সর্ব খর্বতারে দহে তব ক্রোধদাহ-
হে ভৈরব, শক্তি দাও, ভক্ত-পানে চাহো ।।
দূর কর মহারুদ্র যাহা মুগ্ধ, যাহা ক্ষুদ্র-
মৃত্যুরে করিবে তুচ্ছ প্রাণের উত্সাহ ।।
দুঃখের মন্থনবেগে উঠিবে অমৃত,
শঙ্কা হতে রক্ষা পাবে যারা মৃত্যুভীত ।
তব দীপ্ত রৌদ্র তেজে নির্ঝরিয়া গলিবে যে
প্রস্তর শৃঙ্খলোমুক্ত ত্যাগের প্রবাহ ।।
আত্মোন্নতি সমিতির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ক্ষীরোদ কুমার দত্ত লিখেছেন :
“সঞ্জীবনী সভা যখন সশস্ত্র বিপ্লবের উদ্দেশ্য নিয়ে অনুশীলন সমিতিতে পরিণত হল তখন শিবনাথের দলও পিছিয়ে পড়ল না। এদের সমিতির নাম হল আত্মোন্নতি সমিতি। …শিবনাথ শাস্ত্রী পিছন থেকে এঁদের প্রেরণা যোগাতেন। এই সময়ে যাঁরা দলের সংস্পর্শে এসেছিলেন তাঁদের মধ্যে রাধকুমুদ মুখোপাধ্যায় ,বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী, চন্দননগরের প্রভাস দেব, হরিশচন্দ্র শিকদার, সতীশচন্দ্র সেনগুপ্তের নাম উল্লেখযোগ্য। কিন্তু পরবর্তীকালে সাধারণ নাগরিক জীবনে প্রতিষ্ঠা পেয়ে এঁদের মধ্যে অনেকেই বিপ্লবী সমিতির সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করেন। কিন্তু প্রভাস দেবের নেতৃত্বে সংঘের বিপ্লবী প্রচেষ্টা সমান ভাবেই চলেছিল। দলের প্রধান সদস্য আজীবন বিপ্লবী বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী সম্প্রতি দেহত্যাগ করেছেন। পরবর্তী কালে ইন্দ্রনাথ নন্দী, নরেন ব্যানার্জি , নরেন্দ্রনাথ বসু, অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, অংশু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রভৃতি বিশিষ্ট বিপ্লবী এই দলে যোগ দেন। “
শ্রদ্ধেয় ক্ষীরোদকুমারের উপরোক্ত বক্তব্যে কিছু ভ্রান্তি পাওয়া যায়। যেমন – কোনোদিনই ঠাকুর বাড়ির সঞ্জীবনী সভা অনুশীলন সমিতিতে পরিণত হয় নি। শিবনাথ শাস্ত্রী যাঁদের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করেন তাঁরা কেউই আত্মোন্নতি সমিতিতে যুক্ত হন নি। চন্দননগরের প্রভাস দেব এবং আত্মোন্নতি সমিতির প্রভাস দে একেবারেই এক ব্যক্তি নন। হ্যাঁ ,তবে শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় গোপনে আত্মোন্নতি সমিতির অনেককেই প্রেরনা দিতেন এটা সত্য।
ডক্টর ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখেছেন –
“আত্মোন্নতি সমিতি” পূর্ব হইতে মধ্য কলিকাতার জনকতক ছাত্র লইয়া গঠিত হয় । নিবারণ ভট্টাচার্য প্রভৃতি ইহার অগ্রণী সংস্থাপক ছিলেন । ইহাদের মধ্যে ঘোষ নামের একজন আমাকে বলিয়াছিলেন, ” প্রথমে তাঁহারা পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী নিকট যাতায়াত করিতেন। ‘বঙ্গীয় বৈপ্লবিক সমিতি’ স্থাপিত হওয়াতে এই ক্লাবটি বৈপ্লবিক সমিতির অন্তর্ভুক্ত হয় । এই সমিতির কথা একবার শিবনাথ শাস্ত্রী মহাশয় আমার কাছে উল্লেখ করিয়াছিলেন । ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে সুকিয়াস্ট্রিটে অকস্মাৎ তাঁহার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি বলিলেন, এখন আমার সময় নাই । দু এক কথা পর তিনি আমাকে বলিলেন ,তুমি এখন কি করিতেছ তাহা বল? আমি আমার কর্মের কথা তাঁহাকে বলি। তিনি বলিলেন, একদল ছেলে আমার কাছে আসিত । তাহারা এতৎকাল ব্যায়ামাদি করিত। তাহাদের সংবাদ কি? আমি বলিলাম যে, তাঁহারা কর্ম করিতেছেন । তারপর তিনি বলিলেন, ‘ আমি ভাবিতেছি তোমরা কি ইংরেজ তাড়াইয়া দেশ শাসন করিতে পারিবে?’ ইহাতে আমি প্রতুত্তর করি , ‘ মহাশয় আগে ইংরেজকে দেশ হইতে বিদায় দি, তৎপর ওই চিন্তা করা যাইবে । ‘ তবে এই #ঘোষ কে তা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না । সম্ভবত উনি #শ্রীশচন্দ্র_ঘোষ, যাঁর আদি বাড়ি খুলনায় । ইনি আত্মোন্নতি সমিতির সদস্য রূপে ইন্দ্রনাথ নন্দী, বিপিনবিহারী গাঙ্গুলী প্রমুখের সঙ্গে ময়মনসিংহের জামালপুরে গিয়েছিলেন।
আত্মোন্নতি সমিতির – অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক নিবারণচন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছিলেন ” #আত্মোন্নতি নামটা কিন্তু ব্ল্যাকির #Self_Culture – এর অনুবাদ হইতে আসিয়াছিল। পরবর্তীকালে যখন আমরা শিবনাথ শাস্ত্রী সহিত সাক্ষাৎ করিতাম , তিনি একদিন বলিয়াছিলেন, ” বীরাষ্টমী দেখতে গিয়ে আত্মোন্নতির নাম শুনে ভেবেছিলাম এরা বোধয় যপ, তপ, উপোস ইত্যাদি কোন দল ; পরে যখন এদের #ভীমাকায় মল্ল ও মুষ্টিযুদ্ধ সভ্যদের দেখলাম তখন মনে হলো এদের আত্মোন্নতি সমিতির নাম না হয়ে দেহোন্নতি সমিতির নাম হওয়া উচিত ছিল।
যতদূর জানা যায় ১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আত্মোন্নতি সমিতির প্রথম পর্ব ছিল। তখন নিজেদের মধ্যে শরীরচর্চা ,ঘরোয়া আলাপ ,আলোচনা সভা ,মিটিং, ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণ ইত্যাদিতে কেটে গিয়েছিল । দ্বিতীয়পর্ব ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯০১ খ্রিস্টাব্দ ।
নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য লিখেছেন –
“১৮৯৯ সালের পর আত্মোন্নতি সমিতির এত দ্রুত সকল বিষয়ে উন্নতি হতে থাকে যে ইহার ক্রম বেশ একটু গোলমাল হইয়া গিয়াছে । তাঁরা লাঠিখেলা, অসিখেলা শিখতেন। “
১৯০১ থেকে ১৯০২ খ্রিস্টাব্দ সময়কালে বলা যেতে পারে আত্মোন্নতি সমিতির তৃতীয় পর্ব, এই সময় সমিতির সদস্যরা অন্যান্য জাতীয়তাবাদী নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ বাড়ান এবং শেষ পর্যন্ত “অনুশীলন সমিতি”র সঙ্গে যুক্ত হয়ে যান।
যেমন – ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে রাজা সুবোধ মল্লিকের বাড়িতে নানা প্রদেশ থেকে কয়েকজন বিপ্লবী এসেছিলেন। সেখানে এক সভায় উপস্থিত থেকে নিবারণ চন্দ্র ভট্টাচার্য আত্মোন্নতি সমিতি সম্পর্কে একটি স্বলিখিত প্রবন্ধ পাঠ করেন।
১৯০১ খ্রিস্টাব্দ থেকেই আত্মোন্নতি সমিতি শুধুমাত্র শরীরচর্চা , ছুরি বা লাঠিখেলা কিংবা আত্মরক্ষায় সীমাবদ্ধ না থেকে প্রকৃত বিপ্লবী তৎপরতায় নিজেদের সম্প্রসারিত করে।
#ক্রমশ:
#দুর্গেশনন্দিনী
তথ্যঃ বাংলার প্রথম বিপ্লবী গুপ্তসমিতি “আত্মোন্নতি সমিতি”
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনস্মৃতি
হিন্দুমেলার ইতিবৃত্ত