বাংলাদেশে একাত্তরে হিন্দু রাজাকার ছিল এটি বিকৃত ও মিথ্যা তথ্য। একটি সরকার যখন একটি ধর্মীয় গোষ্ঠীকে টার্গেট করে হত্যা করতে উদ্যত হয়, তখন ওই গোষ্ঠীর কারো পক্ষে সম্ভব নয় সেই খুনি সরকারের সঙ্গে হাত মেলানো। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনার টার্গেট ছিল হিন্দুরা। তদানীন্তন পূর্ব-পাকিস্তানকে হিন্দু-শূন্য করার জন্যেই তারা গণহত্যায় নেমেছিল। প্রথম দিন ২৫ মার্চ থেকে বিজয় দিবস ১৬ ডিসেম্বর তারা সাফল্যের সঙ্গে সেই কাজটি সুচারুভাবে করেছে। ‘লুঙ্গি খুলে যাদের ধর্ম পরীক্ষা দিতে হয়েছে, তাদের পক্ষে কী রাজাকার হওয়া সম্ভব ছিল? সিনেটর টেড কেনেডির রিপোর্ট অনুযায়ী ক্ষতিগ্রস্তদের ৮০ শতাংশ ছিল হিন্দু। নিউইয়র্ক টাইমসের রিপোর্ট অনুযায়ী হিন্দু বাড়ি ‘এইচ লিখে চিহ্নিত করা হতো। এই অবস্থায় হিন্দুদের পক্ষে পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ‘রাজাকার’ হওয়া সম্ভব ছিল না। সব সম্ভবের দেশ বাংলাদেশে তাই স্বাধীনতার প্রায় অর্ধ-শতাব্দী পর হিন্দু রাজাকার সৃষ্টি করা হয়েছে। রাজাকার মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গেছে। মুক্তিযোদ্ধা রাজাকার হয়ে গেছে। সেদিক থেকে হিন্দুদের রাজাকার বানানো তেমন কঠিন কিছু নয়। বাংলাদেশে সম্প্রীতির দৃষ্টান্ত উজ্জ্বল করতে ‘সাম্প্রদায়িক রাজাকারদের তালিকায়’কিছু হিন্দু নাম ঢুকিয়ে সেটি অসাম্প্রদায়িক করা হয়েছে। মাত্র। সংক্ষেপে এটিকে ‘রাজাকারের অসম্প্রদায়ীকরণ’বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হলো, হিন্দুদের রাজাকার তালিকাভুক্ত করার সাহস তারা পেল কীভাবে? পুরো রাজাকার তালিকা দেখিনি, তবে তালিকায় নাকি জামাত ৩৮ জন, হিন্দু ৯২ জন। পরিসংখ্যান বলছে, হিন্দুরা পাকিস্তানকে বড্ড ভালোবাসতো। বঙ্গবন্ধু। আমলে যাঁরা ‘শত্রু সম্পত্তি আইনকে ‘অর্পিত সম্পত্তি’ করেছিল, তাদেরই উত্তরসূরীরা শেখ হাসিনার আমলে হিন্দুদের ‘রাজাকার’ বানিয়েছে। মন্ত্রী অনেক আবোল-তাবোল বলেছেন। তাতে কিন্তু নাম ঢোকানো বা বাদ দেওয়ার সমস্যা হবার কথা নয়। তাই বরিশালের মুক্তিযোদ্ধা তপন চক্রবর্তী রাজাকারের তালিকায় ঢুকে পড়েছেন, অথবা দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকারদের নাম বাদ পড়ে গেছে এবং হিন্দুদের নাম ঢুকে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কতটা অদক্ষ ও অযোগ্য এই তথ্য তা প্রমাণে যথেষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের পর শেখ ফজলুল হক মনি বলেছিলেন, ‘মোনায়েম খানের প্রশাসন দিয়ে বঙ্গবন্ধুর সরকার চলতে পারে না।’ ‘মুখে শেখ ফরিদ, বগলে ইট’ প্রশাসন দিয়ে শেখ হাসিনার সরকার।
ক্যামনে চলছে কে জানে? রাজাকার তালিকা স্থগিত হয়েছে। এনিয়ে মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় এবং স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মধ্যেকার বিতণ্ডা থেমেছে। শাহরিয়ার কবীর বলেছেন, তারা ত্রিশ হাজার গেজেটেড রাজাকারের নাম প্রকাশ করবেন। রাশেদ খান মেনন বলেছেন, মুক্তিযোদ্ধা তালিকা প্রণয়নে যে কেলেঙ্কারি হয়েছে, রাজাকার তালিকা দণ্ডপ্রাপ্ত রাজাকারদে নাম নেই, এর সুদূরপ্রসারী একটি তাৎপর্য আছে। মন্ত্রী যতই বলুন না কেন, এর পেছনে চক্রান্ত আছে! এই তালিকা নিয়ে ভবিষ্যতে অনেকে ‘সাধু’ হয়ে যাবেন, অনেকের সম্মান ভুলুষ্ঠিত হবে!মন্ত্রী হয়তো তখন থাকবেন না, কিন্তু তার অপকর্মটি থেকে যাবে।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী সম্পর্কে আমার তেমন কিছু বলার নেই। কদিন আগে তিনি একজন হিন্দুকে মুসলমান বানানোর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন এবং ‘আলহামদুলিল্লাহ বলে ‘শোকরানা আদায় করেছেন। রাজাকার তালিকায় খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ আছে কিনা জানতে পারিনি। সময়ের সঙ্গে দেশ একদিন মুক্তিযোদ্ধা শূন্য হবে, কিন্তু কখনো রাজাকার শূন্য হবে না। তবে এটি স্পষ্ট, হিন্দুদের রাজাকার তালিকাভুক্তি একটি নতুন ষড়যন্ত্র, চরিত্র হননের খেলা। গ্যারি ব্যাস তার ‘টি ব্লাড টেলিগ্রাম : নিক্সন, কিসিঞ্জার অ্যান্ড এ ফরগটেন জেনোসাইড’ গ্রন্থে লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই প্রায় এক লক্ষ হিন্দু নিহত হয়। পঁচিশে মার্চ ১৯৭১ রাতে রাজারবাগ পুলিশ ফাঁড়ির সঙ্গে সঙ্গে হিন্দু অধ্যুষিত শাঁখারি বাজার, জগন্নাথ হল আক্রান্ত হয়েছিল, তারপররমনা কালীবাড়ি, এটাইটার্গেট কিলিং। আওয়ামি লিগ নেতাকর্মীরাও টার্গেট ছিলেন, সেটা ধর্মীয় কারণে নয়, রাজনৈতিক কারণে।
প্রকাশিত রাজাকার তালিকায় রাজাকারের সংখ্যাটি দশ হাজারের বেশি, এর মধ্যে আওয়ামি লিগ ৮০৬০, বিএনপি ২০২৪ অন্যান্য ৮৭৯ জন। এখানেও গোজামিল আছে। একাত্তরে পুরো দেশে ছিল আওয়ামি লিগ এবং কিছু পাকিস্তানপন্থী মুসলিম লিগ বা অন্যান্য ইসলামি দল। তখন আওয়ামি লিগাররা রাজাকার হয়নি, মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। তবে দেশের ভিতরে থেকে যাওয়া অনেকে বহুবিধ কারণে তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। স্বাভাবিক ভাবে ‘রাজাকার’ বলতে আমরা যা বুঝি, আওয়ামি লিগ কর্মীরা তখন তা হয়নি। বিএনপি-র তখন জন্মই হয়নি, বিএনপি এলো কোত্থেকে? রাজাকাররা মুখ্যত পাকিস্তানপন্থী। এখন হিন্দুদের রাজাকার বানানোর উদ্দেশ্য একটাই, তা হলো বাংলাদেশ একেবারে হিন্দুশূন্য করে দেওয়া।
শিতাংশু গুহ
2020-01-15