এবারেও অবলম্বন সেই রবীন্দ্রনাথ। তুমি বিনে চলে না হে কবি। যে প্রশ্ন তুমি তুলেছিলে বিশ্বকবি আজও যে সেই প্রশ্নটাই এই ঘুণধরা গণতান্ত্রিক কাঠামোতে মাথাকুটে মরছে— “নারীকে আপন ভাগ্য জয় করিবারে কেন নাহি দিবে অধিকার হে বিধাতা?”
কথায় কথায় গণতন্ত্র আর সেকুলারিজমের ধ্বজাধারীরা এখন কোথায়? চমকে উঠলাম খোলা বাক্সটার দিকে তাকিয়ে অর্ধদগ্ধ এক নারীদেহ কামনার শিকার কিছু মত্ত মানুষের। তেলেঙ্গনার সামসানদের টোলপ্লাজার আন্ডারপাসের নীচে। ২৬ বছরের পশুচিকিৎসক তরুণী প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি কল্পরু গ্রামের এক পশুচিকিৎসালয়ের চিকিৎসক তিনি। মত্ত চার ট্রাককর্মী মহম্মদ তারিফ (২৬), জম্মুদিন (২০), জল্পনবীন (২০) এবং চিনুকম্ভ (২০)-র লালসার শিকার। এ যেন বিখ্যাত টিভি সিরিয়াল ‘ক্রাইম পেট্রল’-এ সাজানো এক গল্প। কিন্তু এ গল্পের স্ক্রিপ্ট রাইটার কে? গণতন্ত্র না সেকুলারিজম? সামসাবাদ থেকে হায়দারবাদ ৫০ কিলোমিটার নিখুঁত স্ক্রিপ্ট। পশুচিকিৎসক মেয়েটির স্কুটারের চাকা ফুটো করে দিয়ে সেই গাড়ি সারিয়ে দেওয়ার মিথ্যা নাটক করে এদেরই একজন ঘুরে এল গাড়ি নিয়ে। এসে বললো মিস্ত্রী পাওয়া গেল না। ঘড়িতে রাত ৯টা। অযাচিত এত লোক দেখে ভালো লাগেনি প্রিয়াঙ্কার। বোনকে ফোন করে জানায় সেকথা। বোন পরামর্শ দেয় স্কুটার রেখে ট্যাক্সি নিয়ে বাড়ি চলে আসতে। তাই হয়তো করতে চেয়েছিল মেয়েটি। কিন্তু সুযোগ পেল না। ঘড়িতে ৯.৪৫। মেয়েটির ফোন সুইচ অ তখন থেকেই। আর তার পরদিন শামসাবাদের আউটার রিংরোডের আন্ডারপাসের নীচে চারজন মত্ত যুবক গণধর্ষণ করে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে ডাঃ রেড্ডিকে। তারপর এদিক ওদিক খুঁজে পেট্রল যা পাওয়া গেল তা ঢেলে পুড়িয়ে দিল তরুণীকে। স্কুটারের নেমপ্লেট খুলে ফেলে দেওয়া হল অন্য জায়গায়। লালসা এবং খুন একইসঙ্গে দুই ক্রাইম মানবতার চরমলজ্জা।
নারকীয় এই ঘটনামনে করিয়ে দিল দিল্লির নির্ভয়া কাণ্ডকে। মনে পড়ে যায় কলকাতার পার্কস্ট্রিটের সুজানের গণধর্ষণের ঘটনাকে। মেয়েটির পরিবার সূত্রে জানা যাচ্ছে মেয়ে না । ফেরায় রাত ১০টাতে উদভ্রান্ত বাবা মেয়েটির খোঁজে ডায়েরি করতে বিভিন্ন থানায় ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু কোনো থানা ডায়েরি নেয়নি। শেষে যখন ডায়েরি নিল তার মাঝে প্রায় ৫ থেকে ৬ ঘন্টা সময় অতিবাহিত। মহম্মদ মাহমুদ আলি তেলেঙ্গনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য নিগৃহীতা মহিলা শিক্ষিতা হয়েও ১০০ নম্বরে ডায়েল না। করে বোনকে ফোন করলো কেন? এরই মধ্যে তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রীকে ক্যাবিনেটের মন্ত্রী সদস্যদের নিয়ে টি আর এস বিধায়ক রেখা নায়েকের মেয়ের বিয়ের হাইপ্রোফাইল অনুষ্ঠানে যোগ দিতে দেখা গেল। এতবড় জঘন্য ঘটনা, সারাদেশ উত্তাল, কোনো বক্তব্য এল না তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে। বর্ষীয়ান সমাজবাদী নেত্রীর নিদান সংসদ ভবনে দোষীদের জনগণের হাতে তুলে দেওয়া হোক, পিটিয়ে মারা হোক। আর এক পরিহাস! আইন নিজের হাতে তুলে নিতে সংসদ ভবনে বসে জনপ্রতিনিধি কী করে এমন দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেন ? প্রশ্ন অনেক। দিল্লির নির্ভয়া থেকে প্রিয়াঙ্কা রেড্ডি অজস্র গণধর্ষণের খবর, প্রশাসন কী করছে? টোলপ্লাজার মতো জায়গায় কোনো পুলিশ নেই কেন তেলেঙ্গনায়? ১০০ নম্বরে ডায়াল করলেই কি পুলিশ এসে যেত? খোদ কলকাতায় কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি এক গায়িকা রাতের বেলায় ফেরার সময় শিকার হয়েছিলেন কিছু গুন্ডা বদমায়েশের।তিনি ছুটে গিয়েছিলেন থানায়। থানা কি তখন তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেছিল? এ থানা বলছে আমার এরিয়ায় এটা হয়নি, যেখানে ঘটনা ঘটেছে আপনি সেই এরিয়ার থানায় যান। পুলিশ প্রশাসন রাতের বেলায় একটি মেয়েকে আগে নিরাপত্তা দেবে না থানার এক্তিয়ার দেখবে? কোনটা? কালীঘাটের মতো জায়গা যেখানে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী থাকেন হাই প্রোফাইল জায়গা সেখানে দুই নাবালিকা ধর্ষিতা হয় কী করে? সেখানে প্রশাসন কোথায় ? তেলেঙ্গনার মুখ্যমন্ত্রী, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী কেউ কি দুঃখপ্রকাশ করেছেন? পার্কস্ট্রিটের ঘটনায় আমরা দেখেছিলাম দায়িত্বপ্রাপ্ত মহিলা পুলিশ অফিসার তদন্তের মূলে পৌঁছে গিয়েছিলেন। কিন্তু তারপর?সাতবছর এমন একডিপার্টমেন্টে রাখা হলো দময়ন্তী সেনকে তিনি হয়ে গেলেন নিষ্ক্রিয়। কেন? অথচ তাপসী মালিক কিন্তু ক্ষমতায় আসার হাতিয়ার। তাহলে কি আমরা এটাই ধরে নিতে পারি না যে, মেয়েদের নিরাপত্তা নিয়েও চলছে রাজনীতি? কোনো ধর্ষণকাণ্ড যদি আমাকে রাজনীতির সিড়ি বেয়ে উপরে ওঠার রাস্তা করে দেয় তবেই সেই ধর্ষণ নিয়ে প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। তাই আসামিকে নিয়ে মন্তব্য করলেও প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির ক্ষেত্রে। আমরা সামান্য দুঃখপ্রকাশও করবো না? এ কেমন ধারা বিচার ? লোকসভার স্পিকার থেকে শুরু করে আমাদের বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিংহ কঠোর থেকে কঠোরতম নিন্দা করেন শুধু তাই নয়, কঠিন আইন এনে কঠোর হাতে এ ধরনের ঘটনা বন্ধ করার কথা বলেন।
একজন নারী হিসেবে আমি গর্বিত তাদের জন্য। হবেও এবার সেরকমই কিছু। তেলেঙ্গনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বোঝা উচিত বিপদে পড়লে বাড়ির লোেককেই আগে মনে পড়ে মানুষের। আর মেয়েটির জীবনসংশয় হতে চলেছে তা কি সেই মুহূর্তে বোঝা সম্ভব ছিল ? কারুর পক্ষেই কি বোঝা সম্ভব? কাজেই নিজের প্রশাসনিক ত্রুটির কথা স্বীকার করে নেওয়াটাই ভালো নয় কি? প্রধানমন্ত্রীর কাছে সমস্ত মহিলা সমাজের হয়ে আমার আবেদন তিন তালাক বিল এনে এবং তা কার্যকরী করে আপনি মুসলমান নিপীড়িত নারীদের লজ্জামুক্ত করেছেন। এবার আপামর সমস্ত ভারতীয় নারী আপনার শরণাপন্ন, আপনি কিছু করুন। আমরা জানি আপনিই পারেন একমাত্র ভোটবাক্সের কথা না ভেবে কিছু করতে।
পূর্বা চৌধুরী
2020-01-14