সত্তরতম গণতন্ত্র দিবসে জনগণের কর্তব্য

দেশে সাধারণতন্ত্র বা গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর দেখতে দেখতে কেটে গেল সত্তরটি বছর। সত্তর বছর আগে ১৯৫০ সালের ২৬ জানুয়ারি গৃহীত হয়েছিল ভারতের সংবিধান। সংবিধান রচনা এবং তা রক্ষা করার দায়িত্ব দেশের সাধারণ মানুষের উপর ন্যস্ত হয়েছিল।
স্বাধীনতা লাভ ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এত বছর পর নতুন করে ভাবতে হবে কীভাবে দেশে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব। সাধারণ মানুষের রায়ে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে সংসদেবাবিধানসভায় অধিষ্ঠিত হলেই যে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না— এ কথাটা নতুন করে ভাববার সময় এসেছে। আর তা না হলে জনগণের কাছে গণতন্ত্র শুধু একটি অলীক স্বপ্নই থেকে যাবে।
বর্তমান সময়ে সংসদ থেকে পঞ্চায়েত স্তর পর্যন্ত সাধারণদের ব্যাপক উপস্থিতি অনেকের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই তাদের গাত্রদাহ শুরু হয়েছে সামান্য একজন চাওয়ালা ভারতের মতো বিশাল দেশের গদিতে বসার জন্য। এ তারা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না।
এই গণতান্ত্রিক কাঠামো জনগণের স্বার্থরক্ষায় অতন্দ্রপ্রহরীর মতো কাজ করে যাচ্ছে। এই গণতন্ত্রের মুখ্যমন্ত্রী হয়েছিলেন বিহারের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর আব্দুল গফুর, মহারাষ্ট্রের সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর আব্দুল রহমান আন্তুলে, অসমের সৈয়দ আনোয়ারা তাইমুর। শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠের কথা হলে এরা কোনোদিন মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন না। দলিত নেত্রী মায়াবতী, দরিদ্র ঘরের কন্যা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও মুখ্যমন্ত্রী হতে পারতেন না। সহমতের ও নমনীয় গণতন্ত্রের জন্যই তা সম্ভব হয়েছে এবং হচ্ছে। এই কাঠামোতেই উদ্বাস্তু আই কে গুজরাল প্রধানমন্ত্রী হন, উদ্বাস্তু আদবানী উপ-প্রধানমন্ত্রী হন, অত্যন্ত দরিদ্র ঘরের সন্তান চা-র বিক্রেতা নরেন্দ্র মোদী প্রধানমন্ত্রী হন, উপজাতি সাংমা লোকসভার অধ্যক্ষ হন। তপশিলি কে আর নারায়ণন রাষ্ট্রপতি হন, মুসলমান ফকরুদ্দিন, জাকির হোসেন, এপিজে আবুল কালাম রাষ্ট্রপতি হন, খ্রিস্টান ফার্নান্ডেজ প্রতিরক্ষামন্ত্রী, পারসি সোলি সোরাবজি অ্যাটর্নি জেনারেল হন। সর্বোপরি সংবিধান রচনা করার খসড়া কমিটির চেয়ারম্যান হন দলিত আম্বেদকর। এর পরে আর বলা যায় না গণতন্ত্রে জনসাধারণ অবহেলিত, বঞ্চিত।
তবে সাধারণ মানুষের প্রতিনিধি হয়ে যাঁরা বিধানসভা বা সংসদে যান, রাজনীতির গতিপ্রকৃতির উপরই তাদের ক্ষমতা নির্ভর করে। গণতন্ত্রে শাসক ও বিরোধী দুই পক্ষেরই ভূমিকা সমান গুরুত্বপূর্ণ। দেশে দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ শাসনব্যবস্থা কায়েম করার জন্য দু’ পক্ষকেই নিতে হয় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। কিন্তু ভারতের সাংসদ বা বিধায়করা জনগণকে সুশাসন দেবার পরিবর্তে নিজেদের ক্ষমতা লাভ এবং দীর্ঘ সময় তা ভোগ করার বিষয়েই বেশি আগ্রহ প্রকাশ করেন। সাধারণ মানুষের রায়ে জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়ে সংসদে বা বিধান সভায় অধিষ্ঠিত হলেই যে প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না— একথা নতুন করে বোধহয় ভাববার সময় এসেছে।
আজ ভারতীয় গণতন্ত্র যখন সত্তর বছর অতিক্রম করছে তখন আমরা পিছনে তাকিয়ে দেখি কতদূর এগিয়েছি। কৃষিতে, শিল্পে, সমাজ কল্যাণে, খাদ্যের নিরাপত্তায়, দুর্বল ও দলিতদের যত্নে দেশ পথিকৃতের উদ্যোগ নিয়েছে। জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আমরা অন্তরীক্ষে হাত বাড়াতে কোনও বাধার তোয়াক্কা করিনি। মহাসমুদ্রের গভীরে ঝাপ দিয়েছি এবং আই টি ক্ষেত্রে নতুন নতুন উচ্চতায় পৌঁছে বিশ্বজুড়ে সফটওয়ার পাওয়ার হাউস নামে অভিহিত হয়েছি। এই সব কিছুই সম্ভব হয়েছে তার কারণ আমরা জনশক্তিকে যুক্ত করে নিয়েছি। ভারতীয় গণতন্ত্র সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বমূলক এবং তৃণমূল স্তর পর্যন্ত অংশগ্রহণমূলক রূপে সমৃদ্ধ হয়ে উঠেছে, সংবিধানে স্থাপিত সেইসব মহান আদর্শকে পূরণ করছে—ন্যায়, স্বাধীনতা, সাম্য ও মৈত্রীর আদর্শকে, যা আমাদের গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
গণতন্ত্র দিবসে সৈনিকরা যখন জনগণের হর্ষধ্বনির মধ্যে দিয়ে কুচকাওয়াজ করেন, ট্যাবলোগুলো যখন বৈচিত্র্য আর ঐক্যকে পরিস্ফুট করে, তখন গর্বে আমাদের বুক ভরে ওঠে। তবে নানা দিকের ব্যর্থতার কথা অবশ্যই তোলা যেতে পারে, সেসবের অনেকটাই মামুলি অভিযোগ। যেমন, এখনও ভারতের সব মানুষ পেট ভরে খেতে পায় না, পানীয় জলের অভাব, মাথার উপর সকলের ছাদ নেই, লেখাপড়া থেকে অনেকেই বঞ্চিত, সকলের কাজ জোটে না। এই অভিযোগগুলো সত্য বটে, কিন্তু সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রকে অভিযুক্ত করা যায় না।
সে সবই মানসিক ব্যর্থতা। দায়িত্বে আছেন কিন্তু দায়িত্ব পালন করছেন , ক্ষমতা হাতে পেয়ে শুধু নিজের স্বার্থ সিদ্ধি করছেন— এই মানবিক দোষ ও দুর্বলতা দেশের পক্ষে অভিশাপ হয়ে দাঁড়ায়। এই অভিশাপ গণতন্ত্রকে কলঙ্কিত করে, জনগণের বঞ্চনা বাড়ায়। এখনও যে হাহাকার শুনি তবে তার উৎস সেখানেই। কিন্তু এও শেষ কথা নয়। জনগণের আত্মচেতনা বাড়তেই থাকবে। তারাই গণতন্ত্রকে জীবন্ত ও নিষ্কলুষ করে তুলবে। মহান গণতন্ত্র দিবস উপলক্ষ্যে আমি প্রণাম জানাতে হয় আমাদের গণতন্ত্রের প্রহরী প্রকৃত দেশভক্ত জনগণকে।
মণীন্দ্রনাথ সাহা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.