বড়দেরকে সকলেই বড় চোখে দেখেন। কিন্তু ছোটেদেরও বড় চোখে দেখার মানুষ কম হয়। সেই দুর্লভ শ্রেণির মানুষ ছিলেন অসীম মিত্র।
চিরটাকাল তাঁর কাছে ছাত্র হিসেবেই থেকেছি। কিন্তু আমার ছাত্র জীবনে এমন শিক্ষক আর কাউকে পাইনি যিনি আমার মধ্যে এত গুণ দেখেছেন। শুধু আমি নয়, সকলের মধ্যে গুণ দেখার ‘অসীম ভালোবাসা’ ছিল অসীমদার সম্পদ। কখনও কারও নিন্দা ছিল না তাঁর গলায়। শাসন ছিল কিন্তু সেটায় রাগ ছিল কখনও।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন সাংবাদিকতা বিভাগে পড়িয়েছেন। সেই পড়ানোটাও ছিল ভালোবাসায় ভরা। খুব বেশি বিষয়কেন্দ্রিক না থেকে গল্পে গল্পে সাংবাদিকতার প্রতি ভালোবাসা তৈরি করাই যেন তাঁর লক্ষ্য। আর গল্পেরও কোনও শেষ নেই। আসলে অনেক কাজের অভিজ্ঞাতাই তাঁর গল্পের ভাণ্ডার ভরে দিয়েছিল। শিবরাম চক্রবর্তীর স্নেহভাজন অসীম মিত্রও ছিলেন রসিক চূড়ামণি। কখনও কখনও ছাত্র-শিক্ষক দূরত্ব অতিক্রম করতেও দ্বিধা করতেন না।
আজকাল পত্রিকায় তাঁর একটা কলাম ছিল ‘ক্রেতা সাধারণ’ নামে। সেই কলামে ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ক লেখা লিখতেন। সেই সুবাদে সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে তাঁর জানা শোনাও ছিল অনেক। ক্রেতা সুরক্ষা বিষয়ক আইন সম্পর্কেও ছিল জ্ঞান। আর সেই জ্ঞান ও যোগাযোগ শুধু লেখার কাজে না লাগিয়ে অনেককে পরামর্শ দিয়েছেন নানা সময়ে। কী ভাবে কোনও ক্রেতা সুবিচার পেতে পারেন সে ব্যাপারেও তাঁর উদ্যোগ ছিল সমান।
সংগঠন, সাংবাদিকতা এই দুই-ই ছিল তাঁর ধ্যানজ্ঞান। আর এই দু’টি কাজের মধ্যে প্রয়োজনীয় ফারাক রেখেই চলেছেন বরাবার। একের সঙ্গে আর এককে মিলতে দেননি। আবার একের পরিপূরক করে তুলেছেন অপরটিকে। সংগঠনের কাজে যেমন একজন সাংবাদিকের সমস্ত গুণাবলী প্রয়োগ করতেন তেমনই সাংবাদিকতার ক্ষেত্রেও অসীম দার ভূমকি ছিল একজন সংগঠকের মতো। তাঁর সঙ্গে কাজ করা সকলেরই জানা সেই সব।
বয়স হয়েছিল। নানা অসুস্থতাও ছিল। কিন্তু তাতেও দমে থাকেননি কখনও। কাজের বাইরে থাকেননি কখনও। একেবারে শেষের কটা দিন বাদ দিলে নানা কাজেই নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন সদা হাস্যময় মানুষটা।
একটু নিজের কথা বলি। আমার জীবনের যেটুকু পাওয়া তার সবটার সঙ্গেই কোনও না কোনও ভাবে জড়িয়ে তিনি। জড়িয়ে তাঁর আশীর্বাদ, ভালোবাসা। আবার সবরকমের কষ্টের দিনেও তাঁকে পাশে পেয়েছি পরামর্শে, সাহায্যে। সেই কবে দ্বিতীয় বর্ষ সঙ্ঘ শিক্ষাবর্গে তাঁর গল্পে গল্পে ভরা বৌদ্ধিক আজও মনে আছে। আজও মনে আছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাসে মজার মজার উদাহরণে ভরা তাঁর লেকচার। আরও অনেক জায়গায় অনেক বক্তৃতা। বিষয় বৈচিত্রে যা বিস্ময় তৈরি করে। সু-বক্তা অসীম দার অবাধ বিচরণ ছিল ধর্ম, সাহিত্য, সংস্কৃতি, রাজনীতি সব ক্ষেত্রে। জানার খিদেও ছিল খুব। ছোটেদের কাছেও কুণ্ঠাহীন গলায় প্রকাশ করতেন কৌতূহল। সোজাসুজি বলতেন, “আমার জানা নেই, তুমি একটু বুঝিয়ে দাও।”
স্বস্তিক পত্রিকায় একটা বড় সময় ধরে ‘অগ্নিশর্মা’ নামে কলাম লিখতেন। সেই লেখা পড়েই প্রথম পরিচয় অসীম মিত্রের সঙ্গে। ক্ষুরধার কলাম পড়ে মনে হতে ব্যক্তিটি নিশ্চিত রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে থাকেন। সেই ভুল ভেঙেছিল প্রথম আলাপে। ভেঙেই রইল।
পিনাকপাণি ঘোষ