ভূসম্পত্তি ও আবাসন ক্ষেত্রে শুধুই কালো মেঘ নয়, রুপালি রেখাও আছে

ভারতের অর্থনীতির সাম্প্রতিক দোলাচল নিয়ে একটা অস্বস্তিকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এই বছর বিশ্বের কী উন্নত কী উন্নতিশীল সবরকম দেশেই কিন্তু অর্থনীতি নিয়ে প্রচুর বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছে। এই বিক্ষোভের কারণ সব দেশের ক্ষেত্রে এক এমন নয়। তবে অসন্তোষের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে জনমানসের নেতিবাচক অবস্থান। একটা বিষয়ে সব দেশের মধ্যেই যে মিলটি পাওয়া যায় তা হলো সাধারণ মানুষ তার দৈনন্দিন জীবনযাত্রার ভবিষ্যৎ মানোন্নয়নের সম্পর্কে হতাশ।
বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো গণতান্ত্রিক দেশ ভারতের মানুষও বিক্ষোভে গলা চড়িয়ে সরকারের বিরুদ্ধে যখন রাস্তায় নামে তখন পরিষ্কার হয়ে যায় দেশে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ কত শক্তপোক্ত ও সর্বজনগ্রাহ্য। সেই কারণে দেশের নাগরিক অধিকারকে কেউ অগ্রাহ্য করার সাহস দেখায় না, বরঞ্চ সরকার তার মর্যাদা দিতেই তৎপর হয়। ভারতের ওপর সারা বিশ্বের এখন কড়া নজর। তাই এটা নিশ্চিত যে, ক্ষমতায় যারাই থাকুক না কেন স্থিরমস্তিষ্কে তারা সাধারণ নাগরিকদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ মেটাতে সচেষ্ট হবে।
২০১৯ সাল ভারতীয় অর্থনীতির পক্ষে নিশ্চিত ভাবেই একটা বিশেষ চ্যালেঞ্জ। বৃদ্ধির শ্লথতা রুখতে নানাবিধ ব্যবস্থা সরকারের তরফে নেওয়া হলেও আরও অনেক বাধা টপকাতে হবে। অবশ্য একটা চরম নিরাশাজনক পরিস্থিতির আবর্তে বসে থেকে নিরাপদ দূরত্বের আরামকেদারা-সমালোচক হওয়া খুব সহজ। এর বিকল্প হিসেবে দেশের শিল্প বাণিজ্য পরিচালকদের সরাসরি সরকারের সঙ্গে আলোচনা, নির্দিষ্ট সংশোধনী প্রস্তাব দেওয়া এবং প্রয়োজনীয় নীতি প্রণয়নে গঠনমূলক ভূমিকা নেওয়া এক বিরাট পরিবর্তন এনে দিতে পারে। সন্দেহবাদীরা বলতেই পারেন এতে কি সত্যিই কোনো ফল হবে? অবশ্যই, আমাদের হাতে অকাট্য প্রমাণ থাকার কারণে আমরা বলতেই পারি সর্বসাধারণের সাধ্যের মধ্যে আবাসন ক্ষেত্রে (affordable limits) এই মত বিনিময় প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত সুফল পাওয়া গেছে। নিশ্চিত ভাবেই এখানে রুপালি রেখা দেখা যাচ্ছে, যা মনযোগের দাবি রাখে।
নাগরিকরা সম্পত্তির মালিক হতে পারবে এমন একটি গণতন্ত্র গড়ে ওঠার বহুবিধ সুফল যে আছে তা বিশ্বে স্বীকৃত। ভারতে যতই মফস্সল থেকে শহুরে অঞ্চল বেশি গড়ে উঠছে। সাধ্যের মধ্যে আবাসনের প্রয়োজনীয়তা ততই বাড়ছে। শহরবাসীর কর্মক্ষেত্র ও আর্থিক ক্ষমতার নাগালের মধ্যে বাসগৃহ থাকা inclusive city এর প্রধান শর্ত। যে কোনো পরিবারের ক্ষেত্রেই নিজস্ব বাড়ি থাকাটা ক্ষমতায়নের প্রথম ধাপ। এর সঙ্গেই জড়িত উন্নত জীবনযাপন ও সামাজিক নিরাপত্তার প্রসঙ্গটি। বিশ্বের মধ্যে ভারতই একমাত্র দেশ যেখানে বাড়ি কিনলে গৃহঋণ বাবদ একই সঙ্গে মূল ঋণের কিস্তি পরিশোধের টাকা ও সুদ এই দু’য়ের ওপরেই আয়করে ছাড় দেওয়া হয়। এটা সরকারের তরফে নিঃসন্দেহে বড়ো পৃষ্ঠপোষকতা। সকলের জন্য আবাস— এই লক্ষ্যটি সরকারের অগ্রাধিকারে রয়েছে। বলতেই হবে দেশের আবাসন ও নগর উন্নয়নমন্ত্রক এই যোজনায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়ে। কাজ করছে। ২০১৫ সালে শহরে বাস করা নির্ধারিত সীমার অধীন মানুষদের প্রধানমন্ত্রী। আবাস যোজনার মধ্যে আনা হয় যাতে তারা পাকা বাড়ির মালিক হতে পারেন। পরিসংখ্যান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ডিসেম্বর অবধি এই যোজনায়১.০৩ কোটি বাড়ি তৈরির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ৬০ লক্ষ বাড়ি তৈরি শুরু হয়েছে, আর ৩২ লক্ষ বাড়ি তৈরি হয়ে গেছে। এটা সরকারের একটা বলার মতো সাফল্য সন্দেহ নেই।
প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় চার ধরনের বাসস্থান সংক্রান্ত নীতি প্রণয়ন ও তার নির্দিষ্ট রূপায়ণের ব্যবস্থা রয়েছে (১) শহুরে বস্তি ঢেলে সাজানো, (২) ঋণের সঙ্গে (গৃহ) সরাসরি সরকারি ভরতুকি পাঠিয়ে দেওয়া, (৩) একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে অংশীদারিতে সাধ্যের মধ্যে আবাসন নির্মাণে ভরতুকি, (৪) নিজের বাড়ি নিজেই তৈরি করা। এই চারটি। ক্ষেত্রেই নির্মাণ খরচ কেন্দ্রীয় সরকার, রাজ্য সরকার ও কিছু অংশ আবাসন মালিকের মধ্যে ভাগ হয়ে যাবে।
ঋণের সঙ্গে ভরতুকি সংযুক্ত করে দেওয়ার প্রকল্পটি অত্যন্ত সদর্থক ও জনহিতকর। সমাজের দরিদ্রতম স্তর, কম আয়ের মানুষ, একই সঙ্গে নিজ গৃহের আকাঙ্ক্ষা রয়েছে এমন বার্ষিক ৬ লক্ষ থেকে ১৮ লক্ষ টাকা আয়ের মধ্যমবর্গের মানুষের ক্ষেত্রেও এটি প্রযোজ্য। এই সিএলএসএস যোজনায় প্রথমবার যারা ঋণের মাধ্যমে বাড়ি বা ফ্ল্যাট কিনতে যাচ্ছেন কেন্দ্রীয় সরকারের তরফে সুদের অংশটি সঙ্গে সঙ্গে ক্রেতার অ্যাকাউন্টে দিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে ব্যাঙ্ক যখন মাসিক কিস্তি ঠিক করে, সুদের অংশ আগেই পেয়ে যাওয়ায় কিস্তির পরিমাণ অনেক কমে যায়। বোঝাই যাচ্ছে এই যোজনা সম্ভাব্য গৃহক্রেতাকে শুরুতেই ঋণ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে উৎসাহিত করে। এর ফলে তুলনামূলকভাবে বেশ তরুণ বয়সেই অনেকে নিজের বাড়ির স্বপ্ন পূরণ করতে পারছেন। এই প্রকল্প যে পর্যাপ্ত সাফল্য পেয়েছে তার প্রমাণ তিনশোরও অধিক প্রাথমিক ঋণদান সংস্থা সরাসরি এগিয়ে এসে এই প্রকল্পে যোগ দিয়েছে। উদ্দেশ্য নিজেদের লাভের সঙ্গেই প্রকল্পটিকেও সফল করে তোলা। একটা বিষয় এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ তাহালো যে। কোনো ভরতুকি নির্ভর প্রকল্পের সফল রূপায়ণের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নজরদারি ও নিরীক্ষণ ব্যবস্থা ঠিক রাখা। অর্থাৎ সঠিক উপভোক্তার কাছেই সরকারের ভরতুকির অংশ পৌঁছচ্ছে কিনা তা নিশ্চিত করা। সিএলএসএস যেহেতু একটি যৌথ প্রকল্প তাই অংশীদারদের মধ্যে ন্যাশনাল হাউসিং ব্যাঙ্ক আবাসন মন্ত্রক স্বয়ং ও প্রাথমিক ঋণদানকারী সংস্থা (পিএলআই) রয়েছে।
ইতিমধ্যে এই প্রকল্পে ১.২ লক্ষ কোটি টাকার ঋণ ৮.২ লক্ষ ঋণ গ্রহীতাদের বাড়ি তৈরির জন্য বিতরিত হয়েছে। এর মধ্যে সরকারের তরফে বিপুল ১৮৫০০ কোটি টাকার ভরতুকি দেওয়া হয়েছে। যে সমস্ত অংশগ্রহণকারী এই প্রকল্পের ভাগীদার তাদের সকলের সম্পূর্ণ স্বচ্ছতার জন্য আবাসন মন্ত্রণালয় একটি ওয়েব ভিত্তিক সর্বক্ষণ নজরদারি সক্ষম Credit Link Awas Portal খুলেছে। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কোনো ঋণগ্রহীতার আবেদনপত্র গ্রহণ করা, পরীক্ষা করা থেকে ভরতুকি প্রদান করা একই সঙ্গে করা হয়। এর মাধ্যমে ঋণদানে পূর্ণ স্বচ্ছতা, ঋণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ খবরাখবর ভরতুকির পরিমাণ ও প্রদানের সঠিক তারিখ ঋণগ্রহীতা সরাসরি জানতে পারেন। এর ফলে সরকারের ওপর আস্থা বাড়ার সঙ্গে তার অভিযোগও কমে যায়। আজকে সিএলএসএস ভরতুকি প্রদানের । প্রথা প্রকরণ নিয়ে একটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ হয়ে উঠেছে যেখানে শুরু থেকেই সরকার সর্বদা ঋণদাতা ও গ্রহীতা উভয়ের কাছ থেকে প্রতিনিয়ত সুবিধে অসুবিধে, প্রকল্পের পরিবর্তন পরিমার্জন সম্পর্কে মতামত পেয়ে চলেছে। সেই অনুযায়ী প্রকল্পটিকে সর্বদা সংস্কারের মাধ্যমে আরও উন্নত করে উপভোক্তা ও ঋণদাতাদের কাছে সহজ ও দ্রুত ফলদায়ী করে তুলেছে।
তবে, সাধ্য অনুযায়ী আবাসনের এই প্রকল্পে বাড়ি করার ক্ষেত্রে জমি সংক্রান্ত অনুমোদন পাওয়ার এখনও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। এক্ষেত্রে এক জানালা সমাধান লাগু করা প্রয়োজন। এতে গৃহনির্মাণে ইচ্ছুক ব্যক্তিকে বাড়ি তৈরির জন্য সেইসব সরকারি দপ্তরে ঘুরতে হবে না যেখানে বেআইনি অর্থের আদান প্রদান এখনও বিরাজমান। এই ঘোরাঘুরি নিরসন করতে পারলে বাড়ি তৈরির সময় ও খরচ দুটোই কমে যেতে পারে। একটা উদাহরণ দিলে বিষয়টা পরিষ্কার হবে Urban land ceiling Act মহারাষ্ট্রে ২০০৭ সালে বাতিল করা হয়। কিন্তু কী এক অজানা কারণে বৃহত্তর মুম্বাই নিগমের অধীন অঞ্চলগুলিতে গৃহনির্মাণের ক্ষেত্রে নো অবজেকশান সার্টিফিকেট জোগাড় করতে হয় ওই urban land ceiling দপ্তর থেকেই।
সর্বাধুনিক প্রযুক্তির ধনী-নির্ধন সকলকেই এক পঙক্তিতে নিয়ে আসার ক্ষমতা রয়েছে। তাই অন লাইন এক জানালা পদ্ধতির মাধ্যমে জমি সংক্রান্ত ছাড়পত্র প্রদান শুরু করা অত্যন্ত জরুরি। এর ফলে গৃহ নির্মাণ ও আবাসন শিল্পে অভাবনীয় কিছু ঘটে যেতে পারে।
ভারতের অর্থনীতির উন্নয়নের ক্ষেত্রে শিল্পপতি ও সরকারের পরস্পর মতবিনিময় করে পরিস্থিতি নির্ভর সিদ্ধান্ত নিতে পারলে বৃদ্ধির গতি আসবেই। আর পরস্পর হাত মিলিয়ে চলার ফেলে যে সাফল্যগুলি ইতিমধ্যেই অর্জিত হয়েছে তা মানুষের কাছে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা দরকার। শুধু কিছুই হলো না বলে বিলাপ করার মধ্যে কোনো সমাধান নেই, অর্থনীতির খারাপ অবস্থা নিয়ে কেবল বুক চাপড়ালে এর থেকে উত্তরণের পথ মিলবে না। ভারতের অর্থনীতির ক্ষেত্রে অনেক রুপালি রেখা উঁকি দিচ্ছে। এখন প্রয়োজন যৌথ উদ্যোগে যাতে কালো মেঘ কেটে যায় সে কাজে আত্মবিশ্বাস ও সঙ্কল্প নিয়ে সরকার ও শিল্পমহলের নেমে পড়া।
দীপক পারেখ
(লেখক হাউজিং ডেভেলপমেন্ট ফাইনান্স করপোরেশনের চেয়ারপার্সন)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.