কয়েকদিন আগেই রাজ্যসভায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলের কথা বলেছেন। চলতি অধিবেশনেই হয়তো পাশ হবে ঐতিহাসিক নাগরিকত্ব সংশোধনী। এটি আইনে রূপান্তরিত হলে পাকিস্থান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্থান থেকে ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হয়ে আসা হিন্দু, জৈন, বৌদ্ধ, শিখ, খ্রীষ্টান ও পারসিক সম্প্রদায়ের মানুষেরা এদেশের পূর্ণ নাগরিকত্ব পাবেন। আজকের ভারতবর্ষে এই আইনে সবচেয়ে বেশি উপকৃত হবেন পূর্ববঙ্গ থেকে বিতারিত হয়ে আসা হিন্দু উদ্বাস্তুরা, প্রকৃত অর্থে আন্দোলনের সবকটি দাবীকেই পূরণ করবে। পূর্ব পাকিস্থান, বাংলাদেশ থেকে আসা হতভাগ্য মানুষগুলি স্বাধীনতার এত বছর পরে সোয়াস্তি পাবেন।
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল বাংলা। সে যুগে সারা ভারতবর্ষ থেকে মানুষ এই বাংলায় আসতেন দেশপ্রেমের পাঠ নিতে। অগ্নিযুগের সেই দাবানল কলকাতা থেকে ঢাকা, মেদিনীপুর থেকে চট্টগ্রাম, হুগলী থেকে বরিশাল কিংবা ব্রাহ্মণবেড়িয়ায, সমানভাবে ছড়িয়ে গিয়েছিল। তাই ভারতবর্ষের স্বাধীনতা পূর্ববঙ্গের অর্জিত ধন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, বাঘাযতীন বা মাস্টারদা সূর্যসেনের মতো শত শত বিপ্লবীর জন্মস্থানের যে মানুষ নিজের ধর্মরক্ষার জন্য অত্যাচারিত হচ্ছেন তাঁরা ভারতবর্ষের সম্মানজনক নাগরিকত্ব পাবেন না?
দেশ ভাগের সঙ্গে সঙ্গেই সকলে এদেশে চলে আসেন নি। সাম্প্রদায়িক অত্যাচার এত বিভৎস রূপ নেবে তা অনেকেই বোঝেন নি। পূর্ববঙ্গের প্রতি ছিল তাঁদের গভীর নাড়ীর যোগ। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দেশভাগ হয়ে যাওয়ার পরেও তারা আশাবাদী ছিলেন। উল্লাসকর দত্ত আলিপুর বোমার মামলায় অভিযুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর দ্বীপান্তর হয়েছিল, আন্দামানে সেলুলার জেলে বহুদিন ছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ব্রাহ্মণবেড়িয়ার নিজের গ্রাম কালিকারাতে ফিরে গিয়েছিলেন। কিন্তু বেশী দিন থাকতে পারেন নি। তেমনই রাজশাহিতে কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। বামপন্থী নেত্রী ইলা মিত্র, তাঁর উপর অবর্ণনীয় অত্যাচার হয়। ১৯৫৪ সালে তিনি গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় কলকাতায় চলে আসতে বাধ্য হন।
হাজার হাজার মানুষ বছরের পর বছর ধরে সীমান্ত পার হয়ে এদেশে আসতে বাধ্য হয়েছেন এনারা কেউ অর্থনৈতিক কারণে ভারতবর্ষে আসেননি। দশকের পর দশক ধরে হিন্দুদের উপর লাগাতার অত্যাচার হয়েছে, মেয়ের সামনে মা ধর্ষিত হয়েছেন মায়ের সামনে মেয়েকে কোথাও বা বাড়ির দুর্গামণ্ডপে তিন প্রজন্মকে গণধর্ষিত হতে হয়েছে। ১৯৫০ সালের ৮ এপ্রিল নতুন দিল্লীতে নেহরু লিয়াকত চুক্তিতে ঠিক হয়েছিল দুই দেশ তাদের সংখ্যালঘুদের অধিকার রক্ষা করবে। কিন্তু পাকিস্তান পূর্ববঙ্গে এই চুক্তি রক্ষার কোন চেষ্টা করে নি। ভারত সরকারও এই ভীষণ অত্যাচারকে অন্তর্জাতিক মহলে তুলে ধরতে অক্ষম হয়েছে, তাই লাগাতার অত্যাচার হয়েছে হিন্দু, বৌদ্ধ খ্রষ্টান সম্প্রদায়ের বাংলাভাষী মানুষদের উপর। তাই অবিরত অত্যাচারিত জনপ্রবাহভারতবর্ষে শরণনিয়েছে।
ভারতবর্ষ ছাড়া এই হতভাগ্য হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুদের তো যাওয়ার আর কোন জায়গা নেই। ওপার বাংলায় তাদের অন্নবস্ত্র বাসস্থানের কোন অভাব ছিল না। এনারা ধর্ম পরিবর্তন করে ওপারে থাকতেই পারতেন। কিন্তু তা না করে তারা ধর্ষিতা মেয়ের মুখ চেপে ধরে, গৃহস্থালির যেটুকু সামগ্রী হাতের কাছে পেয়েছেন তা পুটলিতে বেঁধে, রাতের অন্ধকারে সীমান্ত পার হয়ে এই দেশে এসেছেন। যে মানুষটা নিজের চোখের সামনে পরিবারের সদস্যদের খুন হতে দেখে নিজের প্রানটুকু নিয়ে কোন মতে সীমান্ত পার হয়ে এসেছেন, সেই সর্বশ্রান্ত ভাগ্যহতটিও পরের দিন বনগাঁতে তার কোন আত্মীয়ের বাড়িতে প্রিয়জনদের শ্রাদ্ধ করার আগে ম্লান মন্ত্রে বলেছেন, “গঙ্গে চ যমুনে চৈব গোদাবরী সরস্বতী” এত কষ্টের মধ্যেও যারা গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, কাবেরীকে ভোলেননি, ভারতবর্ষের সংস্কৃতির ত্যাগ করবেন না বলেই যারা চোদ্দ পুরুষের ভিটে ত্যাগ করলেন, ভারতবর্ষের নাগরিকত্ব তো তাদের জন্মগতউত্তরাধিকার।
সমগ্র বাংলাকেই পাকিস্তানে নিতে চেয়েছিলেন মহম্মদ আলি জিন্না। ১৯৪৬ সালে ১৬ আগষ্টশহিদমিনার ময়দানে সভা করে সোহরাওয়াদি সাহেব হিন্দুদের বিরুদ্ধে ডায়রেক্ট অ্যাকশানের ডাক দিয়েছিলেন। যার ফলশুতি ছিল “গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং” ঠিক একবছর পরেই ওই সোহরাওয়াদি সাহেব অখন্ড বাংলাকে ভারত ও পাকিস্তানের থেকে আলাদা করে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের কথা বললেন। কলকাতার কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব তাকে সমর্থনও করেছিলেন। তাঁরা বোধ হয় ভুলে গিয়েছিলেন যে ভারতবর্ষে না থাকলে বাংলার না থাকবে শ্রী, থাকবে না অসাম্প্রদায়িক চরিত্রও।
সেদিন বাংলার আকাশে সিঁদুরে মেঘ দেখেছিলেন ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, ভবিষ্যতে ধর্মীয় অত্যাচারের কথা ভেবেই “বেঙ্গলী হিন্দু হোমল্যান্ড মুভমেন্ট শুরু করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সেই ঐতিহাসিক সময়ে নিজেদের রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে ড: মুখোপাধ্যায়ের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন অধ্যাপক মেঘনাদ সাহা, সুচেতা কৃপালিনীর মত অনেক দেশবরণ্য প্রবুদ্ধজন। এই শুভশক্তির অক্লান্ত প্রয়াসে ১৯৪৭ সালের ২০ জুন বঙ্গীয় বিধানসভা ভেঙে পশ্চিমবঙ্গ ও পূর্ববঙ্গ বিধানসভা গঠিত হল। তাই ঐতিহাসিক ভাবে পশ্চিমবঙ্গের জন্মই হয়েছিল, পূর্ববঙ্গ থেকে অত্যাচারিত হয়ে আসা প্রতিটি হিন্দুর স্থায়ীশান্তিপূর্ণ বসবাসের জন্য।
১৯৪৭ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মহাত্মা গান্ধী বলেছিলেন, “পাকিস্তানে যে হিন্দু আর শিখ আছেন, তাঁরা ভারতে আসতেই পারেন। সেক্ষেত্রে ভারত সরকারের প্রথম কর্তব্য তাদের হাতে কাজ দেওয়া আর হতভাগ্যদের জীবনে একটু স্বচ্ছন্দ প্রদান করা। কিন্তু মহাত্মা গান্ধী এবং ড: শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের অকাল প্রয়ানের পরে পূর্ববঙ্গের হিন্দু উদ্বাস্তুদের কথা আর কেউ হৃদয় দিয়ে ভাবেননি।
ছিন্নমূল মানুষ দন্ডকারন্য থেকে আন্দামান, মানা ক্যাম্প থেকে উড়িষ্যার কান্দামালে ছুটে বেড়িয়েছেন একটু আশ্রয়ের সন্ধানে। প্রায় পশুর মত জীবন যাপন করতে হয়েছে। এক উদ্বাস্তু শিবির থেকে শত শত কিলোমিটার দূরে অন্য শিবিরে খোলা ট্রাকে করে তাদের আনা হত। পুরুষ, মহিলা থেকে অসুস্থ শিশু সকলের জন্য এক ব্যবস্থা। মানা ক্যাম্পেমৃতদেহ স্তুপ করে পোড়ানো হত। এত কষ্ট সহ্য করতে না পেরে হিন্দু বাঙালি উদ্বাস্তুরা জোর করে পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করেছিলেন। বসতি স্থাপন করেছিলেন সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিতে। ১৯৭৯ সালের ২৪ জানুয়ারী রাজ্যের পুলিশ শতশত নিরস্ত্র, অসহায় উদ্বাস্তুকে গুলি করে হত্যা করেছিল। তারপর সেখান থেকে তপশিলি জাতিভুক্ত উদ্বাস্তু পরিবারগুলিকে ঘাড় ধরে বের করে দেওয়া হয়েছিল। উদ্বাস্তুরা সেদিন বঝেছিলেন, কেউ কথা রাখেনি, কেউ কথা রাখে না।
এই প্রথম ভারত সরকার কথা রাখলেন। কথা দিয়েছিলেন গভর্নর জেনারেল অফ ইন্ডিয়া দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে। কথা ছিল সব অত্যাচারিত মানুষ ভারতে এলে নাগরিকত্ব পাবেন। প্রশ্ন হল কতদিন পর্যন্ত পাবেন? সহজ উত্তর যতদিন না সীমান্তের ওপারে বাঙালি হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রীষ্টানের উপর অত্যাচার বন্ধ হবে। ১৯৬৪ সালে ১৬ জানুয়ারী ঢাকার, নেটরডাম কলেজের অধ্যাপক ফাদার রিচার্ড নোেভক নারায়ণগঞ্জেও হিন্দুদের গণহত্যার খবর নিতে গিয়ে মৌলবাদীদের হাতে খুন হলেন। ১৯৬৪ সালে ঢাকার মার্কিন দূতাবাসের কনসোল জেনারেল হিন্দু হত্যার বর্ণনা দিয়ে তাঁর শিহরন জাগানো “ব্লাড টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন। যার অর্থ ১৯৭১ সালেও প্রতিশ্রুতি রক্ষার প্রয়োজন ছিল। আবার ২০০১ সালে ১৯ অক্টোবর সিরাজগঞ্জের ১৩ বছরের পূর্ণিমা শীলের উপর অত্যাচারের দিন বা ১৬ নভেম্বর চট্টোগ্রামের নাজির হাট কলেজের অধ্যাপক গোপালকৃষ্ণ মুহুরীর নির্মম হত্যার ঘটনায় আবার মনে হয়েছে ভারতের দায়বদ্ধতা শেষ হয়ে যায়নি। ২০০১ সালে এমনই শতশত ঘটনার প্রতিবাদে মুখর হয়েছে “বাংলাদেশ হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান ঐক্য পরিষদের ” মতো অনেক সংগঠন। তাই অত্যাচারিত উদ্বাস্তুর জন্য ভারতের দায়বদ্ধতা ২০০১ সালেও ছিল। সঠিক নাগরিকত্ব দেওয়া হয়নি বলেই তো, উদ্বাস্তুদের পরিচয় লুকোতে হয়। অসাধু পুলিশকর্মীর সহজ শিকার হতে হয় অসহায়ভাগ্যহত মানুষদের।
বর্তমান, কেন্দ্রীয় সরকার দেশভাগের পরে গভর্ণর জেনারেল অফ ইন্ডিয়ার দেওয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করছেন মাত্র। নির্যাতিতদের নাগরিকত্ব দেওয়া সাম্প্রদায়িকতা নয় মানবিকতা।
নাগরিকত্ব সংশোধনীবিল, ২০১৯ এর প্রস্তাবনা অভূতপূর্বকিছু নয়, স্বাভাবিক মানবিক প্রয়াস। রাষ্ট্রসঙ্ঘের উদ্বাস্তু বিষয়ের নিয়ামক সংস্থার নাম “ইউনাইটেড নেশনস হাইকমিশন ফর রিফিউজিস” (UNHCR) ১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন এবং ১৯৬৭ সালের উরুগুয়ে প্রোটোকল অনুসারে ইউ.এন.এইচ.সি.আর. উদ্বাস্তুর সংজ্ঞা নিরূপন করেছে। সেই সংজ্ঞা হিসাবে, “জাতি, ধর্ম, রাষ্ট্রীয় পরিচয়, রাজনৈতিক অভিমত বা কোন সামাজিক সংগঠনের সদস্য হিসাবে নিদারুন অত্যাচারের শিকার হয়ে, কোন ব্যক্তি যদি নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয় তবে তিনি দ্বিতীয় দেশে উদ্বাস্তু বা শরণার্থী।” নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে পাকিস্তান, বাংলাদেশ আর আফগানিস্থান থেকে ধর্মীয় কারণে নির্যাতিত হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, শিখ, খ্রষ্টান ও পারসিকসম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষার কথাই বলা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের মানুষ তো চোখের সামনেই দেশভাগের করুণ পরিণাম দেখেছেন। অত্যাচারিত বাঙালি হিন্দুর প্রাপ্য নাগরিকত্বের সঙ্গে অন্য কোন বিষয় বা শর্ত যোগ করাটা কেবল ভুলই নয় মহাপাপ হবে। এতগুলো বছর সীমান্তের ওপারে থাকা মানুষেরা তো বাংলা ভাষাতেই আর্তনাদ করতে করতে জীবন্তদগ্ধ হয়েছেন। এদের দুঃখ পশ্চিমবঙ্গের মানুষ না বুঝলে দেশের আর কে বুঝবে? কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বা বাণিজ্যিক স্বার্থে বাঙালি বাঙালির সঙ্গে এতবড় বিশ্বাসঘাতকতা করবেনা।
‘আত্মঘাতীবাঙালি’ আজ অনেক বেশী সচেতন।
জিষ্ণু বসু
2019-12-30