শহর নিয়ে চিন্তা কম। অন্তত শেষ সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল তেমনই বলছে। তাই এখন বিজেপির ‘শহুরে’ নেতা-নেত্রীরা গ্রামমুখী।
গ্রামে আর শহরে জনসমর্থনের ছবিতে বিস্তর ফারাক। সে ফারাক মুছতে ‘রুটিন’ তৈরি করছে বিজেপি। শহর থেকে নেতা-নেত্রীদের গ্রামে পাঠানোর ‘রুটিন’। গ্রামের মানুষের মধ্যে সময় কাটানোর ‘রুটিন’। ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ছ’টি আসন কমেছে বিজেপির। কিন্তু ফলাফলের এলাকাভিত্তিক বিশ্লেষণ বলছে, কলকাতার বাইরের শহরাঞ্চল বা পুর এলাকাগুলির মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় তৃণমূলের চেয়ে এগিয়ে তারা। সেই হিসেবের উপর ভরসা রেখে এমত সিদ্ধান্ত রাজ্যের প্রধান বিরোধীদলের।
গত ৬ এপ্রিল ছিল বিজেপির প্রতিষ্ঠাদিবস। আর ১৪ এপ্রিল ছিল বিআর অম্বেডকরের জন্মদিন। ওই দু’টি তারিখকে সামনে রেখে একগুচ্ছ কর্মসূচি নিয়েছিল বিজেপি। তার মধ্যে জেলা স্তরে আলোচনাসভা, বিধানসভা স্তরে ‘সক্রিয় কর্মী সম্মেলন’, মণ্ডল স্তরে তফসিলি সমাজকে নিয়ে কর্মসূচিও আছে। কিন্তু তার পাশাপাশিই রাজ্য বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের জন্য রয়েছে আরও নীচের স্তরে গিয়ে জনসংযোগ করার কর্মসূচি। যার পোশাকি নাম ‘গ্রাম চলো’ এবং ‘বস্তি চলো’। নামেই পরিচয়।
শক্তিকেন্দ্র (পাঁচটি বুথ) স্তরের উদ্যোগে ওই সব কর্মসূচি আয়োজিত হবে। তাতে শামিল হবেন সুকান্ত মজমুদার, শুভেন্দু অধিকারী, অগ্নিমিত্রা পাল, জগন্নাথ চট্টোপাধ্যায়, লকেট চট্টোপাধ্যায়, দীপক বর্মণদের মতো নেতা-নেত্রী। রাজ্য স্তরে আহ্বায়ক হিসেবে এই গোটা কর্মকাণ্ড দেখভাল করছেন অগ্নিমিত্রা। তিনি জানাচ্ছেন যে, রাজ্য স্তরের সব গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারীকে এই কর্মসূচিতে শামিল হয়ে গ্রামে গিয়ে দিনের এক-তৃতীয়াংশ কাটিয়ে আসতে হবে। দিল্লির নির্দেশ তেমনই।
আট ঘণ্টার জন্য এই শহরের নেতারা যে গ্রামে যাচ্ছেন, সেখানকার বুথ ও শক্তিকেন্দ্র স্তরের কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। সাধারণ গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলবেন, তাঁদের অভাব-অভিযোগের কথা জানবেন। সাধ্যমতো সমাধান খোঁজারও চেষ্টা করবেন। সম্ভব হলে এলাকার গণ্যমান্যদের সম্মাননা জ্ঞাপন করবেন। দুপুরে কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে পঙ্ক্তিভোজন সারবেন। বিকেলে বা সন্ধ্যায় ফিরে আসার আগে করবেন ‘উঠোন বৈঠক’। এ রাজ্যে বিজেপি যখন ‘ছোট’ দল ছিল, তখন ভোটের আগে বড় সভা না করে গ্রামে গ্রামে এ রকম বৈঠকে অভ্যস্ত ছিলেন বিজেপি নেতারা। সেই ‘উঠোন বৈঠক’ ফিরিয়ে আনছে বিজেপি।
এক বছর আগে লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যের ১২১টি পুরসভার মধ্যে ৬৯টিতে বিজেপি এগিয়ে ছিল। কংগ্রেস এগিয়ে ছিল বহরমপুর এবং ধুলিয়ান পুরসভায়। বাকি ৫০টি পুরসভায় এগিয়ে ছিল তৃণমূল। কলকাতা বা হাওড়ার পুরনিগমে তৃণমূল এগিয়ে থাকলেও কলকাতার ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৪৬টিতেই এগিয়ে ছিল বিজেপি। যা এই প্রথম। শিলিগুড়ি, আসানসোল বা বিধাননগরের মতো পুরসভায় বিজেপিই এক নম্বরে। তবে তৃণমূলকে ‘উদ্ধার’ করেছে গ্রাম। তার ফলেই তারা ২২ থেকে বেড়ে ২৯ হয়েছে।
আশ্চর্য নয় যে, বিধানসভা নির্বাচনের শহর থেকে নেতা-নেত্রীদের গ্রামমুখী করতে চাইছে বিজেপি।
কিন্তু প্রশ্নও আছে। বাংলার শহুরে রুচি (কলকাতা ছাড়া) যে বিজেপির দিকে ঝুঁকেছে, গ্রামীণ মেজাজও সেই একই বিজেপিকে গ্রহণ করবে? এই ডিজিটাল যুগেও শহুরে পশ্চিমবঙ্গ আর গ্রামীণ বাংলার মানসিকতা বা পছন্দের ফারাক প্রকট। সে ফারাক সাম্প্রতিক নয়, প্রাচীন। সত্যজিৎ রায়ের ছবি শহরে যে ভাবে প্রশংসিত হয়েছে, গ্রামে তেমন সাড়া ফেলেনি। হাল আমলেও শহুরে পরিবারিক টানাপড়েনের প্রেক্ষাপটে তৈরি ছবি ‘বেলাশেষে’ কলকাতা বা নানা মফস্সল শহরে জনপ্রিয় হয়েছে। কিন্তু গ্রামীণ দর্শক দেখেননি। আবার দেবের সাম্প্রতিক ছবি ‘খাদান’ গ্রামাঞ্চল কাঁপালেও শহরের ‘পরিশীলিত’ দর্শকের কাছে প্রত্যাখ্যাত।
এই ফারাকের বাস্তবতা শিল্পীরাও মানছেন। ‘বেলাশেষে’র অভিনেতা সুজয়প্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘বাংলার গ্রাম আর শহর এখনও দুটো আলাদা সভ্যতা। গ্রামের দর্শক আর শহরের দর্শকের মধ্যে সাংস্কৃতিক বিভাজন রয়েছে। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই।’’ সুজয়ের ব্যাখ্যা, ‘‘শহুরে মানে ভৌগোলিক ভাবে শহরের পরিধিতে অবস্থান করা নয়। শহুরে বলতে একটা মানসিকতা, একটা যাপন। শহুরে জীবনে অভ্যস্ত এক দর্শক সন্ধ্যাবেলায় ড্রয়িংরুমে বসে ‘বেলাশেষে’ দেখে নিজের জীবনকে মেলাতে পারবেন। কিন্তু গ্রামের চাষির সারা দিন মাঠে খেটে বাড়ি ফেরার পরে হাতমুখ ধুয়ে উঠে আমার সিনেমাটা দেখতে ইচ্ছা করবে না।’’
পছন্দ বা চাহিদার এই ফারাককে শহর থেকে মাঝেমধ্যে গ্রামে গিয়ে সময় কাটিয়ে নেতারা কি মেটাতে পারবেন? রাজ্য বিজেপির সভাপতি সুকান্তের দাবি, ‘‘শহুরে মানসিকতার কোনও ব্যাপারই নেই। শহর থেকে গ্রামে যাওয়ারও ব্যাপার নেই। আমরা গ্রামেরই মানুষ। কর্মসূত্রে শহরে আসতে বা থাকতে হয়। কিন্তু আমাদের শিকড় গ্রামেই। আমরা শহর থেকে গিয়ে গ্রামকে বুঝতে চাইছি, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই।’’ সুকান্তের আরও বক্তব্য, ‘‘দিলীপদা (ঘোষ) গ্রাম থেকে এসেছেন। আমার নির্বাচনী এলাকা বালুরঘাটও মূলত গ্রামীণ। শুভেন্দুদাও (অধিকারী) গ্রামাঞ্চলেই রাজনীতি করে এসেছেন। তিনি কলকাতা-কেন্দ্রিক নন। ফলে ‘গ্রাম চলো’ কর্মসূচিতে গিয়ে কোনও সাংস্কৃতিক বিভাজনের মুখে পড়ার প্রশ্ন ওঠে না।’’
লকেট বা অগ্নিমিত্রা আদ্যোপান্ত শহুরে। এক জন অভিনেত্রী। খ্যাতনামী হিসেবে রাজনীতিতে প্রবেশ। অন্য জন ফ্যাশন ডিজ়াইনিংয়ের মতো পেশা থেকে ভোটের ময়দানে। তাঁরাও গ্রামে গিয়ে হাওয়া ঘোরাতে সফল হবেন? না কি গ্রামীণ কর্মীদের আতিথ্য গ্রহণ করে ফিরে আসাই সার হবে?
লকেটের জবাব, ‘‘আমার অভিনেত্রীজীবন অনেক দিন আগেই অতীত। গত ১০-১১ বছর শুধু রাজনীতিই তো করছি। এই সময়ের মধ্যে বেশির ভাগটাই গ্রামে কেটেছে।’’ ২০১৬ সালের বিধানসভা বীরভূমের ময়ূরেশ্বরে লড়তে গিয়ে সেখানেই থেকেছিলেন। যা পাওয়া যেত, তা খেয়েই জীবনধারণ করেছিলেন। থাকতেন অভিনেতা খরাজ মুখোপাধ্যায়ের একটি বাড়িতে। বিদ্যুৎ চলে যেত মাঝেমধ্যেই। জেনারেটরে আলো জ্বালাতে হত। ২০১৭ সালে ‘বুথ চলো’ কর্মসূচিতে টানা ১৫ দিন গ্রামে গ্রামে ঘুরেছিলেন লকেট। হুগলি থেকে লোকসভায় জিতেছিলেন। সেটাও গ্রামীণ কেন্দ্র। এখন দলের সাধারণ সম্পাদিকা হিসেবে বেশির ভাগ সময়েই গ্রামে কাজ করেন। লকেটের বরং পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘সিনেমার পর্দায় যে ভাবে কথা বলতাম বা যে আচরণ করতাম, এখন কি তেমন করি?’’
অগ্নিমিত্রারও বক্তব্য, জীবনযাপনে আমূল পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে। চলাফেরা, পোশাক-আশাক, খাদ্যাভ্যাস, কথাবার্তা সব বদলে গিয়েছে। কিন্তু রাজনীতিতে এসে বদলে গিয়েছেন বললেই কি সব বদলে যায়? তিরুঅনন্তপুরমের চার বারের সাংসদ শশী তারুর যদি দাবি করেন, তিনি সাধারণ মানুষের মধ্যে মিশে গিয়েছেন, তা হলে সে কথা মেনে নিতে হবে? শুনে লকেটের মতোই পাল্টা প্রশ্ন ছুড়ছেন অগ্নিমিত্রা, ‘‘শশী তারুরের ফোন নম্বর কি তাঁর নির্বাচনী কেন্দ্রে সাধারণ ভোটারদের কাছে রয়েছে? রাতে কোনও গ্রামবাসীর বাড়িতে পুলিশ গেলে তাঁরা কি শশী তারুরকে ফোন করে ডাকতে পারেন? কোনও বাউড়ি পরিবার মেয়ের বিয়ে দিতে না পেরে কি শশী তারুরের কাছে গিয়ে বলতে পারে যে, বিয়েবাড়ির ভাড়াটা তুমি দিয়ে দিয়ো? রামনবমীতে নরনারায়ণ সেবার খরচ জোগাতে না পেরে কোনও পাড়ার লোক শশী তারুরকে বলতে পারে, চাল-ডালটা তুমি দিয়ে দিয়ো? অগ্নিমিত্রা পালকে বলতে পারে!’’
কথাতেই গ্রামের সঙ্গে ‘একাত্মতা’ প্রমাণ করার তৎপরতা স্পষ্ট। উপায় নেই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গ্রাম দিয়ে শহর ঘিরলে তাঁদের শহরের সঙ্গে জুড়তে হবে গ্রামকে। নচেৎ ২০২৬-কে ‘স্পেশ্যাল ছাব্বিশ’ করা দুরূহ!