ভূমিকা
সুপ্রীম কোর্টে নাগরিকপঞ্জী মামলায় রায় দিতে গিয়ে জাস্টিস ফলি নরিম্যান মন্তব্য করেছেন দেবালয়ে যদি দেবতাব সম্মান না থেকে তার থেকে বেশী দুঃখজনক কিছু হতে পারে না। ঠিক তেমনই যদি কোন দেশের নাগরিকের সেই দেশে সম্মান না থাকে তাহলে তা একই রকম দুঃখজনক ও মর্মান্তিক।
এই বক্তব্যের মধ্যে দিয়েই বোধহয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রয়োজনীয়তা সম্যক উপলব্ধি করা যায়। ভারতবর্ষ স্বাধীন হয়েছিল তার মাথার উপরে বিশাল সংখ্যক উদ্বাস্তুর বোঝা নিয়ে। ভারতবর্ষকে পরাধীন রাখার সব চক্রান্ত যখন ব্যর্থ হয় তখন শেষ অস্ত্র হিসাবে গান্ধীজির নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস এবং মহম্মদ আলি জিন্নাহকে পাশে নিয়ে ইংরেজরা সিদ্ধান্ত নেন দেশভাগের। সেই সিদ্ধান্তের পুরোটাই হয় কতিপয় বাবুর খেয়ালী মানসিকতার ভিত্তিতে। যার জেরে হিন্দু অধ্যুষিত সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, সিলেট চলে যায় তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে। উদ্বাস্তু হন এই অঞ্চলের হিন্দুরা। বাংলা এবং পাঞ্জাব যে দুটি রাজ্যের মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাদের রক্তের ধারায় আঁকা হয় পাকিস্তান এবং ভারতের সীমা।
বাঙালী স্বাধীনতার জন্য রক্ত ঝড়িয়ে,ফাঁসির দড়িতে ঝুলে, ব্রিটিশ পুলিশের গুলি খেয়ে, গুলি মেরে, বোমা মেরে, জেলে অত্যাচার সহ্য করে, সেলুলার জেলে বন্দী থেকে উপহার পেল এক খন্ডিত ভূমি। সেই ভূমির এক খন্ডে তার মর্যাদা হল দ্বিতীয় শ্রেনির নাগরিকের। সেখানে তাদের নাম হল মালাউন অর্থাৎনিকৃষ্ট জীব। দেশভাগের পরেও পাঞ্জাবের যে অংশটি ভারতবর্ষে রয়ে গেল তা পাকিস্তানে যাওয়া অংশের প্রায় সমান। আর পাঞ্জাবের উদ্বাস্তুরা সরকারী সাহায্যও বেশী পেয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গে অবস্থা এর সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল। সেখানে আসা উদ্বাস্তুদের ঠাঁই হল আন্দামানেনাহলে দন্ডকারণ্যের ক্যাম্পে। খাওয়ার জন্য জুটল পোকাধরা চাল। এমনকি যে রাজনৈতিক দলটি উদ্বাস্তু রাজনীতির উপরে নির্ভর করেইক্ষমতায় এলো তাদের কাছেও ক্ষমতায় আসার পরে উদ্বাস্তুদের থেকে ব্যাঘ্র সংরক্ষণ অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল। মরিচঝাঁপিতে গুলি করে মারা হল অসহায় উদ্বাস্তুদের যারা বাঁচার লড়াইটা আবার নতুন করে শুরু করতে চেয়েছিল। দীর্ঘদিন ধরে এই পরিস্থিতি দেখে কারুর পক্ষেই খুব সহজ ছিলনা পূর্ব বাংলায় নিজেদের জমি, বাড়ি, পরিচিত গন্ডী ছেড়ে এপারে এসে উদ্বাস্তু হওয়া। এদের অনেকেও আবার ১৯৭১ এ দেশ ছাড়তে বাধ্য হলেন। এমনকি স্বাধীন বংলাদেশ গঠন হওয়ার পরেও যে হিন্দুরা ফিরে গেলেন তারা দেখলেন তাদের জন্য পরিস্থিতি একই রয়ে গেছে। তারা পূর্ব পাকিস্তানেও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক ছিলেন। বাংলাদেশেও তাই রইলেন। তাদের সামাজিক অবস্থানের কোন পরিবর্তন হয়নি। কেউ হয়ত প্রশ্ন তুলবেন তখনও তারা কেন এপারে বা পশ্চিমবাংলায় চলে এলেন না। এর উত্তর আছে আমাদের সংবিধানে। কেন তারা পশ্চিমবাংলায় আসতে সাহস পেলেননা এত কিছু পরেও, তার উত্তর লুকিয়ে আছে আমাদের দেশের অথাৎ ভারতবর্ষের তিনটি আইনে। ১৯২০ সালের পাসপোর্ট এ্যক্ট,১৯৪৬ সালের ফরেনার্স এ্যক্ট বা বৈদেশিক ব্যক্তি আর আইন ১৯৫৫ সালের নাগরিক আইনে। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন অথবা নাগরিকপঞ্জী নিয়ে আলোচনা পূর্বে এই তিনটি আইন নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন আছে। ভারতের সংবিধান-শরনার্থীর অধিকার অস্বীকার ভারতবর্ষের নাগরিকত্বের বৈধতা নির্ণয়ে সাধারণত তিনটি আইনের সাহায্য নেওয়া হয়
১৯২০ সালের পাসপোর্ট (ভারতে প্রবেশাধিকার) আইন
১৯৪৬ সালের ফরেনার্স এক্ট বা বৈদেশিক ব্যক্তি আইন
১৯৫৫ সালের নাগরিকত্ব আইন
১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন মোতাবিক যে কোন ব্যক্তি বৈধ ভিসা এবং পাসপোর্ট ছাড়া ভারতবর্ষে জল, স্থল বা আকাশ পথে প্রবেশ করলে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গণ্য করা হবে এবং এই আইন মোতাবেক তাকে গ্রেপ্তার করা যেতে পারে। বিচারে দোষী সাব্যস্ত হলে তার এক থেকে পাঁচ বছরের জেল হতে পারে সাথে দশ হাজার টাকা থেকে শুরু করে পঞ্চাশ হাজার টাকার জরিমানা।
১৯৪৬ সালের ফরেনার্স এ্যক্ট অনুযায়ী কোন ব্যক্তি যদি বিদেশী হিসাবে চিহ্নিত হন এবং তিনি যদি বৈধ কাগজপত্র ছাড়া ভারতবর্ষে প্রবেশ করে থাকেন তাহলে তার বিচার হবে।
লক্ষণীয় বিষয় হল কোন ক্ষেত্রেই শরণার্থী আর অনুপ্রবেশকারীকে আলাদা করে চিহ্নিত করা হয়নি। তাদের একই পংক্তিতে রাখা হয়েছে। যে দেশটি স্বাধীন হল লক্ষ লক্ষ উদ্বাস্তুকে নিয়ে তাদের আইনেই উদ্বাস্তু বা শরণার্থীদের জন্য কোন বিশেষ অধিকার রইলনা। শরণার্থী এবং অনুপ্রবেশকারী দুই ক্ষেত্রেই একই নিয়ম। ভাবখানা হল ১৯৫১ সালের নেহেরু লিয়াকত চুক্তির পরে পাকিস্তানে আর কোন মানুষ অত্যাচারিত হবেননা ধর্মীয় সংখ্যালঘু হওয়ার জেরে। কিন্তু বাস্তবেও কি তাই তাই হল? যদি তাই হত তাহলে পাকিস্তানের অন্যতম সমর্থক যোগেন মন্ডলকে নিজের পদত্যাগ পত্র ভারতবর্ষে বসেলিখতে হতো না।
১৯৭৫ এ সংবিধান বদলে সংবিধানকে সেকুলার করা হল। কিন্তু সংবিধানে উদ্বাস্তু বা রিফিউজিদের অস্তিত্ব স্বীকার করা হলনা। ভাবখানা হল কটা কালো কালো বাঙালি হিন্দু যারা সব কিছুর পরেও মাটি কামড়ে রয়ে গেল তাদের কি হল না হল তা নিয়ে কারুর কিছু যায় আসেনা। এমনকি বাঙালী হিন্দুদের হোমল্যান্ড যে পশ্চিমবঙ্গ, সেখান থেকেও কোন দাবী উঠল না। এক কথায় আমাদের বোঝাতে চাওয়া হল ‘আল ইজ ওয়েল’। সেই ওয়েল যে আদতে এক গভীর কুয়ো যেখানে চাপা দেওয়া হল বাঙালী হিন্দুদের আর্তনাদকে সে কথা কেউ বললনা। কোন বুদ্ধিজীবী না, কোন শহুরে বাবু না। আসলে বাংলাদেশে তখনও যারা পরে ছিল তাদের ৯৯ শতাংশই হল হতদরিদ্র তপসিলি জাতির মানুষ। তাই তাদের নিয়ে শহুরে বাবুদের কোন মাথা ব্যথারইল না।
দেশভাগের সময়ে কি কি হয়েছে তা নিয়ে শব্দ খরচা করে আর লেখা দীর্ঘ করছিনা। এমনকি ১৯৭১ এ কি কি হয়েছে তা নিয়েও শব্দ খরচা করছি না। যতই পন্ডিত প্রবর আমাদের বোঝানোর চেষ্টা করুন যে ওখানে একটা ব্যাপার হয়েছিল যাকে ‘ভূমিসংস্কার’ বলা যেতে পারে, আমরা জানি ওখানে আসলে কি হয়েছিল। তার জন্য যোগেন মন্ডলের চিঠি আছে। শিয়ালদা স্টেশনে অনাহারে মারা যাওয়া শিশুর বেওয়ারিশ লাশের গাদায় পরে থাকা ছবি আছে বা এসব যদি “ওনাদের কথা মতো সাজানো বলেও ধরে নিই তাহলেও ঋত্বিক ঘটকের সিনেমাগুলো আছে। সেগুলো শিয়ালদা স্টেশনে শুরু হলেও আমরা জানি তারা কোথা থেকে এসেছিল আর কেনই বা এসেছিল। আমরা জানি আসলে তারা বাঁচতে চেয়েছিল। তাই সব হারিয়েও নিজেদের ধর্ম ছেড়ে দিতে পারেনি। এসব নিয়ে অনেক কথা লেখা হয়েছে। তথাগত রায় তার “যা ছিল আমাদের দেশ” বইতে বিশদে সে সব তথ্য তুলে ধরেছেন। তাই এসব নিয়ে আরশব্দ খরচা করছিনা। বরং একটু দেখা যাক এত কিছুর পরেও, দেশের স্বাধীনতার জন্য প্রাণ দেওয়ার পরেও যারা দেখলেন যে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম করা হল। শত্রু সম্পত্তি আইনকে অর্পিত সম্পত্তি আইনে রুপান্তরিত করে হিন্দুদের ২৫ লক্ষ হেক্টর জমি কেড়ে নেওয়া হল, তারপরে যারা নিজেদের নিজেদের ভিটে মাটি কামড়ে পড়ে রইলেন তাদের সাথে কি হল। কয়েকটি সেরকম ঘটনার বিবরণ তুলে ধরলেই পরিস্কার হয়ে যাবে কি হয়েছিল“একই বৃন্তে দুটি কুসুমের’ভবিষ্যৎ।
দৈনিক জনকণ্ঠের প্রকাশিত ৩রা জানুয়ারি, ২০০৩ এর সংবাদ থেকে জানা যাচ্ছে স্ত্রীকে উত্ত্যক্ত করার প্রতিবাদ করায় এক বখাটে যুবকের হাতে প্রাণ দিতে হয় অতুলকৃষ্ণ মন্ডলকে (৫০)। ঘটনাটি ঘটে যশোরের অভয়নগর উপজেলার রামসাড়া গ্রামে। গ্রামবাসীদের বয়ান অনুযায়ী অতুলকৃষ্ণের স্ত্রীকে দীর্ঘদিন ধরে উত্ত্যক্ত করছিল এক যুবক। অতুল যুবকের পিতাকে জানালে যুবকটি ধারালো অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে এবং সেই আক্রমণেনিহত হন অতুল।
কি বলবেন এরকম তো ঘটেই। এর সাথে সংখ্যালঘু বা সংখ্যাগুরুর কোন যোগ নেই। বেশ তাহলে পরের ঘটনার দিকে তাকানো যাক।
দৈনিক জনকণ্ঠের ১লা জুলাই ২০০৫ এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী জানা যাচ্ছে প্রভাবশালী বিএনপি নেতা ও ইউপি চেয়ারম্যান শামসুদ্দিন আহমেদের লাঠিয়াল বাহিনীর আক্রমণে ভিটেহারা হয় পার্বতীপুরের বড়দল খাঁ গ্রামের প্রায় দেড়শ আদিবাসী পরিবার। মিনতি সরেন ও সুখি মুর্মুর বয়ান থেকে জানা যায় উচ্ছেদের আগে তাদের নোটিশ অব্দি দেওয়া হয়নি। এনজিওর ঋণ নিয়ে সমিতির মাধ্যমে ছয়টি বড় পুকুরে মাছ চাষ, বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট এবং কৃষিকাজের মাধ্যমে আদিবাসীরা তিলে তিলে গড়ে তুলেছিল বসতবাড়ি। সরকারের ছয় একর জমির দরকার ছিল ঐ অঞ্চলে। পাশের রাধানগর মৌজায় প্রায় আট একর খালি জমি থাকলেও চেয়ারম্যান সাহেবের নজর পরে এই আদিবাসী গ্রামটির উপরেই।
পন্ডিত প্রবর কথিত “ভূমিসংস্কারটি”১৯৪৭ বা ১৯৭১-এনয় ঘটেছে ২০০৫ সালে।
বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টানদের উপর এরকম অত্যাচারের ঘটনা হাজার হাজার। খুব সম্প্রতি ইসকন মন্দিরকে দেওয়াহুমকিগুলোর কথা নিশ্চয় সবার মনে আছে।
বিএনপি আমল হোক বা আওয়ামি লীগের সরকার, সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার চলেই যাচ্ছে। এবার বলুন, এই অত্যাচারিত সংখ্যালঘুরা যারা নিজেদের ভিটে মাটি আঁকড়ে থাকার সব রকম চেষ্টা চালিয়েও দেশ ছাড়তে বাধ্য হচ্ছেন তারা কোথায় যাবেন? কোথায় ঠাঁই পাবেন তারা?
তাদের আসার একটাই জায়গা, পশ্চিমবঙ্গ। বাঙালিহিন্দুদের হোমল্যান্ড। এই কথার মধ্যে যিনি সাম্প্রদায়িকতা খুঁজে পাবেন তাকে সবিনয়ে মনে করিয়ে দেব “বাঙালি”মুসলিমরা তাদের নিজস্ব হোমল্যান্ড হিসাবে বাংলার দুই তৃতীয়াংশ জমি সেই ১৯৪৭ সালেই নিয়ে নিয়েছে। কিন্তু বাঙালি হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গে এলে কি ধরনের অভ্যর্থনা পাবেন? তারা কি শরণার্থীর মর্যাদা পাবেন নাকি তাদেরকে অবৈধঅনুপ্রবেশকারী বলেই গণ্য করা হবে?
এক কথায় উত্তর এই ২০১৫ সাল অব্দি তারা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলেই গণ্য হতেন। কারন ভারতীয় সংবিধানের ১৯৫৫ সালে নাগরিকত্ব আইনের সেকশান ৩ (২) (খ) অনুযায়ী এদের সবাইকেই “এলিয়েন” বা অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলেই গণ্য করা হোত। ১৯৪৬ ফরেনার্স এক্ট এবং ১৯২০ পাসপোর্ট এক্ট অনুযায়ী এদের গ্রেপ্তার করা যায়। ২০১৫ সালে এই দুটি আইনের সংশোধন করে বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্থান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ খৃষ্টান, জৈন ও পার্সীদের এই দুটি আইনের আওতা থেকে ছাড় দেওয়া হয়েছে। এরা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীনন। এদের এদেশে চাকরি, বসবাস ও সম্পত্তি ক্রয়ের অধিকার দেওয়া হয়েছে লং টার্ম ভিসার পদ্ধতিতে পরিবর্তন করে। শহুরে মানবতাবাদীরা কান্নকাটি করতেই পারেন কেন মায়ানমারের রোহিঙ্গারা একই অধিকার পাচ্ছেনা বলে। কিন্তু তাদের মনে রাখা উচিত রোহিঙ্গা মুসলিমরা রোহিঙ্গা হিন্দুদের গণহত্যার জন্য দায়ী। এমেনেস্টি ইন্টারন্যাশানলও মেনে নিয়েছে রোহিঙ্গা মুসলিমরা রোহিঙ্গা হিন্দুদের গণহত্যা করেছে। শরণার্থীর সম্মান শুধু তারাই পেতে পারে যারা নিজেরা অত্যাচারিত। যারা অন্যকে অত্যাচার করে তারা নয়।
১৯৭১ এর পরের সময়টাকে মোটামুটি ভাবে পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়। ১৯৭১ থেকে ১৫ ই অগাস্ট ১৯৭৫ অর্থাৎ মুজিবের হত্যা পর্যন্ত। দ্বিতীয়—১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬ সাল অর্থাৎ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের মন্ত্রীসভার গঠন পর্যন্ত। তৃতীয় ১৯৯৬ থেকে ২০০১ অর্থাৎ শেখ হাসিনার প্রথম প্রধানমন্ত্রীকাল। চতুর্থ ২০০১ থেকে ২০০৯ পর্যন্ত। এবং পঞ্চম ২০০৯ থেকে বর্তমান অর্থাৎ শেখ হাসিনার দ্বিতীয় দফা।
এই পাঁচটি ভাগে ভাগ করার মূল কারন হল বাংলাদেশেরশাসনভার কার হাতে আছে তার উপরে নির্ভর করে সে দেশের হিন্দু, বৌদ্ধ এবং খ্রীষ্টানদের নিরাপত্তা। আরেকটু ব্যাখ্যা করলে বলতে হয় শাসনভার আওয়ামী লীগের হাতে না আওয়ামী লীগ বিরোধীদের হাতে তার উপরেই নির্ভর করে বাংলদেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের মাত্রা। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সময় শেখ মুজিব ঘোষণা করেছিলেন ধর্মনিরপেক্ষতাই হবে বাংলাদেশের মূল ভিত্তি। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের ভীত, সন্ত্রস্ত, বিপদগ্রস্থ ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা প্রতিটি ভোটেই চোখ বুজে আওয়ামী লীগকে সমর্থন দিয়েছে। ফলে তারা আওয়ামী লীগবিরোধী দলগুলির চক্ষুশূল হয়েছে এবং যখনই বিএনপি জামাত জোট ক্ষমতায় এসেছে হিন্দুদের উপর অত্যাচার আবার প্রায় পাকিস্থান আমলের মাত্ৰাস্পর্শ করেছে।
এই নয় যে আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা খুব সুখে শান্তিতে থেকেছে। এমনও নয় যে তাদের সম্পত্তি হরণে আওয়ামী লীগ নেতারাপিছপা ছিলেন বা ধর্মভিত্তিক ভেদাভেদ করেন না। কিন্তু তাও আওয়ামী লীগ আমলে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপরে অত্যাচার অপেক্ষাকৃত কম হয়েছে।
ফ্রাংকোয়েস গৌতিয়ের নামক ফ্রান্স দেশীয় লেখকের ২২শে মে ২০০ সালে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস, মুম্বাই এডিশানের ‘ফিরিঙ্গি কলামে’ পরিসংখ্যানে দিয়ে দেখানে হয়েছে ১৯৪১ সালে পূর্ব পাকিস্তান বা বর্তমানের বাংলাদেশের হিন্দু জনসংখ্যা যেখানে ছিল ২৯ শতাংশ। ১৯৭৪ সালে তা দাঁড়ায় ১৩.৫শতাংশে। আর বর্তমানে তা দাঁড়িয়েছে৮.২ শতাংশে।
৯২ এর অক্টোবরে একটি গোপন সরকারী সার্কুলার দ্বারা ব্যাঙ্কগুলোকে বলা হয়েছিল হিন্দুদের যাতে শিল্প বা বানিজ্যিক ঋণ না দেওয়া হয় এবং তাদের স্থায়ী আমানতের টাকাও যেন তারা অবাধে তুলতে না পারে। সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে অলিখিত বিধিনিষেধ আগে থেকে যা ছিল খালেদা সরকার তা নিষ্ঠার সাথে অনুসরণ করে। বি এন পির সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের নগ্নরূপ ধরা পরেছে ৯৬ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। হিন্দুপ্রধান এলাকাগুলিতে ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন করে শারীরিক নির্যাতন চালিয়ে তাদের ভোট গ্রহণ কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি। প্রায় সাত থেকে আট লক্ষ হিন্দুকে তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে দেওয়া হয়নি। (বাংলাদেশের মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা)
এই বিষয়ে প্রকৃত কথাটি বলেছেন বাংলাদেশের আরেক লেখক সালাম আজাদ। তার লেখা বই “হিন্দু সম্প্রদায় কেন দেশত্যাগ করছে” বইতে তিনি লিখেছেন “বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত একটিও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়নি। তবে কি হয়েছে—এ দেশের হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার হচ্ছে, নির্যাতন চালানো হচ্ছে—তা কি দাঙ্গা নয়? দাঙ্গা হয় দুই পক্ষে। কিন্তু এখানে এক পক্ষ নীরব থেকেছে, মার খেয়েছে মুসলিম সম্প্রদায়ের মৌলবাদী গোষ্ঠীর হাতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই ঘটনাকে কোন ভাবেই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বলা উচিত নয়। সাম্প্রদায়িক হামলা, সাম্প্রদায়িক নির্যাতন বলাই যৌক্তিক।
১৯৯০ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকার ঐতিহ্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত বহু শতাব্দী প্রাচীন ঢাকেশ্বরী মন্দির ধবংস করা হয়। মূল মন্দিরটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। নাটমন্দির, শিবমন্দির, অতিথিনিবাস ও মন্দির সংলগ্ন শ্রীদাম ঘোষের বাড়িতেও আগুন লাগানো হয়। শাঁখারী বাজার সংলগ্ন হিন্দুদের দোকান ধবংস করা হয়।
এক বীভৎস হত্যাকান্ড ঘটেছিল ব্রাহ্মণবেড়িয়া জেলা এবং থানার অন্তর্গত হরষপুর ইউনিয়নের নিদারাবাদ গ্রামে, ৬ই সেপ্টেম্বর ১৯৮৯ তারিখে। এই ঘটনার বীভৎসতা এতোটাই ছিল যে আজও বাংলাদেশের হিন্দুদের ভয় দেখানোর জন্য বলা হয়, “নিদারাবাদ বানায়ে দিমু”। ঠিক যেমন আমাদের দেশের বামপন্থীরা বলেন, “বিজন সেতু করে দেব।
গ্রামের যুগী সম্প্রদায়ের শশাঙ্ক দেবনাথের জমির উপর স্থানীয় কিছু মুসলমানের লোভ ছিল। তারা শশাঙ্ককে চাপাচাপি করছিল সামান্য টাকায় জমি বিক্রি করে দিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার জন্য। শশাঙ্ক রাজী না হওয়ায় ১৯৮৭ সালের ১৬ই অক্টোবর তারিখে তাজুল ইসলাম, নজরুল ইসলাম, হবিবুর রহমান, আজিজুর রহমান ও আরো কয়েকজন মিলেশশাঙ্কের বাড়িতে চড়াও হয় এবং তাকে ডেকে নিয়ে গিয়ে খুন করে। তারপর তাজুল ইসলাম এক জাল দলিল বানিয়ে দাবী করে যে শশাঙ্ক তার জমি তাজুল এবং মৌলবী ইব্রাহিম নামক একজনকে বিক্রি করেছে। কিন্তু এতদসত্ত্বেও শশাঙ্কর বিধবা স্ত্রী বিরজাবালা জমি ছাড়তে রাজী হননি। শুধু তাই নয়, বিরজাবালা তাজুলের বিরুদ্ধে শশাঙ্ককে খুন এবং দলিল জাল করার জন্য পুলিশে নালিশ লেখান। ইতিমধে মৌলবী ইব্রাহিম আদালতে এক হলফনামা জমা দিয়ে জানান যে তিনি শশাঙ্কের কাছ থেকে কোন জমি কেনেননি। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে ১৯৮৮ সালের ৫ই মার্চ তাজুল তার দলবল নিয়ে বিরজাবালা ও তার পুত্র সুভাষ (১৩), সুমন (৭) ও সুজন (৩) এবং কন্যা মিনতি (১৭) ও প্রণতি (১১) কে অপহরণ করে এবং নিকটবর্তী ধোপাবাড়ী খালে নিয়ে গিয়ে খুন করে। খুন করার পরে তাদের মৃতদেহ খণ্ড খণ্ড করে চুন সহযোগে ড্রামে ভর্তি করে এবং খালের নীচের পাঁকে সেই ড্রাম পুঁতে রাখে। (হিন্দু সম্প্রদায় দেশত্যাগ করছে কেন বইতে উল্লিখিত ঘটনা, পৃ৪৫)
দৈনিক জনকণ্ঠের ১৫ই অক্টোবর ২০০১এর প্রতিবেদনে জানা যাচ্ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে নির্বাচন পরবর্তী কয়েকদিনের মধ্যে প্রায় ৫০ জন সংখ্যালঘুছাত্রীরা কলেজ স্কুলে যেতে পারছেনা।
এরকম আরও অজস্র ঘটনার বিবরণ লেখা যেতে পারে। কিন্তু তাতে লেখা দীর্ঘায়িত, হৃদয় ভারাক্রান্ত হওয়া ছাড়া অন্য কিছুই হবে না। কারণ মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের বিচার পাওয়ার আশা দুরস্ত। এবার হয়ত প্রশ্ন উঠতে পারে যে হিন্দুরা দেশভাগের পরেও নিজেদের ভিটে মাটি ছেড়ে চলে আসতে চাননি তারা কেন পরে পরে মার খেলেন। কেন তারা পাল্টা প্রতিরোধে গেলেন না। তারা পাল্টা প্রতিরোধ এই কারণেই করতে পারেন নি কারন তাদের উপরে ইসলামিক মৌলবাদীরা হামলা চালিয়েছিল রাষ্ট্রের সহযোগিতায়। সম্পূর্ণভাবে রাষ্ট্রীয় মদতেই তাদের উপরে অত্যাচার চলেছিল। সেই রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসকে প্রতিহত করার ক্ষমতা এইগরীব মানুষগুলির ছিলনা।
হে পাঠকগণ আপনারাই বলুন এই অত্যাচারিত হিন্দুরা আর কোথায় যেতে পারতেন ভারতবর্ষ ছাড়া? সবার পক্ষে তো প্রিয়া সাহার মতো আমেরিকা গিয়ে ট্রাম্পের কাছে বাস্তব পরিস্থিতি জানানো সম্ভব নয়। তাহলে তারা কোথায় যাবেন? বিশেষত হত দরিদ্র সেই সব মানুষরা যারা ১৯৪৭, ১৯৫০,১৯৬৪, ১৯৭১ এর সব রকম ঝড় ঝাপটা সামলেও নিজেদের ভিটে মাটি আঁকড়ে পরেছিলেন দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে। তারা যখনউদ্বাস্তু হতে বাধ্য হন তখন তারা কোথায় যেতে পারতেন আর ভারতবর্ষ তথা পশ্চিমবঙ্গ ছাড়া?আর কোন অজানারাউদ্দেশেই তারা পাড়ি দিতে পারতেন।
নাগরিকত্ব সংশোধনীআইনের প্রয়োজন
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রয়োজন এই অনুপ্রবেশকারীদের মধ্যে থেকে শরণার্থীদের আলাদা করার জন্য। একজন বাংলাদেশি হিন্দু যিনি ১৯৪৭ বা ১৯৭১ এও নিজের দেশ ছেড়ে আসেননি তারা যখন পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতবর্ষে আসছেন তারা কখনই অবৈধ অনুপ্রবেশকারী নন। কারণ বাংলাদেশে তারা দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। সেদেশের কোন সরকারই তাদের নিরাপত্তাবোধ দিতে পারছেনা। তাই অসহায় অবস্থায় এসে তারা ঠাই নিচ্ছেন ভারতবর্ষে।
১৯৫১ বা ১৯৭১ কে স্বাভাবিক নাগরিকত্বের সময়সীমা হিসাবে এই কারনেই হিন্দুদের উপর ধার্য করা সম্ভব নয়। কারণ এরপরে স্বাধীন বাংলাদেশেও তারা একই ভাবে অত্যাচারিত হয়ে চলেছে। সুতরাং একজন মুসলিম যিনি ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পক্ষে ছিলেন এবং এখন বাংলাদেশে প্রথম শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদা পান শুধুমাত্র সেখানে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু হওয়ার কারণে, তিনি যে কারনে ভারতে আসছেন একজন হিন্দু, বৌদ্ধ বা খৃষ্টান সেই কারণে ভারতে আসছেন না। মুসলিমরা আসছেন সুযোগের খোঁজে, হিন্দুরা আসছেন বাঁচার তাগিদে। নিজেদের ধর্ম পরম্পরা, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং সর্বোপরি নিজেদের এবং পরিবারের জীবনরক্ষার তাগিদে।
এমত অবস্থায় ২০১৫ সালে ভারত সরকারের আনা কয়েকটি পদক্ষেপ যা নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের প্রাক পর্যায় তা যথেষ্ট ইতিবাচক। কারণ এগুলির দ্বারা এইশরণার্থীদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারীদের থেকে আলাদা করা হয়েছে।
২০১৫ সালে ভারত সরকার দুটি আইনে কিছু পরিবর্তন আনেন। এক ১৯২০ সালের পাসপোর্ট আইন (ভারতে প্রবেশাধিকার) এবং ১৯৪৬ সালের বৈদেশিক ব্যক্তি আইন বা ফরেনার্স এক্ট এবং ১৯৫০ সালের পাসপোর্ট আইনে।
এক গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে ভারত সরকার জানচ্ছেন—
পাসপোর্ট এমেন্ডমেন্ট আইন ২০১৫ এর মাধ্যমে পাসপোর্ট আইন ১৯৫০ এর রুল ৪,সাব-রুল ১ ক্লজ (h) রে পরে (ha) ধারায় পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, শিখ, জৈন, পার্সি এবং খৃষ্টান সম্প্রদায়ের লোক যারা ধর্মীয় অত্যাচারের শিকার হয়ে বা ধর্মীয় অত্যাচারের ভয়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন এবং ভারতবর্ষে ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪তে বা তার পূর্বে এসেছেন কোন বৈধ প্রমাণপত্র ছাড়া, তাদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলা যাবে না। তাদের শরণার্থী হিসাবে গন্য করা হবে। ২০১৫ সালে লোকসভায় এই সংশোধনী লোকসভায় পাশ হয়। যেহেতু এই সংশোধনী রাজ্য সভায় পাশ করানোর প্রয়োজন ছিল না তাই শুধু মাত্র লোকসভাতে পাশ হওয়ার দরুনই এই সংশোধনী বলবত হয়। এরই পরবর্তী ধাপ হিসাবে আনা হয় নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন ২০১৬। যা লোকসভায় পাশ হলেও আটকে যায়। রাজ্যসভায়। এই আইনেই কিছু পরিমার্জন করে এবার আনা হচ্ছে নাগরিকত্ব সংশোধনীআইন, ২০১৯।
এই সংশোধনীর মূল বিষয়গুলি একবার আলোচনা করা যাক।
প্রথমেই বলা ভালো এই আইন মোতাবেক যারা ইতিমধ্যেই ভারতে ছয় বছরের বেশী সময় ধরে আছেন তারা প্রত্যেকেই নাগরিকত্বের অধিকারী। এখানে বলা হয়েছে—
“এই সংশোধনী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্থান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, শিখ, জৈন, পার্শীদের তাদের ভারতবর্ষের প্রবেশের দিন থেকে নাগরিকত্ব গ্রহণের জন্য সক্ষম করবে, যারা এই দেশগুলি থেকে অত্যাচারিত হয়ে বাঅত্যাচারের ভয়ে ভারতবর্ষে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।”
অর্থাৎ মূল কথা হল আবেদনকারী ব্যক্তির নাগরিকত্বের আবেদন গ্রাহ্য হবে সেইদিন থেকে যেদিন তারা ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছে। অর্থাৎ বিল পাশের ছয় বছর পর নয় যারা ইতিমধ্যেই ছয় বছর ভারতবর্ষে অতিক্রান্ত করেছেন তারা প্রত্যেকেই এই বিল পাশের সাথে সাথেই নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবেন এবং বৈধনাগরিকবলে গণ্য হবেন। আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হল এই বিলে বলা হয়েছে আবেদনকারী ব্যক্তি যদি বর্তমানে কোন সরকারী অনুদান পাচ্ছেন তাহলে তা চালু থাকবে। কোনভাবেই তা বন্ধ করা যাবেনা। বিলে বলা আছে— যে ব্যক্তি নাগরিকত্বের জন্য আবেদন করছেন এই সংশোধনী মোতাবেক তাকে কোনভাবেই তার অধিকার এবং প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যাবে না যা সে বর্তমানে উপভোগ করছে। এই আবেদন করছে বলে তাকে অবৈধ অনুপ্রবেশের অজুহাতে তার প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা। অর্থাৎ ধরুন কেউ এখানে কন্যাশ্রী বা আবাস যোজনার টাকা পাচ্ছে তাহলে সেই টাকা কোনভাবেই বন্ধ হবে না। বা কেউ কোন সরকারী চাকরি করছে তাহলে তার চাকরী ক্ষেত্রে কোন প্রভাব পরবে না এই আবেদনের জেরে। অর্থাৎ একজন সাধারন নাগরিক হিসাবে যে অধিকার তার ছিল তা সবই বজায় থাকবে। কোনভাবেই তাকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবেনা।
আরেকটি উল্লেখযোগ্য বিষয় হল এই সংশোধনীর ফলে আসামের যে সব বাঙালি হিন্দুর নাম এন আরসি থেকে বাদ গেছে বা যারা ডিটেনশান ক্যাম্পে বন্দী আছেন তাদের উপর থেকে সব মামলা এই আইন পাশ হওয়ার সাথে সাথেই প্রত্যাহার হবে এবং নাগরিকত্বের আবেদনের ক্ষেত্রে এই মামলাগুলি কোন বাধা হবে না। তাদের আবেদন বৈধ বলে গ্রাহ্য হবে এবং তারা ভারতীয় নাগরিক বলে বিবেচিত হবেন। প্রশ্নোত্তরে নাগরিক আইনঃ ১)নাগরিক সংশোধনী আইন বা সংক্ষেপে CAA কি? নাগরিক সংশোধনী আইন যা বাংলাদেশ, আফগানিস্তান, পাকিস্তান থেকে আগত সে দেশের ধর্মীয় সংখ্যালঘু অর্থাৎ হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, পার্শীদের অধিকার ভারতবর্ষে সুনিশ্চিত করবে। ২) নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন বা CAA এর সুবিধা কারা পাবে? এই আইনের সুবিধা পাবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান, আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, পার্শীরা। ৩) বাঙালী হিন্দুদের এই আইনকি উপকার হবে? বাংলাদেশ থেকে যে সমস্ত হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন তারা প্রত্যেকেই এই আইনের সুবিধা পাবেন। বস্তুত এই আইনের সুবিধার ফলে সব থেকে বেশী লাভবান বাঙালী হিন্দুরাই হবেন। কারণ দেশভাগের পরেও বিশাল সংখ্যক হিন্দুরা অত্যাচারিত হয়ে এদেশে এসে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। তারা প্রত্যেকেই বৈধ নাগরিক বলে গন্য হবেন এই আইন পাশ হলে।
৪) এই আইনে নাগরিকত্বের সুবিধা নিতে গেলে কি আগে নিজেদের শরণার্থী বলে ঘোষনা করতে হবে এবং নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য ছয় বছর অপেক্ষা করতে হবে?
কখনই এদের নিজেদের শরণার্থী বলে নিজেদের ঘোষণা করতে হবে না। যারা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষে ছয় বছরের বেশী আছেন এবং ৩১ শে ডিসেম্বর ২০১৪-এর পূর্বে এসেছেন এবং শেষ এক বছর ভারতবর্ষেই আছেন তারা প্রত্যেকেই এই আইনের সুবিধা পাবেন। হয়ত এমনও হতে পারে যেহেতু ২০১৬ তে প্রথম বার বিল পেশ করার সময় থেকে আরও তিন বছর পার হয়ে গেছে তাই ৩১শে ডিসেম্বর,২০১৪ তারিখটিকে আরও বাড়ানোও হতে পারে। বিল পেশ হলে এই বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া যাবে। কোন কোন স্বার্থান্বেষী মহল থেকে এইসব অপপ্রচার করা হচ্ছে। এদের কথার কোন বিশ্বাস যোগ্যতাই নেই। ৫) আচ্ছা যারা বাংলাদেশ থেকে ১৯৪৭ সালের আগে ভারতবর্ষে চলে এসেছেন তাদেরও কিনতুন করে নাগরিকত্বের আবেদন করতে হবে? নাতারা ইতিমধ্যেই ভারতবর্ষের নাগরিক বলেস্বীকৃত। ৬) ৩১শে ডিসেম্বর, ২০১৪ তারিখটি নিয়ে কিভাবে নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে? কেন্দ্রীয় সরকার ইতিমধ্যেই ২০১৫ সালে নাগরিকত্ব সংক্রান্ত অন্য দুটি আইন যেমন-১৯২০ সালের পাসপোর্ট এ্যক্ট ( এন্ট্রি টু ইন্ডিয়া) এবং ১৯৪৬ সালের বিদেশী আইনে পরিবর্তনের মাধ্যমে বাংলাদেশ,পাকিস্তান এবং আফগানিস্তান থেকে আগত হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃষ্টান, জৈন, শিখ, পার্শী যারা ৩১ শে ডিসেম্বর ,২০১৪ -এর আগে ভারতে প্রবেশ করেছেন তাদের জন্য বিশেষ ছাড় দিয়ে ঘঘাষণা করেছে যে কোন অবস্থাতেই এদের অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বলে গন্য করা হবেনা। ৭) আচ্ছা এই যে বলা হচ্ছে অত্যাচারিত হলে বা অত্যাচারের ভয়ে এদেশে চলে এসেছে যারা। কিন্তু এই অত্যাচারে বা অত্যাচারের ভয়ের প্রমাণ কিভাবে দেওয়া যাবে? কোন প্রমাণ চাওয়া হবে না। শুধুমাত্র ফর্মে একটি ঘোষণার কলম থাকবে। সেখানে উল্লেখ করতে হবে। ভারতসরকার কখনোই এই প্রমাণ চায় না কারণ এ ক্ষেত্রে অপরাধ যা হয়েছে তা বাংলাদেশ সরকারের আওতাধীন। কাজেই সেইবিচারের ভার বাংলাদেশ সরকারের। যেহেতু ভারতসরকার কোন বিচার করছেনা তাই তারা প্রমাণ চাইছেনা। কিন্তু এই অত্যাচারের ক্ষেত্রটির উল্লেখ এই কারণেই থাকছে যাতে পরবর্তীতে কোনো স্বার্থান্বেষী মহল যদি আদালতে মামলা করে এই আইন আটকাতে চায় তখন তা এই আইনের রক্ষাকবচ হবে। ৮) আচ্ছা ৬বছর বসবাসের প্রমাণকিভাবে দেওয়া যাবে? পৌরসভা বা পঞ্চায়েতের সার্টিফিকেট, আঁধার কার্ড, পোষ্টাপিসের খাতা ইলেকট্রিক বা ফোনের বিল ব্যাংকের পাশ বই বা অফিসের রেকর্ড সবই প্রমাণ বলে গণ্য হবে। যদি এসবের কিছু নাও থাকে তাহলে দুজন পরিচিত যাঁরা ইতিমধ্যে ভারতবর্ষের বৈধ নাগরিক তারা আপনার ৬ বছর বসবাসের কথা ফর্মে লিখেদিলেও হবে।
৯) নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন পাশ হলেও আসামের বাঙালীরা এই আইনের সুবিধা পাবেননা? তারাও পাবেন। কারণ এবারে মূল নাগরিকত্ব আইনটি সংশোধনী করা হচ্ছে এই সংশোধনীমাধ্যমে। ১০) কোন কোন সংবাদ মাধ্যম যে বলছে এই আইন উত্তর পূর্বাঞ্চলে প্রযোজ্য হবেনা? উত্তর পূর্বাঞ্চলে অরুণাচল, মিজোরাম, নাগল্যান্ড অর্থাৎ যে রাজ্যগুলিতে যেতে ইনারলাইন পারমিট লাগে এবং উত্তর পূর্বাঞ্চলে ষষ্ঠ তপশিলীভুক্ত অঞ্চলগুলি এই আইনের আওতার বাইরে থাকছে। তা বাদে যে অঞ্চলগুলি অর্থাৎ যে অঞ্চলগুলি বাঙালী প্রধান সেগুলি সবই এই আইনের আওতায় রয়েছে। ১১) তাহলে কি এখানে বসবসকারী হিন্দুরা এই আইনের সুবিধা নিতে পারবেননা? তারা পারবেন। তাদের অন্য যে অঞ্চলে এই আইন বলবৎ সেখানকার ঠিকানা থেকে আবেদন করতে হবে। তাদের ভোটার কার্ড সেখানকার হবে। ১২) আচ্ছা যাদের এন আর সি তে নাম ওঠে নি বা যাদের বিরুদ্ধে বর্তমানে অবৈধ অনুপ্রবেশের মামলা চলছে তাদের কি হবে? তারা কি এই আইনের বলে নাগরিকত্বের আবেদন করতে পারবে? এই আইন পাশ হলে তাদের বিরুদ্ধে চলা এই সমস্ত মামলাই খারিজ হয়ে যাবে। তারাও এই আইনের দ্বারা আবেদন মারফত নাগরিকত্ব পাবে এবং ভারতবর্ষের নাগরিক বলে গন্য হবে। ১৩) আচ্ছা পশ্চিমবঙ্গের কোন অঞ্চল কি এই আইনের আওতার বাইরে থাকছে? না পশ্চিমবঙ্গের কোন অঞ্চলই এই আইনের আওতার বাইরে থাকছেনা। ১৪) আচ্ছা আমি এখন যে কন্যাশ্রীর টাকা পাই বা রেশনে কম দামে চাল পাই তাকিআমিনাগরিকত্বের আবেদন করলে আর পাবনা? কেন্দ্র সরকার এই আইনে খুব পরিষ্কার করে বলে দিয়েছে আবেদনকারী ব্যক্তি বর্তমানে সেসব সরকারী অনুদান বা সুবিধা পান সেসবই বজায় থাকবে। কোনভাবেই তা বন্ধ করা যাবে না তিনি নাগরিকত্বের আবেদন করেছে বলে। অর্থাৎকন্যাশ্রী বা অন্যান্য অনুদানের টাকা চালু থাকবে। ১৫) আচ্ছা এই আমি এখন নাগরিকত্বের আবেদন করলে কি আমার চাকরি চলে যাবে?
কখনই যাবেনা। এই আইনে শুধুমাত্র আপনার নাগরিকত্বকে বৈধতা দেওয়া হবে। আপনার কোন অধিকারই কেড়ে নেওয়া হবেনা।
দীপ্তস্য যশ
2019-12-30