গৌড়বঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. অচিন্ত্য বিশ্বাস মহাশয়ের একটা চমকপ্রদ প্রবন্ধ থেকে জানা গিয়েছে যে, পশ্চিমবঙ্গ সরকার প্রকাশিত একটা ছাত্রপাঠ্য গ্রন্থে লেখা হয়েছে চিকাগো ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ নাকি শুধু মানবমুক্তি, সেবাব্রত, স্বদেশমন্ত্র, ধর্মসমন্বয় ইত্যাদির কথা বলেছিলেন (স্বস্তিকা, ২০.৩.১৮)।
এতে বোঝা যায় রাজনীতি আশ্রিত এই ধরনের লেখকরা স্বামীজী সম্বন্ধে কিছুই জানেন না। তবে এক্ষেত্রে মনে হয়, অজ্ঞতার চেয়ে মানসিক বিকৃতিই রয়েছে বেশি। ‘প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষ’ সাজার এক। উদগ্র কামনাই তাদের বিভ্রান্ত করেছে। ছোটদের পাঠ্যপুস্তক লিখতে গিয়ে যদি এই উদ্ভট মানসিকতা তাদের বিভ্রান্ত করে, তাহলে তারা তাদের শেখাবেন কী ?
প্রথমেই বুঝতে হবে স্বামীজীর চিকাগো যাত্রার পটভূমিটা।
দীর্ঘকাল ভারতবর্ষ ঘুরে তিনি দেখেছিলেন দেশের মানুষের নিদারুণ দুঃখ-কষ্ট ও দারিদ্র্যের করুণ ছবি। দেশ তখন দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অবহেলা ও অনাহারে দারুণ ক্লিষ্ট। ধর্মের নামে অনাচার ও কুসংস্কার তখন দেশকে গ্রাস করেছে। পাশ্চাত্যের নাস্তিকতা ও ভোগসর্বস্বতা দেশের সুপ্রাচীন সংস্কৃতিকে আঘাত করেছে। ভারতবাসীর মন থেকে আত্মবিশ্বাস লোপ পেয়েছে। এভাবে এগিয়ে গেলে ভারতের মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী।
তার তখন মনে হয়েছে এই ভারতবর্ষকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আত্মবিশ্বাস আনতে হবে, ফিরিয়ে আনতে হবে হারানো আত্মবিশ্বাস ও ধর্মচেতনা, আর সমৃদ্ধ করাতে হবে জীবনধারা ও আর্থিক অবস্থা।
সেই সময় স্বামী তুরিয়ানন্দকে বলেছিলেন, ‘হরিভাই…. দেখছি আমার হৃদয়টা খুব বেড়ে গেছে, অপরের জন্য ভাবতে শিখেছি। বিশ্বাস কর, খুব তীব্রভাবে এটা অনুভব করছি। এই সব কথা বলার সময় তার চোখে জল এসে গিয়েছিল।
আর একদিন সমুদ্রতীরে বেড়ানোর সময় তিনি কেঁদে কেঁদে বলেছিলেন, “ ভগবান! এই দুর্ভাগাদের সৃষ্টি করেছ কেন? এই দৃশ্য যে অসহ্য। কতদিন, প্রভু এই দৃশ্য দেখতে হবে’ (স্বামী বিশ্বশ্রয়ানন্দ—স্বামী বিবেকানন্দ, পৃঃ ৪৬)।
তার তখন মনে হয়েছে, ভারতবর্ষকে আবার আর্থিক, সামাজিক, আধ্যাত্মিক দিক থেকে সমৃদ্ধ করতেই হবে। তিনি বলেছেন, দেশের দরকার বিদেশের সমৃদ্ধ দেশগুলোর সঙ্গে সংযোগ, আর্থিক ও বৈজ্ঞানিক সহযোগিতা। তাছাড়া বিদেশিদের চোখে ভারতবর্ষ তখন এক দরিদ্র, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও অন্ধকারময় দেশ। তাই তাদের সামনে। তুলে ধরতে হবে এই দেশের সুপ্রাচীন ঐতিহ্য ও ধর্মীয় আধ্যাত্মিক সমৃদ্ধির কথা। বোঝাতে হবে বিদেশি শোষণে ভারতবর্ষ তখন দরিদ্র শোষিত, কিন্তু ধর্ম, দর্শন ও সংস্কৃতিতে এটা এক মহান দেশ।
সেই সময়ই আমেরিকার চিকাগোতে ধর্ম-মহাসম্মেলনের দিনক্ষণ ঘোষিত হয়েছে। স্বামীজীর মনে হয়েছিল–এই বিশাল মঞ্চকেই ব্যবহার করতে হবে। পৌঁছতে হবে চিকাগোতে।
স্বামী গম্ভীরানন্দের মতে, তাঁর উদ্দেশ্য ছিল স্বদেশের জন্য অর্থসংগ্রহ ও বিদেশের সঙ্গে আর্থিক সংযোগ স্থাপন করা (যুগনায়ক বিবেকানন্দ)। অবশ্য শঙ্করী প্রসাদ বসু জানিয়েছেন, স্বামীজী চেয়েছিলেন, বিদেশের বিজ্ঞান সাধনার সঙ্গে ভারতবর্ষকে যুক্ত করতে (স্বামী বিবেকানন্দ ও সমকালীন ভারতবর্ষ, ১ম খণ্ড)। কিন্তু মনে হয় এগুলো ছাড়াও তাঁর উদ্দেশ্য ছিল দেশের প্রাচীন ঐতিহ্য ও হিন্দুধর্মের মাহাত্ম্য জগতের সামনে তুলে ধরা। তাঁর মতে ধর্ম যখন অন্যান্য জাতির কল্পনাতেও উদ্ভূত হয়নি তার অন্তত তিনশো বছর আগে আমাদের ধর্ম সুপ্রতিষ্ঠিত। …..দর্শনের ক্ষেত্রেও আমরা এখন পর্যন্ত। অন্য যেকোনো জাতির চেয়ে অনেক উপরে। আছি…. আমাদের সংস্কৃত ভাষা যাবতীয় ইউরোপীয় ভাষার ভিত্তি’— (সবার স্বামীজী— স্বামী লোকেশ্বরানন্দ, পৃ:৩৯)।
এই স্বামীজীকেই আমরা চিকাগোতে দেখেছি। তিনি তখন ভারতের ধর্মীয় দূত। তবে অন্যান্য দেশের ধর্মীয় প্রতিনিধিরা সেখানে গেছেন সসম্মানে। স্বামীজী কিন্তু উপস্থিত হয়েছেন অনাহুত এক সন্ন্যাসী হিসেবে। অনেক কষ্টে তিনি পাঁচ মিনিট। বলার অনুমতি পেয়েছিলেন।
অন্যান্য বক্তারা বক্তব্য শুরু করেছেন—- ‘Ladies and gentleman’ দিয়ে। কিন্তু স্বামীজী প্রথমেই বলেছেন, “Brothers and sisters of America।’ মুহূর্তেই আপ্লুত হয়েছেন শ্রোতারা, তুমুল করতালিতে আকাশ যেন বিদীর্ণ হয়েছে, সেটা যেন চলছিল কয়েক মিনিট। গেরুয়া বেশধারী সুদর্শন এই তরুণ সন্ন্যাসীকে উঠতে দেখেই শ্রোতারা মুগ্ধ হয়েছিলেন। এবার সেই মুগ্ধতা এনে দিয়েছে বিস্ময়।
পূর্বোক্ত পাঠ্যপুস্তকের লেখক সম্পাদককে জানাই স্বামীজী নিজেকে হিন্দুধর্মের প্রতিনিধি বলেই দাবি করেছেন। শুরুতেই তিনি বলেছেন সর্বধর্মের প্রসূতি স্বরূপ যে সনাতন হিন্দুধর্ম, তারই প্রতিনিধি হয়ে আমি আজ আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি—পৃথিবীর যাবতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের হয়ে আমি আজ এখানে এসেছি (সত্যরঞ্জন চক্রবর্তী—“বিশ্বকে ধর্মীয় নবচেতনা দিলেন স্বামীজী’, একদিন, ১১.১১.১৮)। তারপর ধাপে ধাপে তিনি হিন্দুধর্মের মহিমা ও স্বরূপ বিশ্লেষণ করে সবাইকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখেছেন।
তিনি আরও বলেছেন, আমি সেই ধর্মের অন্তর্গত বলে গৌরব বোধ করি যে ধর্ম জগৎকে শিখিয়েছে পরমত সহিষ্ণুতা ও সর্বজনীন গ্রহিষ্ণুতার আদর্শ, সেই ধর্ম আক্রমণকারীকেও আপন করে নিয়েছে—তারাও ক্রমে ভারতীয় ধর্ম ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গেছেন। তিনি আরও বলেছেন, আমরা শুধু সব ধর্মকে সত্য বলি না আমরা বিশ্বাস করি সব ধর্মের গোড়ার কথা এক ও অভিন্ন। আমরা সেই জাতির অন্তর্ভুক্ত বলে গর্ব করি যে ধর্ম পৃথিবীর সব ধর্ম ও জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থীদের চিরদিন আশ্রয় দিয়েছে। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছেন, ইহুদিদের একটা অংশকে আমরা দক্ষিণ ভারতে আশ্রয় দিয়েছিলাম, জরায়ুস্টের অনুগামীদের এই হিন্দুধর্মই আদরে গ্রহণ করেছিল। এই প্রসঙ্গেই তিনি গীতার সেই কথা উল্লেখ করেছেন যে যথা মাং প্রপদ্যন্তে তাংস্তথৈব ভজাম্যহম’(৪১১)। সুতরাং হিন্দুধর্ম নিজেকে শ্রেষ্ঠ বলে দাবি করে না, তার শিক্ষা হলো—যিনি ঈশ্বরকে যেভাবে ভজনা করেন, তিনি সেভাবেই তাঁর কৃপালাভ করেন।
তার একটা ভাষণেই বিস্মিত চমৎকৃত হয়েছেন শ্রোতারা। আবেগাপ্লুত হয়েছেন সমস্ত আমেরিকাবাসী। পরাধীন ভারতের এই তরুণ সন্ন্যাসী এভাবে বিশ্বের দরবারে। তুলে ধরেছেন প্রাচীন এই দেশের বিজয়-বৈজয়ন্তী। স্বামীজী এভাবে শুধু চিকাগো জয় করেননি সেই সঙ্গে ম্রিয়মান আত্মবিশ্বাসহারা ভারতবাসীর প্রাণে সঞ্চারিত করেছেন প্রাণ, চেতনা ও গর্ববোধ (প্রণবেশ চক্রবর্তী—শিকাগো ধর্ম সম্মেলনে স্বামী বিবেকানন্দ, পৃ: ৩১-৩২)।
তার ভাষণ সবাইকে এত মুগ্ধ করেছিল যে যখনই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হতো স্বামীজী ভাষণ দেবেন, তখনই আসন সংগ্রহের জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেত। বিভিন্ন রাস্তায় তার ফোটো ঝোলানো থাকত, তার সঙ্গে বিজ্ঞাপন থাকত তিনি কোথায় কী বলবেন। সেই জন্য বলা যায় ‘চিকাগো সভায় তার আত্মপ্রকাশ ভারতবর্ষের নবজাগরণের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরত্বপূর্ণ ঘটনা’ (বিবেকানন্দের ভারত প্রত্যাবর্তন, রামকৃষ্ণ মিশন গোলপার্ক, পৃ: ৫)।
এটা লক্ষণীয় যে, তিনি যেখানে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত হিন্দুধর্মের মহিমার কথা বলেছেন, কিন্তু কখনও এই ধর্মকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে দাবি করেননি। তিনি সমাপ্তি ভাষণে বরং বলেছেন, বিবাদ নয়, সহায়তা; বিনাশ নয়, ভাবগ্রহণ, বিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তিই কাম্য।
এটাও পূর্বোক্ত আঁতেলদের জানানো দরকার, তিনি একটি লিখিত ভাষণ দিয়েছিলেন বিষয়বস্তু হিন্দুধর্ম। পঞ্চম বক্তৃতার বিষয়ও ছিল হিন্দুধর্ম।
একটা ভাষণে ছিল একটা গল্প। কয়েকজন বক্তা তাদের ভাষণে নিজেদের ধর্মের শ্রেষ্ঠত্বের কথা ব্যক্ত করেছেন। স্বামীজী সবার শেষে যখন উঠে দাঁড়ালেন, তখন অনেকের মনে হয়েছিল তিনি হিন্দুধর্মের পক্ষে সওয়াল করবেন। কিন্তু তিনি উঠে কুয়োর ব্যাঙের কথা বলেছেন তাদের ধারণা ছিল কুয়োটাই দুনিয়ার সর্ববৃহৎ জলাশয়।
গল্পটা শুনে পূর্ববতী বক্তারা লজ্জায় অধোবদন হয়ে রয়েছিলেন। ডেইলী হেরাল্ড’ লিখেছেন এই মহান সন্ন্যাসীর দেশে পাদরি পাঠানোর দরকার নেই। নর্দাম্পটন ডেইলী’ জানিয়েছিল তাঁর ভাষণ শোনার জন্য মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে (১১.৪.১৮৯৪)। আর ‘ডেটুইট জার্নাল জানিয়েছিল বহু মানুষ চেয়ারের অভাবে দাঁড়িয়ে স্তব্ধ হয়ে শুনেছেন তাঁর ভাষণ (২১.২.৯৪)।
বিশ্ব বিজয় করে ফিরে আসার পর স্বাভাবিক কারণেই চমৎকৃত ভারতবাসী তাঁকে রাজকীয় সংবর্ধনা দিয়েছে। কলেজের ছেলেরা ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া খুলে তাঁকে টেনে নিয়ে গেছে বক্তৃতা মঞ্চে। শ্রী অরবিন্দ লিখেছেন, স্বামীজী ভারতে এক মহাজাগরণ করে দিয়েছেন তাঁর চিকাগো জয়ের মাধ্যমে। তিনি শুধু প্রাচীন ভারতের মহান ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিক সমৃদ্ধির কথা তুলে ধরেননি, মনে করিয়ে দিয়েছেন হিন্দু ধর্মের মাহাত্ম্য ও উদারতার কথা।
আমাদের দেশের স্বল্প শিক্ষিত অনেক বুদ্ধিজীবী প্রগতিশীল সেজে সেটা অস্বীকার করতে চান। এটা অজ্ঞতা, সঙ্কীর্ণর্তা ও রুচি-বিকৃতির এক কদর্য মিশ্রণ।
ড. নির্মলেন্দুবিকাশ রক্ষিত
2020-09-11