#একটি_আদি_সমাজের_গল্প

#পর্ব_৬ : যত শত ভাষার কথা

মায়ের কোলেতে শুয়ে ঊরুতে মস্তক থুয়ে

খল খল সহাস্য বদন।

অধরে অমৃত ক্ষরে আধ আধ মৃদু স্বরে

আধ আধ বচনরচন।।

কহিতে অন্তরে আশা মুখে নাহি কটু ভাষা

ব্যাকুল হয়েছে কত তায়।

মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা আবো আবো আবা আবা

সমুদয় দেববাণী প্রায়।।

ক্রমেতে ফুটিল মুখ উঠিল মনের সুখ

একে একে দেখিলে সকল।

মেসো, পিসে, খুড়ো, বাপ জুজু, ভুত, ছুঁচো, সাপ

স্থল জল আকাশ অনল।


ভাষা, মাতৃভাষা….মাতৃভাষা মাতৃদুগ্ধ সম। বিদেশি ভাষায় কোনো জটিল বিষয়কে আত্মস্থ করতে অধিক সময়, অধ্যাবসায় ও অনুশীলনের প্রয়োজন হয় কিন্তু মাতৃভাষার মাধ্যমে তা অপেক্ষাকৃত অল্প সময়ে অধিগত করা সম্ভব হয়।সমাজের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ভাবের আদান প্রদানের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম হল মাতৃভাষা। যা সকল জনগণের  ভাষা। মাতৃভাষার মাধ্যমে আপন সৃজনী শক্তির চরম বিকাশ ঘটানো সম্ভব। সাহিত্য সৃষ্টিতে ,বিজ্ঞান চিন্তার মৌলিকতায় মাতৃভাষার ভূমিকা অসামান্য। এছাড়া মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা দিলে শিক্ষার্থীর উন্নত রুচিবোধ ,জাতীয় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগ জন্মায়। এর ব্যতিক্রম কিন্তু আদিম সমাজেও হয় নি আর হয় না। তবে ক্রমাগত মিশনারী বা মধ্যপ্রাচ্যে মরুদস্যু আগ্রাসনের প্রভাবে ঠিক কত দিন সেই ধারা বজায় রাখতে পারবেন সেটাই এখন প্রশ্ন চিহ্নের সম্মুখীন হয়েছে। 


অরুনাচল প্রদেশের নানা জনগোষ্ঠী সহ আদি জনগোষ্ঠীগুলোর মধ্যে একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত এমনকি এখনো স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখেছেন।  নিজেদের মধ্যে সুপ্রাচীন কাল হতে পারস্পরিক সম্পর্ক ও আদানপ্রদানকে সুদৃঢ় করে তুলেছেন। তার প্রভাব পড়েছে তাঁদের ভাষার উপরেও। আদি জনগোষ্ঠীদের মাতৃভাষাগুলোকে একটি আদি- ভাষা পরিবারের অন্তর্গত হিসাবে ধরা যায় । জনগোষ্ঠীর ভাষা গুলির মধ্যে যেমন পার্থক্য আছে তেমন সাযুজ্যও আছে, আছে পরস্পর বোধ্যতা। এমন পাঁচটি ভাষার কথা বলব।  যথা – বোকার , বোরি , কারকো , মিলাঙ ও তাঙ্গাম। ভাষাগুলির মধ্যে বেশ কিছু অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়।


যেমন –
#বোকার –  আমি → গোঁ , তুমি → লানয়ি, সে →লাকুম, আমরা → গোঁনয়ি ( ২ জন) / গোলু ( ২ জনের বেশি), তোমরা → মানয়ি ( ২ জন) / মালু ( ২ এর বেশি) , তারা → মেনয়ি ( ২ জন) / মালু ( ২ এর বেশি)
#বোরি – আমি → গোঁ , তুমি → নো, সে →বি , আমরা → গোঁলু , তোমরা → নোলু, তারা → বুলু 
#কারকো -আমি → গোঁ , তুমি → নো, সে →বিই, আমরা → গোঁনয়ি ( ২ জন) , তোমরা → নোনয়ি ( ২ জন) , তারা → বিনয়ি ( ২ জন) 
#মিলাঙ- আমি → গাঁ , তুমি →গিঁ, সে →জি, আমরা → গাঁজি ( ২ জনের বেশি), তোমরা → ন্যা ( ২ এর বেশি) , তারা → জাজি ( ২ এর বেশি)
#তাঙ্গাম -আমি → গোঁ , তুমি → নো , সে →জি, আমরা → গাঁজি ( ২ জনের বেশি), তোমরা → নোরু  ( ২ এর বেশি) , তারা → ডাটাঙ- মেরু ( ২ এর বেশি)
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে যে  আমি এই সর্বনাম প্রায় সব গোষ্ঠীর ভাষার ক্ষেত্রেই একরকম। অন্যগুলির ক্ষেত্রে পার্থক্য চলে আসছে।বহুবচনের ক্ষেত্রে লক্ষ করার মত যে কিছু ভাষায় শব্দ ব্যবহারের দুই বা দুজনের বেশি বোঝাতে পৃথক পৃথক শব্দ ব্যবহারের রীতি আছে।


এবার আসি গণনার আলোচনায় । কেমন রীতি তাঁরা অনুসরণ করেন ? 
#বোকার – এক → আকেন , দুই →আনয়ি,  তিন →অউম, চার→আপ্পি,  পাঁচ→ওঙ্গো, ছয় →আক্কি ,সাত →কিনি, আট→ পিনয়ি , নয় →নোনোঙ , দশ →ঈয়িঙ, এগার →ঈয়িঙ গোলা/আকেন
#বোরি -এক → আকোন , দুই →আনয়ি ,  তিন →আওন, চার→আপ্পি,  পাঁচ→এঙ্গো, ছয় →আক্কে ,সাত →কিনিট, আট→ পিনয়ি , নয় →কোনাঙ , দশ →ঈয়িঙ ,এগার →আকোন কু
#কারকো-এক → আতের , দুই →আনয়ি,  তিন →আরুম, চার→আপ্পি,  পাঁচ→পির্নগো, ছয় →পির্কয়াঙ ,সাত →কিনিট, আট→ পিনয়ি , নয় →কোনাঙ , দশ →ঈয়িঙ এগার →ঈয়িঙ কোলাঙ আতের
#মিলাঙ-এক → আকান , দুই →নে,  তিন →হাম, চার→পে,  পাঁচ→পাঙ্গু, ছয় →সাপ ,সাত →রাঙ্গাল, আট→  রায়েঙ, নয় →কান্যেম , দশ →হাঙটাক, এগার →হাঙটাক কালো আকান
#তাঙ্গাম-এক → য়োকোন , দুই →য়োঙ্গি,  তিন →য়োদেন, চার→য়োপি,  পাঁচ→য়োঙ্গো, ছয় →য়োঙ্গকুঙ ,সাত →কেনে, আট→ পিনয়ি , নয় →কোনাঙ , দশ →আইঙ , এগার →আইঙ্গেটোলা য়োকেন


দশ এবং এক কে ব্যবহার করে যে প্রকারে এগারো করা হয়েছে , সেইভাবেই বারো এবং তার পরের সংখ্যা গুনটি চলে উনিশ অবধি।তারপর আসে কুড়ি। নিয়ম সেই একই। দেখা যায় যে সব ভাষার মধ্যেই গুন্তির ক্ষেত্রে সাযুজ্য আছে।কিছু কিছু সংখ্যা আছে যাদের নামও এক, কিন্তু ভেদাভেদ কেবল ভাষায়।প্রতিটি জনগোষ্ঠীর ভাষার মধ্যেই গণনার মৌলিক কাঠামোটি স্বকীয় চেহারায় হাজির।


 উক্ত ভাষাগুলির ক্ষেত্রে আরো কিছু বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যেতে পারে।।যেমন – তাঙ্গাম ভাষায় বিশেষ্য অনুযায়ী বিষেশনের রূপ পাল্টে যায়। উদাহরণস্বরূপ : কালো কুকুর – আকে কেকা, কালো গরু – রুনে রুকা, কালো পোশাক – চিমান নে আগিয়া । এখানে কুকুর – আকে , রুনে – গরু , আগিয়া – পোশাক । এবার ভালো করে লক্ষ্য করলে দেখা যাচ্ছে কালো এই বিষেশনটি ক্রমে ক্রমে পাল্টে যাচ্ছে কুকুরের জন্য সেটি কেকা , গরুর জন্য সেটি রুকা , আর পোশাকের জন্য তা হয়েছে চিমান নে।।কেবল তাই নয়, বিশেষ‍্য‍র সাপেক্ষে তার অবস্থান পাল্টে যাচ্ছে।। যেমন – কুকুর গরুর ক্ষেত্রে তা বিশেষ্যর  পরে বসেছে আর পোশাকের ক্ষেত্রে তা বিশেষ্যের আগে বসেছে । 


বিশেষণ ব্যবহার আরেকটি বিশেষত্বের উদাহরণ দেওয়া যায় আদি জনগোষ্ঠীর উপশাখা বোরি ভাষায়। বোরি ভাষায় বিশেষ্য বস্তুর আকৃতির উপর নির্ভর করে বিষেশনটি বদলে যায় । যেমন ,  একটি দড়ি → সোকি আয়োঙ,  একটি থালা ― তালি বোরকেন। অর্থাৎ লম্বা আকৃতির বস্তু হলে আয়োঙ এবং একটি চ্যাপ্টা গোলাকার বস্তু হলে বোরকেন ব্যবহৃত হয় । কিন্তু এরা কেউ সমার্থক নয় ।
এবার আরেকটু ব্যাখ্যায় আসি। বোরি ভাষায় একটি বস্তুকে বোঝাতে বিভিন্ন শস্ব্দ ব্যবহার করা হয়। যেমন বাঁশ ― ডিবাঙ ,হেগু, হেপ, হেসো।  এরা  কিন্তু কেউ সমার্থক শব্দ নয়। বাঁশের বিভিন্ন  ধরনের আলাদা আলাদা নাম । আমরা হয়তো সেই সকল বাঁশের মধ্যে আলাদা করে কোন পার্থক্য করতে পারব না । কিন্তু বোরিদের মধ্যে পরম্পরাগতভাবে গুণাবলী অনুযায়ী এইভাবে বাঁশের মধ্যে পার্থক্য করা ও সেই অনুযায়ী আলাদা আলাদা ভাবে তাদের কাজে লাগানোর জ্ঞান আছে । 


মিলাঙ জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে আবার মিলাঙ ভাষা ছাড়াও একটি সাংকেতিক ভাষার চল আছে। এটি গোপনীয়তা বজায় রাখার প্রয়োজন হলে কেবলমাত্র নিজেদের মধ্যেই তারা ব্যবহার করে থাকে।
 লিঙ্গ পার্থক্য বোঝাতে এই সব ভাষাতে  দুই রকমের রীতিই আছে – পৃথক লিঙ্গের জন্য পৃথক শব্দ ব্যবহৃত হয় । অথবা, মূল বিশেষ্যর সঙ্গে উপসর্গ বা অনুসর্গ জুড়ে লিঙ্গ বোঝানো হয়।  প্রতি ভাষাতেই মূলত কর্তা- কর্মপদ ও ক্রিয়াপদ এই বিন্যাসে বাক্য গঠন করা হয়।


 আদি জনগোষ্ঠীর ভাষাগুলি লিপিহীন ভাষা। অথবা বলতে পারেন লিখনরীতিহীন কথ্যভাষা । এই ভাষাই  গ্রামে গ্রামে মানুষের মুখে মুখে প্রবাহিত হয়েছে যুগ যুগ ধরে । সেই ভাষাই বয়স্কদের স্মৃতিতে সঞ্চিত হয়ে আছে। সেই ভাষাই রূপ নিয়েছে কাহিনী, ইতিকথা, রূপকথা ,ছড়া ,গান , প্রবাদ প্রবচনে। সেই ভাষাই এই সমস্ত কাহিনী ,নীতিকথা ,ছড়া ,গান, প্রবাদ-প্রবচন আদি ভাষা গোষ্ঠীর মধ্যে রত্ন ভান্ডারের মতো অবস্থান করছে। আভাঙ হলো আদি জনগোষ্ঠীর পৌরাণিক কাহিনী। এই অঞ্চলের ইতিহাসের আকরিক রূপ হল এই আভাঙ গুলি। 

ভাল মন্দ জানিতে না, মল মুত্র মানিতে না,

উপদেশ শিক্ষা হল যত।

পঞ্চমেতে হাতে খড়ি, খাইয়া গুরুর ছড়ি,

পাঠশালে পড়িয়াছ কত।।

যৌবনের আগমনে, জ্ঞানের প্রতিভা সনে,

বস্তুবোধ হইল তোমার।

পুস্তক করিয়া পাঠ, দেখিয়া ভবের

নাটহিতাহিত করিছ বিচার।।

যে ভাষায় হয়ে প্রীত পরমেশ-গুণ-গীত

বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।

মাতৃসম মাতৃভাষা পুরালে তোমার আশা

তুমি তার সেবা কর সুখে।।

#ক্রমশঃ
#দুর্গেশনন্দিনী

তথ্যঃ তামাঙ , ডয়া, আদি, আপাতনি জনজাতি কথা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.