২০১৯ শেষ হওয়ার প্রাক্কালে বরাবরের মতোই বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেলগুলিতে দেশের বিগত বছরের নানান সাফল্য-ব্যর্থতা তুলে ধরা হচ্ছে। বছরের একেবারে শেষ লগ্নে বক্সার মেরি কমের অলিম্পিক লড়াইয়ের যোগ্যতা অর্জন এমনই একটি বড়ো সাফল্য। বছরের সালতামামি করতে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সব ক্ষেত্রেরই নমুনা উঠে আসছে। এই সূত্রে যে বিষয়টি পরিধির বাইরে থেকে যাচ্ছে তা হলো আন্তর্জাতিক কূটনীতি ক্ষেত্র। বছরের শুরুতে সীমানা পার করে বালাকোটে জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করা সকলে দেখেছেন। কিন্তু এটি যে পররাষ্ট্র আক্রমণ নয় কেবলমাত্র দেশের নিরাপত্তা রক্ষার্থেই সংঘঠিত হয়েছিল তা রাষ্ট্রসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রবল শক্তিধর মার্কিন ও ইউরোপীয় গোষ্ঠীর মাতব্বরদের বোঝানো ছোটো বিষয় নয়। একই সঙ্গে চিরশত্রু দেশ চীন ও পাকিস্তানের চূড়ান্ত বিরোধী প্রচারের বিরুদ্ধে ভারতের কূটনীতিবিদরা এ বিষয়ে নিরাপত্তা পরিষদকে মাথা ঘামানো থেকে বিরত রাখতে সফল হন।
১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামায় জঙ্গিদের আরডিএক্স বোঝাই ট্রাকের আক্রমণে ৪০ জন সিআরপিএফ জওয়ানের মৃত্যু হওয়ার পর, ভারত থেমে থাকেনি। ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৯-এ ঐতিহাসিক বালাকোট বোমা বর্ষণ হয়। আশ্চর্যের বিষয় এর দুদিন আগে ২৪/২-এ মার্কিন রাষ্ট্রপতি ভবিষ্যদ্বাণী করার মতো টুইট করেন, “India is looking at something very strong. And I mean India has lost almost 50 people by an attack. So I could understand the situation also (TOI 24.2.2019) যেন তিনি সম্ভাব্য প্রত্যাঘাত সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। তাই হয়তো এই প্রচ্ছন্ন সমর্থন।
এরই কিছু আগে কুখ্যাত লস্কর -এ-তৈবা প্রধান হাফিজ মহম্মদ সইদের নাম UNSC-র ১২৬৭ জনের কালো তালিকা থেকে বাদ দিতে পাকিস্তান Counter Terrorism কমিটির কাছে প্রবল তদ্বির করেও ব্যর্থ হয়। অবশ্য তার বাজেয়াপ্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। কাজটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা পুলওয়ামা বিস্ফোরণের পর নিরাপত্তা পরিষদের সাত দিন লেগেছিল ঘটনার নিন্দা করতে। আর এই প্রথম জম্মু কাশ্মীরে কোনো সন্ত্রাসী হামলায় নিরাপত্তা পরিষদ সরাসরি নিন্দা করেছিল।
অনেকেরই মনে পড়বে মে মাস নাগাদ পাক-ভারত সীমান্তে সেনা মোতায়েন করা বাড়তে থাকে। দু’ দেশের মধ্যে সংঘর্ষের আবহ ঘনিয়ে আসছিল। এই সময় পাকিস্তানের ওপর চাপ বাড়াতে আর এক ভয়ঙ্কর জঙ্গি পাকিস্তানবাসী ‘জইশ-ইমহম্মদ’ নেতা মাসুদ আজহারকে নিরাপত্তা পরিষদ বিশ্ব সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করে। অতীতে চারবার এ চেষ্টা হলেও চীনের ভেটো প্রয়োগে তা আটকে গেছে। কিন্তু এবার পেরে উঠল না। এর পেছনে রয়েছে। ইউ এনএসসি-তে ভারতের ক্ষুরধার মস্তিষ্কের কূটনীতিক সঈদ আকবরুদ্দিনের সফল দৌত্য। এই সাফল্যের পর তিনি লিখেছিলেন “Big small all join together- Masood Azhar designated as a terrorist in UN sanctions list. Grateful to all for their support.” কূটনৈতিক সফলতা দেশের অন্যান্য ক্ষেত্রের ওপরও বড়ো প্রভাব ফেলে। যেমন কূটনৈতিকভাবে যত বেশি দেশের সঙ্গে।
দৌত্য সফল হয় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও চাপ কমে যায়। বিরোধ কেটে যাওয়ার ফলে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সুদৃঢ় হয়। পক্ষান্তরে অর্থনীতির বুনিয়াদ ও বৃদ্ধির গতি বাড়ে। কূটনৈতিক সাফল্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের চোখে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধিরও সহায়ক। দেশের এই সম্মান বৃদ্ধি সামাজিক ভাবে নাগরিকদের মধ্যেও সঞ্চারিত হয়। এর প্রভাব গণতান্ত্রিক দেশের নির্বাচনী প্রক্রিয়াতেও পরিলক্ষিত হওয়ার সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়। এর প্রমাণ পাওয়া গেছে।
৭০ বছর ধরে আটকে থাকা চরম বৈষম্যমূলক ৩৭০ ধারা তুলে দেওয়ার সময়ও দেশকে এক চরম পরীক্ষার মুখে পড়তে হয়েছিল। পাকিস্তান চীনকে দোসর করে কাশ্মীরের এই ঢেলে সাজা ও নির্দিষ্ট স্বার্থান্বেষীদের সুবিধাভোগকে জারি রাখার প্রসঙ্গ এড়িয়ে এটিকে ভারতের পাকিস্তানের সঙ্গে প্রচ্ছন্ন যুদ্ধ হুঙ্কার ও পাক অধিকৃত কাশ্মীর পুনর্দখলের যুদ্ধ পরিকল্পনা বলে চালাবার প্রচেষ্টায় রাষ্ট্রসঙ্ঘে দাপাদাপি করতে থাকে। এই প্রথম কাশ্মীরের দ্বিপাক্ষিক বিষয় ‘বদ্ধ কক্ষে আলোচিত হয়। কিন্তু এই কূটনৈতিক দৌত্য সফল করতে আমেরিকা প্রভাব খাটিয়ে স্থায়ী সদস্য রাশিয়া ও ফ্রান্সকে পাশে নিয়ে ঘরের আলোচনা ঘরেই পচিয়ে দেয়। প্রকাশ্য ঘোষণা হয় বিষয়টি ভারতের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার।
পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বারবার চিঠি পাঠিয়েছে। নাছোড়বান্দা চীন বন্ধুকে রক্ষা করতে তাদের Xinxiang প্রদেশে উইঘুর মুসলমানদের ওপর লাগাতার নিপীড়ন চালিয়ে ধারাবাহিক ধর্মান্তর, প্রার্থনা পরিবর্তন ও কয়েক মিলিয়ন জনগোষ্ঠীকে ধর্মহীন করে তোলার যে চক্রান্ত চালিয়ে যাচ্ছে তা ভুলে গিয়ে ভারতে কাশ্মীরিদের বন্ধক করে রাখার অভিযোগ ডিসেম্বরেই আবার তুলেছে। UNSC-র। বর্তমান মার্কিন সভাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প তা পত্রপাট নাকচ করে দিয়েছেন।
আকবরুদ্দিন ও তার সঙ্গীরা এক্ষেত্রেও দীর্ঘ মত বিনিময়ের মাধ্যমেই এই সাফল্য নিয়ে এসেছেন। লক্ষ্য করবার বিষয় ভারত তার এমন মহাগুরত্বপূর্ণ পদ কত নিশ্চিন্তে একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিকে অর্পণ করেছে যেখানে মূল প্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান একই ধর্মীয় সম্প্রদায় প্রধান দেশ। এটিই ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রকৃত স্বরূপ। এরই ফলিত রূপ হিসেবে পাকিস্তানে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত কূলভূষণ যাদবকে আন্তর্জাতিক আদালতে হরিশ সালভে জিতিয়ে এনেছেন। তবে, একথা অনস্বীকার্য। কূটনীতির সঙ্গে অর্থনীতির পারম্পরিক সম্পর্কের নিবিড়তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারত। একটি অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ১০টি এশীয় দেশের Regional Comprehensive Economic Partnership (2167 ভারত সরে এসেছে (স্বস্তিকায় এ বিষয়ে লেখা হয়েছে), যাতে সস্তার চীনা মাল ভারতের উৎপাদন ব্যবস্থাকে অলাভজনক না করে দেয়। দীর্ঘদিনের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশারদ কূটনীতিক এস জয়শঙ্করকে প্রধানমন্ত্রী বিদেশ দপ্তরে এনেছেন। জয়শঙ্কর উল্লেখিত RCEP-এর বাইরে Free Trade Agreement-এর দেশগুলির সঙ্গে রপ্তানির জটিল কূটনৈতিক আলোচনা চালাচ্ছেন। যাতে রপ্তানি না মার খায়। তিনি বলেছেন, “the economy drives diplomacy” –এই সূত্রে তিনি ইতিমধ্যে অস্ট্রেলিয়া ইন্দোনেশিয়া ও ফ্রান্সের সঙ্গে ইতিবাচক দৌত্যে লিপ্ত। সামরিক অভিযান, রাজনৈতিক তর্জা, ধর্মীয় বিবাদ সামনে। আসে। কিন্তু এবিষয়ে নির্ণায়ক ক্ষমতার অধিকারী কূটনীতি থাকে নেপথ্যে। তার সাফল্য ব্যর্থতা আমাদের মাতৃভাষার সংবাদমাধ্যম বা চ্যানেলগুলিতে খুব কমই জায়গা পায়। বুদ্ধির কারবারি আমাদের বুদ্ধিজীবীরা এই সব ইতিবাচক খবর নিয়ে মাথা ঘামান না। উল্টে কাক- সংগীতের কাঁসরের তালে তাল মিলিয়ে আখের গোছাতে নিশ্চিন্তে কালাতিপাত করেন।
সুব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়
2020-01-14