(তৃতীয় অধ্যায়ের পর)

চার

কয়েকটি উল্লেখযোগ্য সাক্ষাৎকার

কলেজের পাট চুকে যাবার পর আমায় অত্যন্ত কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছিল। আমি ততদিনে বিবাহিত এবং একটি পুত্রসন্তানের পিতা। গ্রামে আমার পিতামাতা সহ একটা গোটা পরিবারের ভার আমার উপর বর্তেছিল। এদিকে আমার পকেটে একটা কানাকড়ি ছিল না। একমাত্র যে চাকরিটি কেন্দ্রীয় সচিবালয় দপ্তরের কেরানির পদে আমি পেয়েছিলাম, সেটিও ঠিক পঁয়ষট্টি দিন বাদেই ছেড়ে দিলাম, কারণ ব্রিটিশ সাম্রাজ্য-যন্ত্রটিকে সচল রাখবার একখানা চাকা হয়ে থাকতে আমার লজ্জা করত। আমার সর্বোচ্চ আকাঙ্ক্ষাটি ছিল কোনো একটি কলেজে লেকচারার হওয়া। কিন্তু যে ইন্টার্ভিউগুলিতে আমি ডাক পেয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকটিতে নিয়োগকর্তারা আমায় এই ব’লে ফিরিয়ে দিতেন যে পড়াবার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতাই আমার নেই!

এই দুঃসময় চলাকালীনই রাম স্বরূপের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ ঘটে। আমরা একই কলেজে পড়তাম, কিন্তু ও আমার চেয়ে এক বছরের সিনিয়র ছিল। তবে কলেজে পড়াকালীন কোনোদিন তার সঙ্গে আমার দেখাসাক্ষাৎ হয়নি। আমি শুনেছিলাম যে কলেজের ছাত্র সংসদে কিছু ছাত্রনেতার দেওয়া শ্রেষ্ঠ কয়েকটি বক্তৃতা আসলে রাম স্বরূপের লেখা, এবং আমার এক সহপাঠী তার নিজের নামে কলেজের পত্রিকায় যে কয়টি ভালো কবিতা ছাপিয়েছে সেগুলিও আসলে রাম স্বরূপেরই রচনা। কাজেই তার নামটি আমার জানা থাকলেও তার মুখ চেনা ছিল না। আমার একটুখানি কৌতূহলও জন্মেছিল। নিজের কবিতা জনসমক্ষে প্রকাশ করবার জন্য তাকে অন্যের নামের পিছনে লুকোতে হবে কেন?

ইতিমধ্যে, বৌদ্ধিক ধ্যানধারণায় আমি আমার কলেজজীবনের দার্শনিক বন্ধুটির থেকে দূরে সরতে আরম্ভ করেছিলাম। এম.এ. পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও কলেজ থেকে বেরিয়ে সেও আমারই মতো বেকারত্বের কবলে পড়েছিল। মার্ক্সের দর্শনে সে কোনো অর্থবহ তত্ত্ব খুঁজে পেতো না। তার স্বভাবের আরো একটি ব্যাপার – যেটিকে আমি বদভ্যাস ব’লেই মনে করতাম – ছিল এই যে সে সব বিতর্কেই বিপরীত অবস্থানটি গ্রহণ করত যাতে যেকোনো দার্শনিক মতের সমর্থকের মধ্যে থেকে সেরাটুকু বের ক’রে আনা যায়। তবে রাম স্বরূপের প্রশংসায় সে ছিল পঞ্চমুখ, যার সঙ্গে তার পরিচয়ও ছিল। একবার সে রাম স্বরূপকে তার দেখা সবচাইতে নৈর্ব্যক্তিক ব্যক্তি ব’লে বর্ণনা করেছিল।

একদিন আমাদের দুজনেরই বন্ধুস্থানীয় একজন আমায় একটি সভায় যাবার নিমন্ত্রণ জানালো, যার সভাপতিত্ব করবার কথা ছিল রাম স্বরূপের। আমি নির্দিষ্ট জায়গাটিতে গিয়ে পৌঁছলাম, এবং জীবনে সেই প্রথমবার তাকে সামনাসামনি দেখলাম। বুঝলাম রসবোধের নিরিখে ব্যক্তিটি পুরোমাত্রায় শেভিয়ান[1]। তার চোখেমুখ থেকে একরকমের প্রেমপূর্ণ আভা যেন ঠিকরে বেরোতো, যে কারণে প্রথম দর্শনেই তাকে আমার ভালো লেগে গেল। সেই প্রথম দিনটি থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়ে গেল। এরপর থেকে আমরা প্রায় প্রত্যেকদিন দেখা করতাম, কখনো চাঁদনী চকের কোনো রেস্তরাঁয় তো কখনো লালকেল্লার প্রাচীরের তলায় বিছানো ঘাসের উপর ব’সে। আলোচনার বিষয়বস্তু হ’ত রাম স্বরূপের খাড়া করা একখানি অভিনব তত্ত্ব। প্রথম প্রথম আমি ভাবতাম যে সে নিজেই বুঝি এই তত্ত্বটি উদ্ভাবন করেছে।

মানবসভ্যতার ইতিহাসে শ্রেণীসংগ্রামের ভূমিকার প্রশ্নে মার্ক্সকেই রাম স্বরূপ সঠিক ব’লে মানতো। তবে যে প্রশ্নটি সে তুলেছিল তা আরো অনেক বেশি বুনিয়াদী; তার সঙ্গে সাক্ষাৎ হবার আগে আমি অন্ততঃ কাউকে কখনো সেরকম প্রশ্ন তুলতে শুনিনি কিংবা বইয়েও পড়িওনি। এইসব নানাবিধ শ্রেণী গড়ে উঠলই বা কীভাবে? এই ছিল তার প্রশ্ন। সেসময় আমি জানতামই না যে মার্ক্স এই প্রশ্নের একখানি উত্তর দিয়ে গেছেন। মার্ক্সের মতে, আদিমকালের যূথবদ্ধ সমাজব্যবস্থায় শ্রেণীগুলি গড়ে উঠেছিল এমন এক সন্ধিক্ষণে যখন উৎপাদনের সাধনগুলি কেবল বিশেষ একদল লোকের হাতেই জড়ো হ’তে শুরু করে, এবং অন্যদের সুবিধে-অসুবিধের কথা না ভেবে তারা সেইসব সাধনগুলিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের আখের গুছিয়ে নেয়। এইসব উৎপাদনের সাধন যাদের কব্জায় এলো তারা হ’ল গিয়ে সব-পেয়েছির দল। এরাই সর্বহারাদের উপর ছড়ি ঘোরাতে শুরু করলো। কিন্তু এই উত্তরটা আমার জানা থাকলেও রাম স্বরূপের তাতে মন ভরতো না। তার অনুসন্ধিৎসা ছিল মার্ক্সের চাইতেও গভীর। কেমন ক’রে ঐ সব-পেয়েছির দল উৎপাদনের সাধনগুলি নিজেদের কুক্ষিগত করতে পারলো?

অগত্যা আমি এই অপেক্ষায় রইলাম যে রাম স্বরূপ নিজেই নিজের উত্থাপিত প্রশ্নগুলির উত্তর জোগাবে। সে আমায় বোঝালো যে বিভিন্ন জাতির মধ্যে লেগে থাকা বিবাদ থেকেই শ্রেণীগুলির উদ্ভব হয়েছে। এক জাতির লোক অন্য জাতিকে পরাজিত ক’রে নিজেদের অধীনে আনে এবং তাদের উৎপাদনের সাধনগুলির দখল নিজেদের হাতে নিয়ে নেয়। তার চিন্তাধারা অনুযায়ী বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যেকার সংঘর্ষ হ’ল মুখ্য, আর শ্রেণী সংঘর্ষ গৌণ। গৌণ সংঘর্ষটির আড়ালে মুখ্য সংঘর্ষকে চাপা পড়তে দিলে অথবা তার প্রাবল্যকে খাটো করে দেখলে চলে না। অতএব, ভারতীয় সমাজে যতই শ্রেণী সংঘর্ষ থেকে থাক্‌, তা ব্রিটেনের সঙ্গে আমাদের জাতিগত সংঘর্ষের তুলনায় গৌণ। ব্যাপারটা আসলে ছিল একটি মার্ক্সীয় ধারণাকেই দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার ক’রে মার্ক্সকে পরাস্ত করা। আমি কিছুতেই এই যুক্তির সঙ্গে যুঝে উঠতে পারলাম না।

কিন্তু নিজের এই তত্ত্বটিকে প্রমাণ করবার জন্য যখন রাম স্বরূপ আমায় এর সপক্ষে ঐতিহাসিক তথ্য দিতে অনুরোধ করলো তখন আমি বেঁকে বসলাম। সে আমার মতো ইতিহাসের ছাত্র ছিলো না। আমার চিন্তাধারা অনুযায়ী দেখতে গেলে সর্বাগ্রে দরকার তথ্য, এবং সর্বদা ঐ তথ্য থেকেই যুক্তিপূর্ণ বিচার-বিশ্লেষণের মাধ্যমে কোনো একটি সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া সম্ভব। কিন্তু এখানে তো দেখি উলট পুরাণ! ব্যাপারটার অযৌক্তিকতা আমি রাম স্বরূপকে দেখাতে চেষ্টা করলাম। সে কেবল হেসে বললো যে তার মাথায় নাকি সিদ্ধান্তগুলো আগেভাগে আসে, তথ্যগুলি তার পরে এলেও ক্ষতি নেই। তখন আমি তাকে বললাম যে এই ধরণের চিন্তাভাবনার মধ্যে ফ্যাসিবাদের গন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। সে তাতে আরো একগাল হেসে নিজের ঐ প্রখর বুদ্ধিমত্তা ফুটে বেরনো মুখমণ্ডলে “তাতে কী এসে যায়” গোছের একটা ভাব এনে আমার দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে রইল। এই প্রায় গালাগালির পর্যায়ে চলে যাওয়া শব্দটি[2] – যা শুনে আচ্ছা-আচ্ছা বুদ্ধিজীবীর দল কেঁপে উঠত – ওর উপরে কোনোই প্রভাব ফেলতে পারলো না। এমনকী কখনো-সখনো আমার এ সন্দেহও জাগতো যে সে আসলে ফ্যাসিবাদেরই সমর্থক।

আমার এহেন সন্দেহ আরো দৃঢ় ভিত্তি খুঁজে পেতো যখন দেখতাম যে কোনোরকম লুকোছাপা ছাড়াই সে আরএসএস-এর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছে। আরএসএস-কে ততদিনে আমি একখানা ফ্যাসিবাদী সংগঠন ব’লেই ধ’রে নিয়েছিলাম। এদিকে আরএসএস সম্পর্কে আমি যে বিশেষ কিছু জানতাম তেমনটা মোটেই নয়। আমার ফেলে আসা বুধমণ্ডলীগুলিতে যা শুনেছিলাম তারই কেবল পুনরাবৃত্তি করে যাচ্ছিলাম। তবে আরএসএস-এর কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে রাম স্বরূপের আলাপ-পরিচয় ছিল। সে আমাকে বলেছিল যে এঁদের মধ্যে কনট প্লেসের একটি বিখ্যাত দুধের দোকানের ম্যানেজারও ছিলেন। তাঁর দোকানে খদ্দেরের ভিড় লেগেই থাকতো। তিনি একজন সরকারী জমাদারকে দিয়ে খদ্দেরদের মধ্যে দুধের বোতল বিলি করাতেন। একজন জমাদার ভদ্রলোকেদের দুধের বোতল ছুঁয়ে দিচ্ছে – এর বিরুদ্ধে একদিন একজন মুসলমান ভদ্রলোক আপত্তি জানালেন। ম্যানেজারটি এর উত্তরে বলেছিলেন যে তিনি একজন হিন্দু এবং তাঁর ধর্মে ছুৎ-অচ্ছুৎ ব’লে কিছু নেই। এই ব্যাপারটা আমায় বেশ নাড়া দিয়েছিল। আমার মনে হ’ল, যদি প্রত্যেক হিন্দু একথা বলতে পারতো! তবে আরএসএস-এর ব্যাপারে আমার মতামত বদলালো না।

যদি আমি দিল্লীতে থেকে যেতাম এবং রাম স্বরূপের সঙ্গে নিয়মিত দেখাসাক্ষাৎ চালিয়ে যেতাম তাহ’লে আমার বিবর্তন কোন পথে চালিত হ’ত জানি না। সে মার্ক্সবাদী ছিল না। তবে সে একজন নাস্তিক অবশ্যই ছিল, যার বিশ্বাস ভগবানের চেয়ে ভাত বেশি জরুরি। শ্রীঅরবিন্দের কিছু কিছু লেখা সে পড়েছিল, আর তার মাধ্যমে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছিল যে যোগ হচ্ছে আসলে আত্মহননের প্রবণতা। বোঝাই যায় যে সেইসময় সে মানুষের ব্যক্তিত্ব বলতে শুধুমাত্র অহং-কেই বুঝত। বার্নার্ড শ এবং অ্যাল্ডাস হাক্সলীর লেখা তার উপরে গভীর প্রভাব ফেলেছিল, এবং নির্মম যুক্তির সাহায্যে ব্যক্তির আত্মবিশ্লেষণের ক্ষমতাকে সে অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখত। তখনো অব্দি আমি এইসব শক্তিশালী লেখকদের রচনা পড়ে উঠতে পারিনি, সে-ই এঁদের লেখালেখির সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল। মোট কথা, প্রচলিত নৈতিকতা কিংবা ব্যবহারিক শিষ্টাচারকে সে বিশেষ গ্রাহ্য করত না; কারণ সে স্পষ্ট দেখতে পেত যে কীভাবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে অপরকে কাঠগড়ায় তোলবার জন্যই এগুলিকে ব্যবহার করা হয়ে থাকে।

সরাসরি ওর ছত্রচ্ছায়ায় থাকাটা এমনি করেই চলতে থাকলে নিশ্চিত আমি কমিউনিস্টও হতাম না, মুসলিম সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে নিরপেক্ষও থাকতাম না। যে ক’দিন আমি দিল্লীর বাইরে কাটিয়েছিলাম সেই সময়ে আমাকে লেখা তার চিঠিপত্র আমার বিবর্তনের পথে গুরুত্বপূর্ণ মোড়গুলিতে আমায় ভীষণভাবেই প্রভাবিত করেছিল। কিন্তু তার সমগ্র ব্যক্তিত্বের যে শক্তি তা যদি সামনাসামনি পেতাম তাহ’লে সে প্রভাব আরো বেশি কার্যকরী হ’তে পারত। সে নিজের জোরেই বেড়ে উঠতে লাগল, বিবর্তিত হ’তে থাকল। আমার ক্ষেত্রে কিন্তু তেমনটা হয়নি। যারা আমার চেয়ে অগ্রগণ্য, তারা আমায় টেনে নিয়ে যাবে – এমনটাই আমার দরকার ছিল। এছাড়া তার অগ্রগতির ধরণটা ছিল আমার চাইতে অনেক বেশি দ্রুত এবং সুদূরপ্রসারী। আমার একার পক্ষে অমন বৌদ্ধিক অগ্রগমন লাভ করা সম্ভব ছিল না।

উনিশশো চুয়াল্লিশের ডিসেম্বরে আমায় দিল্লী ছেড়ে আসতে হ’ল। আমার প্রথম চাকরিটি জুটেছিল বম্বেতে, যেখানে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমার সঙ্গে খুবই বাজে ব্যবহার করতেন। শেষমেশ আমি একেবারে ভেঙে পড়ি এবং দিল্লীতে আমার আত্মীয়কে অত্যন্ত করুণ ভাষায় চিঠিপত্র লিখে সব জানাই। মাসদুয়েক বাদে বম্বে ছেড়ে আমি কলকাতার উদ্দেশ্যে পাড়ি দিই, যেখানে আমার বাবা আমার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা ক’রে দিতে পারবেন ব’লে আমার আশা ছিল। তিনি সত্যিই আমায় চাকরি পেতে সাহায্য করেছিলেন। কিন্তু আমার আত্মীয়স্বজন এবং হরিয়ানায় আমার গ্রামের লোকেদের ঘৃণাভরা গঞ্জনার হাত থেকে তিনি আমায় রক্ষা করতে পারেননি। আমার উচ্চশিক্ষা এবং যৎসামান্য বেতনের মধ্যেকার ফারাকটিকে লক্ষ্য ক’রে তারা আমায় ‘শিক্ষিত বেকার’-এর তকমা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে আমি যখন একটু অর্থ উপার্জন করতে সক্ষম হলাম তখন এরাই কিন্তু আমাকে অত্যন্ত সম্ভ্রমের চোখে দেখত। অথচ কলকাতায় আমার শুরুর দিনগুলোতে এরা আমার মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

যতক্ষণ অব্দি আমি আমার নিজস্ব প্রজ্ঞা এবং অনুপ্রেরণার প্রতি সৎ থেকেছি, ততক্ষণ অব্দি আমার সম্পর্কে কে কী বলল তাতে আমি বিশেষ পাত্তা দিইনি। এতদ্‌সত্ত্বেও, যারা শুধু টাকা টাকা করে এমনতরো লোকের ভিড়ে বাস করা খুবই যন্ত্রণাদায়ক। আমি এদেরকে খুব ভালো ক’রে চিনতাম। আমি জানতাম যে এদের কাছ থেকে এর চেয়ে বেশি প্রত্যাশা করা চলে না। এমনকী এদের প্রতি আমি সহানুভূতিও টের পেতাম; হাজার হোক এরা এমন সব প্রথাগত রীতিনীতির দাস যেগুলি ভয়ঙ্কর রকমের বিকৃতিপ্রাপ্ত হয়েছে। কিন্তু আমার অপযশ রটানো এদের পেয়ে বসেছিল কেন তা আজ পর্যন্ত আমার মাথায় ঢোকেনি। এরা নিজের চরকায় তেল দিত না কেন, আর কেনই বা আমাকে আমার মতো থাকতে দিত না?

কলকাতায় পৌঁছোবার দিনকয়েকের মধ্যেই রাম স্বরূপের কাছ থেকে যে চিঠিটি আমি পেলাম তা কোনো আদেশ কিংবা নির্দেশিকা জারি করবার চেয়ে কোনো অংশে কম ছিল না। সে লিখেছিল : “তোমার আত্মীয়কে যেসব চিঠিপত্র তুমি দিয়েছ আমি সেগুলি পড়েছি। তোমার এই অবস্থার জন্যে তোমার প্রতি আমার সম্পূর্ণ সহানুভূতি রয়েছে, কিন্তু নিজেকে করুণা করবার এই যে ভাবটি তোমার মধ্যে দেখা দিয়েছে সেটি আমি কিছুতেই সমর্থন করতে পারছিনা। সমাজ তোমাকে কিছুই দেয়নি, এমনকী প্রতিবাদ করবার অধিকারটুকুও নয়। কিন্তু তাই ব’লে তুমি কেবল অভিযোগ-অনুযোগ করে কাটাবে কেন! আমি চাই যে তুমি তোমার ব্যক্তিগত দুর্ভাগ্যকে এই গোটা সমাজব্যবস্থাটার বিরুদ্ধে একটি সুচিন্তিত প্রতিবাদে পরিণত করো।” এই বার্তাটি আমার ক্ষেত্রে কড়া দাওয়াইয়ের কাজ করেছিল। তখন থেকে আমি আরো বেশি ক’রে নৈর্ব্যক্তিক হবার চেষ্টা শুরু করলাম।

আমার ছিল নানা জায়গায় ঘুরে ঘুরে সেল্‌সের চাকরি, এবং এর দরুন আমায় কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত সর্বত্র ছুটে বেড়াতে হয়েছিল। বিহার, ইউ.পি., এবং দেশভাগের পূর্ববর্তী পাঞ্জাব প্রদেশের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর আমি চষে ফেলেছিলাম। নানান ধরণের লোকজনের সঙ্গে আলাপ করা, নানা স্থান দর্শন করা – সবমিলিয়ে দারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছিল। এর ফলে আমার অনেক গোঁড়ামিপূর্ণ অভ্যেস ভেঙে গিয়েছিল। আমি নিরামিষাশী ছিলাম, এবং চিরকাল তা-ই থেকেছি। কিন্তু মুসলিম-সহ নানান সম্প্রদায়ের মানুষের হাতে পরিবেশন করা নানান ধরণের খাদ্য ও পানীয় গ্রহণ করাতে আমি একেবারেই অভ্যস্ত ছিলাম না। একদিন অম্বালার এক হোটেলের জনৈক শিখ মালিক আমায় যখন জানালেন যে সকালে আমি যে জলে স্নান সেরেছি সেটি একটি চামড়ার থলেতে ক’রে স্নানঘর অব্দি বয়ে আনা হয়েছে তখন আমি আঁতকে উঠেছিলাম। নিজেকে তখন খুব অশুচি মনে হয়েছিল।

একবার সীতাপুর থেকে লখ্‌নউ ফেরবার পথে আমি একজন মাঝবয়েসি মুসলিম ভদ্রলোকের সঙ্গে ঈশ্বরের অস্তিত্ব সংক্রান্ত একটি চিত্তাকর্ষক আলোচনায় ডুবে গিয়েছিলাম। তিনি ইংরেজি একেবারেই জানতেন না, কিন্তু চোস্ত উর্দুতে কথাবার্তা বলছিলেন। এই ভাষায় দর্শনশাস্ত্রের নানান খুঁটিনাটি বিষয়ে পারিভাষিক শব্দের এমন প্রাচুর্য রয়েছে জেনে আমি আশ্চর্য হয়ে গিয়েছিলাম। যেখানে যেখানে আরবি শব্দ বুঝতে আমার অসুবিধে হচ্ছিল, সেখানে তিনি আমায় সেগুলি বুঝতে সাহায্য করছিলেন। আরেকজন সহযাত্রী অনেকক্ষণ ধ’রে খুব মন দিয়ে আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন। যে মুহূর্তে তিনি বুঝলেন যে আমি একজন নাছোড়বান্দা নাস্তিক, তিনি আমায় জিজ্ঞেস ক’রে বসলেন যে আমি কী কী পরীক্ষায় পাশ করেছি এবং সেগুলিতে কোন্‌ কোন্‌ শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়েছি। সব জেনে তিনি ভীষণ অবজ্ঞাভ’রে আমায় বললেন : “তুসী মালিক নু নহীঁ মানদে তভি পক্‌খে বেচদে ফিরদে হো, নহীঁ তাঁ ইন্নি তালিম পাকে কোঈ ওহ্‌দা নহীঁ পা জাঁদে (ঈশ্বরে বিশ্বাস করো না তাই তোমায় পাখা বেচে বেড়াতে হয়, নইলে তোমার এত ডিগ্রি রয়েছে যে তুমি সহজেই বড়সড় অফিসার ব’নে যেতে)।” পাল্টা আমিও বললাম যে ঈশ্বর যদি আমায় একটা ভাল চাকরি পাইয়ে দেন তাহলে আমিও তাঁকে মানতে রাজি আছি। এইসব অর্বাচীন কুতর্ক শুনে মুসলিম ভদ্রলোকটি সদাশয়ভাবে হাসলেন, কিন্তু মুখে কিছু বললেন না। এই রকমের খোঁচা দার্শনিক আলোচনার ক্ষেত্রে কখনোই সমীচীন নয়। স্বাভাবিক কারণেই তিনি অসহায় বোধ করেছিলেন হয়তো। এধরণের কুতর্কে তিনি নিজেকে জড়াতে আগ্রহী ছিলেন না।

একবার রাওয়ালপিণ্ডি থেকে পেশোয়ার যাবার পথে পাকিস্তান কাম্য কি না এই নিয়ে দুজন মাঝবয়েসি মুসলমান ভদ্রলোকের মধ্যে একটি ভীষণ উত্তপ্ত বাদানুবাদের সাক্ষী হ’তে হয়েছিল আমাকে। এঁদের মধ্যে একজন ছিলেন পাঞ্জাবী, আর অন্যজন পাঠান। এঁরা পাঞ্জাবী ভাষার এমন একটি বাচনধারায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন যার কিছু কিছু অংশ আমি স্পষ্ট ক’রে বুঝে উঠতে পারিনি। তর্কাতর্কির মধ্যে পাঠান ভদ্রলোকটি একখানা মোক্ষম কথা বলে বসলেন : “জিন্নাহ্‌ সালা সুয়র দা পুত্তর এহ্‌”, অর্থাৎ, জিন্নাহ্‌ হচ্ছে শুয়োরের বাচ্চা। রেগে লাল হয়ে পাঞ্জাবী লোকটি নিজের আসন ছেড়ে উঠে দাঁড়াল, এবং পাঠান ভদ্রলোকটিকে দ্বিতীয়বার ঐ একই বাক্য বলবার স্পর্ধা দেখাতে বলল। পাঠান ভদ্রলোক তখনো নির্বিকারভাবে নিজের আসনে ব’সে। পাঞ্জাবী লোকটির চোখে চোখ রেখে তিনি শুধু বললেন “অসী ফের দসদাঁ হাঁ। জিন্নাহ্‌ সালা সুয়র দা পুত্তর এহ্‌ (আমি আবারো বলছি। জিন্নাহ্‌ শালা শুয়োরের বাচ্চা)।” পাঠান ভদ্রলোকের গলার আওয়াজ এবং চোখেমুখ থেকে এতখানি আত্মবিশ্বাস ঠিকরে বেরোচ্ছিল যে পাঞ্জাবী লোকটি আর ওঁর গায়ে হাত তোলার সাহস করেনি। সে যাত্রায় পেশোয়ার অব্দি বাকি রাস্তাটুকু একেবারে নিঃস্পন্দ নিস্তব্ধতার মধ্যে দিয়ে কেটেছিল।

পেশোয়ার থেকে ফেরবার পথে আমায় একজন মধ্যবয়স্ক ইংরেজ ভদ্রলোকের সঙ্গে নীচের বার্থখানা ভাগাভাগি ক’রে ব’সে আসতে হ’ল। লোকটি তখন সদ্য ব্রিটিশ সেনার মেজরের পদ থেকে অবসর নিয়ে বম্বে হ’য়ে দেশে ফিরছিল। লোকটির স্বভাব ছিল ভারি নম্র, এবং ব্রিটিশ জাতির সহজাত ন্যূনভাষণের প্রতিভাটিও তাঁর করায়ত্ত ছিল। যুদ্ধ তখন শেষের পথে। আমরা যুদ্ধের ব্যাপারে কথা বলছিলাম, কথা বলতে বলতে আমাকে তাঁর ভালো লেগে গেল। দু-এক ঘণ্টার মধ্যে দেখতে দেখতে তিনি আমার অভিভাবকের মতো হয়ে গেলেন, এবং নিজের সঙ্গে আনা মধ্যাহ্নভোজটি আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চাইলেন। আমাকে তাঁর প্রস্তাব ফেরাতে হ’ল, কারণ আমি ছিলাম নিরামিষাশী। পরের স্টেশনের প্ল্যাটফর্ম থেকে আমি নিজের জন্য কিছু খাবার কিনে খেলাম। এরপর তিনি তাঁর নিজের কোণটিতে দুপুরের ঘুম দেবেন ব’লে যখন তৈরি হচ্ছেন, তখন আমি পড়বার জন্য একটা বই বের করলাম। বইটি ছিল “ইম্পিরিয়ালিজম :  দ্য হাইয়েস্ট স্টেজ অফ ক্যাপিটালিজম”, লেনিনের রচনা, লাহোরের কমিউনিস্ট পার্টি অফিস থেকে কিছুকাল আগে আমি বইটি কিনেছিলাম। ওর প্রচ্ছদে উদ্যত মুষ্টিবদ্ধ হাতের ছবিওয়ালা প্রতীকটি আঁকা ছিল। হঠাৎ মেজর সাহেবের মুখে আতঙ্কের ছায়া দেখা দিল। একজন ধর্মভীরু খ্রিস্টানের ন্যায় বারবার নিজের বুকে ক্রশ এঁকে তিনি যতদূর সম্ভব নিজের কোণে স’রে গেলেন। কিন্তু মুখে একটি টুঁ শব্দ উচ্চারণ করলেন না। আমি তৎক্ষণাৎ বইখানা আমার সুটকেসে ঢুকিয়ে ফেললাম। এরপর পুরনো দিল্লী স্টেশনে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নেবার আগে অব্দি আমি ঐ বইটি কিংবা অন্য কোনো কমিউনিস্ট বই আর বের করিনি। তিনি আমায় নিজের কার্ড দিয়েছিলেন এবং তাঁর বাড়িতে নিমন্ত্রণ জানিয়ে বলেছিলেন যে আমি যদি কখনো ইংলন্ডে যাই তাহলে অবশ্যই যেন তাঁর সঙ্গে দেখা করি। সেই কার্ডটি আমি বেশিদিন যত্ন ক’রে রাখিনি তার কারণ সেসময় ইংলন্ডযাত্রা আমার স্বপ্নেরও অতীত ছিল।

কিন্তু আমার এই ভ্রমণকালের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাটি ছিল লাহোরের ম্যাকলীওড রোডে স্থিত কমিউনিস্ট পার্টি অফিসে যাওয়াটা। বহু বছর আগে যার বাবা আমায় অপমান করেছিলেন আমার সেই সহপাঠীটি তখন থাকে লাহোরে। অল ইন্ডিয়া স্টুডেন্ট্‌স্‌ ফেডারেশন করতে করতে সে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যপদ গ্রহণ করেছিল। সে-ই আমায় পার্টি অফিসে নিয়ে গেল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি ও তাদের নিজস্ব প্রকাশনাগুলির সঙ্গে সেই আমার প্রথম পরিচয় ঘটল। ঐ পার্টি অফিসে কর্মরত বেশ কিছু যুবক যুবতী এসেছিল বঙ্গদেশ থেকে। আমি তাদের সঙ্গে আমার ভাঙা ভাঙা বাংলায় কথা শুরু করতেই তারা আমার সঙ্গে জমিয়ে আলাপ জুড়ে দিল। আমি সেখান থেকে লেনিনের কিছু বই কিনলাম, পার্টির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা বেশ কিছু ছোট পুস্তিকাও কিনলাম, যেগুলির বেশিরভাগই ছিল পাকিস্তান গঠনের দাবীটির ব্যাপারে। কলকাতা এসে পৌঁছোবার আগেই এর সবগুলো পড়ে শেষ করেছিলাম।

লাহোরে আমার দিনকয়েকের প্রবাসকালে মুসলিম লীগের তোলা পাকিস্তান গঠনের দাবীটির যৌক্তিকতা নিয়ে আমার বন্ধুটির সঙ্গে লম্বা লম্বা আলোচনা করবার সুযোগ হয়েছিল। দাবীটি যে একেবারে যথাযথ এবং গণতান্ত্রিক, সে বিষয়ে তার দৃঢ় প্রত্যয় জন্মেছিল, এবং আমার মধ্যেও ঐ একই প্রত্যয় জাগাবার আপ্রাণ চেষ্টা সে করেছিল। কিন্তু আমার বারবার মনে পড়ে যাচ্ছিল বিরাট সংখ্যক হিন্দু এবং শিখ মানুষজনের কথা। পাঞ্জাব এবং উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের মধ্যে দিয়ে যাত্রা করবার সময় এঁদের অনেকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়েছিল এবং এই বিষয়ে কথাবার্তাও হয়েছিল। মুসলমান মৌলবীরা যেখানে ছড়ি ঘোরাবে সেরকম একটি রাষ্ট্রে বাস করবার এঁরা প্রত্যেকেই ভয়ানক বিরোধী ছিলেন। কিন্তু আমার বন্ধুটির মত এই যে মৌলবীরা আসল জনতা নয়। সে কেবলই বলতে থাকল এমন কিছু প্রগতিশীল ব্যক্তির কথা যারা নাকি ধর্মীয় ভেদাভেদ ভুলে ভাষা ও সংস্কৃতির ঐক্যসূত্রে ভ্রাতৃত্বের বন্ধনে আবদ্ধ। আমিও নিজেকে প্রগতিশীল ভাবতাম। কিন্তু পাকিস্তানের ধারণাটির মধ্যে আমি কোনো প্রগতিশীলতা খুঁজে পেলাম না। মুসলিম লীগে যাদের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল তারা হচ্ছে অভিজাত সম্প্রদায়, নবাব ও নবাবজাদাদের দল, খান বাহাদুরের দল, এবং ধর্মোন্মাদ মৌলবীদের দল।

কলকাতায় ফিরে আমি আমার আপিসের মনিবদের জানালাম যে আমি আর ঘোরাঘুরি করতে রাজি নই, তা সে চাকরি থাক আর না-ই থাক। তাঁরা আমায় থিতু হবার সুযোগ ক’রে দিলেন। আমি কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে প্রায়ই যেতাম, এবং সেখানে বসে আমি আমার প্রথম উপন্যাসটির রচনায় হাত লাগিয়েছিলাম। আমার বাসস্থানের যে ছোট্ট কুঠুরিটিতে আমাকে আরো চারজনের সঙ্গে ভাগাভাগি ক’রে থাকতে হ’ত, সেখানে আমার লেখা আসতো না। সেইজন্যে বিভিন্ন কফিখানায় ব’সে লেখালেখি করা আমার অভ্যেসে দাঁড়িয়ে গিয়েছিল, যে অভ্যেস আমার নিজের একটা আরামদায়ক বাড়ি জুটে যাবার পরেও টিঁকে ছিল। কফি হাউসে ব’সে এইরকম লেখালেখি করবার সময়েই একদল বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে আমার আলাপ হয়, যারা ছিল কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি অথবা সিএসপি-র সদস্য। তাঁরা একদিন আমায় তাদের নেতার কাছে নিয়ে গেল। তাঁর নামটি আমার এখন আর মনে নেই। তিনি আমায় আচার্য নরেন্দ্র দেব এবং শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণের কিছু রচনা হিন্দি থেকে ইংরেজিতে অনুবাদ করবার বরাত দিলেন, যাতে ওগুলি পরে বাংলায় অনুবাদ করা যায়। তখনকার দিনে কলকাতায় এমন বাঙালি পাওয়া ছিল দুষ্কর যে কিনা সরাসরি হিন্দি থেকে বাংলায় অনুবাদ করতে পারবে। মনে হয় সে অবস্থা আজও বদলায়নি।

আমি খুব দ্রুত অনুবাদের কাজ শেষ করলাম। সিএসপি-র এই নেতৃবৃন্দ যা যা লিখেছিলেন তার প্রত্যেকটি কথা আমি অক্ষরে অক্ষরে সমর্থন করতাম। তিরিশের দশকের গোড়ার দিকে, সিএসপি তখনো কমিউনিস্টদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি, তাঁদের এই রচনাগুলি ছিল সেই সময়কার। এদের দুই দলের মধ্যে যে গুরুতর বিবাদ ছিল, যার কারণে উনিশশো চল্লিশ থেকে এদের মধ্যে ভাঙন দেখা দেয়, সেই বিষয়ে আমি একেবারেই অবগত ছিলাম না। আমার ইংরেজি অনুবাদগুলি আদৌ কখনো বাংলায় অনূদিত হয়েছিল কিনা তা আমার জানা নেই। কিন্তু এই সুবাদে আমি ঐ সোশ্যালিস্ট নেতাটির শ্রদ্ধা এবং সম্ভ্রম আদায় ক’রে নিতে পেরেছিলাম। তিনি ছিলেন মাঝারি উচ্চতাবিশিষ্ট, চাপা গায়ের রঙ এবং জীর্ণ-শীর্ণ চেহারার মানুষ। এককালে তিনি বিপ্লবী ছিলেন, বহু বছর ব্রিটিশের জেলে কাটিয়েছেন, একবার আন্দামানেও কারাবাস করতে হয়েছিল। একটা সরু, অন্ধকার কানাগলির মধ্যে একখানা ভাঙাচোরা ঘরে অত্যন্ত কৃচ্ছ্রসাধনের মধ্যে তিনি বাস করতেন। তাঁর পরনের জামায় সবসময় অনেকগুলি তাপ্পি দেখতে পাওয়া যেত। তিনি বসতেন একটা ছোটো মাদুরের উপর, চারপাশে অন্য কোনো বিলাসব্যসনের উপকরণ ছাড়াই। মাঝেমধ্যে বিড়ি টানতেন। কিন্তু তাঁর চেহারার মধ্যে একটা কড়া ভাব ছিল। এবং তিনি খুব কম কথা বলতেন। তাঁর উপস্থিতি আমার মধ্যে একটা ভয়মিশ্রিত গভীর শ্রদ্ধার উদ্রেক করত।

আমার উপর তাঁর আস্থার কারণে তিনি একদিন আমায় একটি হিন্দি সাপ্তাহিক পত্রিকার সম্পাদনার দায়িত্ব নেবার কথা বললেন, যে পত্রিকাটি সিএসপি কলকাতার হিন্দিভাষী মানুষজনের সুবিধার্থে কিছুদিন যাবৎ প্রকাশ করতে শুরু করেছিল। এই দায়িত্ব নেবার ব্যাপারে আমার মধ্যে অনেক দ্বিধা ছিল। একেই এই ক্ষেত্রে আমার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল না। কিন্তু তিনি আমায় উৎসাহ দিতে লাগলেন। তিনি বললেন যে আমার কাজ অন্ততঃ তৎকালীন সম্পাদকটির চাইতে খারাপ হবে না, যে কিনা – তাঁর ভাষায় – ইউপি থেকে আসা স্রেফ ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করা একজন ব্যক্তি। আমি দায়িত্বটি নিলাম এবং কিছুদিনের মধ্যেই প্রথম সম্পাদকীয়টি লিখে ফেললাম। সোশ্যালিস্ট পত্রিকাটির জন্য আমার লেখা সেইটিই ছিল শেষ সম্পাদকীয় কলাম।

নেতাটি হিন্দি পড়তে পারতেন না। কিন্তু কেউ পড়ে শোনালে হিন্দি তিনি খুব ভালোই বুঝতে পারতেন। ভূতপূর্ব সম্পাদকটি যখন তাঁকে আমার লেখা পড়ে শোনাচ্ছিল, তখন তিনি খুব অস্থির হয়ে ওঠেন। এরপরই তিনি তৎক্ষণাৎ আমায় ডেকে পাঠান।

অনেক ভাবনাচিন্তা এবং ভাষা নিয়ে অনেকরকম ঘষামাজা করবার ফলস্বরূপ আমি যেটা লিখেছিলাম সেটার জন্য আমি পিঠচাপড়ানি পাবো এই আশা ছিল। কিন্তু সোশ্যালিস্ট নেতাটির কঠিন চোখমুখ দেখে আমি থতমত খেয়ে গেলাম। তিনি আমায় সোজাসুজি জিজ্ঞেস করলেন : “তুমি কি কমিউনিস্ট?” আমি এই অভিযোগ দৃঢ়ভাবে অস্বীকার করায় তিনি প্রতিবাদ ক’রে উঠলেন; “কিন্তু এই সম্পাদকীয়তে তুমি যে অবস্থান নিয়েছ সে তো কমিউনিস্টদের অবস্থান। এর ব্যাখ্যা তুমি করবে কীভাবে? কমিউনিস্টরা এর আগেও আমাদের দলে চুপিসারে ঢুকে পড়েছে এবং আমাদের দলের পক্ষে তার ফলাফল হয়েছে মারাত্মক। ফের সেটা হতে দিতে আমরা পারিনা। কলকাতার মতো শহরে তো কদাপি নয়। এ কোনো ছোটখাটো শহরতলি নয় যেখানে আমাদের কিছু সহযোদ্ধাকে কমিউনিস্টরা তাদের চালাক চালাক কথা শুনিয়ে সহজেই বোকা বানিয়ে পার পেয়ে যাবে।” এই কথাগুলি বলতে বলতে তাঁর মেজাজের পারদ ক্রমশঃ চড়ছিল। সেই প্রথমবার আমি তাঁকে এত অল্প সময়ের মধ্যে একবারে অতগুলি কথা উচ্চারণ করতে শুনেছিলাম।

ঐ সম্পাদকীয়টির বিষয়বস্তু কি ছিল তা আজ আর আমার মনে নেই। খুব সম্ভবতঃ সেটা ক্যাবিনেট মিশনের প্রস্তাব বিষয়ক হয়ে থাকবে। ঐ বিষয়ে অথবা অন্য কোনো বিষয়েই সিএসপি-র অবস্থান কী ছিল তা আমি জানতাম না। এমনকী কমিউনিস্টদের অবস্থান কী তাও আমার জানা ছিল না – এক পাকিস্তানের বিষয়টিতে তাদের অবস্থান ছাড়া। আমি আশা করেছিলাম যে আমার কফি হাউসের বন্ধুরা আমায় তাদের নেতার ক্রোধের হাত থেকে আমায় উদ্ধার করবে। কিন্তু তাদের চেহারাতেও আমার প্রতি বেশ খানিকটা প্রতিকূলতা টের পেলাম। বেপরোয়া হয়ে নেতাটির পায়ে ধ’রে তাঁকে বললাম যে আমি যা কিছু পবিত্র ব’লে গণ্য করি সেসমস্ত ছুঁয়ে হলফ ক’রে আমি বলতে পারি যে আমি জেনেশুনে এই বিকৃতি ঘটাইনি। ঐ মহানুভব মানুষটি সঙ্গে সঙ্গে গ’লে গেলেন। তাঁর দুই হাত আমার মাথার উপর রেখে আমায় তিনি আশীর্বাদ করলেন এবং বিভিন্ন দলের অবস্থান সম্পর্কে আলোচনা করবেন ব’লে আমায় আবার একদিন আসতে বললেন। তার আগে অব্দি আমি যেন তাঁর সাপ্তাহিক পত্রিকার জন্য কোনো সম্পাদকীয় না লিখি।

তাঁর সঙ্গে এরপর আর কোনোদিন আমার দেখা হয়নি। কয়েকদিন বাদেই ১৯৪৬-এর ১৬ই অগাস্ট তারিখে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। সেদিন সকাল সকাল কফি হাউসে গিয়ে দেখি যে সেটি বন্ধ রয়েছে। সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে একদল উন্মত্ত মুসলিম জনতার হাতে আমি হয়তো মারাই যেতাম। আমার চোস্ত উর্দু এবং পশ্চিমা পোশাক আমাকে সে যাত্রায় রক্ষা করেছিল। এর মাত্র কয়েকদিন আগে আমার স্ত্রী এবং দু’বছর বয়সের শিশুপুত্র আমার সঙ্গে একটি বড় বাড়ির ছোট্ট একটা ঘরে থাকতে এসেছিল, যেটি একটি বিশাল মুসলিম এলাকার লাগোয়া অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। ১৭ তারিখ সন্ধেবেলা আমাদের ঐ বাড়ি ছেড়ে পিছনের দেয়াল টপকে পালাতে হয়েছিল, তার কারণ একদল উন্মত্ত খুনে মুসলিম জনতা হাতে আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে বাড়ির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল। এর কিছুক্ষণ বাদেই সেনাবাহিনী যদি সেখানে এসে না পৌঁছত, তাহলে আজ যা লিখছি তা লেখবার জন্য আমি আর বেঁচে থাকতাম না।

পাদটীকা

[1]  অর্থাৎ লেখকের মতে রাম স্বরূপের রসবোধ ছিল জর্জ বার্নার্ড শ’-এর সমতুল।

[2] ফ্যাসিবাদWhatsAppFacebookTwitter

মূল গ্রন্থের রচয়িতা: সীতারাম গোয়েল
বঙ্গানুবাদ : শ্রীবিজয়াদিত্য

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.