাসের শুক্লা পঞ্চমীতে বাগ্দেবীর আরাধনায় মেতে উঠবে ছাত্রছাত্রীর দল। মা সরস্বতীর কাছে পুষ্পাঞ্জলী দিয়ে চেয়ে নেবে শিক্ষায় সফলতা লাভের আশীর্বাদ। বৈদিকযুগ থেকে ভারতবর্ষে সকল প্রকার জ্ঞান ও বিদ্যার অধিষ্ঠাত্রী দেবীরূপে মা সরস্বতী পূজিতা হয়ে আসছেন।
সরস্বতীনামের মধ্যেই প্রবাহমানা জলরাশি অর্থাৎ বেগবতী নদীর রূপ লুকিয়ে আছে (সরস্ + বতী)। বৈদিক সভ্যতা বিকাশের ঊষালগ্নে যে নদী তার সমস্ত কল্যাণকর উপাদান দিয়ে তৎকালীন সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে সবদিক দিয়ে ঋদ্ধ করেছিল, করেছিল জ্ঞান ও মেধার বিস্ময়কর বিকাশে সহায়তা— সেই নদীটিই হল আমাদের আলোচ্য অধুনালুপ্ত জ্ঞানপ্রসারিণী দেবী স্বরূপা সরস্বতী নদী।
ঋক্ বেদে সরস্বতী শুধুমাত্র নদী নয়— তিনি সরস্বতী নদী—দেবী। তাঁর সম্বন্ধে স্তুতি স্বরূপ ঐ বেদে এমন ৬০টি ঋক্ বা মন্ত্র আছে, যেগুলিকে আজকের বিজ্ঞানীরা প্রামাণ্য হিসাবে গ্রহণ করে প্রাচীন সরস্বতী সভ্যতাকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। ঐ সকল স্তুতি এবং পরবর্তীকালে বিজ্ঞানীদের গবেষণায় এটা পরিষ্কার যে, যেহেতু বিশাল সরস্বতী নদীর কৃপায় অফুরন্ত ধন-সম্পদ এবং মানব সভ্যতা ও সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়েছিল তাই সেই নদী বিদ্যা-বুদ্ধি, ধন ও জ্ঞানের দেবী রূপে পূজিতা হয়েছিলেন যা আজও সমগ্র ভারতবর্ষে হয়ে থাকেন। এই নদী উত্তর-পশ্চিম ভারতে যে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও সম্পদ দান করেছিল, তার প্রভাবে ব্যাপক বিদ্যাচচা তথা বেদের উৎপত্তি সম্ভব হয়েছিল বলে মনে হয়। ঋক্ বেদ নিজেকেই সরস্বতীর সন্তানরূপে অভিহিত করেছে।
ঋক্ বেদের সূক্তাংশ (ঋ. ৭৯৫।২) অনুসারে সরস্বতী নদী হিমালয় পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন হয়ে সমুদ্রে গিয়ে মিশেছে। এটি একটি প্রধান নদী হলেও তার কোনো উপনদী বা শাখা নদী ছিল না। সিন্ধুক্ষিৎ ঋষি ভারতবর্ষের পূর্বদিক থেকে প্রথমে গঙ্গা, তারপর যমুনা, তারপরে সরস্বতী ও তারপরে শতদ্রু নদীর নাম উল্লেখ করেছেন (ঋ. ১০।৭৫।৫)। অর্থাৎ, সরস্বতী ছিল যমুনা ও শতদ্রু নদীর মধ্যবর্তী তথা সিন্ধুনদীর পূর্বদিকে প্রবাহিতা। মধুচ্ছন্দা ঋষি এবং ভরদ্বাজ ঋষির সশ্রদ্ধ বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, সরস্বতী ছিল প্রবল বেগবতী ও বলশালিনী নদী, যার অপরিমিত অকুটিল দৃপ্ত, অপ্রতিহত গতি ও জলবর্ষী বেগ প্রচণ্ড শব্দে প্রবাহিত হত, যার তরঙ্গ ভেঙ্গে দিত পর্বতসানুসকল (ঋ. ৬।৬১।২, ৬।৬১৮)। ঐ নদী প্রবাহিত হয়ে প্রভূত জল সৃজন করেছিল, করেছিল সকল জ্ঞান উদ্দীপন (ঋ. ১।৩।১২)। সে ছিল অন্নসম্পন্না সরস্বতী দেবী, যে মানবগণকে ভূমি দিয়েছিল এবং তাদের জন্য করেছিল বারিবর্ষণ (ঋ. ৬।৬১৩)। অথাৎ, সরস্বতীর পলি মাটি দিয়ে অতি উর্বর কৃষিজমি তৎকালীন মানুষকে দান শুধু নয়, কৃষি ও পানীয় জলেরও পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করেছিল। উদ্বৃত্ত কৃষি সম্পদই সভ্যতা সৃষ্টিকে সম্ভব করেছিল। এই নদীর প্রতি সানুনয় কৃতজ্ঞতা, শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা তাই বারবার উচ্চারিত হয়েছে মুনি-ঋষিদের কণ্ঠে, ঋক্ বেদের সূক্ততে।
ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব সরস্বতী সভ্যতার সময়ের নিরিখে কিছুটা অনুধাবন করা যায়। ঋক বেদের সৃষ্টিকালের আগেও প্রাচীন ঋষিগণ তথা তাঁদের পূর্বপুরুষেরা সরস্বতী উপকূলে স্থায়ীভাবে বসতি স্থাপন করেছিলেন—তারও ইঙ্গিত পাওয়া যায় ভরদ্বাজ ঋষির উচ্চারিত ঋকে (ঋ. ৬।৬১।১০) যেখানে তিনি “সপ্তনদীরূপ সপ্তভগিনীসম্পন্না প্রাচীন ঋষিগণ কর্তৃক সম্যকরূপে সেবিতা আমাদের প্রিয়তমা সরস্বতী দেবী যেন নিয়ত আমাদিগের স্তুতিভাজন হন’— এই প্রার্থনা করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে বহু প্রাচীন রাজা, রাজ্য, জনপদ ও সভ্যতা সরস্বতী সভ্যতার অবদান। বিখ্যাত রাজা নহুষ এবং চিত্র দু’জনেই রাজত্ব করেছেন সরস্বতী নদীর উপকূলে। বলা হয়, সম্পদের ও বিশাল বিশ্বের জীবদের কথা ভেবে সরস্বতী নদী রাজা নহুষকে যেমন খাদ্যসম্পদ ঢেলে দিয়েছিল (ঋ. ৭।৯৫।২) তেমনি চিত্র রাজাকে সে মেঘ, বৃষ্টি ও অযুত ধন দান করে প্রজাদের করেছিল প্রীত (ঋ. ৮।২১।১৮)।এছাড়াও, অন্য রাজা যেমন ‘ভবরাজ্য’ এবং পুরু’ জাতির মানুষেরা সরস্বতী নদীতীরে বসবাস করতেন।
১৯৪১ সাল থকে বহু বৈজ্ঞানিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের ফলে এখন সরস্বতী নদী ও তার সভ্যতা সম্পর্কে বহু তথ্য জানা গেছে। বিজ্ঞানী অরেল স্টেইন (১৯৪১), হেনরি ফিল্ড (১৯৫৫), এম আর মুঘল (১৯৭৪-১৯৭৭) এবং নাসা (NASA) ও ইসরো (ISRO) প্রভৃতির বহুমুখী গবেষণা থেকে জানা যায়, সরস্বতী সভ্যতা কম করে ৬০০০ বছর প্রাচীন যা বর্তমানে পাকিস্তানের অন্তর্গত চোলিস্তান মরুভূমিতে বিনষ্ট। পাকিস্তানের হাকরা নামক স্থানে প্রথম এ সভ্যতার সন্ধান পাওয়া যায়। চোলিস্তান মরুভূমিতে প্রায় ৩০০ মাইল সরস্বতীর গতিপথ অনুসন্ধান করে এখন অবধি ১০৭৪টি সভ্যতাস্থান সনাক্ত করা হয়েছে। এই সভ্যতাস্থানগুলি ও সরস্বতী নদীর গতিপথের মানচিত্র তৈরি হয়েছে প্রাগৈতিহাসিক সরস্বতী নদীর ‘ভৌত সমতুল’ (Physical equivalent) নির্ণয় অনুসারে এবং এই সভ্যতার সংগৃহীত নিদর্শনগুলির সময় নির্ধারণ হয়েছে ‘রেডিও কার্বন’ (Radio-carbon) পরীক্ষাপদ্ধতি অনুসারে।
সরস্বতী নদী কোন কোন স্থানে প্রস্থে ছিল ২২ কিমি এবং বলশালী নদীরূপে ঋকবেদে এই নদীর যে তথ্য পাওয়া যায়, তা আজ প্রমাণিত এবং বৈজ্ঞানিক সত্য। সরস্বতী নদীর উভয় কূলেই ছিল সভ্যতা এবং মানুষের বসতি ছিল নদী উপকূলে উঁচু সমতল এলাকায় এবং ধাঁচটি ছিল অত্যধিক শান্ত। তৎকালীন তৈরি মৃৎপাত্রগুলি রঙ্গীন, কারুকার্যখচিত এবং সুন্দর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। লাল, চকোলেট, কাল ও গেরুয়া রঙের ব্যবহার শুধু নয়, মৃৎপাত্রকে পালিশ করে উজ্জ্বল করার পদ্ধতিও তৎকালীন মানুষেরা জানতেন। জানতেন চাকা ঘুরিয়ে সেই সকল পাত্র তৈরি করতে। সরস্বতী সভ্যতা থেকে পাওয়া গেছে গরু ও ষাঁড়ের মূর্তি, পাওয়া গেছে কচ্ছপের শক্ত খোলা, পোড়া মাটির হাতের বালা, শস্য গুঁড়ো করার পাথরের খণ্ড। এছাড়াও দু’দিকে ধারাল ছোট-বড় ছুরি, তীরের ফলা, ঘসার পাথর প্রভৃতিও পাওয়া গেছে বিগত ৬ষ্ঠ সহস্রাব্দের সরস্বতী সভ্যতায়।
এখন থেকে ৫০০০ বছর আগে অর্থাৎ বিগত ৫ম সহস্রাব্দের সরস্বতী সভ্যতাকে আমরা আরেক নামে চিনি, যার নাম হরপ্পা সভ্যতা। যে সভ্যতা ৩০০০ বছর আগে অবধি বিদ্যমান ছিল। এই সময়কালের মধ্যে সভ্যতা তার আয়তনে ও সংখ্যায় বাড়তে থাকে। ঘটতে থাকে নগরায়ন। এই কালখণ্ডে জনগণ সরস্বতী নদীতীরে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন, বাড়তে থাকে বহুমুখী গুণকর্ম ভিত্তিক বসতির অনুপাত। ঘরে বসে কাজ, বিশেষ বিশেষরকমের কাজ, হস্তশিল্পের কাজ প্রভৃতি বাড়তে থাকে—বাড়তে থাকে উন্নততর সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনশৈলী। চোলিস্তান মরুভূমিতে প্রাপ্ত গমনওয়ালা বসতি, জলওয়ালি বসতি এবং গণউরিওয়ালা নগরের অস্তিত্ব সরস্বতী ও পরবর্তীতে হরপ্পা সভ্যতার সুনির্দিষ্ট বিস্তারের সাক্ষ্য বহন করে। সরস্বতী সভ্যতা এই সময়কালেই ক্রমশঃ উত্তর-পূর্ব দিক থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে সরতে থাকে। পণ্যদ্রব্যের গুণমান অক্ষুণ্ণ রাখার তাগিদে কাজের অতি বিশেষিকরণ হয়েছিল, বিভিন্ন স্থানের মধ্যে শুরু হয়েছিল বিনিময় বা বাণিজ্য। ক্রমে তা ছড়িয়ে পড়েছিল বালুচি পাহাড়ের পাদদেশে এবং সিন্ধুসাগর (আরব সাগর)-এর উপকূলে। ফলে শুরু হয়েছিল দূরবর্তী সমুদ্র বাণিজ্য বা বিনিময়। এই সময়কালে (বিগত ৫০০০-৩০০০ বছর) যে মৃৎপাত্রগুলি পাওয়া গিয়েছিল সেগুলি ছিল সাধারণত চাকা ঘুরিয়ে তৈরি, ওজনে হাল্কা, পেট মোটা এবং কারুকার্য করা। এই সভ্যতার ধ্বংসাবশেষ থেকে পাওয়া গেছে বহু মাতৃদেবীর মূর্তি, যার সঙ্গে বর্তমান ভারতে পূজিত মূর্তির মিল লক্ষ্যণীয়। পোড়ামাটির ছোট ছোট খেলনা মূর্তি ছাড়াও দুই রূপের নারী মূর্তি আবিষ্কৃত হয়েছে— কতকগুলির শান্ত সুন্দর রূপ, বাকিগুলির রূপ ভয়ঙ্কর। ভয়ঙ্কর রূপের মূর্তিগুলিকে জন মার্শাল ভয়ঙ্কর কালীমূর্তির পূর্বরূপ বলে মনে করেছেন।
বিগত ৪র্থ সহস্রাব্দের মধ্যকাল থেকে পরবর্তী ৫০০ বছরে প্রাকৃতিক কারণে সরস্বতী নদীর জলের উৎস হিমালয়ের হিমবাহগুলির জলধারা ক্রমশঃ রুদ্ধ হয়ে আসছিল এবং নদীর গতিপথ পুরোপুরি রুদ্ধ হলে সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটে। থর মরুভূমি চোলিস্তানকে গ্রাস করে। মরুভূমির আবহাওয়ার ফলে জনগণ সরস্বতী উপত্যকা ত্যাগ করতে বাধ্য হলেন (বিগত ৩য় সহস্রাব্দ)। মৃত সরস্বতী নদীর নামে ‘বিনশন তীর্থ’ স্থানের নাম আছে মহাভারতের শল্য পর্বে এবং প্রাচীনকালে সরস্বতীর তীরে বিশাল যজ্ঞের উল্লেখ আছে মহাভারতে।
আজ সরস্বতী নদী আর নেই, তবে সেই নদীর অস্তিত্ব আছে আমাদের সভ্যতা তথা সংস্কৃতির গভীরে, আছে আমাদের বৈদিক মন্ত্রে, আমাদের অন্তরে অন্তরে। যতদিন ভারতবর্ষ থাকবে, যতদিন থাকবে হিন্দু সংস্কৃতি—ততদিন দেবী সরস্বতী আমাদের হৃদয়-সিংহাসনে বিদ্যা বুদ্ধি ও জ্ঞানের অধিষ্ঠাত্রী দেবী রূপে বিরাজ করবেন, আমাদের উত্তরণ ঘটাবেন অন্ধকার থেকে আলোর দিকে, অসত্য থেকে সত্যের দিকে এবং অবশ্যই মৃত্যু থেকে অমৃতের দিকে। হে মা সরস্বতী, তোমাকে প্রণাম।
ডাঃ শিবাজী ভট্টাচার্য
[কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ডঃ কৃষ্ণকান্ত সরকার রচিত ‘পুরাতত্ত্বের আলোতে প্রস্তর যুগ থেকে জন্ম ভারতের সভ্যতা (মেহরগড়-সরস্বতী-হরপ্পা)’ গ্রন্থটির প্রভূত সাহায্য নেওয়া হয়েছে এই প্রবন্ধ রচনায়।]
2020-01-29