বিদ্যাসাগর-নির্মাণ : পরিকল্পিত মিথ্যাচার

সম্প্রতি একটি পত্রিকায় অধ্যাপক শীতাংশু চক্রবর্তী একটি প্রবন্ধ (ভারতবর্ষ, বঙ্গদেশ এবং মূল্যবোধ : নিকট দিগন্তে কালো মেঘ’) লিখেছিলেন ২০১৩ খ্রি. জুলাই সেপ্টেম্বর। সে লেখার উদ্দেশ্য নিয়ে আশীষ লাহিড়ী তীব্র সমালোচনামূলক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন : ‘দীর্ঘ রবীন্দ্রনাথ, খর্ব ঈশ্বরচন্দ্র’। শীতাংশু চক্রবর্তী দেখেছেন পশ্চিমি ভাবাদর্শের আরোপে বিদ্যাসাগর মহাশয়ের ব্যাখ্যা ক্রমে ভারতের চিরন্তন মূল্যবোধ থেকে টেনে নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এর ফলে তাকে ভারতীয় সমাজ, আদর্শ, দেশচেতনা থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা হচ্ছে। ফলে মূল্যবোধ হ্রাস পাচ্ছে। পাশাপাশি, রবীন্দ্রনাথকে অধ্যাপক চক্রবর্তী বিদ্যাসাগরের তুলনায় অনেক দীর্ঘ করতে চেয়েছেন। আশীষবাবু গণ-বিতান আন্দোলনের মানুষ। তার মতে, শীতাংশুবাবু সমাজে বিদ্যাসাগরের শাশ্বত হিন্দুধর্ম সম্পর্কিত মূল্যবোধকে অস্বীকার করার প্রবণতাকেই একালে পাশ্চাত্য ভাবাদর্শে পুষ্ট (পড়ুন দরকচা মার্কা বামপন্থী মার্কসবাদী মতে নিষ্ঠ) গোষ্ঠী বিদ্যাসাগরকে বড়ো করে তুলছেন। রবীন্দ্রনাথ থেকে অরবিন্দ বিদ্যাসাগরর মতো শাশ্বত ভারতীয় হিন্দু সংস্কারের বিরোধিতা করেননি। আমাদের মনে হয় বিতর্কটি অবান্তর। বিদ্যাসাগরকে ভারতীয় শাশ্বত মূল্যবোধের বাইরে স্থাপন করা মূঢ়তা ছাড়া কিছু নয়। তা তিনি ছিলেন না। অধ্যাপক চক্রবর্তী প্রশ্ন তুলেছেন— “কোন মূল্যবোধের প্রেরণায় এই প্রাতঃস্মরণীয় পুরুষটিকে নিয়ে হঠাৎ এত আলোড়ন?’ তাঁর নিজস্ব ব্যাখ্যান অনুযায়ী এর কারণ তিনটি :১. তিনি ইংরেজ সরকারকে বেদ-বেদান্ত, হিন্দু-শাস্ত্রাদি যে ভ্রান্ত, সেকথা জানিয়েছিলেন। ২.‘বোধোদয়ে’প্রথমে পদার্থ, পরে ঈশ্বর সম্পর্কে লিখেছেন। এবং ৩. বিধবা বিবাহ আন্দোলনে তিনি পুরোধা ছিলেন।
পাশাপাশি আশীষবাবু এই যুক্তিগুলি অস্বীকার উদ্দেশ্যে পণ্ডশ্রম করে ওই প্রবন্ধ লিখেছেন। আবার বলি, বিদ্যাসাগর মূল্যায়নে রবীন্দ্রনাথ বা অন্য কোনো ব্যক্তিকে পাশে রাখার দরকার নেই। যাঁরা সমাজ-সংস্কারক শিক্ষাবিদ ঈশ্বরচন্দ্রকে পূজনশীল যুগস্রষ্টা কবি রবীন্দ্রনাথের তুলনা করছেন—তাঁরা দুজনকেই মর্যাদা দিচ্ছেন না। বিদ্যাসাগরের দ্বিশতবর্ষ পূর্তি উপলক্ষ্যে এসব বিতর্ক উদ্দেশ্যমূলক বলে পরিহার্য।
বিদ্যাসাগর বেদান্ত ও শাস্ত্রাদিকে মিথ্যা ভাবতেন, একে অবান্তর বলে মনে করি। ১৮৫৩, সেপ্টেম্বর ৭, তখনকার সম্পাদক : শিক্ষা দপ্তর, এফ. জে. ওয়াট-কে বিদ্যাসাগর যে চিঠি লিখেছিলেন, তার একাংশে আছে : বেদান্ত, ন্যায় ও সাংখ্য-দর্শনকে তিনি মিথ্যা দর্শন মনে করেন ! These systems false they are, command unbounded reverence from the Hindus শুধুমাত্র এই বাক্যাংশ থেকে যাঁরা দেখতে চান বিদ্যাসাগর দর্শন হিসেবে বেদান্ত, ন্যায় ও সাংখ্য-কে অকিঞ্চিৎকর মিথ্যা দর্শন বলেছেন—তাঁরা এই চিঠির অন্য অংশ পড়ে দেখেছেন নিশ্চয়। এই পত্রের প্রসঙ্গ ছিল সংস্কৃত কলেজের । ছাত্রদের পাঠ্যপুস্তক নির্বাচন সংক্রান্ত। ড. ব্যালান্টাইন লিখেছেন তিনটি বই— সেই তিনটিকে পাঠ্য হিসেবে নির্বাচনের প্রস্তাব এসেছিল। বিশপ বার্কলের পক্ষ থেকে ছিল চাপ। বিদ্যাসাগরের ভাষায় Inquiry’-র উত্তরেই মূল্যায়ন করেছিলেন তিনি। বইতিনটি যথাক্রমে—১. বেদান্তসার’, ২. ‘তর্কসংগ্রহ ও ৩. ‘সত্ত্বসমস’। বিদ্যাসাগরের মতে তৃতীয় বইখানি সাংখ্য দর্শনের ভাষ্য হিসেবে ‘are very poor treatises in their own departments’। অস্যার্থ, সাংখ্য দর্শনের পক্ষপাতীদের তুলনায় এই ভাষ্য যথাযথ নয়। হিন্দুরা যাকে প্রথম শ্রেণীর দর্শন ভাবে (command unbounded reverences), করে—ড. ব্যালান্টাইনের উক্ত তিনটি গ্রন্থ সেই তুলনায় যথাযথ নয় বলেই ভ্রান্ত পদ্ধতি (false system) ভাবা হয়েছে কিনা বিশেষ করে ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে। পাঠ্যপুস্তক রচয়িতা বিদ্যাসাগর ছাত্র পাঠ্য বইয়ের ভালো-মন্দ বুঝতেন।তিনি এসবের পঠনপাঠন বাদ দিতে চাননি। চিঠিতেই আছে :‘Of these the ‘Vedantasara’, text book on Vedanta, is already a class book here and it version in English might be read with advantage.’ Jogt বিদ্যাসাগরের চিঠি আসলে কোনো দর্শন বিষয়ে আপত্তি বা আসক্তি হিসেবে দেখা উচিত নয়। ড. ব্যালান্টাইনের বইগুলি যাতে সংস্কৃতে কলেজের ছাত্রদের পাঠ্য হিসেবে বিবেচিত হয়।
সে ব্যাপারে বইগুলির ভূমিকায় লেখা ছিল আর্চ বিশপ হোয়ার্টলি ‘strongly recommends’! সংস্কৃত কলেজের ছাত্ররা সংস্কৃত ভাষাতেই সর্বদর্শন পাঠ করতেন সন্দেহ নেই। সহায়ক পাঠ্যপুস্তক নির্বাচনে সাহেবদের চাপ সৃষ্টিকে অস্বীকার করার সাহস দেখিয়েছিলেন বিদ্যাসাগর। এখান থেকে একটি অংশ তুলে মিথ্যার চক্র ঘুরে চলেছে! একে বিজ্ঞানমনস্ক যুক্তিবাদ বলা চলে না।
বেদান্ত দর্শন সম্পর্কে বিদ্যাসাগরের আসক্তি ছিল না। তাকে তিনি মিথ্যা দর্শন বলে ঘোষণা করেননি। ২০ জানুয়ারি ১৮৫৮-তে দি এশিয়াটিক সোসাইটি থেকে ‘বিবলিও থেকা ইন্ডিকাসিরিজে ৬৩ ও ১৪২ সংখ্যক প্রকাশনী হিসেবে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর সম্পাদনা করেন। মাধবাচার্যের ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ। এই গ্রন্থের ভূমিকা (তখন বলা হতো ‘বিজ্ঞাপন) বিদ্যাসাগর লিখেছেন, ‘It contains short notices of all the systems of Indian Philosophy, and as such is very valuable. এখানে ভারতীয় দর্শনের কোনো অংশ সম্পর্কে তাঁর বিশেষ পক্ষপাতিত্ব নেই। বরং বেদ-শাস্ত্র সম্পর্কে আগ্রহীদের এই গ্রন্থ যে জরুরি সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ ছিল না। স্বাভাবিকভাবেই এই গ্রন্থে বেদ-বিরোধী চার্বাক দর্শনের কথা সবার শেষে আছে। তা থেকে কিছু বিচিত্রমনা পণ্ডিত বিদ্যাসাগরকে চার্বাকপন্থী সাজিয়েছেন ! জনৈক চার্বাক বিশেষজ্ঞ রামকৃষ্ণ ভট্টাচার্যের কথা বলেছেন এক প্রাবন্ধিক। তার ভাষা : ‘এই বইটির হাত ধরেই চার্বাক দর্শন চর্চানবজীবন লাভ করেছে। …আজ দেশবিদেশে যেখানেই চার্বাক চর্চা হয়, তার আধার কিন্তু বিদ্যাসাগর সম্পাদিত ওই ‘সর্বদর্শন সংগ্রহ। বিচিত্র যুক্তিই বটে। বিদ্যাসাগর সম্পাদনা করলেন বেদ – বিশেষজ্ঞদের কাছে সুপরিচিত (well known scholar of the vedas’-এর টীকাকার) মাধবাচার্যের গ্রন্থ। লিখলেন, এখানে আছে। ভারতীয় দর্শনের সব কটি প্রস্থানের ভাষ্য : ‘treatise of so much importance 67157 সেজন্য তিনি বেদ বিরোধী চার্বাক দর্শনের প্রবক্তা হয়ে গেলেন! পরে অবশ্য ওই প্রাবন্ধিক বুঝেছেন, বিদ্যাসাগর মশাই চার্বাক দর্শনে বিশ্বাসী ছিলেন— এর সপক্ষে কোনো স্বীকারোক্তি পাওয়া যায় না। রবীন্দ্রনাথ এধরনের প্রজ্ঞাকে ‘ধানের খেতে বেগুন খোঁজা বলে বিবেচনা করেছিলেন। অথচ সবাই মিলে দশচক্রে ভগবান ভূত হবার উপক্রম হয়েছে। বিদ্যাসাগরকে অধার্মিক, নাস্তিক বলে ধরে নিয়েছি আমরা। তাঁকে বড়োজোর অজ্ঞেয়বাদী বলতে পারি। তুবও বলবো, এনিয়ে শেষ কথা বলার সময় আসেনি।
১৮৬৬-তে ২৫ ভাদ্র (সম্ভবত আগস্টসেপ্টেম্বর), ১৯২৩ সংবৎ ‘বোধোদয়’-এর ঊনসত্তরতম সংস্করণ প্রকাশ পায়; তারপর ১৮৮২-তে প্রকাশিত ঊনআশিতম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ডিসেম্বর ২২ পৌষ ১৯৩৯ সংবৎ। মধ্যবর্তী ১৬ বছরে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর বহু পাঠক শুভানুধ্যায়ী ভদ্র লোকের পরামর্শ পেয়ে ‘বোধোদয়’-এর সংশোধন করেন। খুব সম্ভবত এইসব পরামর্শ মেনে নিয়েই বিদ্যাসাগর বোধোদয়ে সন্নিবেশ করলেন ‘ঈশ্বর’ সম্পর্কে বিশেষ অনুচ্ছেদ। সেখানে। আছে :
‘ঈশ্বর নিরাকার চৈতন্য স্বরূপ। তাহাকে কেহ দেখিতে পায় না; কিন্তু তিনি সর্বদা সর্বত্র বিদ্যমান আছেন। আমরা যাহা করি, তিনি তাহা দেখিতে পান; জানিতে পারেন। ঈশ্বর পরম দয়ালু; তিনি সমস্ত জীবের আহার দাতা ও রক্ষাকর্তা।১২
‘বোধোদয়ের প্রথম অনুচ্ছেদ‘পদার্থ। এ থেকে জড়বাদী মহান আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক মেধাবীদের আনন্দের সীমা নেই। তাদের ধারণা ঈশ্বর-অনুচ্ছেদটি পরে রাখার মাধ্যমে তারা মনোমতো বস্তুবাদী-বিদ্যাসাগর নির্মাণের চেষ্টা করছেন। অথচ‘বোধোদয়ে’র পরবর্তী অনুচ্ছেদ কি তাঁরা পড়ে দেখেছেন? ‘চেতন পদার্থ অনুচ্ছেদে যখন তিনি লিখেছেন :
‘পুত্তলিকার চক্ষু আছে, দেখিতে পায় না, মুখ আছে খাইতে পারে না,…ইহার কারণ এই। পুত্তলিকা জড় পদার্থ; উহার চেতনা নাই; ঈশ্বর কেবল প্রাণীদিগকে চেতনাদিয়াছেন। তিনি ভিন্ন আর কাহারও চেতনা দিবার ক্ষমতা নাই।১৩
অজ্ঞতা ভালো নয়। অজ্ঞের পাণ্ডিত্যাভিলাষ অত্যন্ত মন্দ।
পুত্রশচন্দ্র বিদ্যারত্নকে ৩১ শ্রাবণ ১২৭৭ বঙ্গাব্দে যে চিঠি লিখেছিলেন তা অতি বিখ্যাত। বিশেষত বস্তুবাদী পাঠশালায় বিদ্যাসাগর-নির্মাণে এই উদ্ধৃতি বেশ আকর্ষণীয় বটে। বিদ্যাসাগর লিখেছিলেন :
‘…আমি দেশাচারের নিতান্ত দাস নহি, নিজের বা সমাজের মঙ্গলের নিমিত্ত যাহা উচিত বা আবশ্যক হইবে, তাহা করিব, লোকের বা কুটুম্বের ভয়ে কদাচ সঙ্কুচিত হইব না।১৪
ব্যক্তিজীবনে দেশাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন বলেই বিদ্যাসাগর সমাজ সংস্কারে ব্রতী হয়েছিলেন, তাকে সর্বসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেবার সময় তিনি দেশের মানুষের যুক্তিকে পাশ্চাত্য যুক্তি বিধানের মাধ্যমে অস্বীকার করেননি। সংস্কৃত শাস্ত্র বিচারের মাধ্যমেই তার মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োগ করেছেন। যদি বলি, দেশাচারকে অবলম্বন করে দেশাচারকে আঘাত দিতে চেয়েছিলেন—নিশ্চয় ভুল হবে না।
শাস্ত্র স্মৃতি অবলম্বন করেই বাল্যবিবাহের দোষ’ নিবন্ধে তিনি জানিয়েছেন, ৮ বৎসরের বালিকাকে দান করাকে বলা হতো গৌরীদান; ৯ বৎসর বয়স্কা বালিকাকে দান করলে তা ছিল ‘পৃথ্বীদান’আর ১০ বৎসরের বালিকাকে পাত্রস্থ করলে দাতার পবিত্র লোকপ্রাপ্তি’ হতো। এর পর ‘বাল্যবিবাহের দোষ’– দর্শন করে তিনি সখেদে লিখেছেন, ‘হায়! জগদীশ্বর আমার দিনের দুরবস্থা হইতে কতদিনে উদ্ধার করিবেন।১৫ এই জগদীশ্বর কি কথার কথা, না। দেশাচারকে অবলম্বন করা? পাঠক বিবেচনা করবেন।
বিদ্যাসাগরের ব্যক্তিগত পত্র ব্যবহারে প্রায়ই ঈশ্বর, দেব-দেবীর শরণ, মঙ্গল কামনা রয়েছে। একটি সারণি রচনা করছি।
সূচনায় ‘শ্রীশ্রী হরিঃ শরণ’ আছে।
১. জননীকে লেখা ১২ অগ্রহায়ণ ১২৭৬ বঙ্গাব্দের পত্রে।
২. স্ত্রী দিনময়ী দেবীকে লেখা (একই দিনে লেখা পত্র)।
৩. পিতাকে লেখা ২৫ অগ্রহায়ণ ১২৭৬ বঙ্গাব্দের পত্র।
৪. পুত্রবধূ ভবসুন্দরী দেবীকে লেখা ১ চৈত্র ১২৮৫ বঙ্গাব্দের পত্র।
৫. পৌত্র প্যারিমোহনকে লেখা ২৭ পৌষ ১২৮৭ বঙ্গাব্দের পত্র।
৬. প্রসন্ন কুমার সর্বাধিকারীকে লেখা ১৫ মাঘ ১২৮৭ বঙ্গাব্দের পত্র ‘শ্রীশ্রী হরিশরণ’ আছে।
৭.পিতাকে লেখা একটি তারিখবিহীন পত্রে “শ্রীশ্রী হরি’আছে।
৮. পুত্র শম্ভুচন্দ্রকে লেখা ২১ মাঘ (বছর অনুল্লেখিত)
এর পত্রে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। ‘বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা এতদ্বিষয়ক প্রস্তাব’-এর চতুর্থবারের বিজ্ঞাপনে আছে বেশ কিছু সমর্থক ব্রাহ্মণ পণ্ডিতের কথা। সংখ্যায় তারা বেশি ছিলেন না, কিন্তু দেশের প্রচলিত আচারের বিরুদ্ধে তারা দাঁড়িয়ে মেধা ও বিদ্যা প্রয়োগ করেছিলেন। এদের মধ্যে কয়েকজনের নাম লিখছি :
১. শ্রীযুক্ত তারানাথ তর্কবাচস্পতি ভট্টাচার্য।১৬
২. শ্রীযুক্ত ভারতচন্দ্র শিরোমণি ভট্টাচার্য; তিনি ছিলেন সংস্কৃত বিদ্যালয়ের ধর্মশাস্ত্রের ‘ভূতপূর্ব অধ্যাপক। তিনি বিভিন্ন শাস্ত্র ঘেঁটে ৬টি প্রমাণ দিয়ে বিধবা বিবাহের সমর্থন করেছেন। বিদ্যাসাগর তার গ্রন্থে এগুলি সন্নিবেশ করেছেন।১৭
৩. শ্রীযুক্ত গিরিশচন্দ্র বিদ্যারত্ন ভট্টাচার্য ‘আদিপুরাণ’তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখিয়েছিলেন একটি শ্লোক সুনির্দিষ্ট ভাবে ‘পরাশরভাষ্যে’ আছে।১৮
৪. এছাড়া নানা ভাবে সাহায্য করেন— ছাত্র রামকমল ভট্টাচার্য ও শ্রীযুক্ত রামগতি ন্যায়রত্ন।১৯
ভারতীয় পুরাণ-শাস্ত্র-স্মৃতি অবলম্বন করে দেশাচারকে অবলম্বন করে দেশাচারের বিরুদ্ধতা করেছেন বিদ্যাসাগর। সুতরাং একটি পত্রের বাক্যাংশ অবলম্বনে যাঁরা বিদ্যাসাগরনির্মাণ করেন তাঁদের চেষ্টাকে অন্ধের হস্তীদর্শন। ছাড়া কী বলা যাবে?
দেশবাসী বিধবার বিবাহ দিতে চাইতেন না, শাস্ত্রসম্মত কিনা তা জানা ছিল না। এজন্যই বিদ্যাসাগর নানা শাস্ত্র অবগাহন করে দেখলেন সত্যযুগে মনু, ত্রেতাযুগে গৌতম, দ্বাপরে শঙ্ক। লিখিত ওই স্মৃতি গ্রাহ্য। কলিযুগে পরাশর সংহিতা গ্রহণ করতে হবে।২° অকাল বিধবা মহিলাদের জন্য তখনকার নিদান ছিল মাত্র দুটি। ১. ব্রহ্মচর্য, ২. সহগমন। রাজা রামমোহন রায়। সহগমন নিবারণের প্রয়াস করে সফল হন। বিদ্যাসাগর অন্য নিদানটিকে নানা ভাবে অস্বীকার করলেন। সতীদাহ প্রথা নিবারণের বিষয়টি এক হিসেবে আইন শৃঙ্খলার সমস্যা ছিল। জীবন্ত (অধিকাংশ অনিচ্ছুক) মহিলাদের শ্মশানে চিতায় তুলে দেওয়া দেশাচার ছিল না শুধু, ছিল অত্যন্ত ফৌজদারি অপরাধ। ব্রহ্মচর্যের নামে বিধবাদের তুষানলে পুড়িয়ে মারা হতো। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ কীর্তি অবশ্যই বিধবাবিবাহ প্রচলন। এই কাজে তিনি। ব্যক্তিগত ভাবে দেশাচার মানুন বা না মানুন— সামাজিক স্তরে দেশাচারকে অবলম্বন করে অস্বীকার করেছেন। এই নিষ্ঠা, পরিকল্পনা, চরিত্র বল আমাদের দেশে বিরল।
অনুসঙ্গ :
১. ‘অন্তঃ সার’; ২০১৪; সম্পাদক : রত্নাংশু বর্গী। সাউথ গড়িয়া; দক্ষিণ ২৪ পরগনা,
৭৪৩৬১৩।
২. কথাটি লিখলাম, কারণ ‘পশ্চিমবঙ্গ গণতান্ত্রিক লেখক শিল্পীসঙ্ঘ’, সোনারপুর থেকে ‘সংবীক্ষণ’ নামক সংকলনে (২৭তম) ২০১৯ আশীষবাবুর লেখাটি পুনর্মুদ্রণ করেছেন। উদ্দেশ্য পরিষ্কার, বিতর্কটি চলমান রাখা।
৩. ‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’ : অখণ্ড সংস্করণ, কামিনী প্রকাশনালয়; কলকাতা, দ্বিতীয় সংস্করণ, ১৪০৬ বঙ্গাব্দ (১৯৯৯ খ্রি.);
৫৫০ পৃ.।
৪. চিঠিখানি সম্পূর্ণ পড়লে উৎসাহী পাঠক আরও বহু তাজ্জব করার মতোখবর পেতে পারেন। উক্ত আর্চ বিশপ হোয়ার্টলি আর ড. ব্যালান্টাইন চেয়েছেন সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত বই পড়া হোক ইংরেজি ব্যাখ্যা সহ। আর এমনকী কোরান ইত্যাদিকে পড়াতেও চেয়েছেন তারা! এ নিয়ে অন্য কোনো প্রবন্ধে আলোচনা করা হবে।
৫. ‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’; উক্ত; ৪১১ পৃ.।
৬. প্রজ্ঞা পারমিতা : ‘বিদ্যাসাগর : প্রসঙ্গ দর্শন ও জীবন দর্শন’; ‘সংবীক্ষণ’; উক্ত; ৫৯
৭. ‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’; উক্ত।
৮. প্রজ্ঞা পারমিতা : উক্ত; ৬৩ পৃ.।
৯. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর : ভারতবর্ষ ও স্বদেশ’; ‘রবীন্দ্র রচনাবলী’, জন্ম শতবার্ষিকী সংস্করণ; পশ্চিমবঙ্গ সরকার, ১৯৬১;
১০২৭ পৃ.।
১০.‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’, উক্ত; ১১৫৩ পৃ.।
১১. এঁদের মধ্যে ছিলেন তখনকার ত্রিপুরা জেলার ‘রুপসা গ্রামের রিডিং ক্লাব’-এর ‘কার্যদর্শী শ্ৰীযুক্ত মহম্মদ রেয়াজউদ্দিন মহাশয় এবং কলকাতার শ্রীযুক্তবাবু চন্দ্রমোহন ঘোষ ডাক্তার মহাশয়। তদেব। ১২. তদেব; ১১৫৪ পৃ.। ১৩. তবে ।
১৪. ইন্দ্র মিত্র : ‘করুণাসাগর বিদ্যাসাগর’ : আনন্দ পাবলিশার্স প্রা. লি.; কলকাতা, ১৯৯৭:৩০০ পৃ.। ১৫. ‘বিদ্যাসাগর রচনাবলী’; উক্ত; ৫৫৫ পৃ.। ১৬.তদেব; পরে বিদ্যাসাগর উল্লেখ করেছেন
তারানাথতৰ্কৰ্বাচস্পতি ভট্টাচার্য তাকে ৭টি প্রমাণ সংগ্রহ করে দিয়েছেন। তদেব; ৫৬২ প.।
১৭. তদেব; ৫৬১-৫৬২ পৃ.।
১৮. তদেব; ৫৬২-৫৬৩ পৃ.।
১৯. তদেব; ৫৬৩ পৃ.। ছাত্র রামগতি ন্যায়রত্ন মারা যান অকালে। স্নেহাতিরেকে এই প্রসঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় কয়েকটি বাক্য লিখেছেন। এখানে অপ্রয়োজন বলে উদ্ধৃত করছি না।
২০. শ্লোকটি ছিল : কৃতে তু মানবা ধর্মস্রেতায়াং গৌতমাঃ স্মৃতয়ঃ। দ্বাপরে শঙ্কলিখিতঃ কলৌ পরাশরাঃ স্মৃতাঃ। —“বিদ্যাসাগর রচনাবলী’; উক্ত; ৫৭০ পৃ.।
ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.