উদ্বাস্তু সমস্যা আমাদের দেশের যাতীয় সমস্যা বলে আখ্যা দিয়েছে কেন্দ্র সরকার দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে যখন দেশ ভাগ হয়েছিল সেইসময় মহাত্মা গান্ধী থেকে শুরু করে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহরু, প্রথম রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ রায় প্রত্যেকেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন উদ্বাস্তুদের। সেইমত তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার উদ্বাস্তুদের পাঞ্জাব এবং বাংলাতে বিভক্ত করে দেয়। পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুরা কেন্দ্ৰীয় সরকারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুযোগ সুবিধাগুলো পেয়েছিল। কিন্তু প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বাংলার উদ্বাস্তুরা কিছুই পায়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল অর্থনৈতিক পুনর্বাসন, চাষী হলে জমি, লাঙল, গরু এবং চাষযোগ্য জমি, যারা শিক্ষিত তাঁদের শিক্ষার অনুপাতে চাকরি, যারা ব্যবসায়ী তাঁদের ব্যাবসার জন্য লোন দেবার কথা ছিল। কিন্তু গোটা বাংলায় উদবাস্তুদের ক্ষেত্রে সেটা কার্যকর হয়নি।
শুধু তাই নয়, ৭০ থেকে ৮০ লক্ষ পরিবার এখনও পুনর্বাসন পায়নি। এছাড়া যে উদ্বাস্তু ক্যাম্পগুলো রয়েছে তাঁদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে যে ব্যাবস্থা করার কথা ছিল যেমন তাঁদের সুষ্ঠ ভাবে দেখা শোনা করা, প্রয়োজনীয় খাদ্য, চিকিৎসা, অন্যান্য সুযোগ সুবিধা, শৌচাগার থেকে শুরু করে পানীয় জল পর্যন্ত তাঁরা খুব একটা পায়নি। এছাড়া বহু উদ্বাস্তুদের জন্য কোনও আশ্রয় শিবিরের বন্দোবস্ত করেনি। ফলে উপায়ন্তর না থাকায় সেইসময় লক্ষ লক্ষ আশ্রয়হীন উদ্বাস্তু রেলের লাইনের ধারে, হাইওয়ের পাশে, নয়ানজুলির পাশে থেকে শুরু করে সরকারী কেন্দ্ৰীয় সরকার বা রাজ্য সরকারের পড়ে থাকা জমি জবরদখল করে বসবাস করতে থাকে। লক্ষ লক্ষ পরিবার আশ্রয়হীন অবস্থায় সেইসব জায়গাগুলো দখল করে। সেইসময় উদ্বাস্তুদের জন্য গড়ে ওঠে সম্মিলিত কেন্দ্ৰীয় বাস্তুহারা পরিষদ বা ইউনাইটেড সেন্ট্রাল রিফিউজি কাউন্সিল যা ইউ সি আর সি নামেও পরিচিত।
বাম পরিচালিত ইউ সি আর সি কমিটির কার্যকরী সভাপতি তথা নদীয়া জেলার সম্পাদক অশোক চক্রবর্তী জানান,
প্ৰথমে কেন্দ্র ১৪৯টা জবরদখল কলোনীকে স্বীকৃতি দেয়, পরে ১৭৫ টা কলোনী, তারপর ধাপে ধাপে ৬০৭টা জবরদখল কলোনীকে স্বীকৃতি দেয় কেন্দ্র। তবে এখনও পর্য্যন্ত প্রায় ১৮০০ কলোনী আছে যারা জবরদখল করে আছে কেন্দ্রীয় বা রাজ্য সরকারের জমি অথবা রায়তি সম্পত্তি যেগুলি এখন স্বীকৃতী পায়নি। এরমধ্যে নদিয়ার রাণাঘাটের মহিলা পিএল এ থাকতেন সরস্বতী রায় তার পরিবারকে নিয়ে। গত দশ বছর হল তিনি গত হয়েছেন। এখন তার ছেলে বিমল রায় ও স্ত্রী সুলেখা রায় এক ছেলেকে নিয়ে থাকে। বিমল রায় জানান মা যখন বেঁচে ছিলেন পরিবারের প্রধান হিসাবে ৩ কেজি করে চাল, ৮ কেজি করে গম দিত। আর বছরে ৩টে করে শাড়ি, সায়া, ব্লাউজ দিত। কিন্তু ১০ বছর হল সেটা বন্ধ হয়ে গেছে। মাঝে ৯ বছর আগে একবার রিলিফ চালু হয়েছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। আমার স্ত্রী লোকের বাড়ি কাজ করে ১৫০০ টাকা পায় সেই টাকা দিয়েই সংসার চলে। আমরা কোনও সাহায্য পাই না। পুনর্বাসন তো দূরের কথা। সরকারের ২টাকা কেজি চালটা শুধু পাই, আর যে আটা দেয় তা খাওয়ার অযোগ্য।
অশোক চক্রবর্তী জানান, নদীয়াতে এরকম উদ্বাস্তু কলোনীর সংখ্যা ১৩৫। যার মধ্যে ৩১টা বর্তমান রাজ্য সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। সারা রাজ্যে ১৮০০ কলোনীর মধ্যে ১৯৮৫ সালে বামফ্রন্ট পরিচালিত রাজ্য সরকার স্বীকৃতি দিয়েছিল ৯৯৮ কলোনীর। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার সেটাকে আর স্বীকৃতি দেয়নি। এরমধ্যে ২০১৮ সালে বর্তমান রাজ্য সরকার উদ্বাস্তু বিভাগটিকে এল আর বিভাগের সঙ্গে যুক্ত করেছে। সেখানে ১৮০০ কলোনীর মধ্যে ৯৪টা কলোনীকে স্বীকৃতি দিয়েছে। তবে স্বীকৃতি পেয়েছে বলে এই নয় যে সব পেয়ে গেছে। ৮০ শতাংশ পরিবার যারা বসবাস করছে তাঁরা না পেয়েছে দলিল, না পেয়েছে জমি।
রাণাঘাট মহিলা ক্যাম্পের গীতা দাস জানান, আমরা চাই সরকার আমাদের ঘর বাড়ি করে দিক আর ভাতার ব্যবস্থা করে দিক। ভোটের সময় আশ্বাস দেয় দেখছি দেখব বলে পারব বলতে পারে না। রেশন দিচ্ছে ৬ মাস করে। ঘর দিয়ে জল পড়ছে। ঐ এলাকারই লিলি রায় খুব ছোটবেলায় বাংলাদেশের কুমিল্লা থেকে এসছিলেন। তিনি জানান, সরকারের কাছে আমরা জায়গা চেয়েছিলাম, পুনর্বাসন চেয়েছিলাম, তা আমরা পাইনি। তাছাড়া এবছর কাপড়, সায়া, ব্লাউজ এখন পাইনি। তবে টাকাটা এই সরকারের আমলে বামফ্রণ্টের আমল থেকে বেড়েছে। মাথা পিছু ২০০০ করে দিচ্ছে। বাম আমলে কিছু জমি, ১৪০০ টাকা দেওয়া হত বাড়ির জন্য, আর ৭০০ টাকা বিজনেস লোনের জন্য আর বর্তমান সরকারের আমলে দেওয়া হচ্ছে ৭০০০ টাকা। তবে এখন ক্যাম্প নেই। ক্যাম্পগুলো সব উঠে গেছে। এখন রাজ্যে ৮টা পিএল হোম আছে। যারা অনাথ, চলাফেরা করতে পারেন না এই ধরণের পরিবারগুলিকে সেখানে রাখা হয়েছে।
ইউ সি আর সি কমিটির কার্যকরী সভাপতি অশোক চক্রবর্তী জানান, এরমধ্যে হুগলি জেলায় ২টি পিএল ভদ্রাকালী পিএল এবং বাঁশবেড়িয়া পিএল, উত্তর ২৪ পরগণা জেলায় অশোক নগর পিএল, আর বাকি পাঁচটা পিএল আছে নদীয়া জেলায়। যারমধ্যে আছে চাঁদমারি পিএল, কুপার্স পিএল, রাণাঘাট মহিলা শিবির, চামটা পিএল এবং ধুবুলিয়া পিএল। ধুবুলিয়া পিএল ক্যাম্পটি ডিফেন্সের জমিতে গড়ে উঠেছে। পরিমাণ অনুযায়ী ধুবুলিয়া ক্যাম্পের জমির পরিমাণ সবচেয়ে বেশি।
নদীয়া জেলায় সরকারী পুনর্বাসন প্ৰাপ্ত কলোনী এখন ৬০টি। কেন্দ্রীয় সরকার অনুমোদিত (১৭৫) গ্রুপভুক্ত জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনী ১০টি। কেন্দ্ৰীয় সরকার অনুমোদিত (৬০৭) গ্রুপভুক্ত জবরদখল উদবাস্তু কলোনী ৬৫ টি। সম্প্রতি রাজ্য সরকার অনুমোদিত (৯৯৮)গ্রুপভুক্ত ও বিশেষ গ্রুপভুক্ত জবরদখল কলোনী ৩১টি, জেলায় এখনও অনুমোদন হয়নি এমন জবরদখল উদ্বাস্তু কলোনী ১০৫ টি এবং বায়নানামা স্কিমের কলোনী ও প্রাইভেট কলোনী ৬৫ টি।