প্রায় ৪ বছর আগে শ্রী সুমন্ত ভট্টাচার্য একটি লেখা লেখেন লক্ষ্মী অগ্রবালকে নিয়ে। তার সাথে একটা ছবিও ছিল, যার নীচে লক্ষ্মীর প্রেমিক অলোক দীক্ষিতের মহত্ত্বের বেশ গদগদ বর্ণনা ছিল। তখন অলোক বাবু আমার ফেসবুকের বন্ধু তালিকাতেই ছিলেন। আমি ওনাকে সেই পোস্টে ট্যাগ করায় উনি আমাকে মেসেজ করে জানান যে- “পাণ্ডে বাবু, আমাকে এসব সংঘী-দের পোস্টে ট্যাগ করবেন না”!

ঠিক তার পরের দিনই প্রেস ক্লাবে সুমন্ত বাবুর সাথে আমার দেখা হয়। শ্রীবাস্তব নামের কেউ একজন সেদিন ওর সাথেই ছিলেন। ভদ্রলোক বেশ সংবেদনশীল মানুষ। কথায় কথায় সুমন্ত বাবুর আগের দিনের পোস্টের ব্যাপারটা উঠল। হঠাৎ করেই শ্রীবাস্তব বাবু বললেন- “এই অলোককে আমার খুব ভাল ভাবে চেনা আছে। ভীষণ অসৎ চরিত্রের বামপন্থী ছেলে। আপনি দেখবেন, অলোক কোনদিনই লক্ষ্মীকে বিয়ে করবে না। ক বছর পরেই ছেড়ে দিয়ে পালাবে। যেই না মেয়েটা একটু বিখ্যাত হয়েছে, অমনি লাভের গুড় খাবার ধান্দায় এসে জুটেছে।” এই কথাগুলো শুনতে আমার খুব খুব খারাপ লেগেছিল। এসিডে মুখ ঝলসে যাওয়া একটা মেয়ের যে জীবনসঙ্গী হতে পারে, সেরকম সজ্জন একজন মানুষের নামে এমন কথা শুনলে, কারুরই হয়তো ভাল লাগবে না। কেন জানি না, আমার কানে শুধুই ধাক্কা মারছিল, একটা সাক্ষাৎকারে অলোক দীক্ষিতের নিজের বলা কয়েকটা কথা। “যতদিন বাঁচব, আমরা দুজন একসাথেই থাকব।”

অলোকের জন্ম হয় কানপুরে, ১৯৮৮ সালে। ও ২০০৭ এ ভারতীয় বিমান বাহিনীতে যোগ দিলেও ২০০৯ সালে ছেড়ে দেয়। তারপরে ভর্তি হয় “Indian Institute of Journalism & New Media , Bangalore” এ। সেখানকার পড়াশুনা শেষ হলে টিভি৯ চ্যানেলে সাংবাদিক হিসেবে কাজ শুরু করে। তারপর কাজ নেয় INEXT Live পোর্টালে। ২০১৩ র শেষের দিকে এসিড আক্রান্তদের একটি এনজিও-তে গিয়েই লক্ষ্মীর সাথে অলোকের প্রথম আলাপ হয়। আর কয়েক দিন যেতে না যেতেই ওরা দুজন একসঙ্গে থাকতে শুরু করে। ওদের মেয়ে পিহুর জন্ম ঠিক দুবছরের মধ্যে, ২০১৫ তে।

একটা কাগজকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে অলোক বলেছিল- “যেভাবে একজন সাধারণ মানুষ আরেকজনের প্রেমে পড়ে, লক্ষ্মীর সাথে আমার প্রেমকাহিনী ঠিক সেভাবেই এগিয়েছে।” তারপরে আরো ও এটাও বলেছিল যে- “জীবনের শেষ পর্যন্ত লক্ষ্মীর সাথে কাটাতে আমি প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কিন্তু শুধু বিয়ে না করার জন্য আমাদেরকে সামাজিক প্রশ্নের মুখে পড়তে হচ্ছে। কিন্তু আমি সত্যিই চাই না যে আমাদের বিয়েতে লোকে আসুক আর লক্ষ্মীর রূপ নিয়ে উল্টোপাল্টা কেচ্ছা করুক। বিয়েতে তো লোকে কনের রূপটাই দেখে, তাই আমরা কখনো বিয়ে করব না বলেই ঠিক করেছি।” পরে অবশ্য দুজনের পরিবার থেকেই এই সম্পর্কের সম্মতি দিয়ে দেওয়া হয়।

অসীম ত্রিবেদীকে সাথে নিয়ে “Save your voice” নামে সংস্থা খোলে অলোক। অসীম ত্রিবেদীর পরিচয় দিলে হয়তো অনেকেই চিনবেন। ফেসবুক এবং টুইটারে এনার “Cartoons Against Corruption” নামক কার্যক্রম বেশ বিখ্যাত। ইনি “আম আদমি পার্টি”-রও প্রচারের কাজ করে থাকেন। এমন গুণধর দুই ব্যক্তি মিলে কোন সংস্থা খুললে, সেখানে “টুকরো টুকরো গ্যাং”-এর চিন্তাভাবনার প্রকাশ ঘটাই স্বাভাবিক। এক্ষেত্রেও তার কোন ব্যতিক্রম হয়নি।

মেয়ে পিহু-র জন্মের কয়েক মাস পরেই অলোক আর লক্ষ্মীর ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এবং মেয়ের ভরণ-পোষণ বাবদ এক পয়সাও খরচ দিতে রাজি হয়নি। এমন কি একথা খোলাখুলি স্বীকার করে ও জানিয়েছে যে- “he has not been able to provide any financial assistance to her or the child” …. তাহলে এতরকম কাজে এত অভিজ্ঞতা জমিয়ে লাভ কি হল? যদি আপনি ওর প্রোফাইলটা খুব খুঁটিয়ে পড়েন, হয়তো আপনারও আশ্চর্য লাগবে যে এত উচ্চ-শিক্ষিত একটা লোক কি কারণে নিজের বউ-বাচ্চার জন্য টাকার জোগাড় করতে পারছে না? বামপন্থী চরিত্রগুলো ঠিক এইরকমই। এদের কাছে পারিবারিক মূল্যবোধের কোন দাম নেই। শুধু আরাম-আয়েশের জীবন পেলেই এরা খুশি।

২০১৫ তে ছাড়াছাড়ি হবার পর অলোক নানান অজুহাতে লক্ষ্মীকে এনজিও থেকে তাড়িয়ে দেয়। ফলে এনজিওর কাজ বাবদ লক্ষ্মী মাসে মাসে যে ১০,০০০/- টাকা করে পাচ্ছিল, সেই রোজগারটুকুও বন্ধ হয়ে যায়। তারপর তিন বছর একটা প্রাণান্তকর সংগ্রাম করতে হয়েছিল মেয়েটাকে। কোলে বাচ্চা নিয়ে সম্পুর্ন একা একটা শহরে ঘর ভাড়া আর পেটের ভাত জোটানোটা দুষ্কর হয়ে উঠেছিল। ওই পোড়া মুখের জন্য বেচারীকে কেউ চাকরি দিতে রাজি ছিল না। এমন কি কল সেন্টারগুলোতে আবেদন করেও কোন লাভ হয়নি। কল সেন্টারের গ্রাহকরা কর্মীদের মুখ এমনিতেও দেখতে পায় না, শুধুমাত্র গলার আওয়াজ শোনে। তবুও লক্ষ্মীর জন্য চাকরির দরজাগুলো এক ইঞ্চিও খোলেনি। তারই মধ্যে ঘনিয়ে এল আরেক বিপদ। যেই বাড়িটায় মা-মেয়েতে ভাড়া থাকত, সেই বাড়ির মালিকের বাচ্চারা নাকি লক্ষ্মীর মুখ দেখে আঁতকে উঠত। তাই হুকুম জারি হল, অবিলম্বে ওদেরকে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।

লক্ষ্মীর ব্যাপারে কিভাবে যেন জানতে পেরেছিলেন অক্ষয় কুমার। উনি পাঁচ লাখ টাকা সাহায্য পাঠিয়েছিলেন। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে আরো কিছু অর্থ সাহায্য এসেছিল যেগুলো দিয়ে আরো কিছু এসিড আক্রান্তের সাথে মিলে লক্ষ্মী একটা ক্যাফে খোলে। কানপুর আর লখনৌ-তে সেই ক্যাফের দুটো শাখা।

লক্ষ্মীর খারাপ আমি কখনোই চাইব না। ওর লড়াইটাকে আমি প্রচন্ড সম্মান করি। ভগবান করুন পিহুকে নিয়ে ও যেন আজীবন সুখে-স্বচ্ছন্দে থাকতে পারে। তিন বছর আগে যখন লক্ষ্মীর আর্থিক দুরবস্থার কথা জানতে পারি, ভীষণ ইচ্ছা ছিল কিছু সাহায্য করার। কিন্তু সেটার রাস্তাটা জানা ছিল না। ভবিষ্যতে আশা করি সেই সুযোগ অবশ্যই হবে।

আমার এই লেখার একমাত্র উদ্দেশ্য হল, বামপন্থীদের শঠতার বিষয়ে সাধারণ মানুষকে সচেতন করা। তারাই বামপন্থী যারা দেশ, দারিদ্র্য, সমাজ, ন্যায়, সাংবিধানিক মূল্যবোধের কথা জোর গলায় বলে অথচ নিজের ব্যক্তিগত জীবনে এর প্রায় কিছুই মেনে চলে না। যে লোকটা নিজের অসহায় স্ত্রী-সন্তানকে অনাহারে রেখে পালিয়ে যেতে পারে; তার কাছ থেকে যদি আপনি গরিব-অসহায়দের প্রতি সত্যিকারের সহানুভূতি আশা করেন, তাহলে আপনার থেকে বড় বোকা আর কেউ নেই।

বামপন্থার আসল মুখ এইটাই। শ্রীবাস্তব বাবু বোধ হয় সেদিন ঠিকই বলেছিলেন- “অলোক অসৎ চরিত্রের বামপন্থী ছেলে। দেখবেন, মেয়েটাকে ব্যবহার করে ছুঁড়ে ফেলে দেবে।”

অভিষেক পাণ্ডে

(তথ্য এবং মতামত সম্পূর্ণ ভাবেই লেখকের নিজস্ব।)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.